আকবর সুন্নী মুসলমান ও আকবর

আকবর সুন্নী মুসলমান – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক সমন্বয়” বিভাগের একটি পাঠ। তৈমূরী বংশ মধ্য-এশিয়াতেও ইসলামী রক্ষণশীলতার পক্ষপাতী ছিল না। দেশ-লুণ্ঠনে তৈমূর যদিও মাহমুদ গজনওয়ি ও অন্যান্য মুসলিম বিজেতাদের অনুকরণ করেছিলেন, তবুও রাজকার্যে শরীয়ত নয়, সর্বোপরি চেঙ্গিসের তূরা (ইয়াস্সা) কে স্থান দিতেন।

আকবর সুন্নী মুসলমান

আকবর সুন্নী মুসলমান | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

বাবর ও হুমায়ূনও এ বিষয়ে তৈমূরের অনুগামী ছিলেন। আকবর সম্ভবত শৈশব থেকেই এসব কথা শুনে এসেছিলেন সেজন্য তার মনে ধর্মের গোড়ামি শিকড় গাড়তে পারেনি। হয়তো তিনি শাহ তহমাস্প ও তাঁর পিতার কথাবার্তাও শুনেছিলেন, যে আলোচনার মধ্যে তমাম্প হুমায়ুনকে বহুসংখ্যক হিন্দু প্রজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ইসলামের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিবাদ কম তীব্র নয়। পরস্পরকে তারা বিধর্মী মনে করত। বৈরাম খাঁ শিয়া ছিলেন এবং সেরকম আরও অনেক বড় বড় আমির-ওমরাহ্ মনের দিক দিয়ে শিয়া কিন্তু বাইরে সুন্নীর মতো আচরণ করতেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আকবর নিরক্ষর হলেও অত্যন্ত সুশিক্ষিত ছিলেন। তিনি ফারসি ও তুর্কি ভাষা ও সাহিত্য শ্রবণের মাধ্যমে ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি জন্মগত সৈনিক ছিলেন।

সৈনিক রীতি-রেওয়াজেরও তিনি ধার ধারতেন না, এটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি, নিষিদ্ধ বর্ষাকালেও তিনি বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। রীতি-রেওয়াজ নয়, প্রয়োগ-বিশেষজ্ঞতাকেই তিনি যথার্থ বলে স্বীকার করতেন।

মানুষের স্বাভাবিক ভাষা কি, এ বিষয়ে তিনি অনেক কথা শুনেছিলেন। মোল্লা বলতেন— আসল ভাষা আরবি, যা আল্লার ভাষা। আকবর পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিরিবিলিতে ‘গঙ্গামহল’ তৈরি করে সেখানে কয়েকটি শিশুকে রেখে সে দেন। খাওয়া-পরার ভালো ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কেউ যেন তাদের সঙ্গে কথা না বলে । কয়েক বছর পর দেখা গেল, কেউ কোনো ভাষাতেই কথা বলতে পারছে না, অর্থাৎ ভাষা হল সমাজ-প্ৰদত্ত ।

বিপজ্জনক খেলায় তার খুব শখ ছিল । মত্ত হাতিকে বশীভূত করার জন্য বহুবার তিনি কিভাবে নিজেকে বিপদে ফেলেছিলেন, সে-কথা আগে বলা হয়েছে। সঙ্গীতে তিনি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। সেজন্যই তিনি তানসেনকে নিজের দরবারে নবরত্নের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি স্বয়ং ভালো পাখোয়াজী ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে ব্যস্ত থাকার সময়েও তিনি খুব শখ করে মাদারি ও নটদের খেলা দেখতেন।

মনোরঞ্জক গল্প ও সরস কথাবার্তার জন্য বীরবল ও মোল্লা দোপিয়াজা তার দরবারে সসম্মানে স্থান লাভ করেছিলেন। আকবর রাতে বড় জোর ঘণ্টা তিনেক ঘুমোতেন, কিন্তু তাঁর শরীর ছিল ইস্পাতের মতো। তার স্বভাবের মধ্যে ক্রোধও ছিল, তবে সেই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার, তবু যখন সেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন, তখন ক্ষণকালের জন্য সবকিছু বিস্মৃত হতেন তিনি ।

নিজের দুগ্ধ-ভ্রাতা আদহম খাঁকে কিভাবে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করিয়েছিলেন, সেই ঘটনাই তার উদাহরণ। বাতি জ্বালানোর নওকর সিংহাসনের কাছে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ করেছিল, সেজন্য তাকে নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করার দণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। ইউরোপীয় পর্যটক জেসুইট সাধু পেরুশচি আকবরের স্বভাব সম্পর্কে লিখেছেন—

“বাদশাহ খুব কমই ক্রুদ্ধ হন, কিন্তু যখন ক্রুদ্ধ হন, তখন সেই ক্রোধ কোথায় গিয়ে পৌছবে, বলা মুশকিল। মন্দের ভালো এই যে খুব শীঘ্রই তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়। তাঁর ক্রোধ ক্ষণস্থায়ী, দ্রুত দূর হয়ে যায়, বস্তুত তিনি সজ্জন, কোমন ও দয়ালু স্বভাবের মানুষ।

সামরিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতি-বিশারদের গুণেও ভরপুর ছিলেন তিনি। সাধু বারতোলীর বক্তব্য অনুসারে— “তিনি কখনো কাউকে জানার সুযোগ দিতেন না যে তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে কি আছে অথবা কোন ধর্ম বা বিশ্বাস অবলম্বন করেন। যাতে তাঁর নিজের উদ্দেশ্য সাধিত হতো, তিনি তাই করতেন। তিনি স্বপক্ষে নিয়ে আসার জন্য কখনো একপক্ষকে, কখনো আবার অপরপক্ষকে সাহায্য করতেন।

উভয়পক্ষকে ভালো ভালো কথায় উৎসাহিত করতেন এবং নিজের সংশয় প্রকাশ করতেন, “আমি তোমার বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ জবাবকে নিজের পথপ্রদর্শনের উপায় হিসেবে দেখতে চাই, যাতে তার অন্তর্নিহিত সত্যটাকে জানতে পারি।” তা তিনি যাই জবাব পান না কেন, সেটাকেই নিঃসংশয়ে মেনে নিতেন না। বিতর্কেরও শেষ হতো না, কারণ প্রতিদিন আবার সেখান থেকেই আরম্ভ হতো। সব বিষয়েই বাদশাহ আকবরের এটাই রীতি ছিল। তিনি কোনোরকম অস্পষ্টতা ও কপটতার আশ্রয় নিতেন না।

তাঁর সততা ও দৃঢ়তা এমন ছিল যে কল্পনা যেত না। তবে, প্রকৃতপক্ষে তিনি এত আত্মনির্ভরশীল এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ছিলেন যে তিনি নিজের কথা ও কাজে পরস্পর-বিরোধী কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, উলটে-পালটে তা পরখ করে দেখতেন বলে তাঁর মনের গভীরের থই পাওয়া মুশকিল ছিল। প্রায়শই এমন হতো যে, যে-লোকটা আজকে তাঁকে যেমন দেখল, পরদিনই তাঁকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে হতো। খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করে এবং বহুদিন ধরে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পরেও কেউ তাঁকে প্রথম দিন যতটুকু জেনেছিল, তার চেয়ে বেশি জানা তার পক্ষে সম্ভব হতো না।” আকবরের স্বভাব সম্পর্কে উক্ত সাধুদের বক্তব্য যথার্থ বলেই গণ্য করা যেতে

পারে, তবে এসব কথা সেই সময়ের, যখন আকবর প্রৌঢ়ত্বে পৌছেছিলেন। বত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছতে পৌঁছতেই তাঁর জীবনের ধর্মভীরু সুন্নী মুসলমান পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেজন্য পাদরীদের বক্তব্য আকবরের প্রথম জীবন সম্পর্কে কিছু জানার ক্ষেত্রে খুব একটা সহায়ক হতে পারে না। তাঁর মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য আগেও ছিল।

খাজা মুজফ্ফর আলী বৈরাম খাঁর দীওয়ান ছিলেন। খানখানার দুঃসময়েও খাজা সঙ্গ ত্যাগ করেননি। খানখানার অপরাধ মাফ হয়ে গেলে খাজারও সুদিন ফিরে আসে। তিনি উন্নতি করতে করতে ৯৭১ হিজরীতে (১৫৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে) ওয়াকীল-মুতলাক (সর্বাধিকারী) পদে পৌছে মুজফ্ফর খাঁ ও উমদতুল্-মুল্‌ক্ পদবিতে অলঙ্কৃত হয়ে সাম্রাজ্যের আমিরুল-উমরা হন।

তাঁরই সুপারিশে ১৫৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর তাঁর দশম রাজ্যবর্ষে শেখ আব্দুন্ নবীকে সরুস-সদর (ধর্মাধ্যক্ষদের অধ্যক্ষ) নিযুক্ত করেন। ‘শেখ আব্দুন নবী’ অধ্যায়ে আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে বাইশ বছর বয়স্ক আকবরকে রেশমী বস্ত্র পরিধান করতে দেখে আব্দুন্ নবী তাঁর শরীরে ছড়ি দিয়ে স্পর্শ করেছিলেন ।

 

আকবর সুন্নী মুসলমান | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

আকবর শেখের জুতো সোজা করে পেতে দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না, কিন্তু শেখ পর্যন্ত (নভেম্বর, ১৫৮১ খ্রিঃ) ক্ষতিকারক মনে করে ওই পদটি বিলুপ্ত করা হয় এবং শেখের ভাগ্য-নক্ষত্র অস্তমিত হয়। কাজী ইয়াজদী ফতোয়া দিয়ে আকবরকে বিধর্মী ঘোষণা করে তাঁকে রাজ্য থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন, তাও আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি। আকবর তাঁর চিন্তাভাবনায় স্বতন্ত্র হয়ে উঠছিলেন, তবু তখনও সময় অনুকূল নয় ভেবে অনেক কিছু দেখেও না-দেখার ভান করতেন।

প্রায়ম্ভিক জীবনে ইসলাম ও পীর-ফকিরদের কত ভক্ত ছিলেন, তা এই ব্যাপার থেকেই বোঝা যায় যে প্রত্যেক বছর তিনি আজমের শরীফ জিয়ারত করতে যেতেন এবং ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সেই শেষ যাত্রা, তবে পরের বছরেও (১৫৮০ খ্রিঃ) তিনি তাঁর পক্ষ থেকে শাহজাদা দানিয়ালকে প্রেরণ করেন। যদিও এ কথা বলা যায় না যে ওই সময় পর্যন্ত তাঁর চিন্তাভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেনি, তবুও এক সময় তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার চলছে দেখে তিনি নিয়ম করে দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তে শুরু করেছিলেন ।

আজমের থেকে প্রত্যাবর্তন-কালে তাঁর সঙ্গে একটি বিশাল তাঁবুর মসজিদ ছিল। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মীর আবু তুরাব মক্কা থেকে প্রস্তর নির্মিত চরণ-পাদুকা নিয়ে আসেন। আকবর ভালো করেই জানতেন যে সেটা নকল জিনিস, তবু তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য খুব সমারোহের আয়োজন করেন এবং স্বয়ং কিছুদূর গিয়ে কাঁধে করে সেই ভারি পাথর বহন করেন।

আকবরকে কতবার জোর করে এরকম ভড়ং করতে হয়েছে। একবার তিনি পাঁচ ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে আজমেরী দরগায় যান। সে-বিষয়ে বদায়ূনী চুপিসাড়ে তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন— “তাই দেখে সমঝদার লোকে হাসত আর বলত: কেমন অদ্ভুত ব্যাপার, খাজার উপর মহামান্য বাদশাহের এত ভক্তি, অথচ 

মূল ভিত্তির প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের সেই পয়গম্বরকেই তিনি অস্বীকার করেছেন, যার করুণায় খাজার মতো লক্ষ লক্ষ পীরের জন্ম হয়েছে।” আকবর খুব ভক্তিভরে পীর-ফকিরদের কবর জিয়ারত করতেন। ১৫৭৫ থেকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, যদি কেউ হজ করতে চান, তাহলে তার ব্যয়ভার বহন করা হবে শাহী কোষাগার থেকে।

অতীতের বিষয় স্মরণ করে বদায়নী লিখেছেন— “কিন্তু এখন উলটো ব্যাপার। তিনি তাদের নামও শুনতে চান না । হজের জন্য ছুটি প্রার্থনা করা তো মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ করার সামিল হয়ে দাড়িয়েছে।” ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের আশেপাশে আকবর খাজা সুলতানকে মীর-হাজ করে হাজীদের দলের সঙ্গে রাজপুতানার পথে রওনা করে দেন এবং স্বয়ং এহরাম (হজের পোশাক) পরিধান করে মীর-হাজের পিছনে পিছনে কয়েক পা গমন করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে তার এই কাজকর্মকে ভড়ং বলা যেতে পারে না । সলীম চিন্তীর উপর ভক্তিবশত আকবর আগরা ত্যাগ করে সিক্রীতে এসে প্রতিষ্ঠিত হন, কিন্তু তাঁর উপর শাহ সাহেবের প্রভাব এক বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। 

এ বিষয়ে ইবাদতখানায় চলতে-থাকা শাস্ত্রালোচনা ও সৎ-সঙ্গও যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইবাদতখানা নির্মাণ আরম্ভ করার আদেশ দেন। প্রথমদিকে সেখানে মুসলমান মোল্লারাই আসতেন। চেঙ্গিস খাঁ পৌত্র কুবলে খানও ধর্ম-জিজ্ঞাসার জন্য এরূপ ব্যবস্থা করেছিলেন।

তিন শতাব্দী পরে আকবর তার পুনরাবৃত্তি করেন। ধর্ম-বিষয়ক শাস্ত্র নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আকবরের খুব পছন্দ ছিল । সে- সব কথা উদ্ধৃত করে আবুল ফজল লিখেছেন— “দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা এত আকর্ষণীয় ছিল যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে যাওয়ার জন্য আমাকে টানাটানি করতেন। অত্যাবশ্যক রাজকার্যে যাতে অবহেলা না হয়, সেজন্য জোর করে আমাকে থামাতে হতো।” যে-জায়গায় আকবর ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে-জায়গায় পূর্বে এক সময় মিয়া আব্দুল্লা নিয়াজী সরহিন্দীও থেকেছিলেন, পর শেখ সলীমও (তাঁকে নিয়াজীর গুরুও বলা হয়) সেখানে আস্তানা গাড়েন।

বর্তমানে ইবাদতখানার কোনো চিহ্ন নেই। সম্ভবত সেটা ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত শেখ সলীমের বিখ্যাত মসজিদের উত্তর-পশ্চিমে ছিল। বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তের পর আকবর ইবাদতখানায় যেতেন এবং শাস্ত্ৰালোচনায় স্বয়ং মধ্যস্থতার কাজ করতেন। দুই-তিন বছর পর্যন্ত ইবাদতখানা মুসলমান পণ্ডিতদেরই স্থান হয়ে থাকে, কিন্তু ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে অথবা তার পূবেই হিন্দু, পারসি ইত্যাদি ধর্মের পণ্ডিতদের প্রবেশও অবারিত হয়ে যায়। মখদুমুল্-মুল্ক্ মোল্লা সুলতানপুরী ও শেখ আব্দুন্ নবী ইসলাম ধর্মের নামে নিজেদের পাণ্ডিত্যের জোরে একজন আর একজনকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করতেন।

তখন আবুল ফজল ও মোল্লা বদায়ূনীর মতো নব্য তরুণও জুটে গেছেন। যে-সব বইপত্র পড়ে আলিম-ফাজিল হওয়া যায়, সে-সব বইপত্র তাঁরা ইতিমধ্যেই পড়েছেন। আকবর সেই তামাশা দেখতেন খুব আগ্রহের সঙ্গে। তিনি ছিলেন প্রবীণ রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে। তরুণ বদায়ূনীকে দেখে তিনি বলেছিলেন— “হাজী ইব্রাহিম কাউকে দম ফেলার সুযোগ দেন না, এই যুবক তাঁর ঘাড় ভাঙবে। বিদ্যা-বল ছিলই, মনে ছিল সাহস, ছিল যৌবনের দত্ত, বাদশাহ পিঠ চাপড়ানোর জন্য তৈরি।

বৃদ্ধের ক্ষমতা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তাকে ধরাশায়ী করে বদায়ূনী আরও এগিয়ে গিয়ে আব্দুন্ নবীকে প্রহার করতে শুরু করলেন।” আজাদ লিখেছেন— “তখনকার দিনগুলোতে আবুল ফজলও এসে পৌছে গেলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের ঝুলিতে তর্কবাণের কি অভাব? তাঁর ভগবদ্দত্ত জ্ঞানবুদ্ধির সামনে কারো কি রেহাই ছিল? যিনিই তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তাঁকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বড় কথা হল, শেখ ও শেখের পিতাকে মখদুম ও সদর আব্দুন্ নবী ইত্যাদির হাতে কয়েক বছর ধরে এত আঘাত সইতে হয়েছিল যে সে আঘাত কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়।

আলিমদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও মতভেদের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় । কয়েক দিনের মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে গৌণ প্রশ্নের ব্যাপার তো পৃথক, প্রধান ইসলাম ধর্মের আসল সিদ্ধান্তসমূহের উপরেও কটাক্ষ শুরু হল, কথায় কথায় প্রশ্ন করা হয়: কারণ বলো, কেন এরূপ হবে।’ শেষে তর্ক-বিতর্ক মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না, এমনকি অন্য ধর্মের পণ্ডিতেরাও তাতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। আকবর ধর্মে ‘বাবা-বাক্যং প্রমাণম্’ ছেড়ে তিনি নিজে প্রত্যেক ব্যাপারে খোজখবর করতে লাগলেন।”

কিন্তু তার মানে এই নয় যে আকবর ইসলাম অথবা ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ৯৮৭ হিজরী (১৫৭৮-৭৯ খ্রিঃ) পর্যন্তও, বদায়ূনীর মতে, “বাদশাহ রাত্রিবেলা প্রায়ই ইবাদতখানায় আলিম ও শেখদের (সন্তদের) সৎ-সঙ্গে কাটাতেন । বিশেষ করে শুক্রবার রাত তো রাতভর জাগতেন এবং ধর্মীয় সিদ্ধান্তসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণে লেগে থাকতেন।”

আজাদের ভাষায়, “মোল্লারা বাক্য-তরবারি কোষমুক্ত করে একজন আর-একজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন, কেটে ফেলতেন, মেরে ফেলতেন। শেখ সদর ও মখদুমুল্-মুকের সম্পর্ক এমন ছিল যে, একজনের হাত, অন্যজনের গর্দান। উভয়পক্ষই একে অপরের ভাত মারার তালে, উভয়পক্ষেই উৎসাহ- দাতা মোল্লাদের পাল্লা ভারি। …

এক আলিম একটা কাজকে হালাল করেন তো আর- একজন তাকেই হারাম প্রমাণ করে দেন। …আবুল ফজল ও ফৈজীও এসে গেলেন। দরবারে তাঁদের পক্ষপাতী লোকেরও অভাব হল না। তাঁরা তাঁদের সব সময় উস্কানি দিতে থাকেন। …

শেষে ইসলামের পণ্ডিতদের হাতেই এই দুরবস্থা হল যে ইসলাম ও অপরাপর ধর্ম যেন এক হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি বদনাম হল আলিম ও শেখদের। আকবর প্রত্যেক ধর্মের পণ্ডিতদের জড়ো করেন, সমস্ত ব্যাপার জানতে চান। …বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। কোনো ধর্মের দাবিদারের পক্ষেই তাঁকে নিজের দিকে টেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

তিনিও সকলের কথা শুনতেন, নিজের মনেই তা পর্যালোচনা করে নিতেন। শেষ পর্যন্ত মোল্লারা লড়াই করতে করতে নিজেরাই লেজেগোবরে হয়ে গেলেন।” আজাদ আরও লিখেছেন— বাংলার যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে চলছিল। জানা গেল, অধিকাংশ আলিম ও শেখের সন্তান-সন্ততিরা অভাব অনটনে না খেয়ে মরছে। দয়ালু বাদশাহের করুণা হল। হুকুম দিলেন: সবাই যেন শুক্রবার সমবেত হয়, নামাজের পর আমি নিজে টাকা বিলাবো। শুক্রবার চওগান মাঠে এক লক্ষ নারী-সমাগম হয়। তাদের কারো ধৈর্য নেই। বেচারিদের অবস্থা খুবই করুণ। ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে আশিজন প্রাণ হারায়। …

তাদের কোমর থেকে বেরুলো আশরফি-ভরা বটুয়া। বাদশাহ দেখলেন, যাদের আশরাফ রয়েছে, তারাও এসেছে ভিক্ষা নিতে। তিনি শেখ সদরকে বরখাস্ত করে দিলেন। ধর্মীয় সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার খবর পেতেই তিনি তদন্ত করালেন। দেখা গেল, মসজিদ-মাদ্রাসার ভগ্নদশা, ধর্ম-সংক্রান্ত তহবিলের টাকা মোল্লারা হজম করে ফেলেছেন। এইভাবে শৈশব থেকে আকবরের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। জৌনুপরী মোল্লা আহমদ ইয়াজদী ও মুয়াজ্জি-মুল্‌ক্ প্রমুখেরা আকবরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন।

আকবর আগরা থেকে দশ ক্রোশ দূরে অবস্থিত ওয়াজিরাবাদে ছিলেন। তিনি আদেশ পাঠান, মোল্লা দু’জনকে আলাদা আলাদা ভাবে যমুনা-পথে গওয়ালিয়রে পাঠিয়ে দাও। কিছুকাল পরেই দ্বিতীয় আদেশ এল, ওদের কিস্সা খতম করে দাও। তাদের দু’জনকে একটা ভাঙা নৌকোয় তুলে দেওয়া হল, কিছুদূর গিয়েই জলের চাদরের কাফন মুড়ে জলঘূর্ণিতে সমাধিস্থ হন তাঁরা ।”

আকবরের ধর্মবিশ্বাস লঙ্ঘন নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। ফৈজী ও আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারকের মতো দিগ্‌গজ পণ্ডিত তাঁর চিন্তাভাবনার সমর্থক ছিলেন। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় একটি সংক্ষিপ্ত শাসনতন্ত্র রচনা করে কিভাবে আলিমদের সিদ্ধান্তের উপরে বাদশাহের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত প্রতিপন্ন করেন এবং কিভাবে মোল্লারা ভয়ে ভয়ে তাতে নিজেদের সীলমোহরের ছাপ দেন, সে-ঘটনার কথা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি । আকবরের ৩০-তম রাজ্যবর্ষের পর (১৫৮৬ খ্রিঃ) বদায়ূনীর বক্তব্য অনুসারে,

যুগের হাওয়া একদম বদলে গেল, কেননা ধর্ম বিক্রী করে খাওয়া মোল্লারাও তাঁর ‘হ্যাঁ’- তে ‘হ্যাঁ’ দিতে শুরু করল। পয়গম্বরীর উপরে সন্দেহ, কুরান ঈশ্বর-প্রেরিত বাণী — সে- বিষয়ে নীরবতা, দৈব-শক্তির প্রকাশ ও আলৌকিক ক্রিয়াকলাপ এবং অদৃশ্য জিন-পরী মানতে অস্বীকার— এইসব চলতে লাগল। কুরানের প্রামাণিকতা এবং তা যে আল্লার বাণী, তার সাক্ষ্য-সাবুদ হাজির করার দাবি উঠল। এটাও স্থির হল যে মৃত্যুর পরে যদি পাপ-পুণ্যের ফলাফলের বিচার হয়, তাহলে তা পুনর্জন্মের পরেই হতে পারে। অন্য কোনো পথ নেই ।

পুনর্জন্ম নিয়ে বইপত্রও লেখা হয়ে গেল। বাদশাহের দুগ্ধ-ভ্রাতা খানে-আজম, যিনি ইসলাম-বিরোধী মনোভাব দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত ছেড়ে কাবায় চলে গিয়েছিলেন, সেই খানে-আজম কাবা থেকে ফিরে এসে তোবা করলেন এবং আকবরের দরবারে দাড়ি নাড়তে লাগলেন। ৯৯০ হিজরীতে (১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে) যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরলে বাদশাহ তাঁকে বললেন: আমি পুনর্জন্মের অকাট্য প্রমাণ যোগাড় করে ফেলেছি। শেখ আবুল ফজল তোমাকে বুঝিয়ে দেবে, তুমি  মানবে না? না মেনে উপায়ই বা কি ছিল?

বদায়ূনী লিখেছেন— “বীরবল এটা প্রতিপন্ন করলেন যে সূর্য ভগবানের রূপেরই প্রকাশ, কেননা বনস্পতির জন্ম, শস্যের পরিপক্বতা, পুষ্পের বিকাশ, ফলের পরিণত হওয়া, পৃথিবীর আলোকোদ্ভাসিত হওয়া, সমগ্র জগতের প্রাণস্পন্দনের নিয়ামক তিনিই । সেজন্য তাঁর উপাসনা করা উচিত। সূর্যোদয়ের দিকে মুখ করা দরকার, সূর্যাস্তের দিকে নয় । এইভাবে অগ্নি, জল, প্রস্তর, অশ্বথ, সেই সঙ্গে সমস্ত বৃক্ষই ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করছে। গাভী ও গোময়ও ঈশ্বরের মহিমা। সেই সঙ্গে তিলক ও উপবীতেরও প্রশংসা করেন তিনি।

বাহবা দেওয়ার মতো ব্যাপার এই যে আলিম-ফাজিল আর ওই ছাই দরবারীরাও তাঁর মতের পুষ্টিসাধন করে বলেন, সত্যই সূর্য মহৎ জ্যোতি, তিনি সারা পৃথিবীর কল্যাণকারী, বাদশাহের সংরক্ষক। যত সৌভাগ্যবান বাদশাহ, সকলেই তাঁর মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন। হুমায়ূনের আমলেও এই প্রথার চল ছিল, কেননা তিনি চেঙ্গিস তুর্কিদেরই উত্তরাধিকারী ছিলেন।”

পুরনো আমলে বছরের প্রথম দিনটিতে নববর্ষের উৎসব পালন করা হতো। আকবর যেদিন সিংহাসনে বসেন, সেই দিনটিতেই নববর্ষ পালন শুরু হল। তারপর তাতে ভারতের রীতি-রেওয়াজও যুক্ত করে দেওয়া হল। আকবর স্বয়ং ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে পূজা-পাঠ ও মন্ত্র শেখেন। ‘সিংহাসন বত্তীসী’র অনুবাদ-লেখক পুরুষোত্তম ব্রাহ্মণ একান্তে তাঁকে পূজা-পদ্ধতি বলে দিতেন।

মহাভারতের অনুবাদক দেবী ব্রাহ্মণকে নিভৃতে খাটিয়ার উপর বসিয়ে তাঁর হাতে দড়ির এক প্রান্ত দিতেন, অন্য প্রান্ত নিজের মুখে চেপে ধরতেন। সেখান থেকেই ব্রাহ্মণ আগ্নি, সূর্য তথা অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা-বিধি জানাতেন। বাদশাহ মাঝরাত পর্যন্ত সূর্যের মন্ত্র জপ করতেন । রাজা দীপচন্দ্র একবার বলেন: হুজুর, গরু যদি খোদার কাছে পবিত বস্তু না হতো, তাহলে কুরানের সর্বপ্রথম সূরা (অধ্যায়) গরু (বকর) হবে কেন? তার ফলে বাদশাহ গোমাংশ হারাম করে দেন এবং আদেশ জারি করেন, যে গো-হত্যা করবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে।

হাকিম-বৈদ্যরা সমর্থন করে জানালেন : গোমাংস আহারে নানারকম রোগ হয়, গোমাংস নিকৃষ্ট ও দুষ্পাচ্য। তবে আকবর তখন ইসলাম সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন বলা যায় না। ৯৮৭ হিজরীতেই (১৫৭৯-৮০ খ্রিঃ) মীর-হাজ আবু তুরাব মক্কা থেকে পয়গম্বরের চরণচিহ্ন-মুদ্রিত পাথর নিয়ে আসেন, তা সে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যই হোক না কেন— আকবর তার যথোচিত মর্যাদা প্রদর্শন করেছিলেন।

বদায়ূনীর বর্ণনা অনুসারে, সেই বছরই পরামর্শ হয় যে “লা-ইলাহা ইল্লাল্-লাহ”-এর সঙ্গে “আকবর খলীফতুল্লাহ” (আকবর আল্লার নায়েব) বলা হোক। বাইরে তা বললে শোরগোল পড়ে যেত, সেজন্য স্থির হয়, প্রাসাদের ভিতরেই তা বলা হবে। বহু ব্যক্তিই ‘সালাম আলায়কুম’-এর বদলে ‘আল্লাহু আকবর’” এবং উত্তরে ‘জন্মে জলালুহু” বলা শুরু করে। আকবরের অনেক মুদ্রা পাওয়া যায় যেগুলির উপর এই বাক্য মুদ্রিত আছে ।

 

আকবর সুন্নী মুসলমান | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের শেষ দিকে আকবর এক নতুন বিতর্ক খাড়া করলেন। সিক্রীর প্রধান মসজিদের ইমামকে সরিয়ে দিয়ে তিনি মাসের প্রথম শুক্রবার স্বয়ং মেম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা পাঠ করলেন। কবিরাজ ফৈজী সেটাকে পদ্যবন্ধ করে দিয়েছিলেন । তার কয়েকটা পঙ্ক্তি হল—

যিনি আমাকে বাদশাহী দিয়েছেন,

যিনি আমাকে জ্ঞানময় হৃদয় ও সুদৃঢ় বাহু দিয়েছেন,

যা আমাকে ন্যায় ও সমদর্শিতার পথে নিয়ে চলেছে, 

যা আমার হৃদয় থেকে বৈষম্য দূর করেছে, তাঁর প্রশংসা 

আমার মন ও চিন্তাভাবনায় বিরাজমান ।

আল্লাহু আকবর (ঈশ্বর মহান) ।

 

যদিও ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আকবর ইসলামের ঘোমটা খুলে ফেলেননি, তথাপি, তার তিন বছর পূর্বেই তার বিশ্বাস টলে গিয়েছিল। তবে তাঁর চিরদিন বিশ্বাস ছিল এক আল্লার (তওহিদ ইলাহী আল্লার অদ্বিতীয়তা, ব্ৰহ্ম-অদ্বৈত) উপর । ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে মোল্লা সুলতানপুরী ও শেখ আব্দুন্ নবীকে মক্কায় নির্বাসিত করার ঘটনা, আকবর যে ইসলামের প্রতি সম্পূর্ণ বিমুখ হয়েছিলেন, সেই ইঙ্গিত বহন করে । 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment