শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন

শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন, আকবর যদিও দুই মোল্লাকে আজীবন নির্বাসন-দণ্ড দিলেন, কিন্তু, তবুও, যেহেতু তাঁরা উচ্চ-উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, জনসাধারণের কাছে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত রূপে গণ্য হতেন, সে-কারণে বাদশাহ মক্কা শরীফে পত্র লিখে তাঁদের সঙ্গে সুব্যবহার করতে বললেন। মক্কা শরীফে পৌঁছে তাঁদের মনে হলো পৃথিবীটা বড় রূঢ়। কোথায় ভারতে তাঁরা ধর্ম বিষয়ে সর্বেসর্বা ছিলেন, আর এখানে মক্কায় একজন ক্ষুদে মৌলভীও তাঁদের পাত্তা দেন না। তাঁর সামনে মুখ খোলারও সাহস হয় না তাঁদের। ভারতের সেই সব বিগত দিনগুলির কথা স্মরণে আসতে লাগল।

শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন

 

শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

ভাবতে লাগলেন, এ কোথায় এসে ফেঁসে গেলেন তাঁরা! অথচ ফিরে যাওয়ার অনুমতি নেই। অবশেষে বসে বসে আকবর ও তাঁর পারিষদদের অধার্মিক বলে বদনাম রটাতে শুরু করলেন। সে খবর রুম বোখারাতেও ছড়িয়ে পড়ছিল, আকবরের নিকটে এক-একটি কথা নুন-মরিচ সহযোগে পৌঁছে যাচ্ছিল।

দু’বছর পর পুনরায় যখন হাজীদের দল রওনা হলো, তখন শাহী মীর হাজত তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। হজের জন্য একটা বিশেষ বিভাগই ছিল, তারা হাজীদের যাত্রার বন্দোবস্ত করত এবং হাজীদের সঙ্গে মীর হাজকে পাঠাত। তিনি বাদশাহের একখানি পত্র নিয়ে গেলেন, তাতে লেখা ছিল— “আমি শেখ আব্দুন্ নবী ও মখ্দুমুল্-মুকের হাতে নগদ টাকা ও প্রচুর ভেট ভারত থেকে পাঠিয়েছিলাম। তা যথেষ্ঠ পরিমাণ ছিল সমস্ত লোকজনের মধ্যে ও তীর্থক্ষেত্রে বণ্টনের জন্য। তালিকাভুক্ত অঙ্ক ছাড়াও কিছু অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছিল কয়েকজন ব্যক্তিকে গোপনে দিতে।

শেখ সদরকে এ আদেশও দেওয়া হয়েছিল, ওদিকের দেশগুলির সুন্দর সুন্দর বিচিত্র জিনিসপত্র পেলে তাঁরা কিনে নেবেন। তার জন্য যে টাকাকড়ি দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত না হলে গুপ্তভাবে প্রদানের জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে ব্যয় করবেন। লিখে জানান, তাঁরা আপনাদের কত টাকা দিয়েছেন।” সেই সঙ্গে মোল্লাদের কীর্তিকলাপের বিবরণ দিয়ে লিখেছেন— “এরকম ব্যক্তিরা যেন পবিত্র স্থান থেকে বেরিয়ে চলে আসতে না পারে।”

শিরে সংক্রান্তি— দুই মোল্লা আল্লার গৃহে তিনটি বছর কোনো রকমে অতিবাহিত করলেন। তারপর আল্লার গৃহ থেকে বিধর্মীর গৃহ ভারত তাঁদের আকর্ষণ করতে লাগল— শয়তান প্রায়ই খোদার চেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়। মোল্লারা শুনেছিলেন যে আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মির্জা মহম্মদ হাকিম ভারত অধিকার করার জন্য কাবুল থেকে যাত্রা করেছেন। তাঁরা ভাবলেন, আকবরকে খতম করার এ এক অপূর্ব সুযোগ। তাঁর বিধর্মিতার কারণে মুসলমানরা তো এমনিতেই তাঁর দুশমন হয়ে উঠেছে।

এখন শুধু আমাদের ফতোয়া দেওয়া বাকি, সেটা করলেই আকবরকে ইহলোক ছেড়ে অন্যান্য কাফেরদের মতো পরলোকে দোজখেই ঠাঁই নিতে হবে। বেচারিরা অনেক দূরে রয়েছেন, তা ছাড়া আজকালকার মতো তখন দূরভাষ – সংবাদপত্রও ছিল না, খবর পৌঁছাত খুবই বিলম্বে। তাঁদের ফিরতে কয়েক মাস নয়, বলতে গেলে এক বছরই কেটে গেল। ততদিনে হাকিম মির্জার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা সম্ভাতে জাহাজ থেকে অবতরণ করলেন, সেখান থেকে আহমদাবাদে এলেন।

 

শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

সব শোনার পরেও পিছনে ফেরার রাস্তা ছিল না। একই সঙ্গে হজ থেকে প্রত্যাবৃত্ত বেগমদের দিয়ে দরবারে সুপারিশ করালেন, আর আব্দুন্ নবী নিজের ফতেহপুর সিক্রীর দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। গত এই তিন বছরে যে পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়ল, তাতে শেখের আক্কেল গুড়ুম। তাঁর পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হচ্ছিল— এই সেই ভারত, সেই দরবার, যেখানে ধার্মিক বাদশাহের আনন্দোচ্ছ্বাসের ফোয়ারা ছিল। অথচ, এখন মুবারকের অধার্মিক দুই পুত্র— ফৈজী ও আবুল ফজলের রাজ চলছে।

তার আগেই তাঁদের কীর্তিকলাপের চিরকুট এসে পৌছে গিয়েছিল দরবারে। মক্কা- মদীনায় বসে তাঁরা যে আকবরকে অধার্মিক ও নরকগামী বলে কুৎসা ছড়িয়েছিলেন, বাদশাহ ওই চিরকুট থেকে সমস্ত অবগত হয়েছিলেন। কথাবার্তার সময় বৃদ্ধ স্বভাবদোষে এমন কিছু বলে ফেললেন যে বাদশাহের ভ্রূকুঞ্চিত হলো। তিনি সেই শেখ নিজের সদর, একদা আকবর যাঁর পাদুকা সহস্তে সোজা করে পেতে দিয়েছিলেন, যাঁর ছড়ি তাঁর জামা স্পর্শ করা সত্ত্বেও নীরবে সহ্য করেছিলেন। সেই পাদুকা-উত্তোলন করা হাত আজ বৃদ্ধের মুখে সজোরে মুষ্ট্যাঘাত করল। বেচারি বৃদ্ধ কেবল বললেন— “ব-কারদ্ চিরা ন ভী জনী (তরোয়ালের কোপ মারলেন না কেন)!”

 

শেখ আব্দুন্ নবীর মক্কায় নির্বাসন | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

মক্কায় বণ্টনের উদ্দেশ্যে যে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল, বাদশাহ শেখের কাছ থেকে তার হিসাব নিতে আদেশ করলেন টোডরমলকে। হিসাব-নিকাশের কাজে আবুল ফজলকেও জুড়ে দেওয়া হলো। তহবিল তছরুপের দায়ে যেভাবে আর পাঁচজন করোড়ী (পরগণা শাসক) কয়েদখানায় পড়ে থাকে, সেভাবেই কয়েদখানায় ফেলে রাখা হলো আব্দুন্ নবীকেও।

অপরাধীদের মতো তাঁকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য হাজিরা দিতে হতো। যে গৃহে তাঁর নিজের দরবার বসত, আমির ও আলিমেরা জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন, এখন সেখানে কেউ তাঁকে গ্রাহ্যই করে না। অনেকদিন ধরে মোকদ্দমা চলছিল। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, রাতে কেউ তাঁকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। লোকে বলে, সেটাও বাদশাহের ইঙ্গিতেই। পরদিন মিনারের ময়দানে তাঁর লাশ পড়ে ছিল । লোকে মোল্লাকে ভর্ৎসনা করে কবিতা আবৃত্তি করত— গর্চ ঈ শেখ ক-ন্নবী গুতান্দ্ । ক-নবী নেস্ শেখে-মা কনবী-স্ত্ । (যদ্যপি শেখকে নবী- -সমকক্ষ বলা হতো, তথাপি নবী-সমকক্ষ নয়, আমাদের শেখ ছিল বকধার্মিক।)

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment