আসিরগড় বিজয়

আসিরগড় বিজয় – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শাসনব্যবস্থা” বিভাগের একটি পাঠ। খানদেশের অধিপতি রাজা আলী খাঁর পুত্র মীরা বাহাদুর খাঁ পিতাকে অনুসরণ করা অর্থহীন ভাবেন । তিনি মনে করেন, আসিরগড়ের মতো অজেয় দুর্গ হাতে রয়েছে যখন, তখন মোগল সেনা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অতএব আকবর আসিরগড় দখল করে নেওয়াই স্থির করে ফেললেন। বুরহানপুর যাত্রার সময় তিনি ওই দুর্গের কয়েক মাইল দূর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ ফুট উঁচু সাতপুরা পর্বতমালা, তার উপর আশপাশের ময়দান থেকে নয় শত ফুট উঁচু এক পাহাড়ে আসিরগড় দুর্গ অবস্থিত। 

আসিরগড় বিজয়

 

আসিরগড় বিজয় | দাক্ষিণাত্যের সঙ্ঘর্ষ | আকবর

 

উত্তর ভারত থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পথ সমর- (দক্ষিণাপথ) এখান দিয়েই গেছে। সেজন্য এই দুর্গের গুরুত্ব সহজেই প্রতীয়মান হয় । সমস্ত সমকালীন অভিযাত্রীই এই সুদৃঢ় দুর্গের প্রশংসা করেছেন— কামান, সরঞ্জাম, রসদে এর চেয়ে পরিপূর্ণ সুদৃঢ় সুরক্ষিত দুর্গ আর কল্পনা করাই যেত না। পর্বত-পৃষ্ঠে ষাট একর স্থান জুড়ে অনেক জলাশয় জলের আবশ্যকতা পর্যাপ্তভাবে পূরণ করত। দুইটি জায়গা ব্যতীত সোজা খাড়া পাহাড়ের উপর পৌঁছানোর কোনো পথ ছিল না।

দুর্গ অধিকার করার পর সেখানে দেখতে পাওয়া যায় তেরো শত ছোট-বড় কামান, বিশাল বিশাল আকারের প্রচুর মারতৌল, পর্যাপ্ত বারুদ এবং নানা রকমের রসদ সামগ্রী যথারীতি দুর্গ অবরোধ আরম্ভ হয়েছিল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে শেখ ফরিদ বুখারী (মুর্তজাখান) ও আবুল ফজলের নেতৃত্বে।

বিশাল বিশাল যাবতীয় কামান থাকা সত্ত্বেও জানা যায়, দুর্গের ধ্বংস-সাধন ক্ষমতা-বহির্ভূত। সেখানে সুড়ঙ্গ তৈরির সুযোগ- সুবিধেও ছিল না। অতএব অবরোধ করে বসে থাকা ব্যতীত আর উপায় কি? দুর্গের ভিতরে এত রসদ-পানীয় ছিল যে রক্ষীবাহিনী অনিশ্চিতকাল নিশ্চিন্তে কাটাতে পারে।

আকবর কিভাবে আসিরগড় অধিকার করেছিলেন, সে-বিষয়ে সমসাময়িক লেখকেরা পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন। মোগল ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, ভয়ঙ্কর মহামারীর কারণে দুর্গরক্ষীদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। সাধু জেরোম জেভিয়ার সে- সময় আকবরের সঙ্গে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, আকবর শঠতার দ্বারা সাফল্য লাভ করেছিলেন। মীরা বাহাদুরকে আকবরের শিবিরে ডেকে আনা হয় এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাঁকে বন্দী করা হয়। 

জেস্যুইটের বর্ণনা অনুসারে, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে নিজের শত্রুর কথায় বিশ্বাস করে বাহাদুর শাহ শেখ ফরিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ফরিদ তাঁকে অনেক করে বোঝান যাতে তিনি বাদশাহের অধীনতা স্বীকার করেন। বাহাদুর তাতে অসম্মতি জানিয়ে দুর্গে ফিরে যান। সে-সময় বাহাদুরের সঙ্গে বহু সৈন্য ছিল, ফরিদ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে সাহস পাননি।

বিনা প্রতিরোধে বুরহানপুর অধিকার করে আকবর ৩১শে মার্চ থেকেই সেখানকার প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। ৯ই এপ্রিল দুর্গের নিকটে গিয়ে বিভিন্ন সেনাপতিদের জায়গা ও কাজ বণ্টন করে দেন। রাতে ও দিনে দুর্গের উপর গোলা বর্ষণ চলতে থাকে।

মে মাসে বাহাদুর খান তার মাতা ও পুত্রকে ষাটটি হাতি-সহ আকবরের নিকটে সন্ধির শর্তাবলী জানার জন্য প্রেরণ করেন। আকবর বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ চান। বাহাদুর শাহ তাতে রাজি ছিলেন না। জুন মাসে মোগল সেনা ঝটিকা আক্রমণ করে নিকটস্থ পাহাড় অধিকার করে নেয়। ফলে সেখান থেকে দুর্গের দিকে অগ্রসর হওয়া অনেক সহজ হয়। এই পর্যন্ত আবুল ফজল ও জেস্যুইটের বর্ণনার মিল আছে। তার পরেই তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। সাধু জেভিয়ারের পত্রাবলী থেকে জানা যায়, ১৯শে আগস্ট আহমদনগরের পতনের সংবাদ ২২শে আগস্ট আসিরগড়ে এসে পৌছায়। বাহাদুর শাহের উপর তার প্রভাব পড়ে।

আকবর আহমদনগর থেকে সুসংবাদ পেলেন তো দুঃসংবাদ এলো আগরা থেকে, সলীম প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তখন আকবর আসিরগড়ের সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে চাইলেন। ২২শে আগস্টের পর সন্ধির কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল। 

খানদেশের প্রথা অনুযায়ী গদির সবেচেয়ে কাছের উত্তরাধিকারী সাত শাহজাদা আসিরগড়ে থাকতেন, শূন্য সিংহাসনে সর্বজ্যেষ্ঠ বসার অধিকারী ছিলেন। সাতজনের মধ্যে বাহাদুর শাহ সিংহাসনে বসার জন্য গেলেন, অন্য শাহজাদারা দুর্গের অভ্যন্তরেই রইলেন। দুর্গের অধিকর্তা ছিলেন একজন আবিসিনীয় । দুর্গ রক্ষার কাজ করছিলেন সাতজন পোর্তুগিজ গোলন্দাজ অফিসার।

আকবরের দুই লক্ষ সৈন্য দুর্গ ঘিরে রেখেছিল। কোনোদিক থেকে আশা নেই দেখে আকবর মীরা (বাহাদুর) শাহের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য শপথপূর্বক তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন যে আলোচনার পর তাঁর দুর্গে ফিরে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। পোর্তুগিজ অফিসাররা নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু বাহাদুর শাহ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে অধীনতা স্বীকারের নিদর্শনস্বরূপ গলায় চাদর জড়িয়ে দুর্গ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। আকবর তাঁকে দরবারে স্বাগত জানালেন।

 বাহাদুর শাহ সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্ত তিনবার সিজদা (দণ্ডবৎ) করলেন। এই সময় মোগল অমাত্যরা ঠিকমতো সিজদা করানোর অছিলায় তাঁর মাথা ধরে মাটিতে ঠুকে দেয়। আকবর তাতে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারপর বাহাদুরকে বলা হল দুর্গের লোকজনের নিকটে লিখিত আদেশ পাঠাতে যেন তারা আত্মসমর্পণ করে। বাহাদুর শাহ সে-কথায় অসম্মতি জানিয়ে দুর্গে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন। 

তার ফলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হল। আবিসিনীয় দুর্গ অধিকর্তা যখন এই খবর পেলেন, তখন তিনি তাঁর পুত্র মকব খানকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মতো হীন আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য প্রেরণ করলেন। আকবর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন— তোমার পিতা কি দুর্গ সমর্পণ করার জন্য প্রস্তুত ? মুকব উত্তর দিলেন— আমার পিতা দুর্গ সমর্পণ করা তো দূরের কথা, এ-ব্যাপারে কথা বলতেও চাইবেন না । 

জেস্যুইট সাধুর বর্ণনা অনুসারে, মুখের উপর ওইরূপ জবাব শুনে আকবর তৎক্ষণাৎ তাঁকে কতল করার হুকুম দিয়ে দেন। এ ঘটনার পর দুর্গের অধিকর্ত আকবরের নিকটে বার্তা পাঠান: আমি এমন মিথ্যাবাদী বাদশাহের মুখদর্শনও করতে চাইনে । তারপর তিনি তাঁর দুর্গরক্ষীদের বলেন—

“বন্ধুগণ, শীতকাল আসছে। মোগলরা অবরোধ তুলে নিয়ে ঘরে ফিরতে বাধ্য হবে, কেননা তাদের সেনা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারো পক্ষে জোর-জবরদস্তি দুর্গ দখল সম্ভব নয়। একমাত্র ভগবানের ইচ্ছায় অথবা দুর্গরক্ষীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই তা সম্ভব হতে পারে। যে ইমানদারির পথে চলে, সেই বেশি সম্মানের পাত্র হয়। সেজন্য তোমরা মনেপ্রাণে তোমাদের জায়গাটিকে রক্ষা করো। আমি আমার জীবনের কাজ শেষ করেছি, তাই আমি চাই, যাতে অমন নীচ বাদশাহের মুখ দেখতে না হয়।” 

 

আসিরগড় বিজয় | দাক্ষিণাত্যের সঙ্ঘর্ষ | আকবর

 

এ কথা বলে তিনি গলার চাদর শক্ত করে বেঁধে নিজেকে শেষ করে দেন। দুর্গের অধিকর্তার মৃত্যুর পর দুর্গরক্ষীরা বহুদিন ধরেই এমন দৃঢ়তার সঙ্গে দুর্গ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে যে মোগলদের ভীষণ নাজেহাল হতে হয়। আক-বর সাধু জেভিয়ারকে দিয়ে কার্যোদ্ধার করতে চাইলেন। কিন্তু পোর্তুগিজরা খানদেশের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিল, সেজন্য সাধু আকবরের কথায় সম্মত হলেন না, এমনকি জবাবে ঠোঁটের ডগায় আসা দু’টো কথাও শুনিয়ে দিলেন । 

আক-বর অসন্তুষ্ট হয়ে আদেশ দিলেন যে শাহী নিবাস থেকে জেস্যুইট সাধুদের বহিষ্কার করে গোয়া পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সাধু চলে যেতে উদ্যত হলেন, কিন্তু তাঁর কোনো বন্ধু আমির পরামর্শ দিলেন, সেখান থেকে তিনি যেন না যান, গেলে পথেই মারা পড়বেন। তিনি কিছুদূর গিয়েছিলেন। তাঁকে ইদোমে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যতদিন না বাদশাহের রাগ পড়ে। 

সত্য সত্যই স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি আক-বরকে আবার সেই আগের মতোই লক্ষ্য করলেন। বাহাদুর শাহকে গ্রেপ্তার করে কোনো লাভ হয়নি। আকবরের অপরাধ ঘৃণা ছড়িয়েছিল, অবরুদ্ধ দুর্গরক্ষীদের হতোদ্যম করতে পারেনি।

ইলাহাবাদে সলীমের কার্যকলাপের কথা শুনে আক-বর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন, সেজন্য অনিশ্চিত কাল সেখানে বসে থাকাও সম্ভব ছিল না। তিনি সিসের বদলে সোনারূপোর গোলা ব্যবহার করলেন। দুর্গরক্ষীদের সর্দারদের এক এক করে কিনে নিতে শুরু করলেন। সাতজন উত্তরাধিকারী শাহজাদাদের আর কোনো উপায় রইল না এবং সাড়ে দশ মাস অবরোধের পর ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি আসিরগড় আত্মসমর্পণ করল ।

দুর্গদ্বার খোলা হলে দেখা যায়, ভিতরে একটা আস্ত শহর রয়েছে। কিছু লোক পক্ষাঘাত কিংবা চক্ষুরোগে আক্রান্ত অবশ্যই ছিল, তবে তা এমন মারাত্মক নয় যে দুর্গের বিপদ হতে পারত। আবুল ফজল লিখেছেন : মহামারীতে আসিরগড়ের অভ্যন্তরে পঁচিশ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল।

ফরিশতার বর্ণনা অনুযায়ী, আত্মসমর্পণ করার সময়েও দুর্গরক্ষার জন্য যথেষ্ট লোক ছিল। আক-বর দুর্গরক্ষীদের প্রাণভিক্ষা দেন। বাহাদুর শাহ ও তাঁর পরিবারকে গওয়ালিয়র দুর্গে কারারুদ্ধ করে রাখা হয় । তাঁদের খরচের জন্য বাৎসরিক চার হাজার মোহর পেনশন বরাদ্দ করা হয়।

 সাতজন শাহজাদাকে পৃথক পৃথক দুর্গে রেখে তাঁদের প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক দু’ হাজার করে মোহর পেনশন ধার্য করা হল। সাতজন পোর্তুগিজ গোলন্দাজেরও প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়— অবশ্য তাদের কটু-কাটব্য শুনতে হয়— তোমরা খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মিথ্যা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ।

সেখানে যত পোর্তুগিজ ও অন্যান্য খ্রিস্টান নারী-পুরুষ ছিল, সকলকে জেভিয়ারের হাতে সমর্পণ করা  তিনি সত্তর জনেরও বেশি লোককে— এমনকি কিছু মরণাপন্ন শিশুকেও ‘ব্যাপটিজম’ করে খ্রিস্টান ধর্মে পুনঃপ্রবেশ করালেন। দাক্ষিণাত্যের কাজ শেষ করলেন আক-বর। 

নব-বিজিত ভূ-খণ্ডকে আহমদনগর, বরার ও খানদেশ— এই তিন সুবায় পরিণত করা হল, সেগুলোক মালওয়া ও গুজরাতের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে শাহজাদা দানিয়ালের অধীন করে দিলেন। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিলে লিখিত একখানি বিজয়-স্মারক ফলক আসিরগড়ে স্থাপন করা হয়।

খানদেশের নাম পরিবর্তন করে উপরাজের নামে দানদেশ রাখা হয়, সিক্রীকে বুলন্দ দরওয়াজার অভিলেখ থেকে তা জানা যায়, কিন্তু মানুষ দানদেশ নামটি গ্রহণ করেনি, আজও মহারাষ্ট্রের এই অংশের অধিবাসীরা খানদেশই বলে থাকে। 

 

আসিরগড় বিজয় | দাক্ষিণাত্যের সঙ্ঘর্ষ | আকবর

 

আক-বরের মধ্যম পুত্র মুরাদ ইতিমধ্যেই প্রয়াত, জ্যেষ্ট সলীম বিদ্রোহী হয়ে ইলাহাবাদে বসে ছিলেন। সম্ভবত আক-বর তাঁর কাণ্ডজ্ঞান ঠিক করার জন্যই দাক্ষিণাত্যের পাঁচটি প্রদেশই কনিষ্ঠ পুত্রকে প্রদান করেন । আক-বর দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে আগরায় আসেন ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে। এবার আক-বরের কর্মঠ জীবনের শেষ হল। এরপর তিনি আর কোনো নতুন বিজয়ে যাত্রা করেননি, জ্যেষ্ঠপুত্রের বিদ্রোহ ব্যতীত আর কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেও হয়নি তাঁকে ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment