আহমদনগর বিজয় – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “দাক্ষিণাত্যের সংঘর্ষ” বিভাগের একটি পাঠ। দাক্ষিণাত্যের বাহমনী সুলতানিকে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার বড় ইচ্ছে ছিল আকবরের। এই সুলতানি রাজগুলি যতদিন না মোগল-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, ততদিন মনের মধ্যে সেই বাসনা পোষণ করেছিলেন তাঁর পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্ররাও।
আহমদনগর বিজয়
তাঁদের উপর আকবরের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল, কেননা তাঁদের কাছ থেকে তৈমূরী মির্জারা সহযোগিতা লাভ করত, সেটা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। কাবুল- কন্দাহার, কাশ্মীর-সিন্ধু পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করে আকবর এবার দাক্ষিণাত্যের দিকে নজর দিলেন।
পশ্চিমোত্তরে নিজের পিতা-পিতামহের ভূমি ফরগানা পুনরাধিকারের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না অথবা তুরানীদের মোকাবিলা করা ছিল অতি উৎকণ্ঠার বিষয়। তার বদলে দাক্ষিণাত্য অধিকার করা সহজসাধ্য ছিল। আকবর প্রথমে শান্তির মাধ্যমে কার্যোদ্ধার করতে চাইলেন এবং বোঝানোর জন্য দূত প্রেরণ করলেন।
১৫৯১ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে তিনি চারটি দূতমণ্ডলী খানদেশ, আহমদনগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডায় প্রেরণ করেন। দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হতে গেলে সর্বাগ্রে খানা দেশ পড়ে, সেখানে ফারুকী বংশের রাজা আলী খাঁ শাসন করতেন । তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সজ্জন, সাহসী ও প্রতিভাবান লোক ছিলেন।
তাঁর শাসনকালে তাপ্তি উপত্যকায় অত্যন্ত সমৃদ্ধি ঘটেছিল। তিনি আকবরের মতো প্রবল ক্ষমতাশালীর সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হতে চাননি। তাঁর রাজধানী ছিল বুরহানপুরে, দাক্ষিণাত্যের বাণিজ্যিক পথের উপর অবস্থিত হওয়ার কারণে বুরহানপুর অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরী ছিল।
সেখানে জারি ও রেশম বয়নশিল্পের পর্যাপ্ত কাজ হতো। রাজা আলীর রাজ্যে আসিরগড় ছিল প্রসিদ্ধ দুর্গ, তাকে দাক্ষিণাত্যের চাবিকাঠি বলা হতো। সেটাকে হস্তগত না করে বিজয়ীর পক্ষে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। সমকালীন ঐতিহাসিক তাকে ইউরোপ ও এশিয়ার সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দুর্গ বলে স্বীকার করেছেন।
আলীকে নিজের পক্ষে টানার জন্য কবিরাজ ফৈজীকে পাঠানো হয়েছিল, এই থেকেই খানদেশের গুরুত্ব বোঝা যাবে। ফৈজীকে এই আদেশও দেওয়া হয়েছিল যে তিনি সেখানে থেকে আহমদনগরের সুলতান বুরহানশাহ (বুরহানুল্-মুল্ক্)-এর নিকটেও যাবেন, সেখানে পৃথক দূতমগুলী প্রেরণ করা হয়েছিল। খানদেশের পরে আহমদনগর পৌছানো সবচেয়ে সহজ।
ফৈজী রাজা আলীকে কিভাবে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে সফল হয়েছিলেন, সে- খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের নিকটে প্রেরিত দূতমণ্ডলী ফিরে আসে। তারা তাদের কাজে সফল হয়নি। বুরহানুল্-মুল্ক ভালো উপঢৌকন প্রেরণ করেননি। তাঁর পাঠানো পনেরোটি হাতি, কিছু বস্ত্র এবং যৎসামান্য রত্ন যথেষ্ট বলে মনে হয়নি। বুরহানুল্-মুকে সিংহাসন-লাভে আকবর সহায়তা করেছিলেন, সুতরাং তাঁর কাছ থেকে অধিক প্রত্যাশা ছিল। এখন বোঝা গেল, তিনি নতি-স্বীকার করতে রাজি নন।
সেজন্য আকবরের ক্রুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। প্রথমে সত্তর হাজার সওয়ার-বিশিষ্ট একটি বড় সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি (ফিল্ড-মার্শাল) নিযুক্ত করা হয় শাহজাদা দানিয়ালকে । যুদ্ধ-পরিষদ নিয়োগ করা সমীচীন বোধ হয়নি, তার পরিবর্তে আকবর খানখানা আব্দুর রহীমকে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান সেনাপতি করেন।
যে-সময় আকবর দাক্ষিণাত্যের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন, সে-সময় সুলতানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছিল, বস্তুত তাঁদের নিজেদের মধ্যে লড়াই বরাবরই চলে আসছিল। বুরহানুল্-মুল্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহিম তখতে বসেন, ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের সেনা তাঁকে পরাজিত করে।
আহমদনগরের উপর হামলাকারীরাও সস্তায় রেহাই পায়নি। আকবর খানখানাকে প্রধান সেনাপতি করে শাহজাদা মুরাদকেও তাঁকে সঙ্গে দিলেন। মুরাদ গুজরাতের উপরাজ ছিলেন। তিনি চাইছিলেন, গুজরাত থেকেই আক্রমণ করা হোক। কিন্তু রহীম মালওয়া থেকে হামলা করতে চাইছিলেন। তার ফলে দু’জনের মধ্যে মতৈক্য ছিল না, তা সত্ত্বেও বিশাল আকবরী সেনার সামনে দাঁড়ানো সহজ ব্যাপার ছিল না।
অবরোধ শুরু হয়ে গেল। সৌভাগ্যবশত আহমদনগর চাঁদবিবির মতো বীরাঙ্গনা লাভ করেছিল। তিনি বুরহানুল- মুকের ভগ্নী তথা ভ্রাতুষ্পুত্রের অভিভাবিকা । আকবরকে দুই বীর নারীর সম্মুখীন হতে হয়— রাণী দুর্গাবতী ও চাঁদবিবি সুলতানার।
উভয়েই দেখিয়ে দিয়েছিলেন— নারীজাতি রণনৈপুণ্য ও বীরত্বে পুরুষের চেয়ে কম নয়। চাঁদবিবির মোকাবিলা এতই কঠিন ছিল যে আকবরের সেনাপতিরা নরম শর্তে তাঁর সঙ্গে সন্ধি করতে চান, আবুল ফজল সেটাকে অনুচিত বলেছিলেন। স্থির হয়, বুরহানুল্-মুকের পৌত্র বাহাদুরকে সুলতান করা হবে। তিনি আকবরকে রাজাধিরাজ বলে স্বীকার করে নেবেন; হাতি, মুক্তো, রত্নাদি এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী উপঢৌকন পাঠাবেন এবং বরার সুবা মোগল সাম্রাজ্যকে প্রদান করবেন ।
যদিও রাজধানীর প্রাচীর বহু জায়গায় মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিল, তবুও আহমদনগর লৌহ-দুর্গ সেজন্য ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়ে গেলো । দাক্ষিণাত্য অভিযানের প্রথম অধ্যায় শেষ হল । ১৫৯৫-৯৯ খ্রিস্টাব্দে ১০০৪-৭ হিঃ, এই চার বছর ধরে উত্তর ভারতে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ হয়। সমসাময়িক ঐতিহাসিক নূরুলহক লিখেছেন—
“সেইসঙ্গে এক প্রকার প্লেগেরও প্রাদুর্ভাব ঘটে, যার ফলে গ্রাম ও শহগুলির কথা দূরে থাকে, মহানগরী ও তার ঘরবাড়ি জনশূন্য হয়ে যায়। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সহায়- সম্বলের অভাবে মানুষ মানুষকে খেতে থাকে। পথঘাট লাশে ঢেকে যায়, সেগুলো সরানোর ক্ষমতাটুকুও কারো নেই।”
শেখ ফরিদ বুখারীর (মুর্তজা খান) তত্ত্বাবধানে সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। সেই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ উত্তর ভারতে কিরূপ প্রলয় সৃষ্টি করেছিল, সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরা তার উল্লেখ পর্যন্ত করার আবশ্যকতা বোধ করেননি। জেস্যুইট পাদরীদের কথানুসারে ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে লাহৌরেও ভীষণ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। লোকে নিজেদের সন্তান-সন্ততিকেও ত্যাগ করে, পাদরীরা খ্রিস্টান করার ভারি সুযোগ পেয়ে যান। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে খ্রিস্টান মিশনারীরা যে খুব ফায়দা তোলেন, সাম্প্রতিক কালেও আমরা তা দেখেছি।
১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান পরব ইস্টার-দিবসকে আকবর লাহৌরে তাঁর প্রাসাদে সূর্য- মহোৎসব রূপে পালন করছিলেন। সেই সময় প্রাসাদে আগুন লেগে যায়। প্রাসাদের বেশির ভাগটাই কাঠ দিয়ে তৈরি ছিল। প্রাসাদের সঙ্গে দামি কার্পেট, থালা, হীরে- মুক্তো, বহু মূল্যবান সামগ্রী ভস্মীভূত হয়।
সোনা-রূপো গিয়ে রাস্তায় জলের মতো বয়ে যায়। আকবর প্রাসাদ পুনঃনির্মাণের আদেশ দিয়ে লাহৌর ত্যাগ করে গ্রীষ্মকাল কাটানোর জন্য কাশ্মীর চলে যান। সেটা ছিল আকবরের তৃতীয় কাশ্মীর গমন। সাধু পিনহেরোকে গিজা তৈরির দেখাশোনার জন্য রেখে জেভিয়ার ও গোয়েজকে সঙ্গে নিয়ে যান।
ছয় মাস পরে আকবর লাহৌরে ফেরেন। জেভিয়ারের পত্র থেকে জানা যায়, দুর্ভিক্ষের কবল থেকে কাশ্মীরও রেহাই পায়নি। কত মাতা তাদের শিশুদের ছেড়ে পালিয়েছিল, পাদরীরা তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ব্যাপটাইড্ করেন। জেভিয়ার দুই মাস অসুস্থ ছিলেন, সে-সময় আকবর তাঁর খুব যত্ন করেন। জেভিয়ার সেরে উঠলে আকবর অসুখে পড়েন, জেভিয়ারও খুব যত্ন-সহকারে তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করেন।
আকবরের শয়নকক্ষে যাওয়ারও অনুমতি ছিল পাদরীর, বড় বড় আমিরের ভাগ্যেও সে- সুযোগ জুটত না। যদিও কাসিম খাঁ পথ ঠিক করার চেষ্টা করেছিলেন, তা সত্ত্বেও কাশ্মীরের পাহাড়-পর্বত থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বহু হাতি, ঘোড়া, এমনকি লোকজনেরও মৃত্যু হয়। পিতার মতোই সলীম ভয় কাকে বলে জানতেন না । শাহজাদা সলীমকে এক বাঘিনী প্রায় মেরে ফেলেছিল। জেস্যুইট সাধুরা কুমারী মরিয়মের কৃপাতেই তিনি রক্ষা পেয়েছেন বলে জানান। সলীম সর্বদা মরিয়মের তাবিজ গলায় পরে থাকতেন। আকবর কাশ্মীরে থাকতেই ৭ই সেপ্টেম্বর লাহৌরে নির্মিত নতুন গির্জার প্রতিষ্ঠা হয় ।
চাঁদবিবির বীরত্বের কারণেই আহমদনগর উত্তম শর্তে সন্ধি করার সুযোগ লাভ করেছিল, কিন্তু তা থেকে বেশিদিন লাভবান হতে পারেনি। বরার সুবা প্রদান করার টালবাহানায় দরবারের অনেক সভাসদই চাঁদবিবির শত্রু হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁরা সন্ধির শর্ত ভেঙে বরার দখল করতে চাইলেন।
মোগলেরা পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হল। দাক্ষিণাত্যে পূর্ণ অধিকার কায়েম করার এমন ভালো সুযোগ আর হয় না, কিন্তু অযোগ্য শাহজাদা মুরাদ রহীমের পা ধরে পিছনে টানতে থাকেন। তা সত্ত্বেও ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে গোদাবরী উপকূলে সুপার নিকটস্থ অস্টিতে একটা জোর লড়াই হল।
আহমদনগরের সেনাপতি সুহেলখান বিজাপুরের সেনার সহায়তায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। খানখানা অনেক মূল্যের বিনিময়ে জয়লাভ করেন। বস্তুত সেটাকে বিজয় বলা যায় এই জন্যই যে যুদ্ধক্ষেত্র মোগলদের অধিকারে ছিল। এত ক্ষয়ক্ষতি হয় যে শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করা সম্ভব হয়নি । রাজা আলী খা আক-বরের পক্ষে খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করেন এবং তার জায়গায় যোগ্য পিতার অযোগ্য পুত্র মীরা বাহাদুর খানদেশের শাসক হন ।
দাক্ষিণাত্যে রহীম ও মুরাদের অবনিবনা দেখে আকবর উভয়কেই অপসারিত করে মির্জা শাহরুখকে সেনাপতি করেন । মির্জা শাহরুখ বদশার শাসক ছিলেন, উজবেকরা তাঁকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। আবুল ফজলও সে-সময় দাক্ষিণাত্যে ছিলেন। আক-বর তাকে আদেশ পাঠালেন শাহজাদা মুরাদকে দরবারে পাঠিয়ে দিতে। এটা সেই সময় যখন তুরানী আব্দুল্লা খানের মৃত্যু হয়। সেই খবর শুনে আক-বর পশ্চিমোত্তর সীমান্ত সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হন এবং ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তিনি লাহৌর থেকে প্রস্থান করে আগরায় এসে উপস্থিত হন। এবার থেকে আগরাই আক-বরের রাজধানী হয়।
আকবর কোনো উপযুক্ত পুত্র লাভ করেননি, সকলেই অযোগ্য, সকলেই একে অপরকে পথের কাঁটা মনে করে পরস্পর লড়াই করতে উদ্যত ছিলেন। সেই কারণে আক-বরকে কয়েক মাস আগরায় আটকে থাকতে হয়। ১০০৮ হিজরীর শুরুতে (জুলাই, ১৫৯৯ খ্রিঃ) তিনি দাক্ষিণাত্য যাত্রার অবকাশ পান। তিনি রাজধানী ও আজমের সুবার শাসনভার সলীমের হাতে দিয়ে উপদেশ দিলেন, সলীম যেন মেওয়াড়ের রানাকে সম্পূর্ণভাবে আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করেন।
অত্যধিক সুরাপান-হেতু শাহজাদা মুরাদ ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দাক্ষিণাত্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মুরাদ মনে করতেন, সলীম অপেক্ষা তিনিই বেশি উপযুক্ত এবং তাঁরই সিংহাসন পাওয়া উচিত। আক-বরের মৃত্যুর সময় যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে অ অত সহজে তখতে বসার সুযোগ পেতেন না সলীম ।
আরও দেখুনঃ