খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব

খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক সমন্বয়” বিভাগের একটি পাঠ। পোর্তুগিজরা কাঠিয়াওয়াড়ে দমন বন্দর ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে অধিকার করে নেয়। তার পনেরো বছর পরে (১৫৭৩ খ্রিঃ) আকবর গুজরাত যান। সে-সময় পোর্তুগিজদের বিষয়ে তো তিনি শুনেছিলেনই, এমনকি পোর্তুগিজ প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হয় এবং সন্ধি হয়। কয়েক বছর বাদে আকবর তাঁর দূতমণ্ডলীকে সন্ধির শর্তাদি নির্ধারণ করার জন্য গোয়া প্রেরণ করেন।

খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব

 

খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে গোয়ার ভাইসরয় মেনেজেস অন্তনিয়ো কবরাসকে নিজের দূত হিসেবে আকবরের দরবারে প্রেরণ করেন । অন্তনিয়ো ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দেও সাফল্যের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করেছিলেন। অন্তনিয়ো কিছুদিন সিক্রীতে থাকেন। তিনি আকবরকে খ্রিস্টান ধর্মের রীতি-প্রথা সম্পর্কে অনেক কথাই জানিয়েছিলেন । কিন্তু তিনি সাধু (পাদরী) ছিলেন না, সেজন্য বিশেষভাবে জানার জন্য কোনো সুশিক্ষিত পাদরীকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ভাবেন।

১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বড় পাদরী (ভিকর জেনারেল) সাধু জুলিয়ান পরেরা সাতগাঁওয়ে থাকতেন। আকবর তাঁকে দরবারে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করে খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে অনেক বিষয় জানতে পারেন। কিন্তু সাধুর জ্ঞান কম ছিল, তিনি একজন ভালো সাধুই ছিলেন। আকবরের একজন পোর্তুগিজ কর্মচারী ছিল পিয়েত্রী তভারেশ, কিছুদিন পূর্বে সে হুগলী বন্দরে কাপ্তেন হয়েছিল। এর আগে সেও আকবরকে বেশি কিছু জানাতে পারেনি ।

 

(১) প্রথম জেস্যুইট মিশন (১৫৮০ খ্রিঃ)

ইবাদতখানায় জোর শাস্ত্রচর্চা চলছে, এমন সময় আকবর ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে গোয়ার পোর্তুগিজ অধিবাসীদের নিকটে খ্রিস্টান ধর্মের পণ্ডিত প্রেরণের উদ্দেশ্যে একখানি পত্র পাঠান, তার কয়েকটি বাক্য এরকম—

“আমি আমার দূত আব্দুল্লা ও দমেনিকো পেরেজকে এই উদ্দেশ্যে পাঠালাম যাতে আপনি দু’জন পণ্ডিত ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠান। তাঁরা যেন ধর্ম-পুস্তক, করে সমগ্র বাইবেল সঙ্গে এক নিয়ে আসেন। আমি আন্তরিকতার সঙ্গে সে-সবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য জানতে চাই। আমি আরও জোর দিয়ে বলছি যে তাঁরা তাঁদের বইপত্র নিয়ে আমার রাজদূতদের সঙ্গে চলে আসুন। তাঁরা এলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো। তাঁরা আমার প্রিয়জন হয়ে থাকবেন এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারে তাঁদের মান-সম্মান প্রদর্শন করব। যদি তাঁরা চান তাহলে অতি সম্মান-সহকারে যথোচিত ইনাম দিয়ে তাঁদের ফেরত পাঠাব। আমাকে তাঁদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে আব্দুল্লা গোয়া পৌঁছান। পোর্তুগিজ উপরাজ তাঁকে বড় সমাদর করেন। কয়েক বছর ধরে গোয়ার পাদরীদের মনে যে-আকাঙ্ক্ষা ছিল, অনায়াসেই সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ সুগম করে দিলেন আকবর। তাঁরা নভেম্বরে বাদশাহের আমন্ত্রণ স্বীকার করে নিলেন।

সেজন্য সাধু রিদালফো অকভিভার নেতৃত্বে অন্তনিয়ো মোনসেরেত ও ফ্রান্সিসকো এনরিকেজ নামক দু’জন সাধুকে পাঠানোর কথা ঠিক হয়। এনরিকেজ পেরেজে ইরানী মুসলমান থেকে খ্রিস্টান হন, এবং দোভাষীর কাজ খুব ভালো করতে পারতেন, কেননা তিনি ফারসি-ভাষী ছিলেন। সাধু রিদালফো (জন্ম ১৫৫০ খ্রিঃ) নেপস্ রাজ্যের এক অত্যন্ত প্রভাবশালী ডিউকের পুত্র ছিলেন, পিতার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি দীক্ষা নিয়ে জেস্যুইট সম্প্রদায়ের সাধু হয়ে যান। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বিধর্মীদের খ্রিস্টান করার উদ্দেশ্যে তিনি গোয়ায় আসেন। আসার মাসখানেক পরেই বিজাপুর সুলতানের কুড়িজন নওকরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে সফল হন। তিনি গোয়ায় দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। স্থানীয় ভাষা (কোঙ্কণী) খুব দ্রুততার সঙ্গে শিখে নিয়ে ফারসি অধ্যয়ন করেন তিনি ৷

সাধু অন্তনিয়ো মোনসেরেত স্পেন-নিবাসী ছিলেন। আকবরের দরবারে একবার শাস্ত্রচর্চার সময় তিনি পয়গম্বরের ধর্মকে কড়া ভাষায় জোর আঘাত হানেন, আর তাঁকে সংযত করতে হয় আকবরকে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোয়ায় ফিরে যান। মোনসেরেতকে দূতমণ্ডলের ইতিহাস-লেখক নিযুক্ত করা হয়েছিল।

তিনি প্রতিদিনের ঘটনা সেদিন রাতেই লিখে ফেলার নিয়ম করে নিয়েছিলেন। (আরবরা তাঁকে বন্দী করেছে, পাদরীদের তৃতীয় মিশনের কাছ থেকে এই সংবাদ শুনে আকবর খুবই দুঃখিত হন।) মোনসেরেতের বিবরণ ভাস্কো দা-গামার পর উত্তর ভারত সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন ইউরোপীয় অভিলেখ। এতে আকবরের ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দের কাবুল-অভিযানের চমৎকার বর্ণনা আছে।

মোনসেরেত শাহজাদা মুরাদের অধ্যাপক হিসেবে আকবরের সঙ্গে জালালাবাদ (আফগানিস্তান) পর্যন্ত গিয়েছিলেন । অকভিভা ও তাঁর দুই সঙ্গী গোয়া থেকে সমুদ্রপথে ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর দমন পৌছান। সেখান থেকে বালসার ও নওসারী হয়ে ডিসেম্বরে সুরাতে সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করেন। 

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি তাঁরা একটি ক্যারাভানের সঙ্গেই পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। পথে ডাকাতের ভয় ছিল। সেজন্য কোনো বড় সশস্ত্র ক্যারাভানের সঙ্গেই যাত্রা করা সম্ভব ছিল। মুকরমুণ্ডা, তলোদা (খানদেশ), তারপর সুলতানপুর হয়ে নর্মদা অতিক্রম করে মাণ্ডু ও উজ্জয়ন পৌঁছান।

৯ই ফেব্রুয়ারি সারঙ্গপুরে (জেলা দেওয়াস) উপস্থিত হন, ছয় দিন পথ অতিক্রম করে সিরোজে গেলে আকবরের পাঠানো সৈনিকেরা তাঁদের স্বাগত জানান। নরওয়র, গওয়ালিয়র ও ধওলপুর হয়ে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পদরীরা সিক্রীতে পৌঁছান। আকবর তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এতই উৎসুক ছিলেন যে তাঁরা পৌছতেই কাছে ডেকে পাঠালেন এবং রাত্রি দুই ঘটিকা পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলেন। আকবর তাঁদের বহু ধন- সম্পদ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদি আবশ্যকীয় বস্তু ব্যতীত সাধুরা আর কিছুই নিতে সম্মত হননি। পেরেজ দোভাষীর কাজ করেছিলেন। তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল, সাধুদের যেন কোনো কষ্ট না হয়৷

পরদিন দীওয়ানখাসে আকবর তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ৩রা মার্চ স্পেনের রাজা ফিলিপের (১৫৬৯-৭২ খ্রিঃ) জন্য ছাপানো সুন্দর জিদ্ বাঁধাই বাইবেল আকবরকে ভেট দেওয়া হল। (পরে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর এই বাইবেল ও অন্যান্য ইউরোপীয় পুস্তক খ্রিস্টান সাধুদের ফেরত দিয়েছিলেন।) মাথায় পাগড়ি খুলে তিনি বাইবেল সসম্মানে মাথায় রাখেন এবং ভক্তিভরে চুম্বন করেন।

সাধুরা নিজেদের সঙ্গে যীশু খ্রিস্ট ও কুমারী মরিয়মের চিত্র এনেছিলেন। আকবর তাঁর চিত্রকরদের সেগুলোর প্রতিলিপি অঙ্কন করতে বললেন। প্রাসাদের এক অংশে সাধুদের একটা ছোট মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলেন। একদিন আকবর স্বয়ং সেখানে দর্শন করতে যান। তিনি তাঁর দশ বছর বয়স্ক পুত্র মুরাদকে খ্রিস্টান ধর্ম ও পোর্তুগিজ ভাষা শেখানোর ভার দেন মোনসেরেতের উপর। রাজধানীতে সাধুদের ধর্মোপদেশ দানের সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়। এই সময় এক পোর্তুগিজ মারা যান।

 

খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

ক্রুশ ও মোমবাতির আলোকমালা-সহ তাঁর শবযাত্রা পথে নির্গত হয়। জেস্যুইট পাদরীরা ধর্মান্ধ মোল্লাদের অপেক্ষা কোনো অংশেই কম ছিলেন না। আকবরের সমন্বয়বাদ তাঁরা পছন্দ করতেন না। অকভিভা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বরের পত্রে এই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন  “আমাদের কানে বিদ্রূপ ও ঘৃণ্য মুহম্মদের নাম ব্যতীত আর কিছুই আসে না।…সংক্ষেপে এখানে মুহম্মদেরই সবকিছু। এই নারকীয় রাক্ষসের সম্মানে তিনি হাঁটু

গাড়েন, সিজদা করেন, হাত উপরে তোলেন তথা লোকজনকে দান করেন। আমরা সত্য কথা এতটুকুও প্রকাশ করে বলতে পারিনে। যদি আমরা একটু বেশি অগ্রসর হই, তাহলে বাদশাহের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠবে।” অকভিভা ও মোনসেবেত খ্রিস্টান ধর্ম বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন আকবরকে।

এ কথাও উল্লেখ করেছি যে ইবাদতখানায় মোনসেরেত ধর্মশাস্ত্রীয় বাদানুবাদে বাক্- সংযমের পরিচয় দেননি। কয়েকজন মৌলবী আকবরকে পরামর্শ দেন, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের সত্যতার জন্য অগ্নিপরীক্ষা নেওয়া হোক । ইসলামের দাবিদার হাতে কুরান নিয়ে এবং খ্রিস্টান সাধু বাইবেল নিয়ে আগুনে প্রবেশ করুন।

যিনি অক্ষত শরীরে বেরিয়ে আসতে পারবেন, তাঁরই ধর্ম সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া হবে। কথাটা আকবরের খুব পছন্দ হয়। তিনি তিনকে পাঁচ করা এক মোল্লাকে তো বুঝিয়ে রাজি করালেন— এভাবে তাঁর হাত থেকেও রেহাই পেতেন তিনি, কিন্তু খ্রিস্টান সাধুরা এটাকে খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। খ্রিস্টান সাধুরা লিখেছেন, আকবর মক্কা যাওয়ার অজুহাতে গোয়ায় ব্যাপটিজম গ্রহণ করবেন বলেছিলেন।

কাবুল অভিযানের সময় মোনসেরেত শাহজাদা মুরাদের শিক্ষক হয়ে সঙ্গে যাত্রা করেন, কিন্তু অকভিভা সিক্রীতেই থেকে যান। অতিরিক্ত ধ্যান-তপস্যার ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। কাবুল-বিজয়ের পর আকবর অকভিভাকে ডেকে পাঠান । তিনি সরহিন্দে পৌছতে পৌঁছতেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রাণে রক্ষা পান এবং লাহৌরে বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জানান, শাহী অমাত্যদের ও দমনের পৌর্তুগিজদের মধ্যে অশান্তি চলছে।

আকবর খুব বিস্মিত হয়ে বাইরে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে, প্রকৃতপক্ষে আকবর ভারত-ভূমিতে পোর্তুগিজদের আর দেখতে চাইছিলেন না, তাই তাঁর অমাত্যরা নিজের মর্জিতে অশান্তি সৃষ্টি করেনি। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতেই (যখন খ্রিস্টান সাধু সিক্রীর দিকে যাচ্ছিলেন) আকবর ফিরিঙ্গিদের বন্দর অধিকার করার জন্য তাঁর দুগ্ধ-ভ্রাতা সেনাধ্যক্ষ কুতুবুদ্দীনের অধীনে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং গুজরাত তথা মালওয়ার আমির-ওমরাহদের সাহায্য করার জন্য আদেশ দেন। শোনা যায়, নিজেদের মামুলি কলহ বাড়তে বাড়তে পোর্তুগিজ ও মোগলদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের রূপ নেয়।

পোর্তুগিজরা সারা সমুদ্রে নিজেদের শাসন দাবি করত, ছাড়পত্র ব্যতীত মক্কা বা অন্যত্র-গামী যে কোনো জাহাজকে তারা আটক না করে ছাড়ত না। আকবর তাদের এই জবরদস্তি কিভাবে মেনে নিতে পারেন? কিন্তু তাঁর কাছে মজবুত সামুদ্রিক নৌবহর ছিল না। পরে আমরা দেখব যে এদিকেও তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সমুদ্রে লাফ দিয়েই সমুদ্র-বিজয় সম্ভব। রাবী অথবা হুগলী নদীর জন্য নির্মিত বজরা পোর্তুগিজদের মোকাবিলা করতে সমর্থ ছিল না ।

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে গুলবদন বেগমের হজ-যাত্রার উদ্দেশ্যে আকবর দমনের নিকটস্থ বুতসর গ্রাম পোর্তুগিজদের দিয়ে ছাড়পত্র লাভ করেছিলেন। গুলবদনের নির্বিঘ্নে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি সেই বুতসর গ্রাম কেড়ে নেওয়ার হুকুম দেন। কিন্তু পোর্তুগিজরা মোগল সেনাকে সে-কাজে সফল হতে দেয়নি এবং সেই সঙ্গেই একটি মোগল জাহাজও আটক করে। এই সময় দিভোগো লোপেস কুতিনহোর অধীনে পোর্তুগিজ নৌসেনার বহর ছিল সুরাতের নিকটে তাপ্তিতে। তার কয়েকজন সৈনিক শিকার উপলক্ষ্যে মিত্রদেশ ভেবে মোগল-সীমার মধ্যে প্রবেশ করে।

মোগল সৈনিকেরা তাদের উপর আক্রমণ করে কয়েকটি নৌকো আটক করে এবং তাদের সুরাতে নিয়ে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য বলে। তারা অসম্মতি জানালে তাদের হত্যা করা হয়। তাদের সর্দার লা সেরদার মাথা কেটে রাজধানীতে পাঠানো হয়। আকবর না- জানার ভান করে এই বিবাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন । ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজাদেশ অনুসারে কুতুবুদ্দীন পঞ্চদশ সহস্র সওয়ার সংগ্রহ করে দমন এলাকায় লুণ্ঠন চালান। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল তিনি দমন বন্দর আক্রমণ করেন।

 কিন্তু পোর্তুগিজ নৌসেনা তাঁকে পিছু হঠতে বাধ্য করে। পোর্তুগিজ সাধুরা সে- কথা উল্লেখ করলে সে-বিষয়ে আকবর নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন: কুতুবুদ্দীন সিপাহসালার, তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্ভবত তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকবেন । এমনিতে তাঁর উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না।

সেজন্য তাঁকে কিছু বলা সম্ভব নয়। পরে আকবরের হুকুম গেলে কুতুবুদ্দীন তাঁর সেনা দ্রুত সরিয়ে নেন। এই সময় পোর্তুগিজরা দিও (সৌরাষ্ট্র)-এর উপর আক্রমণও ব্যর্থ করে দেন। এতে তো কোনো সন্দেহ নেই যে পোর্তুগিজ সাধুরা কেবল ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেই এ দেশে আসেননি, বলতে গেলে তাঁরা তাঁদের প্রভুর— স্পেন-পোর্তুগালের রাজার— সেবাকার্যও সাধন করতে চাইতেন । এই সময় আকবর ইউরোপের রাজাদের— বিশেষ করে পোর্তুগালের রাজসভায় দূতমণ্ডলী প্রেরণের কথা ভাবেন ।

তুর্কিস্তানের তুর্কিদের সঙ্গে তাঁর বনিবনা ছিল না, অভিপ্রায় ছিল পোর্তুগালের সঙ্গে জোট বেঁধে তুর্কিদের দমন করা। যখন তিনি জানতে পারেন যে ক্যাথলিকদের পোপ কিংবা ইউরোপীয় রাজাদের উপরেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে, তখন আকবর তাঁর কাছেও ধর্মীয় মনোভাব প্রকাশ করে লেখেন: আমি মুসলমান নই । আমার পুত্র তার ইচ্ছানুসারে যে কোনো ধর্মই গ্রহণ করতে পারে। গোয়ার আদেশে মিশনারি ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষে শাহজাদা মুরাদের শিক্ষক হিসেবে অকভিভাকে থেকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

কাবুল-অভিযানের কারণে ইবাদতখানায় শাস্ত্রালোচনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় তার বন্দোবস্ত করা হল। একদিন রাত্রে দীওয়ানখাসে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বিদ্বান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। কুরান ও বাইবেলের মহত্ত্ব নিয়ে তর্ক-বিতর্কে সভা উত্তাল ।

আকবর বললেন, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনে শাস্ত্রচর্চা চলুক যাতে আমি বুঝতে পারি কোন ধর্ম সত্য। পরদিন সন্ধ্যাবেলা সভায় দুই বড় শাহজাদা ও বহু আমির তথা অধীনস্থ রাজারাও হাজির হলেন। তারপর থেকে সভায় উপস্থিতি ক্রমশ কমতে থাকে এবং শেষে অবস্থা এমন হল যে কেবল খ্রিস্টান সাধুরাই অবশিষ্ট রইলেন সভায় হাজির হতে।

আকবরের মনে আর কোনো প্রশ্ন রইল না। তিনি বুঝতে পারলেন, পুরনো ধর্মগুলো থেকে কোনো আশা নেই। ভেবে দেখলেন, যদি ইসলাম, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দু— এই তিন ধর্মের কোনো একটিকে তিনি গ্রহণ করেন, তাহলে অন্য ধর্মগুলির সম্মিলিত বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। আচার-ব্যবহারে তিনি অধিকতর হিন্দু বিধি- বিধান ও রীতিনীতির প্রতি ক্রমশ আকৃষ্ট হচ্ছিলেন এবং সেইরকমই আচরণ করতেন। তিনি ভাবলেন, সমস্ত ধর্মেরই ভালো-ভালো বিষয়গুলি নিয়ে একটি নতুন ধর্ম দীন- ইলাহী প্রতিষ্ঠা করা যাক। এইভাবে পাঁচ বছর পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় শাস্ত্রচর্চা বন্ধ হয়ে যায়।

ইউরোপে দূতমণ্ডলী প্রেরণ যদিও সফল হয়নি, তথাপি বলা যায়, আকবরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । সৈয়দ মুজফ্ফরকে দূতমণ্ডলীর প্রধান ও সাধু মানসেরেতকে তাঁর সহকারী করার কথা হয়। বহুদিন ধরে প্রস্তুতি চালানোর পর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে দূতমণ্ডলী রওনা হন। ৫ই আগস্ট তাঁরা সুরাতে পৌছান। সেখানে একদিন আগে দু’জন খ্রিস্টান তরুণকে হত্যা করা হয়েছে, এ কথা জানতে পেরে তাঁরা মর্মাহত হন। জৈন ব্যবসায়ীরা এক হাজার মোহর দিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শাহী অমাত্যরা তাতে আমল দেয়নি।

পোর্তুগিজদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং তাদের সহযোগিতা ছাড়া দূতমণ্ডলীর পক্ষে ইউরোপ যাওয়া সম্ভব ছিল না। সৈয়দ মুজফ্ফরকে দলের সঙ্গে জোর করে পাঠানো হয়েছিল, তিনি পালিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যান। আব্দুল্লা খাঁ মোনসেরেতের সঙ্গে দমন এবং তারপর সেখান থেকে গোয়া যান। সে-সময় কোনো অনুকূল জাহাজও যাচ্ছিল না, সেজন্য গোয়ার অধিকারীরা দূতমণ্ডলীর যাত্রা পরবর্তী বছরের জন্য স্থগিত করে দেয়। শেষে আব্দুল্লাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হয় ।

এই সমগ্র সময়কাল অকভিভা সিক্রীতেই ছিলেন। আকবরের চিন্তাভাবনার প্রভূত পরিবর্তন দেখে তিনি সিক্রীতে থাকা অর্থহীন মনে করেন । অনেক কষ্টে তিনি অনুমতি লাভ করেন এবং ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গোয়ায় ফিরে যেতে পারেন। জেস্যুইট পাদরীরা নিজেদের এলাকায় লোকজনকে খ্রিস্টান করার জন্য পাশবিক শক্তি প্ৰয়োগ করত।

হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা, হিন্দুদের মনোভাবে সব রকমের আঘাত দেওয়া, ছলনা-কপটতা যে-ভাবেই হোক, হিন্দুদের নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করা— এটা ছিল তাদের কাছে সাধারণ ব্যাপার— নিষ্ঠুর সেন্ট জেভিয়ার ছিলেন তাদের আদর্শ। এইরকমই কোনো আচরণের ফলে হিন্দুরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং অকভিভা গোয়ায় পৌঁছানোর দু মাস পরেই চার সঙ্গী-সহ তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।

পোপ তাঁর ধর্ম- নিষ্ঠার পরিচয় দিতে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে শহীদ সন্ত ঘোষণা করেন। অকভিভা সিক্রী ত্যাগ করার সময় এক রুশ ক্রীতদাস-পরিবারকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারে মাতা-পিতা, দুই পুত্র ও আরও কয়েকজন ছিল। বহুদিন তারা মুসলমানদের মধ্যে বাস করেও গাত্রবর্ণে ও নামে খ্রিস্টান ছিল। আকবরের মাতা বিরোধিতা করছিলেন, কিন্তু আকবর তাদের যাওয়ার অনুমতি দেন।

পাদরী বড় লোভ নিয়ে দরবারে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন, আকবর খ্রিস্টান হয়ে যাবেন, তারপর ভারতের কস্তাতিন হয়ে সমস্ত প্রজাকে খ্রিস্টান করে দেবেন। সফল হতে না পেরে ‘আঙুল ফল টক’ প্রবাদ বাক্যকেই চরিতার্থ করেন, বলেন, আকবর স্রেফ তামাশা করতেই সাধুদের কাছে এটা-ওটা জানতে চাইতেন ।

পোর্তুগিজদের থেকে আলাদা ইংরেজ জেস্যুইট টমাস স্টিফেন ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে গোয়া আসেন। সম্ভবত ভারতে বসবাসকারী তিনিই ইংরেজ, যিনি চল্লিশ বছর ধরে গোয়া ও চারপাশে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার করেন। কোঙ্কণী ভাষার উপর তাঁর পূর্ণ দখল ছিল ।

তিনিই প্রথম ওই ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন, সেটি তাঁর মৃত্যুর পরে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে গোয়ায় ছাপা হয়। কোঙ্কণী খ্রিস্টানদের জন্য তিনি একটি খুব দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন । ১০ই নভেম্বর তাঁর পিতার উদ্দেশে ভারত সম্পর্কে লেখা দীর্ঘ পত্র হকলউইট কর্তৃক প্রকাশিত হয় ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে। সেটা পড়েই ইংরেজদের ভারত সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তার শেষ পরিণাম ভারতে ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা ।

১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের রাণী এলিজাবেথ লেওয়ান বাণিজ্য কোম্পানিকে পূর্ব- ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্য করার অনুপতিপত্র প্রদান করেন। এই কোম্পানি ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনের এক ব্যবসায়ী জন নিউবেরিকে ভারতে প্রেরণ করে। তিনি ভারতে আসা প্ৰথম ইংরেজ বণিক।

তাঁর সঙ্গে একজন স্বর্ণকার উইলিয়ম লীড্‌স্ ও একজন চিত্রকর জেম্‌স্ স্টোরিও ভারতে আসেন। ভারত সম্পর্কে তাঁদের যেটুকু জ্ঞান ছিল, তা ওই স্টিফেনের পত্র থেকেই। লণ্ডনের অপর এক বণিক রাল্ফ ফিচও বিশ্ব-পর্যটনের উদ্দেশ্যে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ত্রিপোলি (সিরিয়া) থেকে তাঁরা স্থলপথে হলব, বাগদাদ হয়ে হোরসুজ (ইরান) পৌঁছে জাহাজ ধরতে চেয়েছিলেন।

অন্য কারো প্রাচ্যদেশে আসা পোর্তুগিজরা সহ্য করতে পারত না। হোরমুজে তারা ওই ইংরেজদের আটক করে কারারুদ্ধ করে, তার কিছুদিন পরে তাঁদের গোয়ার পাঠিয়ে দেয়। গোয়াতেও তাঁরা কারারুদ্ধ হয়ে থাকেন, সাধু স্টিফেনের জামানতের উপর তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। জেম্‌স্ স্টোরি চিত্রকর হওয়ার সুবাদে জেস্যুইটদের অনুগ্রহভাজন হয়ে ওঠেন। সেখানেই তিনি এক অর্ধ-শ্বেতাঙ্গিনী কন্যাকে বিবাহ করে নিজের দোকান খোলেন এবং দেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তা ত্যাগ করেন। তাঁর তিন সঙ্গী প্রোটেস্টান্ট ছিলেন, ক্যাথলিকদের দৃষ্টিতে তাঁরা নাস্তিক। তাঁরা বিপদ বুঝে, জামানত জব্দ হওয়ার আশঙ্কা আগ্রাহ্য করে গোপনে পলায়ন করেন।

বেলগাঁও, বীজাপুর, গোলকুণ্ডা, মুরলীপটম, বুরহানপুর হয়ে মাণ্ডুতে পৌঁছান তাঁরা। যাত্রাপথে কমবেশি ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেদের খরচপত্র যোগাড় করেন। মাণ্ডুতে এসে আকবরী দরগাহ দেখার ইচ্ছে হয় তাঁদের এবং উজ্জয়ন, সিরোজ হয়ে বর্ষাকালে, বন্যা-প্লাবিত বহু নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে, শেষে তাঁরা আগরা পৌঁছান।

তাঁদের মধ্যে একমাত্র ফিচ ইংল্যাণ্ড ফিরে যেতে পেরেছিলেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে অথবা আগস্টের শুরুতে তাঁরা সিক্রীতে হাজির হন। আকবর তখন রাজধানীতেই ছিলেন। ২২শে আগস্ট আকবর কাবুল- অভিযানের জন্য রওনা হন। লীড্‌স্ আকবরের নিকটে কর্মনিযুক্ত হন। তিনি স্বর্ণকার- জহুরি ছিলেন। নিউবেরি ও ফিচ ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিক্রীতে থাকেন। নিউবেরি হলব অথবা কনস্তানতিনোপোল চলে যেতে মনস্থ করেন এবং ফিচকে বাংলা ও পেগু (বর্মা) যাওয়ার জন্য বলেন।

ফিচ বাংলা ও পেগু যান এবং ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ড প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর নিউবেরির আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফিচ সোনারগাঁও বন্দর (জেলা ঢাকা) থেকে ভারত ত্যাগ করেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে নিউবেরির দলটিকে ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করার সময় রানী এলিজাবেথ ভারত ও চীনের সম্রাটের উদ্দেশে সুপারিশপত্র লিখে দিয়েছিলেন। রানী জেলাবদিন এখবারের নাম শুনেছিলেন এবং তাঁর উদ্দেশে খম্ভাতের (কম্বাত) রাজার মাধ্যমে পত্র লিখেছিলেন।

 

(২) দ্বিতীয় জেস্যুইটি মিশন (১৫৯০ খ্রিঃ)

১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে অকভিভার চলে যাওয়ার পর সাত বছর পর্যন্ত আকবরের দরবারে কোনো খ্রিস্টান মিশনারীর পৌছানোর কথা জানা যায় না। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে এক গ্রীক (ইউনানী) পাদরী লেউ গ্রিমোন ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবে এসে পৌঁছান এবং আকবরের দরবারে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি গোয়ার পাদরীদের আমন্ত্রণ জানানোর পরামর্শ দেন। আকবর গোয়ায় একখানি জোরালো পত্র লেখেন। গ্রিমোনের বিষয়ে তিনি তাঁর অমাত্যদের একটি ভালো সুপারিশপত্র দেন। গোয়ায় গ্রিমোন খুব অতিরঞ্জিত করে আকবরের শ্রদ্ধাভক্তির কথা জানান।

পোর্তুগিজ সাধু এয় লেওতান ও ক্রিস্তোফার দিবেগাকে একজন সহকারীর সঙ্গে গোয়া থেকে প্রেরণ করা হয়। তাঁরা ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে লাহৌর পৌছান। আকবর তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান । সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সহ প্রাসাদেই একখানা ঘর দেন তাঁদের থাকার জন্য। শাহজাদা ও আমিরদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য একটি পাঠশালাও খোলেন।

কিন্তু আকবর যে খ্রিস্টান হতে ইচ্ছুক নন, সেটা জানতে বেশি দেরি হয় না তাঁদের। ফলে সেখানে তাঁদের থাকার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সাধু লেওতানকে সেখানেই থাকতে আদেশ দেন। দিবেগা ফিরে যান । সম্ভবত তখনও আশা ছিল, কিন্তু সে-আশা কখনও পূর্ণ হওয়ার নয় ভেবে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় সাধুও গোয়ার ফিরে যান! সম্ভবত এ কাজে তাঁদের এই অধৈর্য দেখানোর জন্য পোপের দরবারে তাঁরা তিরস্কৃত হন।

ধর্ম বিষয়ে আকবরের সদা-সর্বদা তীব্র কৌতূহল থাকার কথা নয়। সে-সময় রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলেন তিনি, সিন্ধু-বিবাদের দিকে তাঁকে মনোযোগ দিতে হচ্ছিল, এমন সময় একান্ত মনে পাদরীদের সরমন শ্রবণ করা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? তাঁর কৌতূহলের ধরনও পাদরীদের খারাপ লেগেছিল । তিনি সমস্ত ধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়ন করতে চাইতেন, সেজন্য শাস্ত্রালোচনা ও সৎসঙ্গের দ্বারা পারসি- জৈন ধর্মাচার্যদের কাছ থেকেও জ্ঞানলাভ করতে চাইতেন। তিনি সকল ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন, সেজন্য সকলকে খুশি করতে পারেননি। ১০০০ হিজরীতে (১৫৯১-৯২ খ্রিঃ) পয়গম্বর মুহম্মদের মক্কা থেকে মদীনা যাত্ৰা

এক হাজার বছর পূর্ণ হচ্ছিল। এই উপলক্ষ্যে আকবর এক ‘সহস্র বর্ষের ইতিহাস’ (তারীখ আলকী) প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ আকবরের ৩৭-তম রাজ্যবর্ষ শুরু হয়। সেই বছর সহস্রাব্দ উপলক্ষ্যে নতুন মুদ্রা চালু হয় । ১০০২ হিজরীতে (১৫৯৩-৯৪ খ্রিঃ) আকবর কয়েকটি আদেশ জারি করেন, তা থেকে বোঝা যায়, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা তিনি কতখানি স্মরণে রাখতেন— “শৈশবে অথবা অন্য কোনোভাবে কোনো হিন্দুকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমান করা হলে, যদি সে তার পিতা-পিতামহের ধর্মে প্রত্যাবৃত্ত হতে চায়, তাহলে তা অনুমোদন-গ্রাহ্য।”

“ধর্মের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতা করা যাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার ইচ্ছানুসারে যে কোনো ধর্ম অবলম্বন করতে পারে।” “যদি কোনো হিন্দু মহিলা কোনো মুসলমানকে ভালোবেসে মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে তাকে তার পতির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গিয়ে তার পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে ।” “যদি কোনো অ-মুসলিম নিজের গির্জা, ইহুদী ধর্ম-মন্দির, দেবালয় কিংবা পারসি

সমাধি নির্মাণ করতে চায়, তাহলে তাতে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না।” ইউরোপীয় ঐতিহাসিক আকবরের সদিচ্ছাগুলির মধ্যেও দুরভিসন্ধি এবং উদারতার মধ্যেও দোষ খুঁজে বের করতে কুণ্ঠিত হননি। উপরোক্ত কথাগুলি উদ্ধৃত করে ভিনসেন্ট স্মিথ জানাতে চেয়েছেন যে আকবরের উদারতা ও সহিষ্ণুতার স্রোত ইসলামের কাছে পৌঁছতে-না-পৌছতেই শুকিয়ে যেত। বস্তুত তার মধ্যে আকবরের দোষ ছিল না । ইসলামের দাবিদারেরা অন্য ধর্মের সমৃদ্ধিসাধন আদৌ বরদাস্ত করতে পারত না। তারা নিজেদের অনুকূলে একতরফা শাসন চাইত এবং আকবর তাতে সম্মত ছিলেন না।

 

(৩) তৃতীয় জেস্যুইট মিশন (১৫৯৪ খ্রিঃ)

আকবর গোয়ার পোর্তুগিজ উপরাজকে বিদ্বান পাদরী পাঠানোর জন্য তৃতীয়বার (১৫৯৪ খ্রিঃ) পত্র লেখেন। পাদরীদের এ বিষয়ে উৎসাহ ছিল না, কিন্তু পোর্তুগিজ উপরাজ তার রাজনৈতিক গুরুত্বও উপলব্ধি করতেন। এবার ধর্মান্ধতার জন্য প্রসিদ্ধ সন্ত ফ্রান্সিস জেভিয়ারের ভ্রাতুষ্পুত্রের পুত্র সাধু জেরোম জেভিয়ার, এক পোর্তুগিজ ইমানুয়েল পিনহেরো তথা সাধু বেনেদিক্ত গোয়েজকে পাঠানো স্থির হয়।

প্রথম মিশনের আর্মেনিয়ান দোভাষীকেও এই সাধুদের সঙ্গে পাঠানো হল। জেরোম কয়েক বছর ধরে ভারতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করছিলেন। তিনি খুব উৎসাহের সঙ্গে এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং লাগাতার কুড়ি বছর পর্যন্ত (আকবরের মৃত্যুর অনেক পরবর্তীকাল পর্যন্ত) মোগল-দরবারে থাকেন। সাধু পিনহেরো অধিকাংশ সময় লাহৌরে পড়ে থাকতেন, আকবরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের সুযোগ হয়নি তাঁর। তিনি বহু পত্র লিখেছিলেন, সেগুলি তখনকার পরিস্থিতির উপর অনেকখানি আলোকপাত করে। গোয়েজ দরবার থেকে প্রায়শই দূরে দূরে 

ভারতে আট বছর কাটান। জেস্যুইট নেতারা ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁকে তিব্বত প্রেরণ করেন। তিনি তিব্বত হয়ে চীন গিয়ে সেখানে ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন। আকবরের শেষ বছরগুলি এবং জাহাঙ্গিরের শাসনকাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের বহুমূল্য সামগ্রী এই জেস্যুইট পাদরীদের পত্রাবলী ও রচনাবলীর মধ্যে পাওয়া যায় ।

দোভাষীর সঙ্গে তিন সাধু ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর গোয়া থেকে দমন, আহমদাবাদ, পাটন, রাজস্থান হয় পাঁচ মাসে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে লাহৌরে পৌঁছান। একটি বড় ক্যারাভানের সঙ্গে তাঁরা ধীরে ধীরে পথ অতিক্রম করছিলেন, নইলে দুই মাসের বেশি সময় লাগত না।

খম্ভাত ও লাহৌরের মধ্যে অধিকাংশ ভূ- ভাগকে তাঁরা জনহীন ও মরু অঞ্চল বলে জানিয়েছেন, লাহৌরের সন্নিকটস্থ কয়েকটি পান্থনিবাস থেকেই উর্বর ভূমির কথা বলেছেন। পথে গরমে-ধূলোয় কাহিল হয়ে পড়েন তাঁরা। ক্যারাভানে চারশত উট, একশত গাড়ি, কয়েকশত ঘোড়া এবং বহু-সংখ্যক পায়ে-হাঁটা যাত্রী ছিল, জল দুর্লভ, কোথাও পাওয়া গেলেও তা লবণাক্ত।

লাহৌরে পৌঁছলে আকবর তাঁদের খুব আদর-আপ্যায়ন করেন এবং পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন। সম্মান প্রদর্শনে আকবর এতই উদারতা দেখান যে তাঁরা তা আশা করতেই পারেননি। তিনি তাঁর আসনের একপাশে কিংবা যুবরাজের বসার জায়গায় বসতে দেন। তিনি তাঁদের সিজদা (দণ্ডবৎ) করতে দেননি, যা রাজাদের ক্ষেত্রেও বাধ্যতামূলক ছিল। সাধুরা মসীহ৬ ও কুমারী মরিয়মের ভারি মূর্তি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। 

আকবর তাঁদের সম্মুখে ভক্তিভরে মাথা নত করেন এবং তারপর ভারির কথা না ভেবে অনেকক্ষণ নিজের হাতে নিয়ে থাকেন। একদিন তিনি তাঁদের প্রার্থনাতেও গেলেন এবং খ্রিস্টানদের মতোই হাঁটু মুড়ে উপরে হাত তুলে প্রার্থনা করলেন। ১৫ই আগস্ট মরিয়মের মহোৎসবের দিন তিনি তাঁর সুন্দর মূর্তি-সমূহের সঙ্গে প্রার্থনা-ভবন সুসজ্জিত করার জন্য দামি জরির পর্দা পাঠালেন।

আকবর ও শাহজাদা সলীম কুমারী মরিয়মের প্রতি বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন করেন। সাধুদের সঙ্গে একজন চিত্রকর এসেছিলেন, আকবর তাঁকে দিয়ে কয়েকখানি চিত্র অঙ্কন করান। শাহজাদা গির্জা নির্মাণের জন্য পিতার কাছ থেকে একটি ভালো জায়গা নিয়ে সেখানে নিজের খরচে অট্টালিকা নির্মাণ করে দেওয়ার কথা বলেন। গ্রিমোন-এর মতোই জেভিয়ার ও পিনহেরো-ও লাহৌর থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিজেদের চিঠিপত্রে উল্লেখ করেছেন যে আকবর ইসলাম-বিরোধী। জেভিয়ার বলেছেন—

“বাদশাহ তাঁর মস্তিষ্ক থেকে মুহম্মদের ধর্মকে একেবারে দূর করে দিয়েছেন। তাঁর আকর্ষণ হিন্দু ধর্মের দিকে। ভগবান ও সূর্যের পূজা করেন। এখন হিন্দুরা তাঁর অনুগ্রহভাজন। আমি জানিনে, মুসলমানরা এটাকে কি মনে করেন, বাদশাহ মুহম্মদের নামেও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন।” গির্জার জন্য প্রাসাদের নিকটে একটি সুন্দর জায়গা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে পিনহেরো লিখেছেন—

“এই বাদশাহ মুহম্মদের অলীক ধর্মকে নষ্ট করে দিয়েছেন, তার একদম বদনাম করে ছেড়েছেন। এই শহরে না কোনো মসজিদ আছে, না কুরান। আগে যে মসজিদগুলি ছিল, সেগুলোকে হয় ঘোড়ার আস্তাবল, না-হয় গুদামঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের অত্যন্ত লজ্জিত করার জন্য প্রত্যেক শুক্রবার সাতচল্লিশটি কিংবা পঞ্চাশটি শূকর এনে তাদের লড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি তাদের দাঁতগুলো সোনায় মুড়ে রাখেন। বাদশাহ নিজে একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, তিনি নিজে তার পয়গম্বর।

তাঁর অনেক অনুগামী আছে, তবে পয়সার জন্য। তিনি ভগবান ও সূর্যের পূজা করেন । তিনি হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের অনুসরণ করেন। আমাদের পাঠশালায় খুব উচ্চ উচ্চ মনসবপ্রাপ্ত আমিরের পুত্র, তৎসহ বাদশাহের তিন পুত্র পড়াশোনা করে, দুই শাহজাদা খ্রিস্টান হতে চায় ।”

এখানে খ্রিস্টান সাধুরা বহু বিষয়েই প্রচুর অতিশয়োক্তির সাহায্য নিয়েছেন এবং বাদশাহের কঠোর ইসলাম-বিরোধিতাকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সম্ভবত তাঁদের মনে ইসলামের প্রতি যে-ঘৃণা, তা আকবরের নামে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। ইতিপূর্বেই আমরা আক-বরের ফরমান উদ্ধৃত করেছি, তাতে দেখেছি, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ইচ্ছানুসারে বিনা বাধায় ধৰ্ম গ্ৰহণ করা কথা বলা হয়েছে। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে পিনহেরোর জায়গায় লাহৌরে আসেন সাধু কোর্সি।

তিনি আকবরকে মরিয়মের চিত্র প্রদান করেন, আক-বর তা অত্যন্ত সম্মান সহকারে গ্রহণ করেন। তিনি পোপ সম্পর্কেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেন। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে তিনি যখন আগরা রওনা হন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেভিয়ার ও পিনহেরো।

১৬০১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লিখিত একখানি পত্র দেখে আক-বর এক দূতমণ্ডলীকে গোয়া প্রেরণ করেন। সাধু গোয়েজ সেই দূতমণ্ডলীর সঙ্গে ছিলেন। মে মাসের শেষ দিকে তিনি গোয়া পৌছান। উপঢৌকনের মধ্যে একটি দামি ঘোড়া, শিকারী চিতাবাঘ ও আরও বহু কিছু ছিল। বুরহানপুর ও আসিরগড়ে ধরা-পড়া অনেক পোর্তুগিজ নারী-পুরুষ বন্দীকে আক-বর গোয়েজের সঙ্গে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। আক-বর সেই পত্রে ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের অবতারণা করেননি, উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং অন্যভাবে সুসম্পর্ক স্থাপন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কয়েকজন দক্ষ শিল্পী চেয়েছিলেন।

গোয়ার থাকার সময় সাধুকে তিব্বত যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। ক্যাথলিকদের আশা ছিল, তিব্বতে ধর্মপ্রচারে বড় সাফল্য পাওয়া যাবে। গোয়েজের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য সাধু মচাদোকে তাঁর সঙ্গে আগরায় পাঠানো হয়। আক-বর বুরহানপুর থেকে ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে যাত্রা করে মে মাসেই আগরায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।

সেখানে গোয়েজ ও মচাদো দরবারে হাজির হন। আক-বর পিলহেরোকে লাহৌর যাওয়ার অনুমতি দেন। সেখানকার নতুন সিপাহসালার কুলিচ খান খ্রিস্টানদের বিরোধী ছিলেন। পিনহেরো একটি আদেশপত্রের জন্য বাদশাহের কাছে প্রার্থনা জানান, যাতে কোনো ইচ্ছুক ব্যক্তি বিনা বাধায় খ্রিস্টান হতে পারে। তখনও পর্যন্ত এরূপ আদেশ কেবল মৌখিক ছিল, এবার আক-বর নিজের মোহরাঙ্কিত আদেশপত্র পিনহেরোকে প্রদান করলেন।

 

খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

যে-সময় জেস্যুইট ক্যাথলিকরা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, সে- সময় তাঁদের বিরোধী এক ইংরেজ বণিক জন মিল্‌ডেনহলও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। মিল্‌ডেনহল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী নিযুক্ত হন। বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য রানী এলিজাবেথ তাঁকে আক-বরের নিকট পত্র দিয়ে পাঠান।

মিল্‌ডেনহল লণ্ডন থেকে জাহাজে যাত্রা করে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার (শাম) উপকূলে অবতরণ করেন। তারপর স্থলপথে যাত্রা করে ২৪শে মে হবল পৌছে সেখানে এক বছরেরও বেশি সময় থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুলাই ক্যারাভানের সঙ্গে রওনা হন।

ইরাক, ইরান হয়ে তিনি কন্দাহারে আক-বরের রাজ্যসীমায় প্রবেশ করেন। ইংরেজ দূতের উদ্দেশ্য আদৌ ধর্ম-সংক্রান্ত ছিল না, পক্ষান্তরে পোর্তুগিজরা ধর্মের আবরণে নিজেদের আবৃত করে দরবারে এসেছিল। কিন্তু সে-সময় আক-বর তো বুঝেই ফেলেছিলেন যে খ্রিস্টানদের মধ্যেও শিয়া-সুন্নীর মতো দুটি সম্প্রদায়— প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক— একে অপরের বুকে ছুরি বসাবার জন্য তৈরি ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment