আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ ,১৯৭৪

আজকে আমরা আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ ,১৯৭৪ নিয়ে আলোচনা করবো।

 

আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ - ১৯৭৪
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ – ১৯৭৪

 

আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ ,১৯৭৪

ইংরেজের সাথে ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান আপসে যে ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমরা সেইভাবে বিচ্ছিন্ন হই নাই। আপনে বিচ্ছিন্ন হলে ঐ ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান যেমন করেছিল সেই সময়ে বিলাতের জিনিসপত্র কিছু কিছু আনত যতদিন পর্যন্ত তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। আর পাকিস্তানের সাথে আমাদের স্বাধীনতাটা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আজও আমাদের কোন রকম সম্পর্ক নেই।

কাজেই পাকিস্তান থেকে হঠাৎ করে যদি কাপড়ের সাপ্লাইটা বন্ধ হয়ে যায় আপনার কি অবস্থা হতে পারে? আর একটা কথা চিন্তা করে দেখুন, লুঙ্গি এবং শাড়ি এই উপমহাদেশের কিছু লোক ছাড়া এমন কি ভারতেরও সকলেও পরে না। পশ্চিম বাংলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পরে, পাকিস্তানের কেউ পরে না আপনাদের জন্য বানাত। বাজারের জন্য বানাত।

এখন যদি জাপান থেকে আপনি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না। আমেরিকা থেকে যদি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না, পাবেন স্কার্ট-সার্ট-গাউন। এখন এই পরিস্থিতিতে এই যে বিরাট gap এই gap পূরণ করতে ভারত থেকে কাপড় আনা হয়েছে। তাতে ভারতের বিরুদ্ধে সেই কি সমালোচনা। ভারত থেকে ৯ হাত শাড়ি এনেছে, সাড়ে নয় হাতি শাড়ি এনেছে, এটা ভারতের দোষ।

আমি বলি ভারত কি আপনাকে এই শাড়িটা জোর করে দিয়েছে? না আপনি দেখে শুনে পছন্দ করে এনেছেন আপনারা পছন্দ করে এনেছেন। আর ৯ হাত শাড়ি যদি আসে, বাংলার গ্রামের মেয়েরা ঢুক পরে না। শাড়িই পরে। ঐ ছোট মেয়েদের কি ৯ হাত শাড়ি লাগে না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলার তাঁতে যে কাপড়-শাড়িগুলি তৈরি হয় তা শহরের মহিলাদের জন্য না। ভদ্র মহিলাদের শাড়ি ১১ হাত বা ১২ হাত হয়। আরো এক দেড় হাত দিয়ে ব্লাউজ হয়। আজকে ভারত থেকে আমদানি করা সাড়ে ৯ হাত শাড়ি- যেটা গরীবের জন্য, সেটা যদি আপনারা কিনতে চান, কিংবা কেউ কিনলে বা ভদ্রমহিলা কিনলে তার কাছে তো খাটোই হবে।

খাটো হলে তিনি যেহেতু Vocal শহরে থাকেন উন্নতমনের মহিলা আর খবরের কাগজের লোকেরা আশে-পাশেই আছে বলে দিলেন যে, শাড়ি ছোট। কত ছোট, কি বিধান, কি শানে নজুল কিছুই বললেন না। এই নিয়ে আরম্ভ হয়ে গেল একটা রব যে, সমস্ত দোষ ভারতবর্ষের। এখন বলি আমরা সুতা বিতরণের জন্য সুতা বিতরণ কমিটি করেছি। তারপর সমবায় করেছি। কতরকম EXPERIMENT যে করেছি। আচ্ছা এই কমিটিগুলিতে কারা কারা ছিল বলুন ও দেখি এতে কি কোন ফেরেস্তা টেরেস্তা ছিল, না ভারতের লোক ছিল, নাকি আমেরিকার লোক ছিল, না রাশিয়ার লোক ছিল, না কি আমাদের লোকজনই ছিল?

সকলেই বলে চোর, চোর, চোর। তবে চুরি করে কে. কে তারা? আমিতো এই পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দু’বছরে যে, কোন কর্মী এসে খাস করে বলেছে যে আমার চাচা ঐ রিলিফের চাল চুরি করেছে । এমনতো কেউ বলেনি । ঐ পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে আর ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলে তাজউদ্দিন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, ওরে ছেড়ে দেন। আমি বলি যে, তুমি না বক্তৃতা করে এলে? উত্তর দেয় বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুরে বাঁচান, এই হল বাংলাদেশের অবস্থা। কোথায় সামাজিক বয়কট! দুর্নীতি যারা করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে।

 

আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ - ১৯৭৪
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ – ১৯৭৪

 

 

সরকারের ব্যর্থতা আপনারা একশতবার বলেন- সরকারের দায়িত্ব যখন নিয়েছি, বঙ্গবন্ধু যখন নিয়েছেন, জাতির পিতা যখন হয়েছেন তখন ভালমন সব ছেলের কথাই শুনতে হবে। খারাপ ছেলে, ভাল ছেলে সব ছেলের আবদারই শুনতে হবে। ঐ দুর্বৃত্তদের কথাও শুনতে হবে। আমরা এড়ালেও বঙ্গবন্ধু এড়াতে পারবেন না। যা বলছিলাম, যারা সমালোচনা করে, তাদেরকে মেহেরবাণী করে আমার ভাই-বোনেরা আপনারা জিজ্ঞাসা করবেন, সরকার না হয় জেল দেয় না, কিন্তু একজন ধরিয়ে দেয় তো আর একজন টেলিফোন করে বের করে নেয় কেন? এটার কি করা?

এই হচ্ছে এক জ্বালা। কাজেই সরকার না হয় করে, অন্যায় করে, দুর্নীতি করে। মা করলেও দোষ আসবে, করলেতো কথাই নেই। সামাজিক প্রতিবিধানটা তো দেশের মানুষ করতে পারে। আপনারা জিজ্ঞাসা করেন তো সমালোচকদেরকে যে, তাদের গ্রামে রিলিফ কমিটির মাল কে চুরি করে? এটা কি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জানা সম্ভব, নাতি যারা শহরে থাকে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব? এটা গ্রামে যে আমার কর্মী আছে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ঐ গ্রামের দুর্নীতিবাজটি কে তো জানিয়েও দিতে পারি?

অন্তত পক্ষে খালু যদি হয় খালাকে, মামা যদি হয় তবে মামীকে বলে নিতে পারি যে, যারা দুর্নীতি করবে তার বউয়েরা কেউ ভাত দেবে না, অন্তত এইটুকুত করতে পারি। এমন ধরনের কিছু কি করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কি ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি তা আমাদের মনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে । পার্টি ভবিষ্যতে যাতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন, তার আবেদন আজ আমরা সকলে রাখছি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের নির্দেশ দিতে হবে পার্টিকেই পার্টি শুধু theoretically সরকারের উর্ধ্বে হতে চলবে না, বাস্তবে হতে হবে ।

এখন আসুন, মিল কলকারখানার ব্যাপারে। মিল কারখানায় যারা শ্রমিক নেতা তারা কারা? আমি আপনাদেরকে বলছি কারো বিরুদ্ধে আমার কোন ইর্যা নেই। আমাকে মাফ করবেন। মাফ করতে পারলে ভাল। না পারলে আমার বিরুদ্ধে অভিসম্পাত দিন আমার কোন আপত্তি নাই । মিল, কল-কারখানার শ্রমিক নেতা কারা?

বিশ্বাস করুন কয়েক সময় মনে মনে অনেক চিন্তা করেছি যে, আজকে যেনো আমাদের বিরোধী দলের কোন নেতাকে ধরবো জব্দ করবার জন্য কিন্তু যখন ধরতে গেছি, ধরে দেখি আমাদের চেনাশোনা মানুষ। এই যে জিনিসটা আরম্ভ হয়েছে এটা বন্ধ করছে আমিও আপনাদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে দাবি করব, বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করব, বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করব। বিনা দাবিতে তিনি সবসময় করেন, তারপরেও যে আমাদের শ্রমিক নেতৃত্ব, এই নেতৃত্বকে যদি সুষ্ঠু করা না যায় তবে বাংলার অর্থনীতি চলবে না। চলতে পারে না।

আমি একটা নমুনা দেই আপনাদেরকে। বন্দরে জাহাজ ভিড়েছে, খাদ্য নামাতে হবে, ৭২ সালের প্রথম দিকের কথ বলছি। UNROD প্রধান আমার কাছে গেছেন। নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর কাছেও গেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, “হি মিনিস্টার, তোমার দেশে ব্যাপারটা কি? খাদ্য বোঝাই জাহাজ এসেছে, তোমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে অ্য শ্রমিকরা কাজ করে না। হাজিরা দেখিয়ে চলে যায়”। এখানে আমাদের শ্রমিক নেতাদের চিন্তা ভাবনা করতে হবে।

আমি শ্রমিক নেতৃত্বে মানুষের পরিবর্তনের কথা বলছি না, আজ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে না পারেন তবে বাংলার অর্থনীতি চলবে না। আমাদের দেশের অবস্থা ভাবতে হবে, আমি যদি ভেবে থাকি আমার দেশের অবস্থা সবচেয়ে ভাল এটা ঠিক কথা নয়। আমাদের মত দেশের অবস্থা ঔপনিবেশি শাসন শোষনে যা হয়, সেই নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

রেলওয়ে ওয়াগনের অভাব, বার্জ, ফ্লাটের অভাব, চালনায় জেটি নাই। যারা জানেন তাদের জন্য বলছি না। যারা জানেন তাদের জন্য বলছি – ANCHORAGE জাহাজ থাকে পানিতে, বার্জ দিয়ে মাল উঠাতে নামাতে হয়, আর রোগ নিয়ে গেলেও ক্রেন দিয়ে সরাসরি জাহাজে ওঠানো যায় না। আপনাকে আবার বার্জে বহন করে নিয়ে গিয়ে জামাতে উঠাতে হয়। ভরবার বেলায়ও তাই। খালাস করবার বেলায়ও তাই। চিটাগাং বন্দরে Capacity কত? আপনার প্রয়োজন কত? মাল আসছে। মাল যাচ্ছে।

বন্দরের ক্যাপাসিটি নেই, আজকে ইচ্ছা করলেই রাতারাতি Capacit বাড়াতে পারেন না। আমাদের সরিয়ে যাকেই বসান অবস্থা একই থাকবে। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদেরকেই রাখতে হবে । পছন্দ না হয় সরিয়ে দিন। আমাদের বদলাবার অধিকার আপনাদের আছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেন এই জন মন্ত্রী যাদের আপনি রেখেছেন এদেরকে বরখাস্ত করুন। বরখাস্তের পরও এরা দেশে থাকলে যদি অসুবিধা হয় তবে নির্বাসনে দিন ।

 

আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ - ১৯৭৪
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ – ১৯৭৪

 

দিয়ে আর এক সেট লোক নিন। দেখবেন একই সমস্যা। এই ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। আজকে ট্রাকের ভাড়া কত? ট্রাক কি ফল চালায় না সৈয়দ নজরুল ইসলাম চালায়? ট্রাকের মালিক কে? চিটাগাং থেকে ৭ টনি যে ট্রাক স্বাধীনতার পরেও 847 ৫০০ টাকায় ঢাকায় আসত এখন সেটার ভাড়া ৩০০০, ৩২০০, ৩৫০০ পর্যন্ত ওঠে। ৭ টন মাল থাকে এক ট্রাকে সামটা কত পড়ে একবার চিন্তা করুন ।

এখন আসুন তেল সঙ্কটে । তবে এই সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হবে। তেলের অভাব নেই তবে দামের সঙ্কট চলবে । দাম কে গেছে । বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুন্নত দেশের পক্ষে আমরা তেল রপ্তানিকারক দেশের সাথে কথা বলে এসো তবে তারা যে তেলের দাম বাড়িয়েছে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে তারা খুব অন্যায় করেছে । কেন যেন নাম বাড়বে না? গমের নাম কত?

স্বাধীনতার পর যে গম প্রতি টন কিনেছি ৭৭ ডলারে সেই গম জুলাই-আগস্টে ডলার আর আজ সেখানে ২৪২ ডলার স্বাধীনতার পর পর প্রতি মনে Subsidy দিতে হয়েছে ২২ টাকা ২৫ টাকা। অর্থাৎ ৫০ টাকায় কিনে ২৫ টাকায় নাই। এই ২৫ টাকা দেয় কে? বাকি টাকা দেবেন আপনারা জনসাধারণ, আজকে ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে আমরা এই সব করেছি।

৭৭ ডলার থেকে শুরু হয়ে আজকের কোটেশন হল ২৪২ র কেমন করে আপনি সপ্তায় খাওয়াবেন? কোথা থেকে খাওয়াবেন? মনে রাখবেন শুধু আপনার দেশের সমস্যা এটা নয় এটা সারা দুনিয়ার সমস্যা। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলো খাদ্য বেশি উৎপাদন করে না। Finished goods উৎপাদন করে। বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করে থাকে। তবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। সাধারণ মানুষের আর রুজি বেশি। আমাদের মত অবস্থা তাদের নয়। আমাদের অবস্থা একবার ভেবে দেখুন। আজকে ২৭২ ডলার এক টন গমের নাম যেটা ৭৭/৮১ ডলারে কিনেছি।

আর এক সমস্যা শুনবেন? তেলের দাম বাড়ার ফলে আজ পর্যন্ত আমরা জাহাজই ঠিক করতে পারিনি। তেলের দাম বাড়ার আগের কিছু কথা বলি। গত জুলাই মাসে (১৯৭৩) ২৮০০০০ টন গম আমেরিকা থেকে কিনেছি তা সবগুলো এখনো এসে পৌঁছেনি। মাত্র ১৯ হাজার টন এসেছে। এই অসুবিধায় বঙ্গবন্ধু সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে অনুরোধ করায় সেখান থেকে আমাদেরকে ২ লক্ষ টন গম ধার নিয়েছিল।

এই প্রকাশা সকায় গোপন বলতে পারি এটা বোধ হয় আর ফেরৎ নাও দিতে হতে পারে। এদিকে মুহিতের সঙ্গে পরতর আলোচনা করেছি। গত অক্টোবরের কিছুদিন আগেও যেখানে পার টন জাহাজ ভাড়া ছিল ৩৯ ডলার ৩৫ সেন্ট খাজনা থেকে বাজনা কত দেখেন, নভেম্বরে সেই ভাড়া ৪৯ ডলার ৪২ সেন্ট এবং ডিসেম্বরে ৭৪ ডলার নাম চেয়েছে। আমি বলেছি ঠিক আছে ৭৪ ডলারে নিয়ে নাও। বর্তমানে ৭৪ ডলারেও কেউ আসে না, ফলে ৭৪ ডলারেও জাহাজ ব্যবস্থা করতে পারি নাই।

জাহাজ কোম্পানিরা তেলের বাড়তি দামের জন্যে জাহাজ কমিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের জন্য তাদের তেমন আসে যায় না। তারা তেল খরচ কমাবার জন্য ৫০টা জাহাজ না চালিয়ে যদি ২৫টা চালায় আর ভাড়াটা বিক্ষণ করে দেয় তবে তাতেই তাদের লাভ। এই কাজটি ভারা করছে।

আজকে আসুন দেখি তেলের দাম বাড়ার পরে কি অবস্থা দাঁড়ায়। ৭২ সালে অপরিশোধিত তেল কিনেছি ১ ডলার ৭২ সেন্ট পার ব্যারেল। ১ ব্যারেল তেল আনার জন্য জাহাজ ভাড়া ছিল ২ ডলার ৭৫ সেন্ট। বর্তমানে ১ ব্যারেলের নাম কমপক্ষে ১১ ডলার, আপনাদের অবগতির জন্য আমি জানাচ্ছি, পরত আমি সে আলোচনা করে এসেছি, সেখানে জানা গেল ১৬ ডলারের কম কোন রিফাইনকারী থেকে অপরিশোধিত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলেছি এই ১৬ ডলারই যেন কিনে ফেলে, না হলে তাও পাওয়া যাবে না। কারণ এই তেল দিয়ে পাওয়ার পাম্প চালাতে হবে। সেই Crude এর কেরোসিন দিয়ে গ্রাম-বাংলার কুপি বাতি জ্বালাতে হবে। সেই ডিজেল দিয়ে কলকারখানা চালাতে হবে । বিভিন্ন এলাকার ১৬/১৭টি পাট কল, অন্যান্য শিল্প, বিদ্যুৎ সরবরাহ সব চালাতে হবে।

এবার তাকাই আমাদের মানব সম্পদের দিকে। আমাদের সবচাইতে বড় সৌভাগ্য আমাদের প্রচুর মানব সম্পন রয়েছে। এই মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকার সম্পদে রূপান্তরিত করতে প্রচুর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি আবার বলছি আমাদেরকে সেমিনার করতে হবে, সেখানে একটা একটা করে প্রশ্ন করে যে যেটা বুঝি সেটা আলোচনা করে সমাধান খুঁজতে হবে। এই সেদিন ইংল্যান্ডের Black Pool 4 Labour Party-র সম্মেলন হল।

 

আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ - ১৯৭৪
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ পর্ব ২ – ১৯৭৪

 

সৌভাগ্যবশত আমি যেখানে ছিলাম। ৭ দিনব্যাপী সম্মেলন, Space Pollution এর ওপর আলোচনা হল । বিরাট বিরাট Physicist, PIED বা বক্তৃতা করেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম যদি আমার দেশে এই আলোচনা হত তবে আমিও দু’কথা বলবার জন্য যেতাম। অথচ ঐ Space Pollution এর ব্যাপারটাই আমি বুঝি না। যে যেটা বুঝি সে সেই বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করলে ভাল হয় বেশি। একজনের পক্ষে সব জানা সম্ভব না।

এখন আইন শৃংখলাজনিত পরিস্থিতিটার যদি উন্নতি না হয় কিভাবে কাজ করবেন? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে যারা আছেন এ ব্যাপারে কিভাবে সরকার এবং দলের সমন্বয় করবেন তাঁরা তা ভেবে দেখবেন । এই ভেবে দেখাটাকে আমি অত্যন্ত জরুফর বলে মনে করি।

এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটা দলের বা সরকারের নয়, অস্ত্রের খেলা বন্ধ করা দরকার। আমি সামান্য যেটুকু লেখাপড়া করেছি তা থেকে বলতে পারি Establishment এর বাইরে অর্থাৎ সরকার যন্ত্রের বাইরে যদি অস্ত্র থাকে তবে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পুলিশ হল মৌলিক প্রতিষ্ঠান। সব তন্ত্রে পুলিশ হল মুখ্য ব্যবস্থা (মিলিটারিকে কথায় কথায় Civilian এ আনা ঠিক হবে না)। যেখানে আইন ভঙ্গ হলে মানুষ পুলিশের কাছে যায়।

সেই পুলিশের প্রতি আস্থা জন্মাতে হবে। আস্থা জন্মাবার দুটো উপায়, এক পুলিশ প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে ঢেলে সাজান। এক দিনে সম্ভব হবে এ কথা বলছি না। কিছুটা সময় সাপেক্ষ। কিন্তু কাজটি শুরু করতে হবে। দ্বিতী প্রত্যেকটা কর্মীকে কি আপনারা ব্যক্তিগতভাবে সবাই চেনেন? বাংলার আপামর সাড়ে সাত কোটি লোকের মাঝে সবগুলি কর্মীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনা সম্ভব নয়। স্থানীয় কর্মীটিকে স্থানীয় নেতা বা নেতৃত্ব চেনেন।

আজকে যদি সরকারের মন্ত্রী মালেক উকিল নিজে উপস্থিত থেকে ঘেরাও দিয়ে ৫ জনকে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্রসহ ধরে পরক্ষণেই আমি তাজউদ্দিন একজন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়ে যদি মালেক সাহেবকে বলি যে, মালেক সাহেব, নি এর অত্যন্ত ভাল আওয়ামী লীগ কর্মী আমি জানি, আমি তার দায়িত্ব নিচ্ছি তখন তার অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? আজকে যদি কারো হাতে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র না থাকত আর বঙ্গবন্ধু যদি হুকুম দিয়ে দিতেন পুলিশকে যে- ধর, অম্লজা সাও পুলিশের কাছে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র যদি আমার দলের লোকের কাছেও থাকে, রেহাই নেই, তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। হত। অনেক বর্ণচোৱা লোক আওয়ামী লীগে বিভিন্ন কৌশলে আসছে আওয়ামী লীগ কর্মী নাম দিয়ে আপনাদের এটা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি না হলে কাজ করবেন কি ভাবে?

বাংলার অর্থনীতির কথা বললামই না, Economic activity মানে কি? ব্যবসা বাণিজ্য চলবে, Commerce Trade চলবে, হাট বাজার চলবে। ব্যবসা বাণিজ্য করলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করবে, সদাই করবে, মাথায় করে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। আর খরিদ্দার টাকা নিয়ে যাবে হাটে-বাজারে ৯ লক্ষ টাকা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালেক সাহেবের কাছ থেকে আনসার ভাড়া করেছি পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলি পাহারা দেবার জন্য। যাতে টাকা লুট করে নিয়ে না যায়। ৫ মাসের জন্যে এরা পাহারা দেবে। একটা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আজকাল রাইফেল কিন্তু না। অটোমেটিক অস্ত্রের কাছে রাইফেল কিছু না। ফড়িয়ারা যায় না পাট কিনতে। ২০ মন পাট কিনতে ১০০০ টাকা লাগে, কে ডাকে নিশ্চয়তা দিবে যে তার পয়সা নিয়ে যাবে না

দুষ্কৃতকারীর একমাত্র পরিচয় সে দুষ্কৃতকারী। সে যে দলেরই হোক আমরা অনেক সময় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে দেই। এতে দু’টা সর্বনাশ হয়। সে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে যায়। রাজনৈতিক স্লোগান তার পক্ষে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। সে যতটা শক্তিশালী নয় কিন্তু জনগণের সামনে শক্তিশালী প্রমাণ হয়। ইংরেজ আমলেও দেখেছি, পোস্ট মাস্টার হত্যা মামলায় এটা রাজনৈতিক ডাকাতি ছিল। ফণীদারা তখন এই কাজ করতেন (বর্তমানে তিনি খাদ্য মন্ত্রী) ।

সেই মামলায় ইংরেজরা অনুশীলন পার্টির নামই উচ্চারণ করে নাই। অনুশীলন পার্টির নাম উচ্চারণ করলে সে রাজনৈতিক Protection পেয়ে যেত। এতে জনগণের সহানুভূতি পেয়ে যেত। তবে তারা কি করল? ঐ ডাকাতির সাথে খুন, ৩৯৬ ধারা দিয়ে ফাঁসি দিয়ে দেয়া। পকেট মারের জন্য পকেট মারের আইনে সোপর্দ করেন সে যদি শ্রদ্ধেয় নেতা হয় নেতা হিসাবে তার ব্যবস্থা নিন নাম উচ্চারণের দরকার হয় না।

তেমনিভাবে ভাল মা যারা তার দুই সন্তান যদি ঝগড়া করে তবে নিজের সন্তানের বিচার তিনি করেন। তেমনি আমি আশা করি এবং বঙ্গবন্ধুর আশা করেন যে আমাদের মধ্যেও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার শাস্তি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। কারণ তা না হলে পার্টির মুখে কালিমা লেপন করা হয়, তাতে ক্ষতি হয় । বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি তার ক্ষতি হয়। কাজেই সেই দিকে দৃষ্টি রেখে গোপনে বা প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি করতে হবে। আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তবে অর্থনৈতিক activity হতে পারে না।

আজকে আমার তরুণ ভাইয়েরা আপনাদের কাছে আমার একটা আবেদন আপনারা যে বিপুল শক্তির অধিকারী সেই শক্তিকে সুসংহত করুন। যুদ্ধের সময় যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছিলেন আজকে সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। অতএব আর কোন লক্ষ্য নেই এই ধারণা থাকার কোন কারণ নেই। আপনাদের পরিষ্কার লক্ষ্য রয়েছে। আপনারা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে উত্তরণ করবেন। উত্তরণ করবেন বলছি এই জন্যে যে আজকেই সমাজতন্ত্র করার মত অবস্থা, পরিবেশ, কর্মী বাহিনী মনোভাব, সবচেয়ে বড় কথা হল সারা জাতির মনোভাব নেই। শুধু কর্মী থাকলে চলবে না, যদি সমস্ত জাতির প্রচেষ্টা না থাকে। সেখানে বিভিন্ন মতের লোক তলে তলে অন্য কথা বলে না তা নয় ।

আমার যখন আওয়ামী লীগ সংগঠন করেছি, তখন মোনেম খাঁকে যারা পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছে তারাও চুপি চুপি বঙ্গবন্ধুকে ৫০ টাকা চাঁদা দিয়ে গেছে। এই জন্য যে, যখন সরকারের পরিবর্তন হবে তখন তারা ঐ সুযোগের সাবহার করবে। সব মানুষের সমান অধিকার বা সমাজতন্ত্র কায়েম করবার জন্য এই যোগাযোগ নয়, নিজের অসুবিধা আদায়ের জন্য তারা এটা করেছে । আজকে তারা বসে নাই । পাট বর্তমানে কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে রপ্তানি হয়। এখন যারা পাট ব্যবসায়ে আছেন, তারা বাঙ্গালি, আমি চিনি তাদের। বঙ্গবন্ধুও অনেককেই চিনেন।

কারা গোপনে পাকিস্তানীদের চেয়ে বেশি শত্রুতা করছে। তারা টাকা পাউন্ডে, ইয়েনে, ডয়েল মার্কে পরিবর্তন করে টোকিওতে, বৈরুতে সহ বিভিন্ন জায়গায় রাখে। তারা বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে টাকা রাখে না, কারণ সেখানে টাকা রাখলে উল্টো শতকরা ৩/- হারে সুদ দিতে হয়। বাংলার অর্থনীতিকে বিপর্যন্ত করার পেছনে এই এরা কাজ করছে। যুবকদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই, কলেজে যারা প্রবেশ করে তারাই তো যুবক হয়ে যায়। কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দেয়, তার জন্য কি ব্যবস্থা? ঢাকা শহরের কথা ধরুন। বর্তমানে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা কত? বঙ্গবন্ধুর মতে ২০ লক্ষ, তা হলে আরও ভাল।

আগের লোকসংখ্যার জন্য ঢাকায় যে স্কুল কলেজ ছিল, যে ব্যায়ামাগার ছিল বর্তমানে তা কি বাড়ছে না কমছে? মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় G.P.O হয়েছে। ঐ পুরা এলাকাতো খালি ছিল। ছোট বেলায় আমরা এখানে খেলাধূলা করেছি। এক একটা স্কুলের জন্য এক একটা খেলার মাঠ ছিল। কলেজগুলোরও নিজস্ব মাঠ ছিল। আর বর্তমানে লোক বেড়েছে সন্তান সন্ততি বেড়েছে। খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে বাড়িঘর হয়েছে। মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠ, ঘাট বাড়ার কথা সেখানে কমে গেছে। বাড়ির জায়গাটা নিয়েই রাস্তার কিনার ঘেঁষে দেওয়াল দিয়ে দেন।

রাস্তাটা সংকীর্ণ হয়ে যায়। দুটো গাড়ি চলাচল করতে পারে না। যে বেশি প্রভাবশালী তার গাড়ি আগে যায়। আর যে কম প্রভাবশালী তার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থা। এটা এক বছরে হয়নি। গত ২৫ বছরে হয়েছে। আগে কলেজগুলোতে যে বিল্ডিং রুম ছিল যেখানে ৫০ জন বসার স্থান ছিল এখনও ঐ ৫০ জনেরই স্থান আছে। অথচ ছাত্র সংখ্যা পঞ্চাশ এর জায়গায় এক হাজার হয়েছে।

যুবকদের পড়াশোনার সাথে সাথে মন ও মননশীলতার বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। পাঠাগার সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। খেলাধূলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি, সাথে সাথে সমস্ত জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যান্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে।

বঙ্গবন্ধু আপনি হুকুম দিয়ে দিন ঢাকায় ১ মাইল লম্বা আধ মাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধূলার ব্যবস্থা করে দিন। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযোগ করে দিন। তা না হলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে সাধারণত কি হতে পারে? চিন্তা করে দেখুন । হাত শুধু পকেটেই যাবে না। নানান দিকে যাবে। কাজেই যুবকদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ভবিষ্যৎ সোনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এখানে আমি রিকশাওয়ালা ও হুমায়ূন খালেদের সোনার বাংলার গল্পটা বলি। একদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সভায় যোগদানের জন্য জনাব হুমায়ূন খালেন সংসদ ভবনে যাচ্ছিলেন। তিনি রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে এক কথা দু’কথায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে তাঁর আলাপ জমে ওঠে। একসময় জনাব খালেদ নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। ফলে সে কথা বলতে সংকোচ করছিল। কিন্তু খালেদ সহজভাবে কথা বলতে অনুরোধ করায় যে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বলে যে, সাব, খাইটা খুইটা কি করবেন? সোনার বাংলা তো অইয়া গেছে। জনাব খালেন প্রশ্ন রাখলেন কি করে সোনার বাংলা হল ভাই? আমরা তো চেষ্টা করছি। কিন্তু হল কোথায়? উত্তরে রিকসাচালক জবাব দেয় ক্যান ছার। দেশে জিনিসপত্র তো সোনার দামে বিক্রি হইতাছে।

জনাব খালেদ এখানে উপস্থিত আছেন (জনাব খালেদ নিজেও বক্তব্যের প্রতি সম্মতি জানিয়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করেন)।

সত্যিকারের সোনার বাংলা হতে হলে এই যুবক, কিশোর ও শিশুদের সম্পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। আমার বয়সে ৩টা পতাকায় সালাম করলাম Union Jack, অর্থ চন্দ্র তারকা, এখন বাংলাদেশের সূর্য। কাজেই আমাকে দিয়ে আপনি কতটুকু আশা করতে পারেন। আমার মজ্জায় ঢুকে গেছে অনেক জিনিস বের করা সম্ভব নাও হতে পারে। মধ্যবিত্তকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মস্তিষ্ক, দেহ, মনের বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।

আমি বিশ্বাস করি এবং আপনারাও বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা একটুও কম নয়। নিরাশ হবার কোন কারণ নাই। আপাতত আমরা যেটা দেখছি সেটা বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতেই হবে। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব আজকে যো আওয়ামী লীগের পরিষদ গঠিত হবে তাকে নিতে হবে। আমাদেরকে মূলনীতি অনুসরণ করে কাজ করে যেতে হবে । বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতাসহ কিছু কিছু ব্যাপারে বিভ্রান্তমূলক প্রচার হচ্ছে। যেমন গত এপ্রিল মাসে খাদ্য বোঝাই জাহাজ গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। যেখানে শুনে এলাম সোভিয়েট ইউনিয়ন আমাদের দেশে নৌ ঘাঁটি করেছে ।

এই যে প্রচার- এর উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশে কারো ঘাঁটি হবে না। এমন কি যুদ্ধের দিনে, সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে, ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতি গান্ধীকে বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে, বন্ধু তখনি হবে, যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাথে এসেছিল। সেই দিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোন গোপন চুক্তি ভারতের সাথে হয় নাই । একটাই চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি প্রকাশ্য এবং কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত। সেই নয় মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আমি যুক্তভাবে সই করেছিলাম।

সেখানে লেখা ছিল আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী Supporting Force হিসেবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এবং যে দিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তোমাদের থাকার দরকার নাই সেই দিন তোমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যে দিন বঙ্গবন্ধু শ্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে তখনই মিসেস গান্ধী ১৯৭২ এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।

আজকে বিভ্রান্তির জন্য বলা হয় যে রক্ষী বাহিনীও নাকি ভারতীয় সৈন্যের পোশাকের ন্যায় তৈরি করা হয়েছে। আমার ভাইয়েরা আপনাদের কাছে একটা কথা বলা দরকার। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আমরা Cabinet Calleague যারা ছিলাম সকলে এবং বাইরেও যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারাও রক্ষী বাহিনীর পোশাক নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। যা বলছিলাম রক্ষী বাহিনীর পোশাকের একটা ইতিহাস আছে। আমাদের তখন কোথায় কাপড় ছিল?

লুঙ্গি পরে তো আর ডিউটি করা যায় না। একাত্তরে লুঙ্গি পরে আমার যোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে। নিজে দেখেছি যশোর নবগ্রাম যেদিন মুক্তি হয় আমি সেদিন রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলাম। চোখের সামনে দেখেছি আমাদের ছেলেদের এক হাতে পোটলা আর এক হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে, গেঞ্জিও গায়ে নেই, জামাও অনেকের গায়ে ছিল না। আমাদের সেই সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের পোশাক দেয়ার জন্য, এক লক্ষ Unform দিতে ভারত সরকারকে আমাদের তখনকার মন্ত্রিপরিষদ অনুরোধ করেছিল। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক আগেই।

আর সেই পোশাকের চালান আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি পোশাকগুলিই রক্ষী বাহিনীকে দেয়া হয়েছে। মোল্লা জালাল উদ্দিন সাহেব বিহারে গিয়ে সেই এক লক্ষ বুট আর কাপড় জামা নিয়ে এসেছেন। এখন এদিকে বলা হচ্ছে ঐ পোশাকে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বাহিনী আনবেন। বঙ্গবন্ধুকে আঘাত দেওয়া হয় এই জন্যে যে তাকে এক জায়গায় কাত করতে পারলে বাকিগুলি তো কিছুই না, এমনিতেই কার হয়ে যাবে।

আর একটা কথা আপনাদের কাছে বলে রাখি। আমি এবং সৈয়দ নজরুল সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যে চিঠিপত্র লিখেছিলাম সেই চিঠিপত্রের কপি আমি ড. কামাল হোসেনের কাছে দিয়েছি। একে চুক্তি বলেন, চিঠি বলেন, দেশ বিক্রি করা বলেন যাই বলেন এটা প্রকাশ্যে হয়েছে, গোপনে না। পরবর্তীতে যে চুক্তি হয়েছে সেটাও প্রকাশ্য চুক্তি ১২টি ধারা আছে তার মধ্যে। যেটা বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী সই করেছেন ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে। এটা গোপন টোপন না।

পার্লামেন্টে ড. কামাল হোসেন সালাউদ্দিন সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে এই চুক্তির এক লাইন এক লাইন করে পড়ে শুনিয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় অনেক কথাই আমরা বলি সেগুলি যদি জাতীয় খবরের কাগজে পুরোপুরি উঠত তবে বিভ্রান্তি অনেক কম হত। খবরের কাগজগুলো বিরোধী দলের যত কথা প্রকাশ করেন আমাদের কথাও একটু হানি সেইভাবে প্রকাশ করেন তবে ভাল হয় । আমি এই কথাটি এই জন্য বলছি যে, সেদিন পার্লামেন্টে এই চুক্তির ওপর যে বক্তব্য ছিল তা বেশি ভাল করে প্রকাশ হয়নি। আরো একটি নমুনা দেই আমি আপনাদের, পার্লামেন্টে অর্থমন্ত হিসাবে বাজেট আলোচনার শেষ দিনে তিন ঘণ্টা সমাপনী বক্তৃতা করলাম। জাতীয় খবরের কাগজ তা থেকে এই লাইনও দেয়নি। (অসমাপ্ত) এর পরের অংশ পাওয়া যায়নি।

জানুয়ারি ২০, ১৯৭৪

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment