দীন ইলাহী ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়

দীন ইলাহী – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক সমন্বয়” বিভাগের একটি পাঠ। আকবর অশোকের মতোই ধর্মে উদার মনোভাব পোষণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ধর্মহীন বা ধর্ম-বিরোধী ছিলেন না, যদিও মুসলিম লেখকেরা তাঁকে সেইরকমই দেখাবার চেষ্টা করেছেন। আকবরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তাঁরা ফৈজী ও আবুল ফজলকে দায়ী করেছেন। অথচ দরবারে উক্ত দুই ভ্রাতার যোগদানের কয়েক বছর পূর্বেই আকবর জিজিয়া ও তীর্থকর তুলে দিয়ে উদারতার চরম পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শন করেছিলেন।

 

দীন ইলাহী

দীন ইলাহী | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

আবুল ফজল ধর্মহীন হতে পারেন, বদায়ূনীর প্রশ্নের উত্তরে বলেও ছিলেন— “এখন তো ধর্মহীনদের দলে ভিড়ে কিছুদিন বেড়াবার সাধ রয়েছে”, কিন্তু আকবর পরমেশ্বরকে মানতে কখনও অস্বীকার করেননি। তাঁর পরমেশ্বর সুফী ও বৈদান্তিকদের ব্রহ্মের মতো ছিল।

আকবরের ধর্মীয় চিন্তাচেতনা আরও একভাবে জাগ্রত হয়েছিল বলা যায়। আজমের থেকে পাঞ্জাবের পীরস্থানগুলি জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় পাকপট্টন থেকে যাত্রাপথে নন্দনা অঞ্চলে উপস্থিত হন এবং সেখানে পাহাড়-সদৃশ তরাইয়ে জীবজন্তুদের ঘিরে ফেলে কমরগা মৃগয়া করতে শুরু করেন। ভয়ে এক জায়গায় গিয়ে জড়ো হওয়া প্রচুর জীবজন্তু হত্যা করেন তিনি।

সেই সময় কলিঙ্গ-বিজয়ে নরসংহারের সময় অশোকের মনের উপর যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেই একই প্রতিক্রিয়া ঘটে আকবরের মনের উপর। একটি গাছের নিচে এক আশ্চর্য সমাধিতে মগ্ন হন তিনি। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করেন। তিনি গরিবদের বহু ধন-সম্পদ দান করেন। যে-বৃক্ষের নিচে তাঁর এই ভাবোদ্রেক হয়েছিল, স্মারক হিসেবে সেখানে একটি বিশাল অট্টালিকা ও উদ্যান নির্মাণের আদেশ দেন। সেই বৃক্ষের নিচে বসে তিনি নিজের মস্তক-মুণ্ডন করান।

কাউকে কিছু না বলা সত্ত্বেও বহু দরবারীও নিজেদের মস্তক-মুণ্ডন করান। শিকারে আকবরের এতে নেশা ছিল, অথচ সেদিন থেকে তিনি শিকার-খেলা ত্যাগ করেন। এই ঘটনা থেকেও বোঝা যাবে যে এমন এক ব্যক্তি ধর্ম থেকে বিমুখ হতে পারেন না ।

প্রাচীন ধর্মগুলির প্রত্যেকটির প্রতিই তিনি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন, সকলেই সেরূপ আচরণ করুক। সেটা সফল না হওয়ার জন্যই সমস্ত ধর্মের সারবস্তু নিয়ে একটা নতুন ধর্ম— দীন ইলাহীর (ভগবানের ধর্ম) সূচনা করেন। আকবরের আগেও ভারতের ধর্মীয় বিবাদ-বিসংবাদ মেটানোর জন্য আলাউদ্দীন খিলজীর মনে এরূপ এক ভাবনার উদয় হয়েছিল।

আলাউদ্দীন খিলজীর পতাকা সুদূর দক্ষিণ পর্যন্ত তাঁর বিজয়-গৌরব ঘোষণা করত। আলাউদ্দীনের সেনা যতদূর পৌছতে পেরেছিল, আকবর ও ঔরঙ্গজেবের পক্ষেও ততদূরে পৌছানো সম্ভব হয়নি। যদি তাঁর সিপাহসালারেরা ও আমিরেরা মন্দির-ধ্বংস ও অন্যান্য প্রকারে নিজেদের ধর্মান্ধতার পরিচয় না দিত, তাহলে তার সমস্ত দোষ-ত্রুটি আলাউদ্দীনকে স্পর্শ করা সম্ভব হতো না, ঠিক যেমন হুসেন খাঁ টুকড়িয়ার পাশবিক আপরাধ আকবরের উপর চাপানো হয়েছিল।

আলাউদ্দীন নতুন ধর্মের উপস্থাপনা সম্ভবত শান্তি ও সমন্বয়ের উদ্দেশ্যেই করতে চেয়েছিলেন, তবে মুসলিম ঐতিহাসিক তা অন্যরূপেই উপস্থাপিত করেছেন “সর্বশক্তিমান আল্লাহ পবিত্র পয়গম্বরকে চার বন্ধু দিয়েছিলেন, যাঁদের শক্তি ও সাহসে শরীয়ত ও ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার দ্বারা পয়গম্বরের নাম কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে।…

আল্লাহ আমাকেও উলুগ খান, জাফর খান, নুসরৎ খান, হলব খানের মতো চার বন্ধু দিয়েছেন, যাঁরা আমার দাক্ষিণ্যে রাজকীয় বৈভব ও মর্যাদা লাভ করেছেন। আমি মনে করি, এই চার বন্ধুর সহযোগিতায় আমি এক নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং আমার ও আমার চার বন্ধুর তরবারি সমস্ত মানুষকে সেই ধর্মের ছায়াতলে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে।” মদ্যপানের আসরে তিনি এ কথা বলে আমিরদের কাছে পরামর্শ চান। দিল্লীর কোতোয়াল আলাউল্-মুল্ক্ সুলতানের বিরোধিতা করে তাঁর মতামত প্রকাশ করে বলেন—

“ধর্ম, শরীয়তকে বিতর্কিত বিষয় করে তোলা হুজুরের উচিত নয়, কেননা এসব পয়গম্বরের বিষয়, বাদশাহদের নয় । ধর্ম ও শরীয়তের সৃষ্টি হয় ঐশ্বরিক প্রেরণা থেকে । মানুষের পরিকল্পনা ও উপায়-উপকরণের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আদম থেকে আজ পর্যন্ত এভাবেই তা পয়গম্বর ও ঈশ্বর-প্রেরিত দূতের কাজ হয়ে চলে আসছে, যেমন বাদশাহদের কাজ শাসন করা। কখনও কোনো রাজা পয়গম্বরের পদ পাননি এবং পরেও—যতদিন এই পৃথিবী থাকবে— পাবে না।

তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো পয়গম্বর রাজার কর্তব্যকর্ম অবশ্যই পালন করেছেন। হুজুরের প্রতি আমার এই পরামর্শ যে এ বিষয়ে যেন কখনও কোনো কথা উচ্চারণ করা না হয়। হুজুর জানেন, চেঙ্গিস খান মুসলিম নগরে নগরে কত রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছেন, মুসলমানদের মধ্যে তিনি কখনও মোগল ধর্ম বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারেননি। বহুসংখ্যক মোগল মুসলমান হয়ে গেছে, কিন্তু কখনও কোনো মুসলমান মোগল হয়নি।”

নিজের মুসলমান আমিরদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস হয়নি আলাউদ্দীনের। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এভাবে কখনও এসব কথা মুখে আনবেন না তিনি। আকবর যদিও দীন ইলাহী চালিয়ে যেতে সফল হননি, তবে তাঁর শাসন কেবলমাত্র মুসলমানদের বাহুবলের উপর নির্ভরশীল ছিল না। তাঁর ক্ষমতার প্রবল স্রোত ছিল রাজপুত, সেজন্য তাঁকে কোনো আলাউল্-মুকের এরূপ পরামর্শ দেওয়ার আবশ্যকতা ছিল না, আকবরেরও তা মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। (১) দীন ইলাহী ঘোষণা— জেস্যুইট সাধুদের বক্তব্য অনুসারে দীন ইলাহী প্রতিষ্ঠার আয়োজন নিম্নপ্রকারে হয়েছিল—

“কাবুল থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আকবর তাঁর আমিরদের তথা গুজরাতের বিদ্রোহীদের বিপদ থেকে মুক্ত হন। এবার তিনি সংগোপনে পরিপক্ক হতে থাকা পরিকল্পনাকে প্রকাশ্যভাবে সকলের সম্মুখে উপস্থাপিত করে এক নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা হতে চাইলেন। মুহম্মদের কুরান থেকে কিছু কিছু, ব্রাহ্মণদের গ্রন্থসমূহ থেকে কিছু এবং কিছু, যা তাঁর নিজের মতের অনুকূল, বাইবেল থেকে নিয়ে এক নতুন ধর্ম তৈরি করা হল ।

“এরূপ করার জন্য তিনি এক মহতী সভা আহ্বান করলেন, তাতে আশপাশের শহর থেকে বড় বড় পণ্ডিত ও সেনাপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হল। সাধু রিদলফোকে ডাকা হল না, কেননা তাঁর কাছ থেকে বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই আশা করা যেত না। যখন সকলে সমবেত হল, তখন তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘একজন প্রধান ব্যক্তি দ্বারা শাসিত সাম্রাজ্যের পক্ষে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে তার জনসাধারণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয় থাকবে এবং পরস্পরের বিরোধী হবে।’ তিনি মোগল রাজ্যের নানা ধর্মের উল্লেখ করেন, যারা নিজেদের মধ্যে কেবল মতবিরোধই পোষণ করে না, এমনকি একে অপরের শত্রু । ….

সেজন্য তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তা এমন পদ্ধতিতে যে তারা এক হবে, তাতে সকলেই থাকবে, প্রত্যেক ধর্মের যেসব ভালো ভালো বিষয়, তা তাদের ত্যাগ করতে হবে না। এইভাবে ঈশ্বরের সম্মান হবে, মানুষের মধ্যে শান্তি বিরাজ করবে এবং রাজ্য সুরক্ষিত হবে।… এখানে যাঁরা উপস্থিত রয়েছেন, তাঁরা নিজের নিজের অভিমত জানান। যতদিন আপনারা এই মত গ্রহণ করবেন না, ততদিন আমি কিছুই করব না।”

“এ কথা বলার পর যেসব আমিরদের (স্তাবক) কাছে বাদশাহ ব্যতীত কোনো ঈশ্বর নেই, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোনো ধর্ম নেই, তারা সমস্বরে বলে উঠল— হ্যাঁ, নিজের পদমর্যাদা ও মহান প্রতিভার কারণে ঈশ্বরের অধিক নিকটস্থ হওয়ার ফলে বাদশাহ-ই সমগ্র রাজ্যের জন্য দেবতা, পূজা-পদ্ধতি, বলি, ধর্মতত্ত্ব, আচার-আচরণ এবং অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বধর্মের বিষয়সমূহ নির্দিষ্ট করে দিন।”

 

দীন ইলাহী | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

“সভার কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর বাদশাহ একজন খুব প্রসিদ্ধ ও অত্যন্ত পণ্ডিত শেখ (মুবারক)-কে চারদিকে প্রচার করতে বললেন যে শীঘ্রই সারা মোগল সাম্রাজ্যের পালনীয় ধর্ম দরবার থেকে ঘোষণা করা হবে, সশ্রদ্ধ চিত্তে সকলেই তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।” জেস্যুইট পাদরীদের লেখা অনুসারে আকবরের সিদ্ধান্ত সকলেই একবাক্যে অনুমোদন করেছিল, কিন্তু বদায়ূনী— সম্ভবত যিনি উক্ত সভায় স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন —

তাঁর মতানুসারে সকলেই ঐকমত্য পোষণ ঘোষণা করেনি— “সাম্রাজ্যে নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যে সভা আহ্বান করা হয়েছিল, সে-সভায় রাজা ভগবানদাস বললেন: আমি খুশি মনেই বিশ্বাস করতে পারি যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মই খারাপ। কিন্তু এটাও জানানো দরকার যে নতুন ধর্ম কিরূপ এবং সেই ধর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্তই বা কি, যাতে আমরা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব। হজরত কিছুক্ষণ এ বিষয়ে আলোচনা করলেন, তারপর রাজার উপর জোর দেওয়া ছেড়ে দিলেন। কিন্তু… (শেষে) ইসলাম-বিরোধী পন্থাই গৃহীত হয়।”

মানসিংহও তাঁর ধর্মপিতা রাজা ভগবানদাসের মতোই নিজের মনোভাব কয়েক বছর পর প্রকাশ করেন। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর মানসিংহকে বাংলা-বিহারের সিপাহসালার নিযুক্ত করা হয়। সেই সময় শাহী সুরাপানের আসরে নতুন ধর্ম গ্রহণ সম্পর্কে কথা উঠলে মানসিংহ বাদশাহের জন্য প্রাণোৎসর্গ করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু নবধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। দীন ইলাহী (তৌহিদ-ইলাহী-ব্রহ্ম অদ্বৈত) ধর্মে যেসব আমির যোগ দিয়েছিলেন,

তাঁদের কয়েকজনের নাম-

১. আবুল ফজল (খলীফা)

২. ফৈজী (কবিরাজ)

৩. শেখ মুবারক (নাগৌরী)

৪. জাফরবেগ আসফ খাঁ (কবি)

৫. কাসিম কাবুলী (কবি)

৬. আব্দুস্ সামাদ (চিত্রকর, কবি)

৭. আজম খাঁ কোকা (মক্কা থেকে আসার পর ৮. শাহ মুহম্মদ শাহাবাদী (ঐতিহাসিক)

৯. সুফী আহমদ

১০. সদরজাহাঁ (মহামুক্তি)

১১-১২. সদরজাহাঁর দুই পুত্র

১৩. মীর শরীফ আমলী

১৪. সুলতান খাজা সদর

১৫. মির্জা জানী (হাকিম ঠাঠা) ১৬. নকী সুস্তরী (কবি)

১৭. শেখজাদা গোসালা (বনারসী)

১৮. রাজা বীরবল

(২) দীক্ষা— দীন ইলাহীতে প্রবেশ করার জন্য একখানি প্রতিজ্ঞাপত্র লিখতে হতো, তার কয়েকটি বাক্য এইরূপ— “আমি অমুকের পুত্র অমুক, নিজের ইচ্ছায় ও আন্তরিকতার সঙ্গে ইসলাম ও গতানুগতিক ধর্ম— যা আমি পিতা-পিতামহের কাল থেকে দেখেশুনে আসছি— তাকে অস্বীকার করছি এবং দীন ইলাহী আকবরশাহীতে প্রবেশ করছি, সেই সঙ্গে চার প্রকার আচার-সম্পর্কিত বিষয় ধন-প্রাণ-সম্মান-ধর্ম ত্যাগ স্বীকার করছি।”

বদায়ূনী কর্তৃক উদ্ধৃত বাক্যাবলী মুসলিম প্রবেশার্থীদের জন্য ধরে নিতে হবে, হিন্দুদের প্রতিজ্ঞাপত্রে নিশ্চয়ই খানিকটা তফাত ছিল। ‘আইনে-আকবরী’ (আবুল ফজল) অনুসারে সমস্ত ধর্মের অনেক বিষয়ই সমানভাবে দীন ইলাহীতে স্বীকার করে নেওয়া হয়, ঈশ্বর ও মানুষ এক। “বাদশাহ রাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতা। নিজের কর্তব্যপালনকে তিনি ঈশ্বরের সন্তোষ বিধানের একটি উপায় বলে মানেন । তিনি এখন  সেই পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, যা সত্যের পথে নিয়ে যায় এবং সকল সত্য-সন্ধানীর তৃষ্ণা নিবারণ করে ।

“জিজ্ঞাসুকে জানার জন্য বেশি-বেশি সুযোগ দেওয়া হয়। যখন সে সন্তুষ্ট হয়, তখন তাকে রবিবার দিন— যখন বিশ্ব-প্রকাশ সূর্য তার সর্বোচ্চ তেজে অবস্থান করে, তখন— দীক্ষা দেওয়া হয়। নতুন ব্যক্তিদের প্রবেশ করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ও দোদুল্যমানতা থাকা সত্ত্বেও সমস্ত শ্রেণীর হাজার হাজার মানুষ বিশ্বাসী হয়ে নবধর্মের দীক্ষাকে সর্বপ্রকার আনন্দপ্রাপ্তির উপায় হিসেবে মানে।

“(দীক্ষার) সময় জিজ্ঞাসু নিজের পাগড়ি হাতে নিয়ে হজরতের চরণে মাথা নত করে। হজরত হাত বাড়িয়ে শিষ্যকে তুলে তার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন। …তারপর হজরত শিষ্যকে অভিজ্ঞান প্রদান করেন, তার উপর মহানাম ও ‘আল্লাহু আকবর’ খোদাই করা থাকে । ”

অভিজ্ঞান সম্ভবত তাবিজ অথবা মালা ছিল। দীক্ষার সময় বাদশাহের ছবিও দেওয়া হতো, দীন ইলাহী ধর্মাবলম্বী তা পাগড়িতে ব্যবহার করত। অভিজ্ঞান মহানাম হিন্দুদের জপমালার মতো ব্যাপার ছিল। আবুল ফজলের কথা অনুসারে, দীন ইলাহী ধর্মাবলম্বীরা পরস্পরের দেখা হলে ‘আল্লাহু আকবর’ এবং উত্তরে ‘জল্লে জালালাহু’ (তাঁরই প্রতাপ) বলে সম্ভাষণ করত। মৃত্যুর শ্রাদ্ধের বদলে দীন ইলাহীতে জীবিতাবস্থাতেই শ্রাদ্ধ করে নেওয়া হতো যাতে নিজের অন্তিম প্রয়াণে তাকে অপরের উপর নির্ভরশীর না হতে হয়।

প্রত্যেক ভক্ত তার জন্ম-দিবসে ভোজ দিত। গুরু আকবর তাঁর শিষ্যদের মাংস-ভোজনে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছিলের। তবে হ্যাঁ, তারা অপরকে মাংস ভোজন করাতে পারত, তবে যে-মাসে জন্ম, সে-মাসে মাংসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার উপদেশ ছিল। নিজের নিহত পশুর কাছে যাওয়া বা শিকার-করা পশুর মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। কসাই, জেলে ও পাখিমারাদের পাত্রে জল খাওয়া বারণ ছিল । দরসনিয়ার (দর্শনীয়, দীন ইলাহীর অনুগামী) নিকট গর্ভবতী, বৃদ্ধা, বন্ধ্যা নারী ও ঋতুমতী না-হওয়া পর্যন্ত বালিকার সঙ্গে যৌন-সংসর্গ অবৈধ ছিল ।

fb দরসনিয়াদের অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সম্পর্কেও বলে দেওয়া হয়েছিল— মৃত স্ত্রীলোক অথবা পুরুষের ঘাড়ে চাল অথবা একটা পোড়ানো ইট বেঁধে নদীতে স্নান করিয়ে এমন স্থানে দাহ করা প্রয়োজন, যেন সেখানে জল না থাকে। মৃতকে পূর্বদিকে মাথা এবং পশ্চিমদিকে পা রেখে শায়িত করে কবরস্থও করা যেতে পারত। গুরু (আকবর) তাঁর শিষ্যদের মৃতকে এইভাবে শয়ন করানোর কথা বলাতেও মোল্লারা তার অর্থ করেছিলেন যে এই বিধর্মী পশ্চিমদিকে অবস্থিত কাবার অপমান করার জন্যই এই পদ্ধতি বের করেছেন।

(৩) বিধি-বিধান— দীন ইলাহীর বিধি-বিধান ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের সভায় নিযুক্ত কার্যালয় ১৫৮৩ ও ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত করে। ১৫৮৮ থেকে ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরও অনেক আদেশ জারি করা হয় যা পূর্বে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়নি। আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দীন ইলাহী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার ফলে আকবরের স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। সূর্য-পূজার প্রাধান্য ছিল। সেই সঙ্গে অগ্নি-পূজা এবং প্রদীপের সম্মুখে জোড়হাত করার কথাও আমরা আগে বলেছি। কোনো শিশুপুত্রের নাম মুহম্মদ রাখতে দেওয়া হতো না এবং যাদের নামের সঙ্গে মুহম্মদ ছিল, দীক্ষার সময় তা বদলে দেওয়া হতো। কথিত আছে, নতুন মসজিদ নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, পুরনো মসজিদের মেরামতির অনুমতি ছিল না ।

আকবর গো-হত্যা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এবং সেই অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের হুকুম অনুযায়ী বছরে এক শত দিনের বেশি মাংস- ভক্ষণ বর্জিত ছিল। এই হুকুম কেবল রাজধানীতেই নয়, এমনকি সারা রাজ্যে চালু ছিল।

দীন ইলাহীর অনুগামীদের জন্য শাশ্রু-মুণ্ডন আবশ্যক ছিল। তাদের জন্য শুধু গোমাংসই নয়, রসুন-পিঁয়াজও পরিত্যাজ্য ছিল। বাদশাহের সম্মুখে সিজদা (দণ্ডবৎ ) করা আবশ্যক ছিল। এই ধর্মের বাইরের লোকদের কাছেও তা বাধ্যতামূলক ছিল। ইসলামে সোনা ও জরিদার বস্ত্র পরিধান নিষিদ্ধ, কিন্তু দীন ইলাহীতে সর্বজনীন প্রার্থনা ও অন্যান্য সময়ে সে-সব ধারণ করা আবশ্যক বলে গণ্য হতো।

দরসনিয়াদের জন্য রমজান মাসের রোজা ও হজ মানা করে দেওয়া হয়েছিল। আরবি, ইসলামী শরীয়ত, কুরানের ব্যাখ্যাও পাঠ করা নিষিদ্ধ ছিল। ৯৮৯ হিজরীতে (১৫৮১-৮২ খ্রিঃ) বহু রক্ষণশীল শেখ ও ফকিরকে কন্দাহারের দিকে নির্বাসিত করে দেওয়া হয়— পূর্ব থেকেই বসবাসকারী ইলাহী নামক সম্প্রদায়ের শেখদের ও তাদের শিষ্যদের সিন্ধু- কন্দাহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খৎনা করাও নিষিদ্ধ ছিল।

প্রাতঃকাল, সায়ংকাল, মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত্রি— চারবার পূর্বদিকে মুখ করে পূজা করা হতো। সূর্যের সহস্র নাম জপ করা হতো। গুরুদেব স্বয়ং দু’কান ধরে পরিক্রমা করতেন। সূর্যোদয় ও মধ্যরাত্রির প্রার্থনার জন্য নাকাড়া বাজানো হতো। গুরু এটাও নিয়ম করেছিলেন যে পত্নীর বন্ধ্যা-দশা ব্যতীত কেউ যেন দ্বিতীয় বিবাহ না করে । সতী প্রথা নিষিদ্ধ ছিল, সে-কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

আকবর ৯৯৯ হিজরীতে (১৫৯০-৯১ খ্রিঃ) আগরায় দুটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করান, একটি নাম ছিল খয়েরপুরা, অপরটির নাম ধর্মপুরা। খয়েরপুরায় মুসলমান ফকিরদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল, ধর্মপুরায় থাকত হিন্দু সাধুরা। সাধুদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যোগীপুরা নামে আর একটি অট্টালিকা নির্মাণ করানো হয়। আকবর স্বয়ং কয়েকজন সেবককে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে সৎসঙ্গ ও যোগশিক্ষা করতেন। আগরায় শিবরাত্রির বড় মেলায় কতবার সাধুদের সঙ্গেই বাদশাহও ভোজন করেছিলেন।

কেউ একজন জানায়, যোগ ও মুক্তির জন্য ব্রহ্মরন্ধ্র উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন, সে-কথা শুনে তিনি ব্রহ্মতালুর কেশ-মুণ্ডন করেন। সাধুরা তাদের শিষ্যদের চেলা বলত। আকবরের শিষ্য ও সেবকদেরও চেলা বলা হতো। আকবর ৯৯১ হিজরীতে (১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে) আদেশ দেন, সব মানুষই ঈশ্বরের দাস, তাদের ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী করে বিক্রি করা মহাপাপ। এবং তিনি সকলকে স্বাধীন করে দেন। কিন্তু তারা প্রভুর সেবা ছাড়তে চাইত না।

এবার থেকে তাদের নাম ‘চেলা’ হয়ে যায়। প্রাতঃকালে সূর্যপূজা ও নাম জপ করে আকবরের ঝরোকার কাছে আসার আগেই হাজার হাজার নরনারী, সেইসঙ্গে বহু ব্যাধিগ্রস্ত প্রতিবন্ধীও, সম্মুখে জড়ো হতো। মহাবলীকে ঝরোকার কাছে দেখলেই সকলে দণ্ডবৎ করত। সুলতান খাজা আমীন (মীরহাজ) খাস চেলাদের অন্যতম ছিলেন। মৃত্যুর পর তার কবর নতুন পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়— মুখের সামনে একটি জাফরি রাখা হয়েছিল যাতে সেখান দিয়ে রোজ সকালে সর্বপাপহর সূর্যকিরণ এসে তাঁর মুখে পড়ে ।

 

দীন ইলাহী | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

দীন ইলাহী আকবরশাহী সম্বন্ধে বহু পুস্তক, পূজা-পদ্ধতি, ধর্মশাস্ত্র রচনা করা হয়েছিল । অনুগামীদের সংখ্যা হাজার হাজার নয়, লক্ষে লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের পর সমস্ত চেলা নিজের নিজের ধর্মে ফিরে যায়। কেননা লাভের বদলে লোকসানে সম্ভাবনা বেশি ছিল, সেটা তারা মেনে নিতে রাজি ছিল না। অনুগামীরা না থাকলে পুস্তকাদি কিভাবে টিকে থাকবে? অল্পকালের মধ্যেই দীন ইলাহী জলের উপর রেখার মতোই মিলিয়ে যায় ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment