হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা

হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। মগধ অথবা পূর্বাঞ্চলের আধিপত্যের সঙ্গেই ভারতের ইতিহাসের সূচনা। প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত মগধ (বিহার) ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। তারপর খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র হয়ে ওঠে কনৌজ ।

হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা

 

হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

 

কনৌজের ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারী তুর্কিদের কল্যাণে দিল্লী বিশাল ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠার সৌভাগ্য লাভ করে। তুর্কিরা অসামান্য যোদ্ধা ছিল, তাদের মধ্যে ছিল অবিশ্বাস্য একতা। ইসলামের পতাকা যে তাদের শক্তি দ্বিগুণ করে তুলেছিল, এ বিষয়েও কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না। কিন্তু মুষ্টিমেয় সৈন্য ভারতের এত বড় ভূখণ্ডে কিভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল, সেটা অবশ্যই বোধগম্য হওয়া কঠিন। বস্তুত সামরিক শক্তি ও ঐক্য না থাকলে জনসাধারণের অস্থিমাংসের স্তূপের আদৌ কোনো গুরুত্ব থাকে না। সে-সময় আমাদের দেশটা ছিল বহুলাংশে সেরকমই ।

দাস বংশ, খিলজী বংশ এবং তুগলক বংশ— এই তিন তুর্কি রাজবংশের পরে দিল্লীর ক্ষমতা ছত্রখান হয়ে যায়। মুসলমানদের জৌনপুর, বাংলা, বাহমনীর মতো শক্তিশালী পৃথক পৃথক রাজ্য গড়ে ওঠে। দিল্লীর তুর্কিরা নিজেদের একমাত্র ইসলামের পতাকাবাহী বলে যে-দাবি করত, দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুসলিম রাজ্যগুলি সে-দাবি করতে পারত না।

দিল্লী ভারতের ইসলামিক কেন্দ্র হয়ে থেকে যায়। বড় বড় ধর্মাচার্য ও আলিম’ ছিলেন দিল্লীর, তাঁরা দিল্লীকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে সমর্থন করার কথা ভাবতেই পারতেন না। জৌনপুর ইত্যাদির শাসকেরা নিজদের বাদশাহ বলে ঘোষণা করে দিল্লীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাবে, সেটাও দিল্লী বরদাস্ত করতে রাজি ছিল না।

দিল্লী জেহাদের নামে নিজের পতাকা-তলে দেশী মুসলমান যোদ্ধাদের সমবেত করতে সমর্থ ছিল, দিল্লীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জৌনপুর তা করতে পারত না। তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য অন্য এক ক্ষমতার উৎস খুঁজে বের করে : আমরা দিল্লীর বিদেশীদের বিরুদ্ধে।

কেবল মুসলমান নয়, হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে মিলেমিশে আমরা দিল্লীর অত্যাচারের মোকাবিলা করব। এভাবেই জৌনপুর হিন্দুদের তরোয়ালের সাহায্য নেয় এবং তার ক্ষমতা এতই সুদৃঢ় হয়ে ওঠে যে এক শতাব্দীর অধিককাল দিল্লী তার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। অধুনা উত্তরপ্রদেশ ও উত্তর বিহারের অধিকাংশ অঞ্চল জৌনপুরের অন্তর্গত ছিল। মুহম্মদ তুগলকেরই অন্য নাম জৌনাশাহ, তাঁর নামেই

 

১. আলিম

পণ্ডিত, বিদ্বান।  সাধারণত ইসলাম-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত অর্থে ব্যবহৃত হয়। আরবি শব্দ। জৌনপুর শহরের প্রতিষ্ঠা। পূর্বে গোমতীর তীরে সেখানে হয়তো কোনো শহর ছিল, তবে তা আমাদের জানা নেই। জৌনপুর মুসলমান বাদশাহের রাজধানী। কিন্তু সেই বাদশাহী ব্যবস্থা এমন যে তাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই অন্তর্ভুক্ত ছিল। দরবারে হিন্দুরা সমান মর্যাদা লাভ করত।

দিল্লীতে হিন্দুরা সেই মর্যাদা পায় দেড়শো বছর পরে, আকবরের আমলে, যখন তিনি নিজের হাতে শাসন-ক্ষমতার বল্গা তুলে নেন। তবে বল্গা হাতে নিয়েই দিল্লী ত্যাগ করে সিক্রী ও আগরায় নিজের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তিনি।

পঞ্চদশ শতাব্দী জৌনপুরের আধিপত্যের শতাব্দী। যে-মাটিতে জৌনপুরের অবস্থান, সে-মাটিকে ভুলতে দেয়নি জৌনপুর, যে-সংস্কৃতিতে নিশ্বাস নেয় মানুষ, সে-সংস্কৃতিকেও ভুলতে দেয়নি। জৌনপুর ভারতীয় সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, অওধী ভাষা ও সাহিত্যেরও সমাদর করেছে, তার প্রমাণ অওধীর প্রথম শ্ৰেষ্ঠ কবি মঞ্জুন, কুতুবন, জায়সী জৌনপুরের দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন।

সকলেই মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেশের ভাষা, কাব্যশৈলী আত্মস্থ করেছিলেন। জৌনপুর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মুসলমানেরা নিজেদের অহংকার কিছুটা বিসর্জন দিয়েছিল, হিন্দুরা নিজেদের হারানো আত্মসম্মান পুনর্লাভ করেছিল। একপক্ষ এক ধাপ নিচে নেমেছিল, অন্য পক্ষ এক ধাপ উপরে উঠেছিল। উভয়ে কাঁধে কাঁদ মিলিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সত্যিই, এর সামনে কি আর দিল্লী রক্তচক্ষু দেখাতে পারে?

বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু সাহসী লোক জৌনপুরে এসে বসবাস শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে পাঠান ছিল, তুর্কি ছিল, সৈয়দও ছিল। এরকমই এক পাঠান যুবক, যিনি জৌনপুরের আবহাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি বুঝেছিলেন, অজেয় হতে হলে দেশের মাটিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আর সেই . ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যদি দেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে।

যুবকটি উপলব্ধি করেছিলেন, দিল্লীর আশপাশের মানুষ এক সময় আগুন-জল নিয়ে খেলা করেছে ঠিকই, সেখানকার হিন্দুরা বহু রণক্ষেত্রে নিজেদের বিক্রম প্রদর্শনও করেছে, কিন্তু কয়েক শতাব্দীর সংগ্রামে তারা এখন অবসন্ন। পূর্বাঞ্চলে কিন্তু এখনও সেই আগুনের তেজ রয়েছে। 

 

হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

এখানকার লোকজন লাঠি ও তরোয়ালে পারদর্শী। হ্যাঁ, অওধ ও ভোজপুরী উভয়ে ভাষাভাষী লোকজন লড়াই-ঝগড়ায় সকলের আগে লাফিয়ে যায় ইংরেজরা তাদের এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিল বলেই না ইংরেজ সৈন্যবাহিনীতে সর্বাে তাদেরই বেশি সংখ্যায় নিযুক্ত করে। তাদের শক্তিতেই ইংরেজরা কাবুল ও মাড পর্যন্ত ধাওয়া করতে সক্ষম হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তারা যখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তখন ইংরেজরা একবার চারদিক অন্ধকার দেখেছিল ।

পূর্বোক্ত যুবকটি জৌনপুরের চাকরিতে সন্তুষ্ট হননি, পৃথিবীতে তিনি নিজের জন স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন। ভোজপুরীদের আরা জেলার সহসরাম ত অবস্থান কেন্দ্র হল। তাঁর বীরত্ব ও উদার মনোভাবে আকৃষ্ট হয়ে ভোজপুরী সেপা সামন্তরা ছুটে এসে তাঁর ছত্রছায়ায় দাঁড়াতে শুরু করে। বিহারের রাজা হতে তাঁর বে সময় লাগেনি। শেরশাহ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন তিনি। বাবর ভারত করেছিলেন, কিন্তু তাঁ তাঁর পুত্র হুমায়ূন বাধ্য হন শেরশাহের হাতে পরাজিত হয়ে ভা ২. অওধী— অযোধ্যা ও তৎ সন্নিহিত অঞ্চলের কথ্যভাষা।

থেকে পালিয়ে যেতে। একের পর এক পরাজয় স্বীকার করতে করতে, সিন্ধুনদেরও পশ্চিমে পালিয়ে গিয়ে, ফের কি হুমায়ূন আশা করতে পারেন ফিরে এসে তিনি ভারতের সিংহাসনে বসবেন! শেরশাহ বেঁচে থাকতে হুমায়ূনের সে-সৌভাগ্য হয়নি। ভোজপুরীদের মতো অওধী ভাষাভাষীরাও শেরশাহের সহযোগী ছিল, কারণ শেরশাহের গর্ব ছিল জৌনপুরকে নিয়ে ।

শেরশাহ জৌনপুর থেকেও আরো এক পা বেশি এগিয়ে গেলেন। বহু বিষয়ের, বহু কাজের প্রথম প্রবর্তক তিনি, সেগুলির আরও উৎকর্ষ সাধন করতে দেখা যায় আকবরকে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পথের দুই পাশে ফলবৃক্ষ রোপণ এবং কিছুদূর অন্তর অন্তর পান্থশালা ও কূপ নির্মাণের কাজ শুরু করেন শেরশাহ। শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলির জন্য হিন্দুদের প্রতি পূর্ণ আস্থা পোষণেরও প্রথম পথিকৃৎ তিনিই। তাঁর শাসনকালে মন্ত্রী ও সেনাপতির মতো উচ্চপদে হিন্দুদের পদোন্নতি হতো। লোকের কাছে শেরশাহ ছিলেন ন্যায় ও ধর্মের অবতার ।

জনসাধারণের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন শেরশাহ এবং তাদের সহযোগি- তাতেই তাঁর কৃতিত্ব অর্জন। বিহারের মুকুটহীন রাজা হয়েও তিনি একজন সাধারণ সৈন্যের মতো কাজকর্ম করতে দ্বিধা করতেন না। যে-সময় হুমায়ূনের দূত তাঁর কাছে উপস্থিত হয়, সে-সময় তিনি অন্য সৈন্যদের মতো নিজেও বেলচা দিয়ে গর্ত তৈরি করছিলেন এবং বেলচা হাতে নিয়েই দূতের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তাঁর কাছে মাটি ও সিংহাসন উভয়ই সুপরিচিত। মুসলমান সুলতানেরা সরকারী পরিষেবার বদলে জায়গির দেওয়ার প্রথা প্রচলন করেছিলেন।

 

হেমচন্দ্ৰর দেশের অবস্থা | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

জায়গিরদার – নিজের জায়গির মর্জি মাফিক চালাত আর হতভাগ্য কৃষকেরা নিষ্পেষিত হতো। শেরশাহ জায়গিরের বদলে তাদের বেতনভোগী করে দেন। তাঁর সৈন্যরা প্রজাদের উত্যক্ত করতে পারত না। এমন কঠোর নিয়ম সত্ত্বেও সৈন্যরা অসন্তুষ্ট ছিল না, তারা নিজেদের নেতাকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করত।

শেরশাহই সেইসব সাদাসিধে যোদ্ধা সৈন্য তৈরি করেছিলেন, পরবর্তীকালে যারা কোম্পানির সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছিল। শেরশাহ বুঝেশুনেই শাহবাদ-সহসরামকে নিজের দুর্গ বানিয়েছিলেন। ভোজপুরী তরুণেরা লাঠি ও তরোয়ালের কদর জানত, এবার তারা পলতেওলা বন্দুক চালাতেও শিখে নিল। চৌসা নামের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। শাহবাদের চৌসা গ্রামেই শেরশাহ হুমায়ূনের সৈন্যবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। সেই যে তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে গেল, তারপর তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারেন নি ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment