পারসি ধর্মের প্রভাব ও আকবর

পারসি ধর্মের প্রভাব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক সমন্বয়” বিভাগের একটি পাঠ। আকবরের মায়ের ভাষা ছিল ফারসি। প্রাসাদে তুর্কির চেয়ে বেশি চলত ফারসি ভাষা । ফারসির বিশাল সাহিত্য-ভাণ্ডার ছিল, শোনার জন্য প্রায়ই তা পাঠ করানো হতো। ফারসি সাহিত্যে ইসলাম-বিরোধী তত্ত্ব বীজরূপে নিহিত ছিল। ইরানীরা ইসলামের তরোয়ালের কাছে মাথা নত করেছিল, তাদের জরথুস্ট্র ধর্মকেও বলি দিয়েছিল, তথাপি নিজেদের উন্নত সংস্কৃতিকে কখনো ত্যাগ করেনি।

পারসি ধর্মের প্রভাব

 

পারসি ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

তাকেই তুলে ধরতে ফিরদৌসী তাঁর ‘শাহনামা’য় প্রাচীন ইরানের গৌরব-গাথা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন এবং মূর্খ অসভ্য আরবদের প্রাণভরে ভর্ৎসনা করেছেন। আকবর তাকে নিজের মনের কথা ভাবতেন। তিনি ফিরদৌসীর নিম্নলিখিত কবিতা বারবার পাঠ করাতেন এবং শ্রবণ করে আনন্দলাভ করতেন—

জ-শীরে-শুতুর খুর্দ ওয়া সূসমার । 

অরবরা বাজারে রসীদ’স্ত্ কার ।

কি তখতে-কিয়া রা কুনদ্ আরজু । 

তফূ বরতু অয়্ চরখে-গৰ্দা তফূ ।

 

(উটের দুগ্ধ পানকারী ও সুসমার” -ভোজী আরবদের তুমি প্রভু বানিয়েছ যাতে তারা ইরানী বাদশাহদের মসনদ কামনা করতে পারে। ও ঘূর্ণায়মান আকাশ, তোর উপর থুতু দিই, থুতু দিই।) আকবরের কোনো ফিরদৌসী জোটেনি যে প্রাচীন ভারতের ‘শাহনামা’ লেখাবেন। শাহনামা শুনতে শুনতে জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারেন, সংস্কৃত ভাষায় ভারতের শাহনামা রয়েছে ‘মহাভারত’। তিনি কেবল তার অনুবাদের আদেশই দেননি, এমনকি দেবী পণ্ডিতের মুখে অর্থ শুনে নিজে তার ফারসি করে নকীব খাঁকে দিয়ে লেখাতে শুরু করেন।

কিন্তু তাঁর অত সময় কোথায়? বাদশাহ মাত্র দুই রাত্রিই শাহনামা শুনিয়েছিলেন। তৃতীয় রাত্রিতে বদায়ূনীকে ডেকে বললেন: তুমি নকীব খাঁর সঙ্গে থেকে তরজমা করো। তিন-চার মাসে অষ্টাদশ পর্বের মধ্যে দুইটি পর্বের অনুবাদ হয়ে যায়। মোল্লা বদায়ূনীর অনুবাদে ক্ষেপণ-প্রক্ষেপণ দেখে বাদশাহের মুখ থেকে তিনি হারামখোর ও শালগম-খোর আখ্যা লাভ করেছিলেন।

শৈশব থেকেই আকবরের কাছে ও তাঁর দরবারে ফারসি সংস্কৃতির প্রতি যে সমাদর ছিল, তা-ই আকবরকে হিন্দু ধর্মের প্রতি আকর্ষণ করতে কার্যকরী হয় এবং শেষে হিন্দু-ফারসি মিশ্রিত সংস্কৃতি তাঁকে হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরাগী করে তোলে। ফারসিরাও অগ্নি ও সূর্যের পূজা করত, যা হিন্দুদের মধ্যেও দেখা যায়। আকবর কি জানতেন, যে মূল-ভাবনা থেকে ফারসি, ধর্ম ও সংস্কৃতির উদ্ভব, সেই মূল-ভাবনা থেকেই হিন্দুদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব!

 

পারসি ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ফারসি মোবিদ (পারসি পুরোহিত)-কে দরবারে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তার কাছ থেকে আকবর পারসি ধর্ম বিষয়ে অনেক কথা জানতে পারেন। পারসিদের মতোই তাঁর কোমরে গুশ্তী বাধা থাকত, লোকে ভেবে নিয়েছিল, আকবর জরথুস্ট্রীয় ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার কিছুকাল পরেই তিনি তিলক- উপবীত ধারণ করে দরবারে উপস্থিত হলেন। 

এই উভয় ধর্মের দিকেই তাঁর বেশ টান ছিল। নওসারীর পারসি পুরোহিতদের প্রধান দস্তূর মেহেরজী রানার আকবরকে নিজেদের ধর্ম ব্যাখ্যা করার বিশেষ সুযোগ লাভ করেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে সুরাত অবরোধের সময় আকবরের শিবির স্থাপিত হয়েছিল কঙ্কড়খাড়ায় । সেই সময় সর্বপ্রথম পারসি পুরোহিতদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়। তখনও তিনি মোবিদদের কাছ থেকে অনেক কথা জানতে পারেন এবং রানাকে তাঁর দরবারে আসার জন্য খুব অনুরোধ করেন। রানা কখন দরবারে এসেছিলেন তা বলা কঠিন, তবে ১৫৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দের শাস্ত্রালোচনায় তিনি অবশ্যই যোগ দিতেন। 

দস্তূর মেহেরজী রানা তাঁর মৃত্যুকাল (১৫৯১ খ্রিঃ) পর্যন্ত আকবরের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। আকবর দস্তুরকে দুই শত বিঘা বংশ-পরম্পরায় লাখেরাজ জমি প্রদান করেন, তাঁর পুত্র সেখানে একটি কাছারি নির্মাণ করেন। রানার আগমনের পর পারসি বিধি অনুসারে প্রাসাদে অগ্নি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার পূজা ইত্যাদির দায়িত্ব সমর্পণ করা হয় আবুল ফজলের উপর। 

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে আকবর প্রকাশ্যে সূর্য ও অগ্নির সামনে দণ্ডবৎ করতে শুরু করেন। সন্ধ্যায় যখন প্রদীপ জ্বালানো হতো, তখন আকবর ও সমস্ত দরবারীরা জোড়হাত করে দাঁড়াতেন। আকবর বলেছিলেন— “প্রদীপ জ্বালানো সূর্যকে স্মরণ করায়।”

 

পারসি ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

পারসি ধর্মকে স্বাগত জানাতে বীরবলের পূর্ণ সহায়তা ছিল। বীরবল বংশ- পরম্পরায় সূর্যোপাসক। অন্তঃপুরে হিন্দু মহিলারা হোম করতেন, সেজন্য পারসিদের অগ্নিপূজা তাঁদের কাছে কোনও নতুন ব্যাপার ছিল না। কিছুদিন পর (১৫৮৯ খ্রিঃ) আকবর মাস ও দিনের পারসি নাম গ্রহণ করেন এবং পারসিদের চোদ্দটি উৎসব পালন করতে আরম্ভ করেন। আকবর পারসি ধর্মের মতোই হিন্দু, জৈন ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, সেজন্য সকলেই তাঁকে নিজের নিজের ধর্মের লোক বলে মনে করত । 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment