বঙ্গোপসাগরে নৌ মহড়া – ১৯৭১

বঙ্গোপসাগরে নৌ মহড়া – ১৯৭১ : ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের উপস্থিতি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় মহাযুদ্ধের প্রায় কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ঘিরে ঠিক একই রকম ভয়াবহ দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। এমন একটি দুর্যোগের কথা সুনির্দিষ্টভাবে জানার পরও নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই ভয়াবহ পথ বেছে নেন শুধু পাকিস্তানকে চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে উদ্ধারে ও নতুন মিত্র চীনকে প্রভাবিত করতে।

বঙ্গোপসাগরে নৌ মহড়া - ১৯৭১ - Nixon and Kissinger
Nixon and Kissinger

১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট ঘনীভূত হয়, তা বড়জোর একটি আঞ্চলিক সমস্যা ছিল। চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের ফলে তা একটি আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নেয়। নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের ভৌগোলিক সংহতি রক্ষার প্রশ্নটি তাদের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত রাজনীতির অঙ্গীভূত করার ফলে তা দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নেয়। তাঁদের নিজেদের স্বীকৃতি অনুসারে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার উভয়েই তাঁদের কূটনৈতিক সাফল্য নিশ্চিত করতে পৃথিবীকে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলেন।

কিসিঞ্জার, এই রণকৌশলের প্রণেতা, এই যুক্তি দ্বারা চালিত হয়েছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের পক্ষে ও চীনের বিপক্ষে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সে পরিস্থিতিতে আমেরিকার চুপ করে থাকা ঠিক হবে না। ভারতের সামরিক পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তান, আমেরিকার বিশ্বস্ত মিত্র, তার পূর্বাংশ হারাতে বসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানও যে ভৌগোলিকভাবে অবিভক্ত রাষ্ট্র হিসেবে অক্ষত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে, তেমন সম্ভাবনা রোধ করতে আমেরিকাকে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

চীন, যার সঙ্গে নতুন মৈত্রীর পথ উন্মুক্ত হয়েছে, সে পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সে (অর্থাৎ চীন) এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে মস্কো ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির অধীনে ভারতের প্রতিরক্ষায় চীনের বিরুদ্ধে সামরিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। সে রকম কিছু যদি হয় তাহলে, নিজের মিত্রদের কাছে মুখরক্ষায় ও পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বে তার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে ওয়াশিংটনকে পাল্টা ব্যবস্থা নিতেই হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নৌবহর প্রেরণের প্রশ্নটি ওঠে।

ভারতের বিরুদ্ধে এবং প্রয়োজনবোধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহারের যৌক্তিকতা কিসিঞ্জার প্রথম তুলে ধরেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ৮ ডিসেম্বর। ভারত যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তার বিমান ও সাঁজোয়া বহরকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়, তাহলে পাকিস্তান ভারতের ওপর নির্ভরশীল এক করদ রাজ্যে পরিণত হবে।

‘ভারত আমাদের ভয় দেখাবে, আর আমরা তা মেনে নেব?’

President Nixon's cabinet in 1971
President Nixon’s cabinet in 1971

স্পষ্টতই পূর্ব পাকিস্তান মুক্ত করার পর ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা অব্যাহত রাখবে—আর কিছু না হোক আজাদ কাশ্মীর তার নিয়ন্ত্রণে আনবে ও বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করবে—কিসিঞ্জার এ কথায় বিশ্বাস করেন, তা নানাভাবে ওয়াশিংটন গ্রুপের সামনে ও নিক্সনের কাছে জানিয়েছেন। পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকাকে শক্ত হতে হবে, এই যুক্তির ভিত্তিতে তিনি সামরিক পদক্ষেপের রণকৌশলটি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হন। (ক্ষমতার অবস্থান থেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার যুক্তিতে ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে। সে সময় মার্কিন রক্ষণশীলদের যুক্তি ছিল, বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার একমাত্র পথ হলো তার সামরিক শৌর্যের ব্যবহার)।

এই নৌবহর পাঠানোর উদ্দেশ্য কী, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কথা উঠলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লেয়ার্ড জানান, আটকে পড়া আমেরিকানদের উদ্ধারে তাকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বড়জোর ২০০ মার্কিন নাগরিককে উদ্ধারে এই বিশাল নৌবহরের কী প্রয়োজন, লেয়ার্ড তা কখনোই বুঝিয়ে বলেননি। ‘এটি আমেরিকার নিয়মিত কন্টিনজেন্সি প্ল্যানিং’-এর অংশ হিসেবেই পাঠানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

বঙ্গোপসাগরে নৌ মহড়া

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর সময় বাংলাদেশে মোট মার্কিন কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৯। এ ছাড়া আরও ১৭৫ জন মার্কিন নাগরিক দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলেন। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। নিজের নাগরিকদের রক্ষার নামে বঙ্গোপসাগর এলাকায় টাস্কফোর্স ৭৪ নামে যে বিশাল নৌবহর প্রেরণ করা হয়, তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল আণবিক শক্তিচালিত যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ।

প্রায় এক লাখ টন ওজনের এই ক্যারিয়ার জাহাজটি সেই সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ যুদ্ধজাহাজ বলে পরিচিত ছিল। এই জাহাজ ১০০টির মতো বোমারু বিমান বহনে সক্ষম ছিল, যেকোনো সময় তাদের ওঠানামা করার মতো ব্যবস্থা সে জাহাজে ছিল। যে ফ্যান্টম বিমানগুলো এন্টারপ্রাইজের গর্ব বলে বিবেচিত হতো তার অধিকাংশই আণবিক অস্ত্রসজ্জিত ছিল। এই নৌবহরে আরও ছিল হেলিকপ্টার বহনকারী জাহাজ ত্রিপলি, যাতে প্রায় ৩০টি হেলিকপ্টার অভিযানের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় মোতায়েন ছিল।

US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)
US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এ কথা প্রথম জনসমক্ষে জানান ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলাম লেখক, অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত জ্যাক এন্ডারসন। তিনি লিখেছেন:

‘প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ধীরে, গোপনে। কিসিঞ্জার ও তাঁর একান্ত অনুগত একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ হোয়াইট হাউসের বেসমেন্টে নিরাপত্তা পরিষদের নিজস্ব ‘সিচুয়েশন রুম’-এ। তাঁর নির্দেশে প্রস্তুত হয় যুদ্ধের নীলনকশা, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আউটলাইন প্ল্যান ফর শো অব ফোর্স ইন দি পাকিস্তান-ইন্ডিয়া এরিয়া।’

ভারত মহাসাগর এলাকায় অনেক আগে থেকেই সোভিয়েতদের লক্ষণীয় নৌ-উপস্থিতি ছিল, যা মার্কিন নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পছন্দ ছিল না।

ব্রিটিশ নৌবাহিনী এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পর রুশরা তার জায়গা দখলের ব্যাপারে অতি আগ্রহী ছিল। মার্কিন নৌ-কমান্ড এবার সুযোগ পেল অবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে। ভারত মহাসাগর এলাকায় যে একটি বড় ধরনের যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়েছে এবং সোভিয়েতদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে পারে, এ কথা জেনেই প্রস্তুতি শুরু হয়। অথচ এ নিয়ে একটি কথাও নিক্সন বা কিসিঞ্জার কাউকে জানতে দিলেন না (সূত্র: জ্যাক এন্ডারসন, দি এন্ডারসন পেপারস, ব্যালান্টাইন বুকস, ১৯৭৪, পৃ: ৩১৫ ও ৩২০)।

ভারত মহাসাগর এলাকায় আগে থেকেই তিনটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ টহলরত অবস্থায় ছিল। সোভিয়েত নৌবহরের অন্তর্গত ছিল ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপের জন্য আণবিক বোমা সজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র, একটি মাইন সুইপার ও একটি নৌ-তেলযান। ভারত মহাসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত মোট ৫০০ মাইল দীর্ঘ সমুদ্র এলাকায় এই জাহাজগুলো নিয়মিত টহল দিত। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম নৌবহরটি তাদের দায়িত্ব শেষে পূর্বনির্ধারিত বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তাদের ঘাঁটি ভ্লাদিভোস্তোকে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে সোভিয়েত নৌ-কমান্ড তাদের সমুদ্র এলাকায় টহল অব্যাহত রাখতে বলেন।

তাদের স্থানে নতুন যে নৌবহরটি ইতিমধ্যেই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য রওনা হয়েছিল, তাদের যাত্রাও অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া যেকোনো বিপদের মোকাবিলায় তাদের সাহায্য করতে ভ্লাদিভোস্তোক থেকে আরও অতিরিক্ত নৌযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়, যার ফলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ভারত মহাসাগর এলাকায় মোট সোভিয়েত নৌযানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬।

প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি [ President Nikolai Podgorny ]
প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি [ President Nikolai Podgorny ]

বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত ও মার্কিন রণতরি মুখোমুখি হওয়ার ফলে বিস্ফোরক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, এ কথা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞাত ছিল না। জ্যাক এন্ডারসন জানিয়েছেন, জন ম্যাককিনন, মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবাহিনীর প্রধান, ১১ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর প্রধানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় গোয়েন্দা কাজের উদ্দেশে বিমান ব্যবহারের অনুমতি চান। উদ্দেশ্য: সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজের গতিবিধি অবলোকন। অ্যাডমিরাল মোরের তাঁকে টাস্কফোর্স মালাকা প্রণালিতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন।

ম্যাককিননের হিসাবে অনুসারে তাঁর নৌবহর ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টার মধ্যে বঙ্গোপসাগর এলাকায় প্রবেশ করবে। এদিকে টাস্কফোর্সের কমান্ডার রিয়াল অ্যাডমিরাল কুপার তাঁর সব নৌসেনা ও বিমানকে পূর্ণ যুদ্ধাবস্থায় তৈরি থাকতে নির্দেশ দেন। তবে সোভিয়েত জাহাজ বা তাদের বিমান আশপাশে থাকার সম্ভাবনা কম বলে তিনি যৌথ বাহিনীর প্রধানকে জানান। কারণ, তাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সোভিয়েত যুদ্ধবিমানগুলো কায়রো ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল, কোনো দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন না করে তার ভারত মহাসাগর এলাকায় পৌঁছাতে হলে চার হাজার মাইল পাড়ি দিতে হবে।

যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে, সে খবর জানাজানি হতেই চারদিক থেকে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হলো। সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হলো ভারতে। পশ্চিম বাংলায় অবস্থান গ্রহণকারী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তীব্র ভাষায় মার্কিন গানবোট রাজনীতির সমালোচনা করলেন। কলকাতায় ও পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন শহরে, বিশেষত উদ্বাস্তু শিবিরে, প্রতিবাদ মিছিল হলো। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং জরুরি তারবার্তা পাঠিয়ে জানালেন মার্কিন নাগরিকেরা, বিশেষত দূতাবাসের কর্মচারীরা, ভারতীয় নাগরিকদের রোষের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

লিওনিদ ব্রেজনেভ [ Leonid Brezhnev ]
লিওনিদ ব্রেজনেভ [ Leonid Brezhnev ]

যুদ্ধের এই অন্তিম প্রহরে কিসিঞ্জার-নিক্সন আশায় ছিলেন যে তাঁদের চীনা বন্ধুরা প্রতীকী অর্থে হলেও কোনো না কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চীনাদের কাছে তেমন পদক্ষেপের প্রস্তাব করে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কিসিঞ্জার ও চীনা রাষ্ট্রদূতের মধ্যে নিউইয়র্কে একটি গোপন বৈঠকও হয় ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে।

১০ ডিসেম্বর চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়া এক জরুরি বার্তায় কিসিঞ্জারের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। সে কথা শুনে কিসিঞ্জার ধরে নেন এবার নিশ্চয় চীনারা ‘অসির ঝলকানি’ দেখাবে। এই চীনা বার্তা পাওয়ার পর পরই নিক্সন টাস্কফোর্স-সংক্রান্ত নির্দেশটি যৌথ বাহিনীর প্রধানকে প্রদান করেন। মজার ব্যাপার হলো, একদিন পরেই জানা গেল সামরিক পদক্ষেপ নয়, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব মার্কিন পক্ষ থেকে তোলার কথা, তাকে তারা সমর্থন করবে, সে কথা বলতেই হুয়া কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছেন।

এ কথায় অবশ্য কোনো ভুল নেই, সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছে, এই খবর পেয়েই পাকিস্তানি জেনারেলরা প্রবল উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রধান নিয়াজি সদম্ভে জানালেন, আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইসলামাবাদ থেকে তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলেন দক্ষিণ থেকে মার্কিনরা এবং উত্তর থেকে চীনারা সামরিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছে।

১১ ডিসেম্বর গোপন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সিআইএ জানায়, ইয়াহিয়া তার নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আশ্বাস দিয়েছেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চীন উত্তর-পূর্বে ভারত-চীন সীমান্ত বরাবর তাদের সেনা সমাবেশ করবে (দেখুন: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন রিলেশনস, ১১ খণ্ড, পৃ: ৭৮৬)।

The Kissinger-Yahya plot against Bangladesh's liberation
The Kissinger-Yahya plot against Bangladesh’s liberation

বাঙালি গভর্নর মালেক ও জেনারেল ফরমান আলী, নিয়াজির সঙ্গে পরামর্শ করে যুদ্ধবিরতির যে খসড়া প্রস্তাব জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন, নৌবহর আসছে জেনেও চীনাদের সেনাসমাবেশের সম্ভাবনায় ইয়াহিয়া তা অনুমোদনে বেঁকে বসেন। ভুট্টোর কাছে তিনি নির্দেশ পাঠালেন মার্কিনদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির দাবি উত্থাপনে। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের কোনো শর্তে পাকিস্তান রাজি হবে না, তিনি জানিয়ে দিলেন।

বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্য ছিল ভিন্ন। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠে বটে, কিন্তু সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ড পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সপ্তম নৌবহর তখনো বাংলাদেশের নৌসীমার অনেক দূরে।

Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev
Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকে জানান, তিব্বতের লাদাখ এলাকায় চীনা সেনাবাহিনীকে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। সিআইএর গোপন প্রতিবেদনেও জানানো হয়, ৮ ও ৯ ডিসেম্বরের দিকে তিব্বত ও পশ্চিম চীনের আবহাওয়া টারমিনাল থেকে চীন-ভারত সীমান্ত এলাকায় আবহাওয়ার খবর ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাঠানো হচ্ছে। অনুমান করা হয়, চীনা সেনাসমাবেশে সহায়তার জন্যই এই তথ্য প্রেরণ করা হচ্ছিল।

দিল্লির কাছে সে খবর ছিল, কিন্তু ইন্দিরা বা তাঁর সামরিক নেতৃত্ব এ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তার একটি সম্ভাব্য কারণ, দিল্লিতে মস্কোর রাষ্ট্রদূত পেগফ তাঁর সরকারের পক্ষে আশ্বাস দিয়েছিলেন চীন সেনাসমাবেশের চেষ্টা করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সমুচিত জবাব দেবে।

চীনারা যে রুশদের নিয়ে ভীত, সে কথা আমেরিকার জানা ছিল। জ্যাক এন্ডারসন কাঠমান্ডুতে মার্কিন সামরিক প্রতিনিধি মেলভিন হলস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, নেপালে সোভিয়েত সামরিক প্রতিনিধি তার চীনা প্রতিপক্ষকে টেলিফোনে জানিয়েছেন, সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তারা যেন বেশি বাড়াবাড়ি না করে কারণ ‘সোভিয়েতরা বসে থাকবে না, তাদের অনেক মিসাইল রয়েছে’ (দেখুন: জ্যাক এন্ডারসন, পৃ: ৩১৬)।

১২ ডিসেম্বরের মধ্যে অবশিষ্ট মার্কিন নাগরিককে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরও সপ্তম নৌবহর তার পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যথেষ্ট দূরে থাকলেও সোভিয়েত নৌবহরও একই সমুদ্রপথে এগিয়ে আসছিল এবং এই যাত্রা অব্যাহত থাকলে কোনো একপর্যায়ে তাদের মুখোমুখি হওয়া ছিল অনিবার্য। এন্ডারসন ক্রোধের সঙ্গে লিখেছেন,

‘নিজের নাগরিকদের প্রকৃত বিপদ সম্বন্ধে অবহিত করার বদলে মার্কিন সরকার তার মিথ্যাচারের নীতি অব্যাহত রাখে।’

সৌভাগ্যবশত এই দুই আণবিক অস্ত্রবাহী নৌবহর একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার আগেই ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে বসে ও এক দিন পরে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
সোভিয়েত ও মার্কিন নৌবহর একে অপরের মুখোমুখি না হলেও সোভিয়েত বাহিনীর ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

অ্যাডমিরাল সের্গেই গরশকফ [ Sergey Georgyevich Gorshkov ]
অ্যাডমিরাল সের্গেই গরশকফ [ Sergey Georgyevich Gorshkov ]

সোভিয়েত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল সের্গেই গরশকফ, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় নৌবাহিনী নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, ভারত সরকারকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মার্কিন নৌবহরকে ভারতীয় নৌসীমানায় আসতে দেওয়া হবে না। একাত্তরে সোভিয়েত নৌবহরের সঙ্গে দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ক্রুগলিয়াকফ। তিনি দাবি করেছেন, ব্রিটিশ বিমানবাহী জাহাজ ‘ইগল’ যাতে ভারতের নৌসীমানার নিকটবর্তী না হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রুশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘স্ট্রাইক ফোর্স’ নামে এক অনুষ্ঠানে সে ঘটনার নাটকীয় বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে:

সোভিয়েত গোয়েন্দা বিভাগের জেনারেল পিওতর ইভাশুতিন খবর পেয়েছিলেন যুদ্ধের প্রথম দিনই ভারতীয় নৌসেনারা তাদের ডেস্ট্রয়ার ‘রাজপুত’-এর সাহায্যে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিন ঘায়েল করেছে। ৪ ও ৯ ডিসেম্বর তারা ১০টি যুদ্ধজাহাজ ও নৌযান তাদের পি-১৫ মিসাইলের সাহায্যে ধ্বংস করে। এ ছাড়া আরও ১২টি তেলবাহী যানে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সোভিয়েত গোয়েন্দারা খবর দিয়েছিল ব্রিটিশ নৌযান ‘ইগল’ ভারতীয় সমুদ্রসীমায় আসার চেষ্টা করতে পারে। সে কথা জানামাত্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ১০ যুদ্ধ গ্রুপের কমান্ডার ভ্লাদিমির ক্রুগলিয়াকফের নেতৃত্বে একটি নৌযুদ্ধ ইউনিট প্রেরণ করে।

Admiral of the Fleet of the Soviet Union Sergey Gorshkov - USSR
Admiral of the Fleet of the Soviet Union Sergey Gorshkov – USSR

ক্রুগলিয়াকফ:

‘সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে আমি নির্দেশ পেয়েছিলাম ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছাকাছি যেন মার্কিন নৌবহরকে আসতে না দেওয়া হয়। মার্কিন নৌবহরের পথ আটকে ছিল আমাদের ক্রুজার ও জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল সজ্জিত আণবিক সাবমেরিন। আমরা মার্কিনদের ঘিরে ফেলি ও আমাদের মিসাইল তাদের দিকে তাক করি। সে সময় সোভিয়েত মিসাইল ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে হানা দিতে সক্ষম ছিল। কাজেই, নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের মার্কিন জাহাজের যতটা সম্ভব কাছে আসতে হয়।’

‘প্রধান কমান্ডার আমাকে নির্দেশ দিলেন, মার্কিনদের দেখামাত্র আক্রমণের জন্য সাবমেরিন প্রস্তুত রাখতে। আমি সাবমেরিন উত্তোলন করামাত্রই মার্কিনরা তা দেখে ফেলে। আমরা আমেরিকান বেতারবার্তাও শুনে ফেলি। সপ্তম নৌবহরের কমান্ডারকে এক বার্তায় বলা হয়, স্যার, আমরা দেরি করে ফেলেছি। সোভিয়েতরা তাদের আণবিক সাবমেরিন ও বিপুলসংখ্যক নৌযান নিয়ে প্রস্তুত।’

 

Soviet Admiral Sergey Gorshkov - USSR
Soviet Admiral Sergey Gorshkov – USSR

অ্যাডমিরাল ক্রুগলিয়াকফের এই দাবির সমর্থনে অবশ্য ভিন্ন কোনো সাক্ষী মেলে না। বস্তুত, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর সব বিদেশির উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর পরই ব্রিটিশ নৌবহর বঙ্গোপসাগর ত্যাগ করে মালদ্বীপের কাছাকাছি সরে আসে। অন্যদিকে এন্টারপ্রাইজ ১৪ ডিসেম্বর আন্দাবার সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে ও অবস্থান গ্রহণ করে। ঢাকায় যুদ্ধ শেষ হতে তখন মাত্র আর এক দিন বাকি। সোভিয়েতরা যে দুটি নৌবহর প্রেরণ করে, তার প্রথমটি জাপানের সুুশিমা প্রণালি ত্যাগ করে ১৫ অক্টোবর।

অন্য নৌবহরটি, যা ভ্লাদিভোস্তোক থেকে রওনা হয়, তা ভারতীয় সমুদ্রসীমায় এসে পৌঁছায় ১৮ ডিসেম্বর। ফলে, এদের কারও পক্ষেই আমেরিকান বা ব্রিটিশদের সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার কোনো সুযোগ ঘটেনি। সোভিয়েত নৌযানসমূহ এগিয়ে আসছে, এ তথ্য মার্কিন ও ব্রিটিশ কমান্ডারদের অবশ্যই জানা ছিল এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছিলেন। কিন্তু মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা সে সময় কখনোই দেখা দেয়নি।

The ultimate Kiev-class heavy - USSR
The ultimate Kiev-class heavy – USSR

মার্কিন ‘গানবোট কূটনীতির’ লক্ষ্য যদি ভারতকে ভয় দেখানো ও চীনকে আশ্বস্ত করা হয়, তো ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌ-উপস্থিতির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতের প্রতি সংহতি প্রকাশ। জ্যাক এন্ডারসনের তথ্য অনুসারে, দিল্লিতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারত সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি হস্তক্ষেপের কোনো চেষ্টা করে, মস্কো তার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। পেগভ অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন পিকিং বা ওয়াশিংটন কেউই যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে না। আমেরিকা ভারত মহাসাগরে নৌবহর পাঠিয়েছে ভারতকে ভয় দেখাতে, অন্য আর কোনো কারণে নয়, এই ছিল পেগভের ব্যাখ্যা। সে ব্যাখ্যা অসত্য এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।

ওয়াশিংটন বা চীন যুদ্ধের ঝুঁকে নেবে না, এ ব্যাপারে যদি মস্কো এত নিশ্চিত হয়, তাহলে তাদের পাল্টা নৌবহর পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিল? সম্ভবত যে কারণে ওয়াশিংটন তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল, সে কারণেই। অর্থাৎ ভারত-সোভিয়েত চুক্তির কী মূল্য, তার প্রমাণ ভারতকে দেওয়া। এই প্রমাণ দিতে গিয়ে মস্কোকে যেকোনো অতিরিক্ত ব্যয়ভার বা যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না, সে বিবেচনা তাকে সক্রিয় হতে সম্ভবত আরও বেশি উৎসাহিত করেছে। বঙ্গোপসাগরের একদিকে চলছে দুই পরাশক্তির নৌ-মহড়া, অন্যদিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের শেষ চেষ্টায় রত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। লক্ষ্য পাকিস্তানকে চূড়ান্ত অবমাননা থেকে রক্ষা।

লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ একাত্তর: আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মস্কো থেকে সংকলিত, সংগ্রহীত।

আরও পড়ুন:

মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা – মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

বঙ্গোপসাগরে চার দেশের নৌ-মহড়া শুরু

 

Leave a Comment