বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর

বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর বাংলার সিপাহসালারের মৃত্যু হয়। তাঁর জায়গায় মুজফ্ফর খাঁ তুর্বর্তী ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চে সিপাহসালার নিযুক্ত হন। তুর্বত (তুর্বতে হয়দরী) খুরাসানের একটি শহর। মুজফ্ফর খাঁ সেখানকার অধিবাসী ছিলেন, হুমায়ূনের সঙ্গে ভারতে আসেন।

বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর

 

বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর

 

সিপাহসালারকে সহায়তা করার জন্য দীওয়ান, ভূ-কর সচিব, বখ্শী (সামরিক বেতন অধিকারিক), সদর (ধর্মীয় বিভাগের অধ্যক্ষ) ইত্যাদি পদে বিভিন্ন লোক নিযুক্ত করা হয়। তাঁর প্রতি আদেশ হয়, তিনি যেন ঘোড়ার উপর দাগ দেওয়ার নিয়ম কঠোরভাবে পালন করেন।

এরূপ কড়াকড়িতে বাংলা-বিহারের মুসলমান আমিরেরা সন্তুষ্ট হতে পারেন না। হাজার হলেও তাঁদের পকেটে হাত পড়ছিল। পূর্বদিকস্থ সুবাগুলিতে কর্মরত সৈনিকেরা যে বিশেষ ভাতা পেত, তাও কাটছাঁট করা হয়। আকবর হুকুম দিলেন, বাংলায় কর্মরত সৈনিকদের বেতন দ্বিগুণ করা হোক, বিহারে কর্মরতদের দেড়গুণ । খাজা মনসুর এই সময় আকবরের অর্থমন্ত্রী ছিলেন । তিনি এই বৃদ্ধির হার ক্রমশ পঞ্চাশ ও কুড়ি শতাংশ কমিয়ে দেন এবং হুকুম দেন, যে অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয়েছে তা ফেরত দিতে হবে।

সেই সঙ্গে আকবরের ধর্মীয় উদারতার ফলেও বাংলা-বিহারের মুসলমান সৈনিকেরা অসন্তুষ্ট ছিল। তখনও সেই সহিষ্ণুতার (সুলাহকুল) নীতিই ব্রত ছিল, তিনি দীন-ইলাহী ঘোষণাও করেননি, ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নেননি। তবে, সিক্রীতে মোল্লাদের কাকতাড়ুয়া বানানো চলছিলই।

ইসলামের পক্ষপাতীরা তখন আকবরের সৎ-ভ্রাতা কাবুলের শাসক মির্জা মুহম্মদ হাকিমের দিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছিল। আকবরের ধর্মীয় উদারতার তারা কত অসন্তুষ্ট ছিল, তা বোঝা যাবে এই ঘটনায় যে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সূচনায় আকবরের একদা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকা মোল্লা মুহম্মদ ইয়াজদী জৌনপুরের কাজী হিসেবে ফতোয়া দেন, এরূপ বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েজ।

এই সবের প্রভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ওয়াজির জামিল, বাবাজান কাকশাল প্রভৃতি বাংলার আমিরেরা খোলাখুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুজফ্ফর খার খারাপ লাগছিল যে বাদশাহ কৃতক নিযুক্ত দীওয়ান, বখ্শীরা তাঁর স্বাচ্ছন্দে বাধা সৃষ্টি করছে।

 

বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর

 

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আকবর এই বিদ্রোহের কথা সমস্তই অবগত হন । তিনি টোডরমল ও অন্যান্য সেনাধ্যক্ষকে বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রেরণ করেন। কিছু দোষ-ত্রুটি মার্জনা করে দেওয়ার কথাও বলেন, কিন্তু পরিণামে তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। পাটনার জায়গিরদার মাসুম খাঁ কাবুলী বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করেন । মাসুম খাঁ— আকবর যাঁকে আসী (অপরাধী) উপাধি দিয়েছিলেন তিনি মির্জা মুহম্মদ হাকিমের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছিলেন। কাবুলের সঙ্গে তাঁর রক্ত-সম্পর্ক বিদ্রোহীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

শুরুতে বিদ্রোহীদের পাল্লা ভারি ছিল । মুজফ্ফর খাঁ বিহারকে সুরক্ষিত নয় মনে করে টাডা চলে যান। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে বিদ্রোহীরা তাঁকে ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। পুরো বাদশাহী কোষাগার তাদের হস্তগত হয়। এই সময় পশ্চিমোত্তর (কাবুলের) দিক থেকে বড় বিপদের আশঙ্কা ছিল, সেজন্য আকবরের পক্ষে বাংলার দিকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ইয়াজদীর মতো মোল্লাদের প্রচারের ফলে বিক্ষুব্ধ সমস্ত মুসলমান সৈনিক ও আমির সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

আকবর যথার্থই বুঝেছিলেন— পশ্চিমোত্তরের বিপদকে ঠেকাতে না পারলে দিল্লী-আগরা হাতছাড়া হয়ে যাবে, তা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হবে । অপরদিকে কাবুল থেকে আসা বিপদকে যদি প্রতিহত করা যায়, তাহলে পূর্বের বিদ্রোহ দমন করতে বিশেষ অসুবিধে হবে না। তিনি পাঞ্জাব ও কাবুলের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন ।

তবে পূর্বদিকের জন্য তিনি টোডরমলের মতো কুশলী সেনানায়ক পেয়েছিলেন । মুঙ্গের দুর্গে টোডরমল চার মাস ধরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন, কিন্তু তিনি এমন উত্তম বন্দোবস্ত করেছিলেন যে অবরোধকারীদের নিজেদেরকেই মুঙ্গের থেকে সরে পড়তে হয়। টোডরমল বাংলার দ্বার তেলিয়াঘাট পুনরায় দখন করে বিদ্রোহীদের মারাত্মকভাবে পরাজিত করেন।

আকবর তাঁর প্রিয় দুগ্ধ-ভ্রাতা মির্জা আজিজ কোকাকে বাংলার সিপাহসালার নিযুক্ত করলেন। তিনি অত্যন্ত দাম্ভিক ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, সেজন্য দীর্ঘকাল তাঁকে উপেক্ষা করা হয়। আকবর তাঁকে পাঁচহাজারী মনসব ও খানে-আজম উপাধি দিয়ে এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।

রাজপুতানার যুদ্ধ থেকে শাহবাজ খাকে ডেকে এনে কোকাকে সাহায্য করার জন্য প্রেরণ করেন। আইনের কড়াকড়ি করার জন্য অর্থমন্ত্রী শাহ মনসুরের দুর্নাম রটেছিল, সেজন্য তাঁকে অপসারিত করে ওয়াজির খাঁকে (গুজরাতের গভর্নর আসফ খার ভ্রাতা) অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।

 

বাংলা বিহারে ফের বিদ্রোহ | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর

 

শাহবাজ খাঁ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দর জানুয়ারিতে সুলতানপুর বেলহরিতে (অযোধ্যা থেকে পঁচিশ ক্রোশ দূরে জৌনপুর ও অযোধ্যার মধ্যে অবস্থিত) বিদ্রোহীদের দারুণভাবে পরাজিত করেন। বাদশাহী সেনার পাল্লা ভারি হয়ে ওঠে এবং ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলা-বিহারের বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন হয়।

ওড়িশ্যা অধিকার করার উদ্দেশ্য কিছুদিনের জন্য পরিত্যাগ করা হয়। আকবর অনেক বিদ্রোহীর প্রতিই অনুগ্রহ-উদারতা দেখিয়েছিলেন, যদিও বিদ্রোহ ছড়ানোর পাণ্ডা মোল্লাদের তিনি রেহাই দেননি। জৌনপুরের কাজী মোল্লা আহমদ ইয়াজদী তথা বাংলার কাজীকে নৌকোয় চড়িয়ে যমুনায় জলমগ্ন করে বেহেশতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment