বিক্রমাদিত্য হেমচন্দ্ৰ , ইসলামশাহের মৃত্যুর পর গৃহবিবাদ শুরু হয়। তাঁর নাবালক পুত্রকে হত্যা করে শেরশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র আদিলশাহ সিংহাসন দখল করেন। সেটা হেমচন্দ্রের পছন্দ ছিল না, কিন্তু তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভবও ছিল না। পাঠানদের নিজেদের মধ্যে কলহে যে- দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাতে তিনি আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। হেমচন্দ্রের যোগ্যতা লক্ষ্য করে আদিলশাহ তাঁকে নিজের মন্ত্রী ও সেনাপতি পদে নিয়োগ করেন।
বিক্রমাদিত্য হেমচন্দ্ৰ বা হেমচন্দ্ৰ হেমু ও আকবর
পাঠানেরা গৃহবিবাদে লিপ্ত, সেজন্য প্রথমে বিহারকে সামলানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে হেমচন্দ্রের । হাজার হলেও তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান অংশই শূর বংশের সেনা। তাঁর অনুপস্থিতির কারণে দিল্লী অরক্ষিত হয়ে পড়ে এবং সেই সুযোগে হুমায়ূন আক্রমণ করে সেখানে নিজের অধিকার বলবৎ করেন। এই ঘটনার ছয় মাস পরে (১৫৫৫ খ্রিঃ) হুমায়ূন দিল্লীতে পাঠাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তাঁর তেরো বছর বয়স্ক পুত্র আকবর বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে সিংহাসনে আরূঢ় হন। হেমু নিজের পরাক্রান্তশালী সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লীর দিকে ধাবিত হলে মোগল সেনারা পলায়নই শ্রেয়স্কর বিবেচনা করে ।
হেমচন্দ্র উপলব্ধি করেন, যে বংশের জন্য তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা এত গুরুভার দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার উপযুক্ত নন। কেবল সমস্ত শূরী নয়, বরং সমস্ত পাঠানই তখন শাহানশাহ হতে লালায়িত। এমতাবস্থায় সেনাবাহিনীর মনোবল ক্ষুণ্ণ হওয়াই স্বাভাবিক।
সেনাপতিদের এবং সৈন্যদের উপরোধে হেমচন্দ্র ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমাদিত্য নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। পিথৌরা ও জয়চন্দের আমলে হারানো সিংহাসন একজন হিন্দু শাসক লাভ করে হেমচন্দ্রের মাধ্যমে। তখনও মাগলশক্তির উচ্ছেদ হয়নি। যদি পাঠানদের মধ্যে শেরশাহ আমলের ঐক্য বজায় থাকত, তাহলে হেমচন্দ্রকে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হতো না।
তাঁর উপর পাঠানদের আস্থা ছিল, সেজন্য তাঁর পতাকা তলে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল তারা। একের পর এক যুদ্ধে মোগল সেনাদের পরাজিত করলেন তিনি। তুগলকাবাদে হেমুর সাফল্য কম ছিল না। একজন লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর সঙ্গে ছিল বড় বড় দলে বিভক্ত যুদ্ধবাজ দক্ষ আফগান এবং যুদ্ধের ভারি সরঞ্জাম, রাজপুত, পাঠান ও মেওয়াতিদের পঞ্চাশ হাজার যোদ্ধার শক্ত সমর্থ বাহিনী, এক হাজার হাতি, একান্নটি দুর্গ-ধ্বংসকারী কামান, পাঁচ শত নৌকা-ডোঙা, জম্বুরক। এই বিশাল বাহিনী অগ্রসর হতে হতে, যেখানে যেখানে মুসলমান শাসনকর্তারা অধিষ্ঠিত ছিল, সকলকে পদপিষ্ট করে দিল্লীতে গিয়ে পৌছাল ।
চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল পানিপথের প্রান্তরে। সেখানে আকবরের সেনাপতি খানেজমান আলী কুল্লি খাঁ নিজের সৈন্যবাহিনী নিয়ে দণ্ডায়মান ছিলেন। এই যুদ্ধ সম্পর্কে শামশুল্- উমা মওলানা আজাদ তাঁর ‘দরবার-আকবরী’ গ্রন্থে লিখেছেন— “হেমু তাঁর হাওয়াই নামক হাতির পিঠে চড়ে সেনাবাহিনীর মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। অবশেষে রণক্ষেত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর হাতি নিয়ে ধাবিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে কালো পাহাড়গুলো যেন নড়ে উঠল এবং কালো মেঘরাশির মতো ধেয়ে এল।
আকবরের বেতনভুক সৈন্যদের আন্তরিকতার অভাব ছিল, তারা পালাতে শুরু করল, কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনা মাথায় রেখে। কালো জলপ্রবাহকে তারা এগিয়ে আসার পথ করে দিল মাত্র। যুদ্ধরত অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে থাকে তারা। যুদ্ধকালে সৈন্যদের অভিমুখ এবং নদীর জলপ্রবাহ একই নিয়ম মেনে চলে, যে পাশে দিক পরিবর্তন করে সেই দিকেই প্রবাহিত হতে থাকে। শত্রুপক্ষের হস্তি-বাহিনী বাদশাহের সৈন্যবাহিনীকে একপাশে ঠেলে নিয়ে গেল ।
খানেজমান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দূরবীন দিয়ে চারদিক লক্ষ্য করছিলেন। তিনি দেখলেন, সম্মুখে যে কালো ঘনঘোর ঝটিকার সৃষ্টি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ দূরীভূত। তখন হেমু সৈন্যবাহিনীর মধ্যখানে। হঠাৎ বাদশাহের সৈন্যরা প্রবল গর্জনে আক্রমণ করল। শত্রুরা হাতির বেষ্টনীর মধ্যে। তাদের চারদিকে বীর পাঠানদের দঙ্গল। হেমু পুনরায় আকবরের সৈন্যদের পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তুর্কিরা অবিরাম শর বর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে। ওদিকে হাতির দল শেকল ঝনঝন করতে করতে শুঁড়ে তরোয়াল নিয়ে ঘোরাচ্ছে এবং এগিয়ে আসছে।…
সাহস ও বিচক্ষণতায় হাতিদের আক্রমণ প্রতিহত করা হল । তুর্কিরা প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে চলল । তারা যখন দেখল, হাতি দেখে ঘোড়াগুলি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে, তখন তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল এবং তরোয়াল আস্ফালন করতে করতে শত্রুসেনার মধ্যে ঢুকে পড়ল।
তাদের অবিরাম তীরবর্ষণে কালো রাক্ষসেরা পিছন ফিরে হটতে লাগল, দেখতে দেখতে কালো পাহাড়গুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সঙ্ঘর্ষ। হেমুর সাহস ছিল প্রশংসনীয়। দাঁড়িপাল্লার কারবারী ডাল- রুটি খাওয়া মানুষটা হাতির হাওদায় খালি মাথায় দাঁড়িয়ে তখনও সৈন্যদের উৎসাহিত করে চলেছেন ।
জয়-পরাজয় ঈশ্বরের হাতে। … শাদীখান পাঠান হেমুর সেনাপতিদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন, তিনি নিহত হয়ে ধরাশায়ী হলেন। সৈন্যরা শস্যদানার মতো চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। তবুও হেমু সাহস হারাননি। তিনি হাতির পিঠে চড়ে চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন।
সেনাপতিদের নাম ধরে ধরে ডাকছিলেন যাতে তাঁরা ছত্রভঙ্গ সৈন্যদের পুনরায় জোটবদ্ধ করেন। এমন সময় এক মৃত্যুবাণ তাঁর চোখে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়। তিনি হাত দিয়ে তীর টেনে বের করে রুমালে চোখ বাঁধেন। ক্ষতস্থানের তীব্র যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি এবং অচৈতন্য হয়ে হাওদা থেকে পড়ে যান। সেই দৃশ্য দেখে তাঁর অনুগামীরা সাহস হারিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।”
পানিপথ প্রান্তরে আকবর বিজয়ী হলেন। খানেজমান ভারতে মোগল শাসন- ব্যবস্থার পত্তন করলেন। হিজরী ৯৬৪ সনের ২রা মহরম (৬ নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রিঃ) শুক্রবারে সংঘটিত পানিপথের যুদ্ধের দিনটি ভারতের ভাগ্য পরিবর্তনের দিন।
সৈন্যরা পালিয়ে গেলে তুর্কিরা হেমচন্দ্রের হাতি ঘিরে ফেলল। অতঃপর তাঁকে বন্দি করে আকবরের সম্মুখে উপস্থাপন করা হল। কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর মর্যাদার পক্ষে হানিকর বিবেচনা করলেন তিনি। তাঁর কেবল দুঃখ হচ্ছিল, কেন তাঁকে জীবিতাবস্থায় এখানে আসতে হল ।
বৈরাম খাঁ আকবরকে বললেন— আপনি স্বহস্তে এই বিধর্মীকে হত্যা করে ‘গাজী’৬ উপাধি ধারণ করুন। আকবর মরণাপন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে সম্মত হলেন না। যদি সে-সময় আকবর চতুর্দশ বর্ষীয় বালক না হতেন, যদি তিনি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব হতেন, তাহলে তিনি হেমচন্দ্রকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করতেন। তাঁর নবরত্নের এক রত্ন হতেন হেমচন্দ্ৰ ৷ মুসলমান ঐতিহাসিকগণ হেমচন্দ্রকে মুদি (বানিয়া/বেনে) বলেছেন। মওলানা আজাদের মতে, তিনি ছিলেন চূসর বানিয়া।
চূসর বানিয়ারা আজকাল নিজেদের ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে থাকেন। সমকালীন এবং আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের আমলের ঐতিহাসিকগণ হেমচন্দ্রের জন্মস্থান সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি পরবর্তী ঐতিহাসিকেরা তাঁকে পশ্চিমেরই কোনো এক বানিয়া বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ও বিহারের রওনিয়ার বৈশ্যদের মধ্যে অন্য এক বংশপরম্পরা দেখা যায়, যাদের খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। হেমচন্দ্র সেই বংশেরই রওনিয়ার ছিলেন, সহসরামের নিকটস্থ কোনো স্থানের অধিবাসী ছিলেন এব নিজের যোগ্যতায় এত উচ্চপদে আরোহণ করেছিলেন।
সেখানকার লোকজনকে শেরশাহ ও তাঁর বংশধরদের কাছে বেশি বিশ্বস্ত মনে হওয়াই স্বাভাবিক । হেমচন্দ্র ডাল রুটি খাওয়া মুদি ছিলেন না, রওনিয়াররা এখনও মাছ-মাংসের ভক্ত, আর পূর্বেই উল্লে করেছি, সার্থবাহ হওয়ার কারণে তাদের ছিল সৈনিকের উপযোগী সাহস। ভোজপুর এলাকায় সব জাতির যুবকেরাই লাঠি ও সাহসে সেরা।
মুসলিম সাম্যবাদী
ভারতে মুসলিম শাসন হিন্দু শাসনের মতোই চরম স্বেচ্ছাচারী ছিল । একই রকম নিষ্ঠুর দাসপ্রথা মুসলিম শাসনেও অবারিত ছিল। অধিকাংশ প্রজার জন্যই সামাজিক ন্যায় বিচার উপেক্ষিত হতো। মানুষ মন-মস্তিষ্ক দিয়ে অবশ্যই অনুভব করত সব কিছু, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবার মতো হিন্দুদের মধ্যে থেকে কাউকেই এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি। এই সময়কালে কবীর এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ সন্তের আবির্ভাব হয়, তাঁরা খানিকটা শীতল বায়ু সঞ্চালনের চেষ্টা করেছিলেন মাত্র, তবে তা রূঢ় জাগতিক নয়, স্বৰ্গীয়।
জাগতিক শীতল বায়ু সঞ্চালনের প্রয়াস ছিল খুবই বিপজ্জনক, মূল্যস্বরূপ মুণ্ডটাই বাজি রাখতে হতো, কে তাতে সম্মত হবে? নিজেদের মতবাদের স্বার্থে মুসলিম সন্তেরা মৃত্যু পণ করেছিলেন, আমাদের সম্মুখে রয়েছে সরমাদের দৃষ্টান্ত। কেবল তাই নয়, আর্থিক বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁদের কেউ কেউ চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তাতে প্রাণ বিসর্জন কিংবা ততোধিক নিপীড়ন সহ্য করা ব্যতীত কিছুই জোটেনি। তাঁদের আত্মত্যাগ মানুষ ভুলে গেছে, ইতিহাসও কি তা ভুলে যাবে? এরকম তিনজন মহাপুরুষ রয়েছে আমাদের সামনে— সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী, মিয়া আব্দুল্লা নিয়াজী এবং শেখ আল্লাঈ ।
আরও দেখুনঃ