মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়ে বারবার আলোচনা হয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর প্রথম সহ সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। লেখাটি বহু জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস এর চতুর্থ খণ্ড ( চতুর্থ পর্ব) তে যুক্ত করা হয়েছে। নিচে লেখাটি হুবহু তুলে দেয়া হল:
Table of Contents
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা
উপক্রমণিকা:
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ৩০ লক্ষ আবালবৃদ্ধ বর্নিতাকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আর ২ লক্ষ নারীকে দিতে হয় সম্ভ্রম। দেশবাসীকে পরিচালনা করতে হয় উদ্দীপ্ত ও সুদৃঢ় ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে পরিচালিত এক মহান জনযুদ্ধ। হানাদার-দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে চালাতে হয় বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগ্রাম। সে সংগ্রাম হয়ে ওঠে সমগ্র জাতির মুক্তিযুদ্ধ।
এই মুক্তিযুদ্ধে এ ভূখণ্ডের মানুষের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সক্রিয় সমর্থন-সহযোগিতা দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একইসঙ্গে ভারতকে সাহস জোগায়, তার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিবাচক পরিণতি লাভ করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের নানাবিধ সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে বিকশিত করে অনিবার্য পরিণতির দিকে অগ্রসর করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা:
মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম, সেটিই হলো ‘মুক্তিসংগ্রাম’। মুক্তিসংগ্রামের ধারায় যে যুদ্ধ তা ই হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ । মুক্তির সে প্রত্যাশা হতে পারে জাতীয় মুক্তির জন্য এবং হতে পারে অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির জন্যও। অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির সাথে সম্পর্কিত বিষয় হলো সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি। জাতীয় মুক্তির বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত প্রসঙ্গটি হলো ঔপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল থেকে মুক্তির প্রশ্ন। মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে জাতীয় মুক্তির বিষয় ও অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির বিষয় এই দুই বিষয়ের মধ্যে একটি স্বাভাবিক আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই দুই উপাদানই প্রযুক্ত ছিল। তবে, তা ছিল মূলত জাতীয় মুক্তির জন্য বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রাম।
জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পটভূমিতে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারা সূচিত হয়। এদিকে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ‘অসম বিকাশের সূত্রের কারণে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো অধিক সম্পদশালী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। দুর্বল জাতিগুলোর উপর তারা জাতিগত শোষণ চালানোর সুযোগ পায় এবং এভাবে আরো সম্পদশালী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এরূপ জাতিগত শোষণের ক্রমপ্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র অর্জন করে।
বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জন্ম নেয় একদিকে কেন্দ্রস্থিত উন্নত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং অন্যদিকে এই ব্যবস্থার প্রাপ্তস্থিত অবস্থানে নিক্ষিপ্ত হয় অসংখ্য রাষ্ট্র। তাদের উপর জাতিগত শোষণ ঔপনিবেশিক আকার গ্রহণ করে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশসহ গোটা অবিভক্ত ভারতবর্ষ এই সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকা পড়ে যায়।
পরাধীনতার এই শৃঙ্খল ভাঙার প্রয়াসে ভারতব্যাপী যে সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাঙালি জাতি সেই সংগ্রামের অন্যতম শরিক হিসেবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে লড়াই করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সেই সংগ্রাম যথার্থভাবেই বাঙালির সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের একটি বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেই পর্বের মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ও অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে বাংলার অগ্রণী অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়ার কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করলেও, সেই ‘স্বাধীনতার’ ভেতর দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকা পড়ে যায়। ভৌগোলিক সংযোগবিহীন পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলাকে জুড়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অবৈজ্ঞানিকভাবে এক কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। শ্রেণি শোষণ, জাতিগত শোষণ, বৈষম্য, জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন চাপিয়ে দেওয়া হয় পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর। তার বিরুদ্ধেই সংগঠিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল নয় মাসের ‘সামরিক অভিযান’ ছিল না। তা কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের ধারাবাহিক বহুমাত্রিক লড়াইয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভিন্নতর একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী আদর্শের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। সব ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক শোষণ-বৈষম্য-আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। সেজন্য মতাদর্শিক লড়াইয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে বহুদিন ধরে তীব্র রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক লড়াই করতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিবেচিত হয়েছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে। সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রচলিত প্রতিক্রিয়াশীল সমাজকে নাকচ করে দিয়ে নতুন চিন্তা-দর্শনের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ধারাকে বিকশিত করার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজের প্রেরণা জোগায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্রের ধারায় অগ্রসর হওয়া। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চার ভিত্তি হিসেবে তাই নির্ধারিত হয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র।
আদর্শিক কারণেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা আর সমাজতন্ত্রমুখীনতা ছিল দীর্ঘদিনের গণসংগ্রামের ধারায় গড়ে ওঠা একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, কেবল বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের কাছেই সমাজতন্ত্রের পথ হলো ‘মুক্তি’ লাভের পথ হিসেবে বিবেচিত। সমাজতন্ত্রের পীঠস্থান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই, আদর্শিক অবস্থানই পূর্ব বাংলার মানুষকে সমাজতন্ত্রের আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। তারা হয়ে ওঠে সোভিয়েতমুখী। মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী উপলব্ধি করলেই বোঝা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধন ছিল স্বাভাবিক ও অপরিহার্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন : জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বাভাবিক মিত্র
১৯১৭ সালে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা একটি বড় ধরনের ভাঙন ঘটায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশ্বের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর মধ্যে তুলনামূলক দুর্বলতম গ্রন্থি। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি ও সমাজ ছিল অগ্রসর ইউরোপীয় দেশসমূহ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পশ্চাৎপদ। সে দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তা অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর তোলপাড় করা প্রভাব সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে তার থেকে অগ্রসর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তথা সমাজতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়।
শ্রেণি-শোষণের অবসানের পথ নির্দেশের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন একই সাথে জাতিগত শোষণ-মুক্তির ঝান্ডাও সমুন্নত করে। জার-শাসিত রাশিয়ার নিপীড়িত জাতিসমূহ জাতীয় মুক্তির স্বাদ অনুভব করতে শুরু করে। জাতিসমূহের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাষ্ট্র এক নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায় সূচনা করে। সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করার এবং দেশে দেশে দৃঢ়ভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
শুধু ঘোষণা প্রদান করেই সে ক্ষান্ত থাকেনি। সেই অঙ্গীকার অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ় ও নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতেও শুরু করে। এসব কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের কাছে হৃদকম্পনের কারণ এবং পরাধীন জাতিসমূহের কাছে প্রেরণা ও ভরসার উৎস। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বাভাবিক মিত্র’।
আদর্শিক অবস্থানের কারণেই ভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ এবং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মিত্র ও ভরসার শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের পাশে অবস্থান নেয়। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিপীড়িত জাতি পরিচালিত মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বতোভাবে সহায়তা করতে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে নির্মমভাবে শোষণ করার সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার কারণে হুমকির মধ্যে পড়ে।
সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। সাম্রাজ্যবাদের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের এই বিরোধ সংকীর্ণ স্বার্থগত কোনো বিষয় থেকে উৎসারিত ছিল না, এটা ছিল এক আদর্শিক লড়াই। ‘দুনিয়ার মজদুর ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও’- এই বজ্রনিনাদ নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একের পর এক দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কবির ভাষায়, যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম সেখানেই কমরেড লেনিন’। সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের সংগ্রামরত মানুষের অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক বন্ধু। এই বন্ধুত্বের ভিত্তি ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রের আদর্শগত অঙ্গীকার। সমাজতন্ত্রের আদর্শের কারণেই সোভিয়েত ছিল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বাভাবিক মিত্র। তাই, সোভিয়েত ইউনিয়ন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও মিত্র হয়ে উঠবে তা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক এবং সেটিই ঘটেছিল।
বন্ধুত্বের বন্ধনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেশ পুরনো। এ ভূখণ্ডের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব সময় সমর্থন দিয়ে তাকে নানাভাবে পরিপক্ব করে তুলতে আগাগোড়া সহায়তা করেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তির জন্য ভারতব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর নবপ্রেরণায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সোভিয়েতের মুক্তিবার্তা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে নতুন জোয়ার এনে দেয়। গত শতাব্দীর বিশের দশকেই বাংলাদেশেও তার প্রভাব এসে লাগতে শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীরা দলে দলে সোভিয়েতপন্থী হয়ে উঠতে থাকে।
১৯৪৭-এ দেশভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেই জাতীয় মুক্তি ও শোষণ মুক্তির সমঅভিমুখীন ধারা ও স্বাভাবিক নৈকট্য অব্যাহত থাকে। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নতুন পর্যায়ের সংগ্রামে তা আরো নতুন মাত্রা লাভ করে। নিজ দেশে ও সারা দুনিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল সাফল্য ও আদর্শনিষ্ঠ ভূমিকা, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের প্রেরণা ও উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র, জাতীয় অধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতির জন্য প্রতিটি সংগ্রামে জনগণের মনের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি মিত্র হিসেবে দৃঢ় অবস্থান অধিকার করে নেয়। শুধু রাজনীতি নয়, সমাজ-সংস্কৃতির সমগ্র প্রগতিমুখীন কর্মকাণ্ডে সে অনবদ্য প্রভাব ও অবদান রেখে চলে।
বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে চাঙা রাখার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ৫০ ও ‘৬০-এর দশক থেকেই সোভিয়েত ধ্রুপদী ও সমকালীন সাহিত্য প্রগতি প্রকাশনা থেকে বাংলায় অনূদিত হতে থাকে। সেসব প্রকাশনার বই এদেশের ব্যাপক সংখ্যক পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। প্রগতিবাদী ধ্যান ধারণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর ফলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম বর্ধিত শক্তি অর্জন করে। ঢাকায় সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ‘উদয়ন’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা সেখান থেকে প্রকাশিত হতে থাকে।
বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অগ্রসর ও সক্রিয় অংশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল। এই অংশের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ৬৭ সালে এদেশে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী পালিত হয়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তা গতিবেগ সঞ্চার করে। বাংলাদেশের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্ব ছিল নিপীড়িত জাতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এক আদর্শিক বন্ধন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই বন্ধুত্বকে আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু বহু দূরের সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
রাজনীতির হিসাব-নিকাশের জন্য নয়, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে তার আদর্শগত অবস্থানের কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেদিন দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত হতো ‘লেনিনীয়’ পথে। শান্তি, জাতীয় মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, ন্যায়বিচার, বন্ধুত্বই যে পথের মর্মকথা। নীতিগত অবস্থানের কারণেই তাই বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন একাত্তরে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার সোভিয়েত ইউনিয়ন
২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও ট্যাঙ্ক নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে, এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যে কয়টি দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাৎক্ষণিক সোচ্চার প্রতিবাদ জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অন্যতম।
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। আলোচনা ভেঙে দিয়ে ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে ইসলামাবাদে ফিরে যাবার পর প্রথম সুযোগেই এবং বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার ৫৬ ঘণ্টার মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের একটি নিন্দা বার্তা নিয়ে ২৮ মার্চ ইসলামাবাদে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত।
ঢাকায় গণহত্যার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করে, এ নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়। কিন্তু গণহত্যার সরাসরি নিন্দা করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে। ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে কড়া ভাষায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি নিম্নরূপ
“মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ঢাকার আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর এবং সামরিক প্রশাসন চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বন প্রয়োজন মনে করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে যে সামরিক বলপ্রয়োগ করেছে সে সংক্রান্ত খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।
এই ঘটনার ফলে পাকিস্তানের অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখ-কষ্টের খবরে সোভিয়েতের জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি ও নির্যাতন করায়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এই নেতারা সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সন্দেহাতীত সমর্থন লাভ করেছিলেন। সোভিয়েত জনগণ সর্বদাই পাকিস্তানের মানুষের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনা করেছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের জটিল সমস্যার সমাধানে তাদের সফলতায় আনন্দিত হয়েছে।
পাকিস্তানের জনগণের কঠিন পরীক্ষার দিনে খাঁটি বন্ধু হিসেবে আমরা দু-একটি কথা না বলে পারি না। আমরা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানে বর্তমানে যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, বলপ্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধান করা যায় এবং করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে দমননীতি ও রক্তপাত যদি চলতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে সমস্যার সমাধান আরও কঠিন হয়ে উঠবে এবং তাতে পাকিস্তানের সব মানুষের মৌল স্বার্থেই বিরাট ক্ষতি হবে।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট মহাশয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ (কর্তৃপক্ষ) সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে আপনাকে কিছু বলা, আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের সব মানুষের স্বার্থ এবং সে অঞ্চলের শান্তি রক্ষার স্বার্থ এর ফলে রক্ষিত হবে। উদ্ভূত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানকে সমগ্র সোভিয়েত জনগণ সন্তোষের সঙ্গে গ্রহণ করবে।
আপনাকে আবেদন জানানোর সম আমরা মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণার লিপিবদ্ধ সর্বজনস্বীকৃত মানবিক নীতির দ্বারা এবং পাকিস্তানের বন্ধু জনগণের কল্যাণের জন্য উদ্বেগের দ্বারা পরিচালিত হয়েছি।
প্রেসিডেন্ট মহাশয়, আপনাকে এই অনুরোধ জানাতে আমরা কোন নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছি, আশা করি আপনি তা সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন। আমাদের একান্ত কামনা যে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।”
ক্রেমলিন, মস্কো, ২ এপ্রিল ১৯৭১; চিঠিটি ৪ এপ্রিল ১৯৭১ প্রাভদায় প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের গণহত্যা চালানোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সময়োপযোগী ভূমিকা, পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা বাংলাদেশের জনগণের মনোবল চাঙা করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাষ্ট্রটি ক্রমাগত তার অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে পালন করে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় : পাকিস্তানের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূরত্ব বৃদ্ধি
স্নায়ুযুদ্ধের কালে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর, সোভিয়েত ইউনিয়নের চেষ্টায়ই ভারত ও পাকিস্তানের মে ‘তাসখন্দ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তান মার্কিন শিবিরের অধিকতর ঘনিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক প্রয়াস ছিল পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহীত সামরিক কৌশল থেকে ফিরিয়ে এনে সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে উৎসাহিত করা।
প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চের পরই সোভিয়েত ইউনিয়নের মনোভাব বদলে যেতে শুরু করে। পাকিস্তান সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চীন সফর তথা চীন-মার্কিন গোপন আঁতাত সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই অবস্থানকে আরো দৃঢ় করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্যমূলক নীতি থেকে সরে আসে।
১২ এপ্রিল ১৯৭১ ক্রেমলিনে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জামশেদ মার্কারকে ডেকে পাঠান, উপমহাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পাঠানো এক বার্তায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন সংকটের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ‘আইনসম্মত অভিপ্রায়’ পূরণের ওপর। স্পষ্টতই, এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি কূটনৈতিক ভাষায় প্রদত্ত একটি আহ্বান।
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জামশেদ মার্কার ১৯৭১ সালের ২২ জুন ক্রেমলিনে প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কোসিগিন মার্কারকে বলেন—
“পাকিস্তানের কৃষক অত্যন্ত রক্ষণশীল, নিজের জমি ও গ্রাম তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তা ছাড়া সে খুব ভালো করেই জানে, ভারত কোনো স্বর্গরাজ্য নয়। তার পরও নিজের জীবনের হুমকি আছে জেনেই, তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হয়েছে।। আপনারা কীভাবে বিশ্বের মানুষের সহানুভূতি আশা করেন, যখন লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে এবং পালানোর সময় গুলিতে নিহত হচ্ছে? আপনার প্রেসিডেন্ট শান্তির পক্ষে অনেক কথা বলেছেন, তা সত্ত্বেও মানুষ ভারতে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। ভারতে খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা রয়েছে, তারপরও তারা সেখানে ছুটছে। এমন একটা অবস্থাকে কি স্বাভাবিক বলা যেতে পারে? এর অর্থ হলো, হয়। কর্তৃপক্ষ অবস্থা সামাল দিতে পারছে না, নয়তো সত্য গোপন করছে। আমাদের দেশের মানুষ ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।”
সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অপর দিকে পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ সম্পন্ন করে। পাকিস্তানের আগ্রাসী মনোভাব ও তৎপরতার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাকিস্তানের দূরত্ব ক্রমশ আরো বৃদ্ধি পায় ।
শরণার্থীদের পাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন:
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি আবালবৃদ্ধবনিতা ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। ভারতের সরকার ও জনগণ সাধ্যমতো আশ্রয় ও সাহায্য দেয়। শরণার্থীদের জন্য খাদ্যশস্য, পোশাক, ঔষধসহ জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিজেরা সাহায্য করার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ত্রাণকাজে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা করে।
জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিমানযোগে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির থেকে শরণার্থীদের মধ্যপ্রদেশের মানা’য় স্থাপিত অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে সাহায্য করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শরণার্থীদের জন্য ঔষধসহ নানা জরুরি সামগ্রী পাঠানো হয়। সে দেশের বিভিন্ন গণসংগঠন পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জন্য সহায়তা কার্যক্রমকে সে দেশের ব্যাপক মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গণসংগঠন:
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গণসংগঠন প্রচারাভিযান পরিচালনা করে। প্রচারাভিযানে শামিল হয় সোভিয়েত শান্তি কমিটি, ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, সোভিয়েত-আফ্রো গণসংহতি কমিটি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, নারী কমিটি, রেডক্রস, শিশুদের সংগঠন পাইওনিয়ার অর্গানাইজেশন, যুব সংগঠন কমসোমলস্কায়া প্রভৃতি গণসংগঠনসমূহ।
সোভিয়েত শান্তি কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়—
“শান্তি রক্ষার স্বার্থে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা, আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ভূত সমস্যাবলির রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ অভ্যাবশ্যক।”
সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়নসমূহের এক বিবৃতিতে বলা হয়
“পাকিস্তানের শ্রমজীবী জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অধিকারসমূহের জন্য, উপনিবেশবাদীদের জোয়ালের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এবং সমাজ প্রগতির জন্য তাদের সংগ্রামে, আন্তর্জাতিক সংহতির প্রতি বিশ্বস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ট্রেড ইউনিয়নসমূহ সর্বদাই পাকিস্তানের শ্রমজীবী জনগণের পক্ষ নিয়েছে।”
সোভিয়েত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়—
“বিশ্বজনমতের প্রতি কর্ণপাত করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা, অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক উপায়ে সমস্যাটির একটি ন্যায্য সমাধানের খুঁজে বের করতে হবে, আর সেটাই হবে আফ্রো এশীয় গণসংহতির উদ্দেশ্য ও নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।”
পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করে ৪ অক্টোবর ১৯৭১ সোভিয়েত নারী কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়—
“পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিশোধস্পৃহা, মানবাধিকার পায়ে মাড়ানো ও গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি লঙ্ঘনের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ নিজ ভিটা ছেড়ে অন্য দেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে। গৃহহীন ও জীবিকা অর্জনের উপায়হীন এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে অনাহার ও মহামারীতে মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন করে হতাশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বহু প্রগতিশীল ব্যক্তির ওপরেও প্রতিহিংসামূলক উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে।”
সোভিয়েত রেডক্রস এক বিবৃতিতে মানবিক নীতিসমূহ অনুসরণ করে ক্রমাগত উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা ও মানবিক নৈতিকতার সর্বজনস্বীকৃত মানগুলিকে নগ্নভাবে লঙ্ঘন করার জন্য ক্ষুব্ধ ঘৃণা প্রকাশ করে।
সোভিয়েত যুব সংগঠনগুলির কমিটি ও ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে আইনসম্মত অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ও যুব সমাজের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করা হয়।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মানবাধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের মানবিক মূলনীতির স্থুল লঙ্ঘনের তীব্র প্রতিবাদ জানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিসংঘ বিষয়ক সমিতি।
৩ অক্টোবর মস্কোর তুরুরূপ ময়দাকলের শ্রমিক ও অফিস কর্মচারীরা পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়নের প্রতিবাদে এক সভার আয়োজন করেন।
৫ অক্টোবর মস্কোর কিরভ ডায়নামো ইলেকট্রিক মেশিন বিল্ডিং প্ল্যান্টে শ্রমিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়
“পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের তৎপরতাকে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের আইনসম্মত ও মানবিক অধিকারের ওপর নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ বলে মনে করি।”
লেনিনগ্রাদ ক্রাস নোগভারদেয়েস ফার্ম-এর শ্রমিকদের এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়—
“আমরা দাবি জানাচ্ছি যে, পাকিস্তান সরকার শান্তিকামী জনগণের ওপর যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছে তা বন্ধ করুক, যাতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন।”
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সভা ও সংহতি সমাবেশ চলতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্র-পত্রিকায় প্রচারণা:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএসইউ)-এর মুখপত্র ‘প্রাভদা’য় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদ, নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
১ জুন ১৯৭১ প্রাভদা মন্তব্য করে
“পূর্ব পাকিস্তানে অব্যাহত রক্তপাতের ফলে শুধু যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে তা নয়, সমগ্র এশিয়ার তথা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।”
১৬ অক্টোবর ১৯৭১ প্রাভদার রাজনৈতিক ভাষ্যকার স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন
“উপমহাদেশে উত্তেজনার কারণ এবং এই উত্তেজনা দ্রুত বৃদ্ধির সমস্ত দোষ সর্বতোভাবেই পাকিস্তানের একার।”
২৪ অক্টোবর ১৯৭১ প্রাভদায় আই শ্ছেদ্রোভর ‘গঙ্গাতীরে ট্রাজেডি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। রচনাটিতে পশ্চিম বাংলায় পরিচালিত শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে—
“একটি ব্যারাকের সামনে শরণার্থীদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা শুরু করলাম। ওখানে শীর্ণকায় ও দুর্বল শিশুদের অতিরিক্ত খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছিল। শরণার্থীরা কী রূপ কঠিন অবস্থায় ভারতে এসে পৌঁছেছেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। দু সপ্তাহ, তিন সপ্তাহও লেগেছে অনেকের ভারতে এসে পৌঁছুতে। খুলনার একজন প্রাক্তন কলেজের ছাত্র আমায় বললেন, ওঁরা সাত হাজার মানুষ একত্রে ভারতের সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। পৌঁছতে লেগেছিল চার দিন, চার রাত। কুড়িজনের বেশি সঙ্গী পথেই মারা যান। অপর কিছু ব্যক্তিকে শিবির হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তাঁদের উপর শারীরিক, মানসিক চাপ পড়েছিল প্রচণ্ড।
……শিবির হাসপাতালে ব্যারাকগুলির দৃশ্য ভয়াবহ। ধোঁয়া আবর্জনায় দুর্গন্ধের সঙ্গে মিশেছে কার্বলিক এসিডের কড়া গন্ধ। অস্থিচর্মসার শিশুরা ও মায়েরা শুয়ে রয়েছে
বাঁশের শয্যার ওপর। … পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য শরণার্থী শিবিরে একই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। বস্তুত এ “এক নৈরাশ্যজনক দৃশ্য। গৃহহীন এই নিযুত নিযুত মানুষ ভারতের উদার সাহায্য
না পেলে, অনাহার ও মহামারীর শিকারের সংখ্যা আরো বেশি হতো।
…..পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা থেকে সবেমাত্র আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। যেসব পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী এখনো শিবিরের আশ্রয় পাননি, তাঁদের সারি সারি ঝুপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে ৯০ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে। এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে বনগাঁ যাবার রাস্তা। এখানে রয়েছে হাজার হাজার ঝুপড়ি, সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না।এই সব শোচনীয় আশ্রয়ের কাছেই ছেলেমেয়েরা খেলা করছে, গরুও চরছে। বনগাঁ শহরটি লোকে উপচে পড়ছে। মার্চের আগে পর্যন্ত এখানকার জনসংখ্যা ছিল ১ লাখেরও কম, এখন তা চার গুণ। চালের জন্য শরণার্থীদের দীর্ঘ লাইন। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে আকাশপানে, সর্বত্রই নোংরা, এখনো পর্যন্ত উঠোন থেকে বন্যার জল সরে যায়নি। ফেরার পথে আবার চোখে পড়ল পথের দু’পাশে সেই শোচনীয় চেহারার ঝুপড়ির সারি, রাস্তার সীমাহীন লোক চলাচল।”
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্পার্তাক রেগলভ ‘ভারতীয় উপমহাদেশ: বিয়োগান্ত নাটকের তৃতীয় অঙ্ক’ শিরোনামে লেখেন—
ভারতীয় উপমহাদেশের বিয়োগান্ত নাটকের কয়েকটি অঙ্ক আছে। প্রথম অঙ্কটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চিত্রনাট্য অনুযায়ী ২৫ বছর আগে মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতার ছক নিজেদের খুশিমতো তৈরি করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল আর তা তৈরি হয়েছিল বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন করার’ নীতির ওপর। ১৯৬৫ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধ এই রক্তাক্ত চিত্রনাট্যের সঙ্গে জড়িত একটি অধ্যায়। দ্বিতীয় অঙ্ক অনিবার্যভাবেই শুরু হলো একটা জাতিগত এবং অর্থনৈতিক অসঙ্গতি থেকে যে অসঙ্গতি পাকিস্তানের গঠনের মধ্যে, তার দুই অংশের মধ্যে নিহিত ছিল।…
…পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের ন্যায্য দাবির কথাই বলেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সুবিচার, তাঁদের জন্য সুবিচার এবং যে দেশে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই দেশের জন্য সুবিচার।
…পূর্ব পাকিস্তানে ‘এক অমানুষিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। এই অত্যাচারিত মানুষের সংখ্যা কত, তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি।
….. সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি স্থাপন এবং নিরাপত্তা বিধানের চাবিকাঠি রয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। তারা একটা সমগ্র জাতিকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা ভেবেছে যে, তরবারি দিয়ে সবকিছু শায়েস্তা করা যায়। সুবিচার প্রতিষ্ঠার সময় এখনো আছে, তখন আর তরবারির প্রয়োজন হবে না। তরবারি তার খাপের মধ্যে ফিরে যাবে।”
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ এপিএন ভাষ্যকার আই পলিশেভস্কি ‘পাক-ভারত উপমহাদেশে সংকটের মূল কারণ দূর করতে হবে’ শিরোনামে লেখেন
…ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘর্ষ বন্ধ হলেই কি পাক-ভারত উপমহাদেশে রক্তপাত বন্ধ হবে? মোটেও তা হবে না। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে বা তার পরে কাছাকাছি কোনো সময়েও সংঘর্ষ শুরু হয়নি। সংঘর্ষ শুরু হলো ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অজস্র ধারায় রক্ত প্রবাহিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের বহু সহস্র মানুষ নিহত হলো। আর প্রায় এক কোটি মানুষ কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে ভারতে পালিয়ে এলো, কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তখন ব্যাপক সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব শুরু হয়েছে। যদি কেউ ‘শীঘ্র’ অথবা ‘অবিলম্বে’ যুদ্ধ বন্ধের ডাকে সাড়া দেয়, তবে তার অর্থ হবে এই যে নিরাপত্তা পরিষদ নতুনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং নতুনভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করছে।
তাই সামরিক সংঘর্ষ বন্ধ করাই একমাত্র জরুরি কাজ নয়। এই রক্তপাত বন্ধের কথা সোভিয়েত ইউনিয়নের খসড়া প্রস্তাবে আছে। …….এই প্রস্তাব রচনার সময় প্রতিনিধিদের মতামতের কথা মনে রাখা হয়েছিল। সোভিয়েত খসড়া প্রস্তাবে একটা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য এবং একই সঙ্গে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যক্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অভিলাষ অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাকিস্তান সরকারকে রাজি করাতে সমস্ত সংশ্লিষ্ট দেশকে আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ এবং রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।”
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রাভদায় ভি. মুরিগিনের ‘ভারত উপমহাদেশে শান্তির জন্য’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটিতে বলা হয়—
“সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিগুলি অনুযায়ী, জাতিসমূহের মুক্তির সংগ্রামকে ব্যতিক্রমহীনভাবে সমর্থন করে। মানবিক বিবেচনাবোধের দ্বারা চালিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তান সরকারের কাছে নিপীড়ন বন্ধ করতে এবং সঙ্কটের এক রাজনৈতিক মীমাংসার উপায় উদ্ভাবন করতে বার বার আবেদন জানিয়েছে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়ে সোভিয়েত সরকার পাকিস্তানি নেতাদের কাজ উপমহাদেশে শান্তির পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক, সেদিকে তাদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছেন।জনগণের ইচ্ছার ওপর সামরিক দমন-পীড়নের প্রত্যুত্তরে জনগণের পক্ষ থেকে এসেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। সরকারি ফৌজের বিরুদ্ধে জনগণের মুক্তিবাহিনীর দলগুলি গেরিলা তৎপরতা চালিয়েছে। এ বছরের বসন্তকালে ভারত-পাক সীমান্তে এইভাবেই উদ্ভব হয়েছে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। রাজনৈতিক সঙ্কটের সামরিক মীমাংসা বাতিল করে এবং জনগণের ইচ্ছা পূর্ণ করে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারতো একমাত্র পাকিস্তান সরকারই।”
ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি :
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন শক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের চক্রান্তে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদদে পাকিস্তান ভারতকে আগ্রাসী শক্তি বলে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালায়। ফলে এসব নানাবিধ বিরামহীন অপপ্রচারের আক্রমণে ভারত অনেকটাই নিঃসঙ্গ এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তার ভূমিকা সম্পর্কে অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টি-র পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি অবগত করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করে সোভিয়েত নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে ৯ আগস্ট ১৯৭১ স্বাক্ষরিত হয় ২০ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’। এই চুক্তির নবম ধারাটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ ধারায় বলা হয় যে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে, তারা তা নিজেদের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করবে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক নোট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রয়োজনীয় সাহায্য-সমর্থন জানাবে, সে কথা জুন মাসের শেষে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর কাছে উল্লেখ করেন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন।
‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’র ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সংশ্লিষ্টতা বেড়ে যাওয়ার পথ তৈরি হয়, যা ভারতকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে নতুন শক্তিতে চাঙা করে তোলে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহযোগিতার এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে সোভিয়েতের কাছ থেকে ভারতের অস্ত্র সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় এই চুক্তির ফলে। চুক্তির ফলে ভারতের পাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা পায় ভারত। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারত নিঃশঙ্ক চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে দ্রুতই সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে। অনিবার্যভাবেই এই চুক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন শক্তি সঞ্চার করে ও আশাব্যঞ্জক অধ্যায় শুরু হয়।
ভারতের কাছে এই চুক্তি ছিল এক ধরনের নিরাপত্তা রক্ষাকবচ। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ভারত দৃঢ় অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’র অনিবার্য প্রভাব পড়তে থাকে। অপর দিকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের মিত্র ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)। সিপিআই-এর প্রভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বামদিকে মোড় নেয় এবং অনেক বামপন্থী কর্মসূচি গ্রহণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। অস্ত্রের স্বল্পতার জন্যই ব্যাপক হারে প্রতীক্ষারত অসংখ্য তরুণকে ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হয়নি। ট্রেনিংপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকে আবার অস্ত্রের অভাবে অ্যাকশনে যেতে পারছিল না। এই চুক্তির ফলে এ সমস্যা মিটে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতা দ্রুতই কেটে যেতে থাকে। শুধু এফএফ বাহিনীতে প্রতি মাসে ২০ হাজার করে নতুন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং-এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। হেনরি কিসিঞ্জার ‘ভারত সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’কে ‘bombshell’ বলে অভিহিত করেন। এই চুক্তিকে ঘিরে উদ্বেগের কথা সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে জানাতে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খানকে মস্কো পাঠান। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্লোমিকো ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’র কথা উল্লেখ করে সুলতান খানকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন:
“বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থাকবে না।”
১৮ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বীম্ মস্কোয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর কাছে পাক-ভারত সীমান্ত থেকে উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন-সোভিয়েত যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। দিল্লি সফরকালে সোভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন মার্কিনের প্রস্তাবের জবাবে ২৩ অক্টোবর ১৯৭১ জানিয়ে দেন—
“শেখ মুজিবের মুক্তি এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সাধন’ ছাড়া কেবল সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা রোধ করা সম্ভব নয়।”
২৭ অক্টোবর ১৯৭১ ফিরুবিনের ভারত সফর শেষ হওয়ার পর দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়—
“বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক শান্তি বিপন্ন হয়ে পড়ায় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তির নবম ধারার অধীনে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে পূর্ণরূপে একমত যে, পাকিস্তান খুব শীঘ্ৰ আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে পারে।”
ফিরুবিনের ভারত ত্যাগ করার ৩ দিনের মধ্যে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল কুতাকভের নেতৃত্বে এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোভিয়েত সামরিক মিশন দিল্লি রওয়ানা হয়। ১ নভেম্বর থেকে আকাশপথে শুরু হয় ভারতের জন্য সোভিয়েত সামরিক সরবরাহ।
বিশ্বজনমত সৃষ্টির প্রয়াস
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে মস্কোতে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএসইউ)-র ২৪তম কংগ্রেসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-র নেতৃবৃন্দ সিপিএসইউ-র প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন।
আওয়ামী লীগের ওপর বামপন্থীদের প্রভাব থাকলেও, সাংগঠনিকভাবে সোভিয়েত নেতৃত্বের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। উপরন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মার্কিনি সামরিক জোট ঘেঁষা বৈদেশিক নীতির জন্য (আওয়ামী লীগের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করা সত্ত্বেও ) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কমিউনিস্ট দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব মূলত এসে পড়ে (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ওপর। (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিপিএসইউ-এর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এক্ষেত্রে বিশেষ সহযোগী ভূমিকা পালন করেন সোভিয়েত ইউনিয়নে কর্মরত ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর।
৩ মে ১৯৭১ (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় সমর্থন ও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করার দ্ব্যর্থহীন আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের সব কমিউনিস্ট পার্টির কাছে একটি বিশেষ চিঠি পাঠানো হয়। জাতিসংঘ, বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে, সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে, বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বিভিন্ন দেশে (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির তার প্রতিনিধি দল ও বিশেষ বার্তা পাঠায়।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে সিপিএসইউ-এর নেতৃবৃন্দের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৩-১৬ মে ১৯৭১ বুদাপেস্টে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও স্বাধীনতা সম্পর্কে (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টির একটি ছাপানো প্রস্তাব ও প্রবাসী সরকারের একটি শ্বেতপত্র বিলি করা হয়। বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সিপিএসইউ এবং সর্বভারতীয় শান্তি পরিষদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নেপথ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব:
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু বিষয়ে ভারতের মধ্যে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দোদুল্যমানতা ছিল, বিভিন্ন সংশয়বাদী লবীর প্রচারণাও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতেকে চাঙ্গা রাখতে ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা করা ছাড়াও, সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃড় অবস্থান এবং ভারতের সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিবাচক প্রভাব, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কার্যকর ভূমিকা রাখার বিষয়টি সহজ করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভারতের চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান ছিল অনেক বেশি আদর্শিক। ভারতের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই প্রভাব ও দৃঢ় অবস্থানের অনুপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিশ্চিতভাবেই পাল্টে দিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মেলবন্ধন মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রসর করছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর উপলক্ষ্যে প্রচারিত হয় সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি। সেই বিবৃতিতে বলা হয়—
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা-বিকাশের বিষয় খেয়ালে রেখে উভয় পক্ষই মনে করছেন, শান্তি বজায় রাখার স্বার্থেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা, অলঙ্ঘনীয় অধিকার আইনসঙ্গত স্বার্থের প্রতি মর্যাদা দিয়ে সেখানে উদ্ভূত সমস্যাবলির এক রাজনৈতিক মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য এবং শরণার্থীদের সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষিত থাকার মতো অবস্থায় তাদের দ্রুত ও নিরাপদে নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য জরুরি ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতির গুরুত্বের কথা বিবেচনার মধ্যে নিয়ে উভয় পক্ষই পরবর্তী সময়েও পারস্পরিক সংযোগ বজায় রেখে চলতে, এই সম্পর্কে উদ্ভূত বিষয়গুলি নিয়ে মতবিনিময় অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছেন।”
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করে। ভারতের পাশাপাশি কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় ফ্রন্টে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে। সামরিক কৌশল নিয়ে দু দেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শলা-পরামর্শ হয়। অনেক স্ট্র্যাটেজিক বিষয় যৌথভাবে নির্ণীত হয়। সপ্তম নৌবহর ঠেকাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের পূর্ণতায় নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি হয়।
৬ জুলাই ১৯৭১ সোভিয়েতের তিনজন নভোযাত্রী এক দুর্ঘটনায় নিহত হলে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক শোকবার্তা পাঠান। সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ইজভেস্তিয়া তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করে। এটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্বীকৃতি।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত সফরকালে সোভিয়েত সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ও সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভি কুদরিয়াভেংসেভ বলেন—
“বাংলাদেশে যে সংগ্রাম চলছে, তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং তার মধ্যে গৃহযুদ্ধের উপাদান রয়েছে। যে সমাধানই নির্ণয় করা হোক না কেন, তা করতে হবে জনগণের ইচ্ছা, তাদের আইনসংগত অধিকার ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে।”
কুদরিয়াভেৎসেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের প্রতিনিধি হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজা মুহম্মদ জহির শাহ-এর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি তাঁর ভাষণে বলেন—
“ভারত উপমহাদেশে সম্প্রতি পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, জনসাধারণ অতিমাত্রায় আতঙ্কিত। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মমভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির মৌল অধিকারসমূহের ও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত ইচ্ছার দমন দেশের সেই অংশে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটিয়েছে। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে পালিয়ে আসতে হয়েছে। এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘর্ষ দানা বেঁধে উঠেছে। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন অবিচলভাবে দাঁড়িয়েছি রক্তপাত বন্ধ করার পক্ষে, বাইরের শক্তিগুলির কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই জনসাধারণের আইনসঙ্গত অধিকারসমূহ বিবেচনার মধ্যে রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মীমাংসার পক্ষে। সেই এলাকায় স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযোগী অবস্থা সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিচ্ছে।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নটিকে, যে সব কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে, সেগুলি দূর করার বৈপ্লবিক উপায় হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না।”
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের লড়াই:
জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন জোরালো ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্ত রুখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তা পরিষদে কার্যত একাই লড়ে যায়। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশই ব্যাপারটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তারা শুধু শরণার্থী সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সাহায্যের কথা বলে। জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টও বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বিষয়টি এড়িয়ে যান।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ যখন তার শেষ প্রান্তে চূড়ান্ত বিজয়ের একেবারে সন্নিকটে, তখন জাতিসংঘে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা শর্তহীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করতে শুরু করে। এসব প্রস্তাবে সংকটের মূল উৎস দূর করা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়ার বিষয়ে কোনো কথাই ছিল না। বরং তাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলদারিত্ব বজায় রেখেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করা হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান টিকিয়ে রাখার এই দূরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন বার বার ভেটো দিতে থাকে। প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতো এড়িয়ে গিয়ে যুদ্ধবিরতি, উভয় দেশের সেনা প্রত্যাহার ও উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়। বার বার ভেটো দেওয়ার বিষয়টি যে কারো জন্যই সরল বিষয় ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবসহ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি অমীমাংসিতভাবে ঝুলে থাকে। জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়যাত্রা রোধ করার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে, পরদিন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রচেষ্টা চালান। বৈঠকের শুরুতেই তিনি প্রস্তাব রাখেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দেওয়া হোক। আগেই বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ চেয়ে সদস্যদের কাছে একটি চিঠি ও পরিস্থিতির বিবরণ সম্বলিত একটি নথি বিলি করেছিলেন। অনেক দেশের আপত্তির মুখেও মালিক তার প্রস্তাবের পক্ষে দৃঢ়তার সাথে যুক্তি উত্থাপন করেন। মালিক তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতা যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বলে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন—
“আমরা যদি উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তাহলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য যদি আমরা জানতে চাই কেন এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, তাহলে এই সংকটের মূল কারণটা জানতে হবে; এই ঘটনা ও তার কারণ নিরূপণ করতে হবে। তা না করে অবশ্য আমরা ভিন্ন পথেও যেতে পারি। আমরা বিদ্রোহ বা বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কথা বলতে পারি। কিন্তু এই যে বিদ্রোহ, জাতিসংঘের নিজস্ব পরিভাষায় একে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। আর তা হলো জাতীয় মুক্তিবাহিনী (ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্সেস) ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট)।”
যদিও শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু মালিকের প্রস্তাবের সূত্র ধরে সকলের সামনে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের প্রশ্নটি শুধু উদ্বাস্তু বিষয়ক একটি সমস্যা নয়। জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে সোভিয়েত প্রতিনিধির বাঙালির সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘে ইয়াকভ মালিক বলেন—
“ভারতীয় উপমহাদেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতি অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক সমাধানের দাবি তুলে ধরছে। এই সমাধান করতে হবে সেখানকার জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা, যা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যক্ত হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। এ কথার অর্থ হলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তথা তাদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরকেই তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণের পূর্ণ এক্তিয়ার দিতে হবে অর্থাৎ তারা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকবে, না তারা স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করবে সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব তাদের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে।”
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক যুক্তি দেখিয়ে বলেন
“সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে এই সংকটে শুধু পাকিস্তান ও ভারত নয়, বাংলাদেশও একটি পক্ষ। দেড় লাখ গেরিলাযোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, তাদের প্রতিনিধির বক্তব্যও শোনা উচিত।”
কিন্তু পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের বিরোধিতার কারণে মালিকের সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের দুই অংশেই প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে এবং পাকিস্তানের পরাজয় অত্যাসন্ন হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ব্যাপারে স্বভাবতই কালক্ষেপণের কৌশল নেয় এবং বার বার ভেটো দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করে তোলে।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিম্নোক্ত বিষয়াবলি সম্বলিত একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে—
(১) পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টে সকল প্রকার বিরোধমূলক কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করার লক্ষ্যে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান;
(২) এই সাথে ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানকার জনগণ যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে, সেই আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান;
(৩) মানুষের জীবন রক্ষা এবং ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন মেনে চলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহ্বান;
(৪) এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত জানানোর জন্য মহাসচিবের প্রতি অনুরোধ;
(৫) সংশ্লিষ্ট সমগ্র এলাকায় শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যে খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হয়, তাতে বলা হয়—
(১) পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ অবসানে অভিনন্দন প্রকাশ এবং কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়া ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচিত আইনসংগত জনপ্রতিনিধিদের হাতে নিঃশর্তভাবে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ যাতে নিশ্চিত হয়, সেজন্য উভয় পক্ষ কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির চুক্তি মেনে চলা এবং এতদঞ্চলে সংঘাত-সৃষ্ট সমস্যাবলির যথাযথ সমাধানের ব্যাপারে আশা প্রকাশ;
(২) ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সীমান্ত এলাকা এবং ১৯৬৫ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি রেখা বরাবর অবিলম্বে সকল প্রকার সামরিক তৎপরতা বন্ধ এবং যুদ্ধ বিরতির আহ্বান। এই সঙ্গে ভারত সরকার ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ গ্রীনিচ মান সময় ৩টা ৩০ মিনিট থেকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ও এই অঞ্চলে সকল প্রকার সামরিক তৎপরতা বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে বিবৃতি দিয়েছে তার প্রতি অভিনন্দন এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়া একই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জরুরি আহ্বান;
(৩) দ্রুততম গতিতে যাতে সকল সামরিক তৎপরতা বন্ধ হয়, সেজন্য সমন্বিত সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং এমন কোনো কার্য যা ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে বাধা তা থেকে বিরত থাকার জন্য জাতিসংঘের সকল সদস্যরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান।
সপ্তম নৌবহর প্রেরণ :
সোভিয়েতের প্রতিরোধে ব্যর্থ মার্কিনের শেষ চক্রান্ত পাকিস্তানের সমর্থনে আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় ঠেকাতে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। সপ্তম নৌবহর ছিল সর্বাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত পাঁচ হাজার নাবিক, ৭৫টি যুদ্ধবিমান, ৫টি হেলিকপ্টার, ৩টি স্বচালিত মিসাইল বিধ্বংসী ডেস্ট্রয়ার, ৪টি কামান বিধ্বংসী ডেস্ট্রয়ার, ১টি হেলিকপ্টার বাহক ছাড়াও অন্যান্য মারণাস্ত্র সন্নিবেশিত। এই নৌবহর সমুদ্রের বহু দূর থেকে নির্ভুলভাবে গোলা নিক্ষেপ করে আমাদের দেশের ব্যাপক সম্পদ ও জনগণকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম ছিল।
সপ্তম নৌবহরের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তপ্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পতন ঠেকানোর জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতা চালানো; বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা; পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা; ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌসেনা অবতরণে সাহায্য করা।
কিন্তু সপ্তম নৌবহরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাল্টা জবাব দিয়ে সপ্তম নৌবহরের গতিরোধ করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সোভিয়েত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল সের্গেই গরশকফ ঘোষণা দেন যে, মার্কিন নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দেওয়া হবে না।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে—এই উপলব্ধি সোভিয়েত ইউনিয়নের আগে থেকেই ছিল। মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসার আগেই ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবহরের সমাবেশ সম্পূর্ণ হয়। ভারত মহাসাগর এলাকায় আগে থেকেই তিনটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ টহলরত অবস্থায় ছিল।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম নৌবহরটি তাদের দায়িত্ব শেষে পূর্বনির্ধারিত বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তাদের ঘাঁটি ভ্লাদিভস্তকে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনা আঁচ করে সোভিয়েত নৌ-কমান্ড তাদের টহল অব্যাহত রাখতে বলেন। তাদের বদলে নতুন যে নৌবহরটি রওয়ানা হয়, তার যাত্রাও অব্যাহত রাখা হয়। আরো অতিরিক্ত নৌযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ভারত মহাসাগর এলাকায় মোট সোভিয়েত নৌযানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি জানার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন কসমস ৪৬৪ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে, সপ্তম নৌবহর আমাদের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসত। সোভিয়েতের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরে জরুরি কাজ হয়ে ওঠে সদ্যঅর্জিত স্বাধীনতাকে ‘অপরিবর্তনযোগ্য’ বাস্তবতায় পরিণত করে তা সংহত করা, ষড়যন্ত্র থেকে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। এই পর্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অন্যতম। ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সোভিয়েতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৭২ সালের ৩ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম মৌলিক ধরনের কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর। এই ঘোষণা অনুসারে মার্চ মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের আরো একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দৃঢ় ভিত্তির জন্য এসব চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। সবকিছুই ছিল তখন প্রায় বিধ্বস্ত খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ ইত্যাদি জরুরি সামগ্রীর অভাব ছিল অকল্পনীয়। শুরু থেকেই সদ্য স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ নানা চক্রান্তে মেতে ওঠে। তখনও সেই দুঃসময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।
স্বাধীনতা অর্জনের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দশটি মাছ ধরার ট্রলার, তিনটি কার্গো জাহাজ, চারটি হেলিকপ্টার, ৩৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন কোল্ডস্টোরেজ এবং চারটি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণের প্রয়োজনীয় সবকিছু দেয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ পাঠানো হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও প্রকল্প নির্মাণে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে। স্বাক্ষরিত হয় অর্থনৈতিক ও কারিগরি চুক্তি। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, মৎস্য শিকার শিল্প, সামুদ্রিক-নৌ-রেল যোগাযোগ, বিশেষজ্ঞ তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশেষ অবদান রাখে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তারা। এই কাজে একজন সোভিয়েত উদ্ধারকারী প্রাণ দেন। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করতে ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণ কারখানা, সাভার বেতার সম্প্রসারণ কেন্দ্র ইত্যাদির পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান অনস্বীকার্য। সোভিয়েত ইউনিয়নকে যেন ভুলে না যাই
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অপরিহার্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা হয়ে থাকবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচিতও হয়নি। এই ভেবে স্বস্তি পাই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় উপস্থিতি ছিল। এটা খুবই দুঃখজনক যে, নতুন প্রজন্মের মানুষ এখন আর পৃথিবীর মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি খুঁজে পাচ্ছে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসকে কেবল জানার জন্যই নয়, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় যথাযথভাবে দেশকে অগ্রসর করার স্বার্থেও মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীকালে দেশ পুনর্গঠনে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএসইউ), সর্বোপরি সোভিয়েত জনগণের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার কথা যেন ভুলে না যাই। তাহলে যে মুক্তিযুদ্ধকেই ভুলে যাওয়া হবে।
সহায়ক গ্রন্থ:
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা, প্রকাশক : বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি। প্রকাশকাল: জানুয়ারি ১৯৮৭
- হাসান ফেরদৌস, মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন। প্রকাশকাল: জুন ২০১৩
- মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, প্রকাশক : ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬
- আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সম্পাদনা : শাহীন রহমান প্রকাশক : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১১
আরও পড়ুন: