শেখ আল্লাঈ

শেখ আল্লাঈ – কে নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। বাংলায় ফকিরদের (শেখদের) একটি পরিবার বহুকাল ধরে বসবাস করছিল। সেই পরিবারে শেখ হাসান ও শেখ নসরুল্লাহ নামক দুই ভ্রাতার জন্ম হয়। নসরুল্লাহ খুব বিদ্বান ছিলেন । দুজনে দেশ ছেড়ে হজ করতে যান। সেখান থেকে ১৫২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে (৯৩৫ হিজরীতে) প্রত্যাবর্তন করার সময় বাংলায় না গিয়ে বায়ানায় থাকতে শুরু করেন।

শেখ আল্লাঈ

 

শেখ আল্লাঈ | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

গুরুদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা আমাদের দেশের জলে-মাটিতে মিশে আছে। বায়ানাতেও তাঁদের শিষ্যের অভাব হয়নি। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শেখ হাসান তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য বায়ানার মুসলমানদের নিকট এক সম্মানিত গুরু হয়ে উঠলেন। তাঁর সন্তান শেখ আল্লাঈ শৈশব থেকেই পিতার যোগ্য পুত্র।

পরিবারে সাধনা-উপাসনার বাতাবরণ, সেই সঙ্গে জ্ঞানার্জন ও বিদ্যাচর্চার সমাদর ছিল। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বাগ্মিতার গুণে আল্লাঈ পিতার মৃত্যুর পর গদিতে বসলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপন তাঁর পছন্দ ছিল, কিন্তু তাঁর জীবনে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটানোর কারণ হলেন মিয়া নিয়াজী। বৃদ্ধ নিয়াজী তাঁকে নিজের পৃথে টেনে নিলেন। জানা যায়, তিনি মনে মনে কিছু একটা কামনা করতেন, কিন্তু সেটা যে কি, বুঝতে পারতেন না । নিয়াজীর জীবনই আল্লাঈয়ের চোখ খুলে দেয়। তিনি তাঁর শিষ্যবর্গ ও বন্ধুদের জানালেন—“বস্তুত ওটাই হল আল্লার পথ। আমরা যা করছি, তা অন্তঃসারশূন্য আত্মম্ভরিতা মাত্র।”

মানুষের, বিশেষত তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র, তাদের কল্যাণই আল্লাঈয়ের ধর্ম ও জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠল। কারো কাছে দোষত্রুটি হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। মানুষের জুতো সহস্তে পেতে দিতেন। বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে পীর- মুরিদের ধারা চলে আসছে। মুসলমান শাসনকর্তারা জায়গির দিয়েছেন।

খাব্বাহ্ (গুরুদওয়ারা) রয়েছে, সেখানে অতিথিদের ভোজনের জন্য দিনরাত লঙ্গরখানার দ্বার উন্মুক্ত। আল্লাঈ এখন সে-সব তুলে দিতে লাগলেন। মালকড়ি আসবাবপত্র গরিবদের বণ্টক করে দিলেন। এমন কি বইপত্রও কাছে রাখতে চাইলেন না।

যে চাইল তাকেই দিলেন। স্ত্রীকে বললেন—“এখন থেকে আমি এই পথই বেছে নিলাম। তুমি যদি দারিদ্র্য ও অনাহার অনটনে থাকতে সম্মত হও, তাহলে আমার সঙ্গে থাকো। নইলে এই ধন-সম্পদ থেকে নিজের অংশ নিয়ে আরামে থাকতে পারো।” স্ত্রী স্বামীর পথই বরণ করে নিয়ে তাঁর সঙ্গে রইলেন ।

মিয়া আব্দুল্লা নিয়াজীর চরণাশ্রিত হলেন শেখ আল্লাঈ । গুরু তাঁকে মেহ্দীর মত ও পথের কথা জানালেন। কিভাবে ধ্যান-উপাসনা করা প্রয়োজন, তিনি সেকথা বললেন না, বরং দারিদ্র ও অত্যাচারে নিষ্পেষিত হতে থাকা জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশার জন্য যে-আগুন তাঁর অন্তরে জ্বলছিল, সেই আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিলেন আল্লাঈয়ের হৃদয়ে। আল্লাঈয়ের হিতাকাঙ্খী, বন্ধু ও শিষ্যমণ্ডলীও তখন নিয়াজীর জপমালা জপতে শুরু করেছে।

দলে দলে লোক নিয়াজী ও আল্লাঈয়ের পিছনে ছুটে আসছে। আল্লাঈয়ের বাণীতে ইন্দ্রজালের মায়া, তাঁর কথায় মানুষ সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি। যে একবার তাঁর উপদেশ শুনেছে, সে কি আর নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে? তখন তাদের অবস্থা ছিল—“কভী ঘনী ঘনা, কভী মুঠি ভর চানা, কভী উয়োহ্ ভী মানা” (কখনো মেঘের ঘনঘটা, কখনো মুঠো-ভর্তি ছোলা, কখনো আবার তা-ও নেই)।

রাত্রে যে খাবার উদ্বৃত্ত হয়, তা রেখে দেওয়া আল্লাঈয়ের ধর্মবিরুদ্ধ। “কা চিন্তা মম জীবনে ইয়দি হরির ইয়শয়ম্ভরো গীয়তে” (ভগবানই যখন সংসারের প্রতিপালক, তখন আমার চিন্তার কি প্রয়োজন)— এরকমই ধরে নিন। অর্থাৎ মানুষের যেন সর্বদা অন্নচিন্তা থাকে তাহলে সে সুপথে চলার কথা ভাবতে বাধ্য হবে। রাতে অন্ন তো নয়ই, লবণটুকুও নয় জলও রেখো না কলসিতে। রাত্রিবেলা সমস্ত তৈজসপত্র খালি করে উপুড় করে রেখে

দিত তারা। প্রতিদিন নতুন জীবন শুরু হয়, প্রতিটি দিন অম্ল-মধুর, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন প্রতিদিন। গুরু ও পরমগুরু তাতে আনন্দলাভ করেন। তাঁদের অনুগামীদের বৃহৎ পরিবারও এর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক আনন্দ অনুভব করে । কিন্তু তাঁরা জানেন, নিরীহতা ও ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছতে

পারবেন না। জগতের বৈষম্য ও দারিদ্র্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ-কামনা ও প্রার্থনার দ্বারা – দূরীকরণ সম্ভব নয়। সে-কাজে বেশি সহায়ক হতে পারে তারাই, যারা বৈষম্য ও দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় শিকার। তিনি নিয়ম করলেন, তাঁদের মতাবলম্বীরা অষ্টপ্রহর সশস্ত্র থাকবে। তীর-ধনুক ঢাল-তরোয়াল কাছে রাখা প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক। গুরু গোবিন্দ সিংহের দুই শতাব্দী পূর্বেই আল্লাঈ লোহাকে অমৃতের উৎস বলে ঘোষণা করেছিলেন। সমাজে মহল্লায় কোথাও কোনো অনুচিত কাজকর্ম হতে পারত না।

সুলতানের হাকিমেরও সাহস ছিল না যে লোকের উপর জোর-জুলুম চালায়। হাকিম যদি ন্যায়পথে চলার জন্য সাহায্য চাইত, তাহলে মেহ্দী-পন্থীরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিল। আল্লাঈ এবং তাঁর গুরুর জীবনযাত্রা ও শিক্ষা বায়ানায় এক অদ্ভুত পরিস্থিতি উদ্ভব করল, “পুত্র পিতাকে, ভাই ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করে” এই পন্থায় সামিল হতে লাগল।

মিয়া আব্দুল্লা শান্ত স্বভাবের দরবেশ ছিলেন, কিন্তু শেখ আল্লাঈ ছিলেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তাঁর বক্তৃতায় চারদিকে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। গুরু ভয় পেতে লাগলেন, শিষ্য ভয়ানক বিপদ মাথায় নিতে চলেছেন। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মনের আগুন কিভাবে নেভানো সম্ভব? গুরু পরামর্শ দিলেন, এ অবস্থায় তুমি হজ করতে যাও।

ছয়-সাত শত পরিবার হজ করার জন্য আল্লাঈয়ের সঙ্গে রওনা দিলো। সে-সময় হজে যাওয়ার জন্য সুরাতে গিয়ে জাহাজ ধরতে হতো। কিন্তু শেরশাহের রাজ্য সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না। সীমান্তে খওয়াস্ খাঁ শেরশাহের পক্ষের হাকিম ছিলেন। তিনি আল্লাঈকে স্বাগত জানালেন।

হাকিমের বাসভবনে প্রতি বৃহস্পতিবার উপদেশ দান ও সভার অনুষ্ঠান হতে লাগল। খওয়াস খাঁ আমোদ-প্রমোদ ভালোবাসতেন। ন্যায়- অন্যায়ের পরোয়া করতেন না। সৈন্যদের বেতন পর্যন্ত আত্মসাৎ করতেন। ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখালেও শেখ আল্লাঈ তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন কি? হাকিমের ভক্তি বেশিদিন স্থায়ী হল না। শেখ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হজের পথে অগ্রসর হলেন। কিন্তু যাত্রাপথে বাধা পড়ল । আল্লাঈয়ের নিকট মানুষের সেবাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হজ, সেজন্য বায়ানাতে ফিরে এলেন তিনি ।

শেরশাহের পর ইসলামশাহ (১৫৪৫-৫৪ খ্রিঃ) তখন সিংহাসনে। বায়ানা আগ্রা থেকে খুব দূরে নয়। ইসলাম-শাহ সে-সময় আগ্রায় ছিলেন। আল্লাঈয়ের পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা এবং তাঁর দরবেশ-জীবনের কাহিনী ইসলামশাহের কর্ণগোচর হয়েছিল। মখদুমুল মুল্‌ক্ মোল্লা আব্দুল্লা সুলতানপুরী সাম্রাজ্যের সর্বপ্রধান ধর্মাচার্য ছিলেন।

মেহুদী মতাদর্শকে পুনরায় মাথা চাড়া দিতে দেখে তাঁর চোখের ঘুম উড়ে গেল। তিনি বাদশাহের কান ভারি করতে শুরু করলেন—“এইসব সশস্ত্র বুভুক্ষুরা এখন নিজেদের দল ভারি করছে। যদি তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র কখনো বাদশাহের দিকেই ফেরায়, তাহলে কিন্তু ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।” ইসলামশাহ ডেকে পাঠালেন।

আল্লাঈ তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে আগরায় পৌঁছলেন। সকলেই সশস্ত্র, সকলেই বর্ম- শিরস্ত্রাণধারী। ইসলামশাহ তখন সৈয়দ রফিউদ্দীন, আবুল ফাতাহ্ থানেসরী প্রভৃতি নামজাদা আলিমদের দরবারে আহ্বান করলেন। আল্লাঈ দরবারে প্রবেশ করে দরবারের প্রথা অনুযায়ী বাদশাহকে বন্দনা না করে ইসলাম ধর্মের পয়গম্বরের আমলে প্রচলিত রীতি মাফিক সকলকে “সালামো আলায়কুম”১১ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বললেন।

সেটা ইসলামশাহের ভালো না লাগারই কথা, কিন্তু তিনি সালামের জবাব দিলেন। মোল্লা সুলতানপুরী বাদশাহকে কানে কানে বললেন—“দেখেছেন, কত স্পর্ধা! মেহ্দী মানে যেন জগতের বাদশাহ। লোকটা বিদ্রোহ না করে ছাড়বে না। ওকে বধ করে ফেলাই উচিত শেখ আল্লাঈ সুযোগ পেয়ে ভাষণ শুরু করলেন। ভাষণে কুরানের আয়ত১২ -সমূহ ব্যাখ্যা করে নিজের বক্তব্য পেশ করছিলেন। সংসারের দুঃখ- কষ্ট এবং ধন-সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্য প্রদর্শন করে জানালেন— “আমাদের জীবন কত জঘন্য।

জঘন্য স্বার্থের জন্য ধর্মাচার্য কি না করে ফেলেন। তিনি তো নিজেই নিজের পথ জানেন না, অন্যদের পথ দেখাবেন কিভাবে!” আল্লাঈ দরিদ্রদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বললেন—“পরিশ্রম করতে করতে দেহপাত করছে যারা, তারা আমাদের এবং আপনাদের মতোই খোদার প্রিয় সন্তান।” বর্ণনা এমন জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী ছিল যে সকলের চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল । স্বয়ং বাদশাহ্-ও নিজেকে সংযত করতে পারলেন না। তিনি দরবার-কক্ষ থেকে অন্তঃপুরে গেলেন। দস্তরখানে১৩ নানারকম সুস্বাদু ভোজন সামগ্রী সাজানো রয়েছে, অথচ তিনি হাত দিয়ে স্পর্শও করলেন না ।

লোকজনকে বললেন— “তোমরা যা খেতে চাও খেয়ে নাও।” কেন তিনি খাচ্ছেন না, জিজ্ঞেস করা হলে জবাব দিলেন—“মনে হচ্ছে এই সব খাবারে গরিবের রক্ত লেগে আছে।” তারপর পুনরায় সভা বসল। সৈয়দ রফিউদ্দীন মেহ্দী-মতাদর্শ বিষয়ে পয়গম্বরের একটি উক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। আল্লাঈ বললেন— “আপনি শাফি-ঈ১৪ সম্প্রদায়ের লোক, আমরা হানাফি১৫ ।

পয়গম্বরের বাণী বলে যেসব জনশ্রুতি ছিল, সে-সবের প্রামাণিকতা বিষয়ে আপনাদের মতের সঙ্গে আমাদের মতে বিস্তর তফাত।” এ কথায় সৈয়দ রফিউদ্দীন একেবারে চুপ করে গেলেন। মোঃ সুলতানপুরী তো মুখ খুলতেই পারলেন না। আল্লাঈ তাঁকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করলেন—

—“আপনি তো ইহকালের পণ্ডিত, কিন্তু পরকালের ধর্মের চোর। একটা নয়, বহু ধর্মবিরুদ্ধ কাজ সকলের চোখের সামনে করে বেড়াচ্ছেন।” সভা চলতে থাকল কয়েক দিন ধরে। ফৈজী এবং আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারকও উপস্থিত থাকতেন সেই সব সভায় । আল্লাঈয়ের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সহানুভূতি ছিল, মাঝে মাঝে তা প্রকাশ না করেও থাকতে পারতেন না। শেখ মুবারক ছিলেন দারিদ্র্যের শিকার। দারিদ্র্যের চাপে তাঁর সমস্ত প্রতিভা ব্যর্থ হয়ে যায়, সেজন্যও তিনি আল্লাঈয়ের সাম্যবাদ পছন্দ করতেন।

 

শেখ আল্লাঈ | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

আগরায় আল্লাইয়ের জয়জয়কার। বহু অমাত্য চাকরি ছেড়ে তাঁর দলে যোগ দিল । অনেকে ঘর-সংসার পরিত্যাগ করে মেহ্দী-পন্থী হয়ে গেল। বাদশাহের কাছে প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর আসছে। মোল্লা সুলতানপুরী তাতে নুন-লঙ্কা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

অবশেষে ইসলামশাহ বিরক্ত হয়ে হুকুম দিলেন— “এখানে না থেকে তুমি দক্ষিণে চলে যাও।” আল্লাঈয়ের শোনা ছিল, দক্ষিণে মেহ্দী-পন্থীর সংখ্যা প্রচুর। নিজের চোখে তা দেখার সাধ ছিল, এখন সে-সাধ পূর্ণ হতে পারে। ঈশ্বরের ধরিত্রী বিশাল — একথা বলে তিনি দক্ষিণে রওনা দিলেন। দক্ষিণের বাহমনী রাজ্য শূরী সাম্রাজ্য থেকে স্বতন্ত্র ছিল। একমাত্র মোগলরাই তা আংশিক অধিকার করতে সফল হয়েছিলেন ।

আল্লাঈ সীমান্ত-শহর হাঁড়িয়াতে গিয়ে পৌছলেন। প্রধান হাকিম হুমায়ূন শিরওয়ানী আল্লাঈয়ের বাণী শ্রবণ করে তাঁর ভৃত্যে পরিণত হলেন। নিয়মিত তাঁর উপদেশ শুনতে আসেন। তাঁর সেনাবাহিনীর অর্ধেক সৈন্যই মেহ্দীপন্থী হয়ে গেল। সাম্যবাদে নিদ্রা-জাগরণ সমস্তই জনসাধারণের মঙ্গলার্থে ।

তার উপর সেই পরার্থপরতায় যদি আল্লাঈয়ের বাণী যুক্ত হয়, তাহলে কেন তা মানুষের হৃদয় মন্থন করে তাকে অভিভূত করবে না! শিরওয়ানী শূরী হাকিম ছিলেন, মোল্লা সুলতানপুরী তাঁর এই সমস্ত কাজকর্মের সংবাদ অতিরঞ্জিত করে বাদশাহের কর্ণগোচর করলেন। বাদশাহ তাঁকে দরবারে হাজির করতে হুকুম দিলেন ।

১৫৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। পাঞ্জাবে নিয়াজী পাঠানেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। ইসলামশাহ বায়ানার সন্নিকটে এলে মোল্লা সুলতানপুরী বললেন—“আমি ছোট পাজীটার ব্যবস্থা করে ফেলেছি, আপনি বড় পাজীটার খবর নিন।” বড় পাজী হলেন মিয়া আব্দুল্লা নিয়াজী, শেখ আল্লাঈয়ের গুরু।

পীর নিয়াজীর তিন-চার শত সশস্ত্র শিষ্য পাহাড়ে-টিলায় সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে। পাঞ্জাবে নিয়াজীদের বিদ্রোহে এমনিতেই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ইসলামশাহ, তার উপর অন্য নিয়াজীদের সংবাদ পেয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। বায়ানার হাকিমকে লিখলেন— শিষ্য-সহ আব্দুল্লাকে গ্রেপ্তার করে যথাশীঘ্র এনে হাজির করো। হাকিম আব্দুল্লার ভক্ত ছিলেন। তাঁর ইচ্ছে, গুরু অন্য কোথাও চলে গেলেই ভালো হয়। কিন্তু বৃদ্ধ গুরুর তা মনঃপূত হল না। বাদশাহের দরবারে বৃদ্ধ সাম্যবাদী দরবেশ উপস্থিত হলেন। 

“সালাম আলায়কুম” জানালেন, দরবারের রেওয়াজ অনুযায়ী কুর্ণিশ করলেন না। দরবারের নিয়ামক প্রশ্ন করলেন— “শয়খা, বা-বাদশাহী ঈচুনী সালামী কুনন্দ্” (শেখ, বাদশাহকে কি এইভাবে অভিবাদন জানাতে হয়)? শেখ তৎক্ষণাৎ মুখের মতো জবাব দিলেন— সালাম করতেন। মন্ গয়রাঈ নমিদানস্” (আমি এ ছাড়া অন্য কিছু জানি না)। ইসলামশাহ্ জেনেশুনেও জানতে চাইলেন— “পীর আল্লাঈ হার্মী অস্ত্” (এই ব্যক্তিই কি আল্লাঈয়ের গুরু)? মোল্লা সুলতানপুরী তো উন্মুখ হয়ে বসেই ছিলেন, বললেন— “হার্মী” (এই ব্যক্তিই)। ইসলামশাহ্ সঙ্কেত করলেন। অমনি বৃদ্ধ দরবেশের উপর লাথি-ঘুষি-লাঠি-চাবুক সমানে চলতে থাকল।

যতক্ষণ তাঁর হুঁশ ছিল, ততক্ষণ তিনি কুরানের একটি আয়ত্ পাঠ করতে করতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলেন— “রাব্বানা আফার্ লানা জনবেনা ওয়া অস্ত্রাফেনা” (হে আমার পরমেশ্বর, আমাদের ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমাদের সমস্ত পাপ, সমস্ত দুষ্কর্ম)।

বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করলেন— “চি মীগোয়েদ” (কি বলছে)? আরবি ভাষায় বাদশাহের অজ্ঞতার ফায়দা নিতে মোল্লা জবাব দিলেন— “শুমারা ওয়া মারা কাফির মীখান্দ” (আপনাকে এবং আমাকে বিধর্মী বলছে)। বাদশাহ্ আরও ক্রুদ্ধ হলেন, আরও কঠোর শাস্তি দেওয়ার আদেশ দিলেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় বৃদ্ধের শরীরে অবিরাম প্রহার চালানো হল । অবশেষে মৃত মনে করে ক্ষান্ত হল সকলে । অত্যাচারকারীরা চলে যেতেই লোকজন দৌড়ে এল। বৃদ্ধ দরবেশের শরীর আচ্ছাদিত করে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে রাখল তাঁকে । বহুক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে।

দরবেশ বায়ানা থেকে আফগানিস্তানের দিকে চলে যান। তারপর পাঞ্জাবের বেজওয়াড়া এবং আরও কত জায়গায় ঘুরে বেড়ান। অবশেষে সরহিন্দে পৌঁছে সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। সরহিন্দে সেই সাম্যবাদী দরবেশের কোনো সমাধি আছে কি না আমাদের জানা নেই ।

ওদিকে হাঁড়িয়াতে আল্লাঈয়ের কার্যকলাপ সম্বন্ধে যে সংবাদ এল, তাতে চোখের ঘুম উড়ে গেল ইসলামশাহের। এখন তাঁর ব্যাপারেই মনোযোগ দিলেন তিনি। আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য তো মোল্লা সুলতানপুরী ছিলেনই ।

প্রধান হাকিম হুমায়ূন শিরওয়ানী শেরশাহের আমল থেকেই অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তিনি ইসলাম ধর্মের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং বাদশাহের দরবারে মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন । বৃদ্ধাবস্থার কারণে এখন তিনি অধিকাংশ সময় একান্তে কাটান। আল্লাঈ তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন।

বৃদ্ধ প্রভাবিত হলেন। তিনি ইসলামশাহের নিকট পত্র লিখলেন যে, আল্লাঈ ইসলাম ধর্মের মূলোৎপাটন করছে, একথা সত্য নয়। বৃদ্ধের পুত্র বোঝালেন— এ কথায় সুলতানপুরী আপনার উপর অসন্তুষ্ট হবেন। তাতে বৃদ্ধ শিরওয়ানী ভীত হলেন, আপদ বিদায় করার জন্য আল্লাঈকে নিভৃতে বললেন— “তৃ তন্হা দার্ গোশেমন্ বাগো কি আর্জী দাওয়া তায়েব্ শুদম্ (তুমি একান্তে আমার কানে কানে বলো, আমি যেসব দাবির কথা প্রচার করছিলাম, তা ইতোমধ্যেই তোবা১৬ করেছি)।” প্রাণ বাঁচানোর লোভে আল্লাঈ কি তা করতে পারেন? তিনি তো মস্তকে শবাচ্ছাদন নিয়ে এই পথে নেমেছেন ।

আল্লাঈ ইসলামশাহের দরবারে হাজির হলেন। সময় ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ মাস । মোল্লা সুলতানপুরী ও অন্যান্য মোল্লারা সন্ত্রস্ত হবেন না কেন? আল্লাঈ জাদুকর, তাঁর মুখ-নিঃসৃত বাণী শুনলে ইসলামশাহের হৃদয় বিগলিত হবে না, সেটা কি সম্ভব? লোকজন আল্লাঈকে সরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি জানতেন, পৃথিবীতে যে স্বর্গ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন তাঁরা, তা এত সহজে হতে পারে না। সেজন্য লক্ষ লক্ষ প্রাণ বলিদান দিতে হবে। তা থেকে তিনি পিছিয়ে যাওয়ার পাপ করতে পারেন না। গুরুর উপর অকথ্য অত্যাচারের কথা তিনি জানেন। 

 

শেখ আল্লাঈ | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

 

মনে মনে প্রস্তুত হয়ে দরবারে প্রবেশ করলেন। বাদশাহ্ তাঁকে মুখ খোলার অবকাশ দিলেন না, হুকুম দিলেন— “যতক্ষণ ওর দেহে প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ চাবুক মারতে থাকো।” তৃতীয় চাবুকেই আল্লাঈদের শরীর নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। তাতেও মোল্লা সুলতানপুরী এবং ইসলামশাহ্ সন্তুষ্ট হলেন না।

হাতির পায়ে আল্লাঈয়ের লাশ বেঁধে আগরার পথে পথে ঘোরানো হল। হুকুম ছিল : আল্লাঈয়ের লাশ কেউ যেন সমাধিস্থ না করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবাত্যা শুরু হল। মনে হল, মহাপ্রলয় উপস্থিত। শহরবাসীদের এবং বাদশাহের সৈন্যদের কাছে তা ভীষণ অমঙ্গলের সঙ্কেত বোধ হল। সকলেই বলতে লাগল, ইসলামশাহের বাদশাহী আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। লাশটাকে কোনো এক জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছিল। 

রাতের মধ্যেই সেই লাশের উপর এত ফুল জমেছিল যে সেই ফুলই তাঁর কবরে পরিণত হয়েছিল। ইসলামশাহ ও তাঁর বংশের বাদশাহীর কবর খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল যথার্থই। ইসলাম ধর্ম কেবল মোল্লা সুলতানপুরীরই জন্ম দেয়নি, আমাদের দেশে এইসব দরবেশেরও জন্ম দিয়েছে। মজ্‌দক্-মেদীর স্বপ্ন আজ বিশ্বের অর্ধেকে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। চার শত বছর পূর্বে আল্লাঈ যে সাম্যবাদের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, আমাদের দেশও সেই সাম্যবাদের পথে অগ্রসর হচ্ছে। 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment