হিন্দু ধর্মের প্রভাব ও আকবর

হিন্দু ধর্মের প্রভাব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক সমন্বয়” বিভাগের একটি পাঠ। পোর্তুগিজ পাদরিদের মতানুসারে, আকবর হিন্দু পূজা-পাঠ ও রীতি-রেওয়াজের দিকে বেশি বেশি করে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। ১৫৭৫ খ্রিঃ থেকে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত ইবাদতখানায় শাস্ত্রচর্চা চলতে থাকে। কাবুল যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময়ের আগেই ইবাদতখানার অট্টলিকা ভেঙে ফেলা হয়। কিভাবে পুরুষোত্তম পণ্ডিত ও দেবী পণ্ডিত আকবরকে হিন্দু ধর্মের কথা জানাতেন, সে-কথা বলা হয়েছে। বীরবল তো তাঁর সর্বক্ষণের নর্ম-সহচর ছিলেন, তিনিও হিন্দু ধর্মের খুঁটিনাটি বোঝাতেন। আকবর এটাও মনে রেখেছিলেন যে তাঁর প্রজাদের অধিকাংশই হিন্দু।

হিন্দু ধর্মের প্রভাব

 

হিন্দু ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

মানসিংহ, রাজা ভগবানদাস, বীরবলের মতো বিশ্বাসপাত্র দুর্লভ, সেজন্যও হিন্দু ধর্মের দিকে তাঁর আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ছিল। হিন্দুদের কিছু ব্যাপার তিনি শুধু পারসিদের মধ্যেই নয়, তাঁর পূর্বপুরুষ তুর্কিদের মধ্যেও লক্ষ্য করেছিলেন। তুর্কিরাও তাদের আপনজনের মৃত্যুতে ভদ্র করত, সেজন্য আকবরও হিন্দুদের এই প্রথা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর মাতা মরিয়ম মাকানীর মৃত্যুতে ভদ্র করিয়েছিলেন।

খানে-আজম মির্জা আজীজ কোকলতাশের মাতা (আকবরের দুগ্ধ-মাতা) আনগার যখন মৃত্যু হয়, তখনও আকবর ভদ্র করান, খানে- আজমও বাদশাহের অনুসরণ করেন। খবর আসে, দরবারের লোকেরাও খুব আড়ম্বর- সহকারে ভদ্র হচ্ছে। যখন তাদের বিরত করার নির্দেশ যায়, তখন তার মধ্যেই চার শত জন মুখ-মাথা মুড়িয়ে ফেলেছিল। চিন্তাভাবনায় হিন্দু সব সময়েই উদার, সেজন্য দেবী পণ্ডিত আকবরকে বুঝিয়েছিলেন, কেবল ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, সুফী-মতই নয়, দুনিয়ার সমস্ত ধর্মই সত্য, সকলেই এক ঈশ্বরকে মেনে চলে, সুফী “হুমী ওঃ”

(সমস্তই তিনি) বলে থাকে, আমরা বলি “সর্ব খলু ইদং ব্রহ্মাং” (এই সমস্তই ব্ৰহ্ম)। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমস্ত কিছুই আকবরের পছন্দ হতে শুরু করে। মোল্লা বদায়ূনী লিখেছেন; তিনি আরবির বিশেষ বিশেষ অক্ষরের হ, অ, স, জ, ইত্যাদির— উচ্চারণের পার্থক্য পছন্দ করতেন না। ‘অবদুল্লা’-কে তিনি আবদুল্লা,

‘অহদী’কে আহাদী বলতে ভালোবাসতেন। মুনশীরা ইলাহাবাদকে ইলাহাবাস লিখতেন। তখনও বাদশাহ ও সভাসদেরা তুর্কি পোশাক— লম্বা চোগা, কোমরে কোমরবন্ধ— পরতেন, এবার থেকে তিনি ভারতের চৌবন্দী পরতে শুরু করলেন, চোগা ও পাগড়ি খুলে ফেলে গায়ে চড়ালেন জামা, মাথায় দিলেন ফাঁক-ফোকরগুলা পাগড়ি। দাড়িকে তো জঞ্জাল বলা হল এবং তখতের বদলে সিংহাসনে বসতে লাগলেন। দরবারের সমস্ত সাজসজ্জা বলে হিন্দু ঢঙে সাজানো হল। বাদশাহের দেখাদেখি আমিরেরাও তুরানী পোশাক ছেড়ে ভারতীয় পোশাক স্বীকার করে নিল।

নববর্ষের (নওরোজ) উৎসব আগে থেকেই চলে আসছিল। তাতেও হিন্দু রীতি প্রয়োগ করা হল । সেদিন সোনার তুলাদণ্ডে বারোটি বস্তু (সোনা, রূপো, রেশম, সুগন্ধি, লোহা, তামা, দস্তা, তুতে, ঘৃত, দুধ, মধু, চাল ও সপ্তশস্য) দিয়ে নিজেকে ওজন করতেন, ব্রাহ্মণ যজ্ঞ করে দক্ষিণা নিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। জন্মদিনেও (চান্দ্রমাস রজবের ৫ তারিখ) রূপো, তামা, বস্ত্র, বারো রকমের ফল, মিষ্টান্ন তিল তৈল ইত্যাদি। দিয়ে নিজেকে ওজন করতেন, সেইসব বস্তু ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের বণ্টন করে দেওয়া

হতো। দশহরা উৎসবও খুব আড়ম্বর সহকারে পালন করা হতো, ব্রাহ্মণকে দিয়ে করাতেন, কপালে তিলক কাটতেন, হাতে পরতেন মুক্তো-রত্ন খচিত রাখী, নিজের পুজো হাতে বাজপাখি বসাতেন, কেল্লার চুড়োয় চুড়োয় সুরা রাখা হতো ।

 

হিন্দু ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

আকবর প্রত্যুষে যমুনা-তীরের দিকে পূর্বাভিমুখী জানালার কাছে বসতেন এবং সূর্যোদয় হলে তা দর্শন করতেন। যারা প্রত্যুষে স্নান করতে আসত, তারাও জাফরি দিয়ে বাদশাহকে দর্শন করত, মহাবলী বাদশাহের জয়ধ্বনি দিত। আজাদ বলেছেন “আকবর সবকিছু করেছিলেন। রাজপুতরাও নিজেদের চরমতম প্রাণোৎসর্গের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছিল।”

জাহাঙ্গির তাঁর তুজুকে লিখেছেন— “আকবর প্রথম প্রথম ভারতের রীতিনীতি স্রেফ এভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, যেমন অন্য দেশের টাটকা ফল, কিংবা নতুন দেশের নতুন সাজসজ্জা, কিংবা, এমন আর কি, নিজে যাদের ভালোবাসে অথবা যারা তাকে ভালোবাসে তাদের প্রত্যেক ব্যাপারই যেমন ভালো লাগে।” আকবর ইসলাম-বিরোধী হতেন না যদি তাঁর সাংস্কৃতিক সমন্বয়কে মেনে নেওয়া হতো। অথচ মোল্লারা ভাঙতে রাজি ছিল কিন্তু মচকাতে চায়নি। আকবর অশোকের মতো সভীপাখণ্ডো (সর্বধর্ম)-কে এক-সমান ভালোবাসতেন। কিন্তু মোল্লারা তাঁকে ধর্মে পতিত বলে দুর্নাম রটাত ।

হিন্দুরা আকবরের গুণকীর্তনে কোনো ত্রুটি রাখেনি। একটি প্রাচীন পুঁথি হাজির করা হল, তাতে লিখিত ছিল, প্রয়াগে (ইলাহাবাদ) মুকুন্দ ব্রহ্মচারী তাঁর সারা শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে যজ্ঞে আহুতি দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যদের কাছে লিখে রেখেছিলেন যে খুব শীঘ্রই তিনি এক পরাক্রমশালী সম্রাট হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।

শিষ্যরা বলতে শুরু করলেন, মুকুন্দ ব্রহ্মচারীই আকবর রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। হিন্দু যাতে না বাজি জিতে নেয়, তাই হাজী ইব্রাহিম পোকায় কাটা জীর্ণ একখানি কিতাব যোগাড় করলেন, তাতে শেষ ই-আরবির বাণী উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে শেষ পয়গম্বর মেহদীর বহু পত্নী হবেন এবং তিনি শ্মশ্রু-মুণ্ডিত হবেন। আকবর সেই মেহদী ।

আকবর হিন্দুদের কুপ্রথাগুলি দূর করতেও ইতস্তত করতেন না। তিনি সতীদাহ- প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন। হিন্দুরা ওই প্রথার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলে আকবর বলেন— “ভালো কথা, বিধবা যেমন সতী হয়, তেমনি স্ত্রীর মৃত্যু হলে পুরুষকেও সহমরণে যেতে হবে।” তা সত্ত্বেও তারা চাপ দিতে থাকলে তিনি বলেন— “বিপত্নীক সহমরণে না যাক, তবে তাদের অবশ্যই প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তারা পুনরায় বিবাহ করবে না।”

দুই-এক বছর পরে তিনি সতী-প্রথা রদ আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যে-নারী সতী হতে চায় না, তাকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে দাহ করা অপরাধ। মুসলমানদেরও আদেশ দিয়েছিলেন, বারো বছর বয়স পর্যন্ত যেন কোনো বালকের খত্না না করা হয়, তারপর সেই বালকের মতামতের উপরেই ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হোক, সে খত্না করতে চায় কি না চায় ।

রাজা ভগবানদাসের ভ্রাতুষ্পুত্র জলমল কোনো জরুরি আদেশের জন্য দৌড়তে দৌড়তে আসছিলেন, চৌসার কাছে লু-হাওয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পত্নী যোধপুরের মোটা রাজা উদয়সিংহের কন্যা ছিলেন। তিনি সতী হতে অস্বীকার করেন। তাঁর পুত্র (তাঁরও নাম উদয়সিংহ ছিল) ও জ্ঞাতিরা বংশের নাক-কাটা যেতে দেখে তাঁকে দাহ করার জন্য উদ্যোগী হন।

অন্তঃপুরে আকবরের নিকটে সে-খবর তড়িৎ-গতিতে এসে পৌছায় । তিনি তৎক্ষণাৎ একটি ঘোড়ায় চড়ে এবং সঙ্গে যাওয়ার জন্য কাউকে কিছু না বলেই দৌড়ান। চরম মুহূর্তে তিনি পৌছে যান এবং রাজপুতানী সতী হওয়া থেকে রক্ষা পান।

 

হিন্দু ধর্মের প্রভাব | সাংস্কৃতিক সমন্বয় | আকবর

 

প্রথমে তো তিনি বলপ্রয়োগকারীদের দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাদের কারাদণ্ডের শাস্তি দেন। মৃত্যুদণ্ড আকবরের জন্মের বারো বছর পূর্বে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গুরু নানকের (জন্ম ১৪৬৮ খ্রিঃ) মৃত্যু হয় । তখনও শিখ ধর্ম প্রারম্ভিক অবস্থায় ছিল। নতন ধর্মমতের প্রতি আকবর মনে কোনো আকর্ষণ বোধ করেননি। দৈবশক্তি ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ তিনি পরীক্ষা করে বুঝেছিলেন যে এসব ধোঁকাবাজি কারবার, সেজন্য শেষে পীর ও গুরুদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় । বীরবল অবশ্যই শিখ ধর্মকে সুনজরে দেখতেন ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment