হেমচন্দ্ৰর বংশ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। প্রাচীনকাল থেকেই অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও ব্যবসায়ীদের ‘সার্থ’ (ক্যারাভান) যাতায়াত করত। সেকালে কত সার্থবাহº লক্ষপতি কোটিপতি ছিল। তাদের পণ্য বোঝাই নৌকা চলাচল করত আমাদের দেশের নদী-সমুদ্রে। যেখানে নৌকায় পণ পরিবহণের সুবিধা ছিল না, সেখানে তারা স্থলপথে গরুর গাড়ি কিংবা বলদের পিঠে পণ্য বোঝাই করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিক্রি করতে যেত।
হেমচন্দ্ৰর বংশ
কোম্পানির রাজত্বেও বালিয়ার রওনিয়ার সার্থবাহরা বলদের পিঠে কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গিয়ে উপস্থিত হতো। সাধারণ সার্থবাহের মালপত্র সাধারণ মানের হতো। কত রওনিয়ার খাদের মাটি, কোরা কিংবা রঙিন কাপড় নেপালে নিয়ে যেত ।
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের কয়েক বছর আগে তাদের বহু মাল বিক্রি হয়নি। মাল ফিরিয়ে আনা তাদের কাছে লোকসানের ব্যাপার ছিল, তাই মালগুলো বিক্রি করার জন্য তারা সেখানেই থেকে যায়। আজও তাদের বংশধরেরা কাঠমান্ডুতে রয়েছে। শ্রী শিবপ্রসাদজী রওনিয়ার তাদের মুখিয়া। বিবাহের সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য তারা বিহার অথবা উত্তরপ্রদেশের রওনিয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নইলে তারা এমনিতে নেপালী, যেমন অন্য নেপালীরা।
রওনিয়ার হল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও বিহারের সার্থবাহ। তাদের মধ্যে শিবপ্রসাদজীর পূর্বপুরুষদের মতো কয়েক হাজার টাকার পুঁজিওয়ালা ব্যবসায়ীও ছিল, আবার অনেকে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিকও ছিল, তাদের কুঠি ছিল চট্টগ্রাম এবং আরও কত সমুদ্র-বন্দরে । নিজেদের রাজ্যে বড় বড় শহরেও তাদের কারবার চলত । আজকাল আমরা যাদের বানিয়া বলতে অভ্যস্ত, তাদের পক্ষে কিন্তু সার্থবাহের কাজ করা সম্ভব ছিল না।
যেসব রাজ্যের মধ্য দিয়ে পণ্য-পরিবাহক দল যাত্রা করত, সেসব রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করত না। যেখানে সক্ষম শাসনকর্তা থাকত, সেখানে সার্থবাহ উপহার-উপঢৌকন দিয়ে নিজের কাজ আদায় করে নিত। যেখানে অশান্তি বিশৃঙ্খলা, সেখানে নিজদের রক্ষার দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হতো।
সেজন্য তারা শত শত, কখনো কখনো হাজার হাজার সংখ্যায় যাতায়াত করত। তাদের কাছে থাকত তরোয়াল-বর্শা, তীর-ধনুক, এমন কি সেকালের সবচেয়ে জোরালো অস্ত্র পলতেওয়ালা বন্দুকও সঙ্গে নিত তারা। কম সাহসী লোকের জন্য কোনো স্থান ছিল না পণ্য- পরিবাহক দলে, তাই বলদের পিঠে মাল বোঝাই, গরুর গাড়ি চালানো ইত্যাদি কাজের জন্য এমন যুবকদের নেওয়া হতো, প্রয়োজন পড়লে যারা সেপাই হতে পাে পারে । সেপাইগিরি ভোজপুরীদের সহজাত প্রকৃতি ।
সহসরামে এই রকমই এক রওনিয়ার সার্থবাহ ছিলেন; ধনসম্পদ, উদারতা ও সাহসের জন্য প্রদেশের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কেবল মামুলি শাসক নয়, নিজ নিজ এলাকার হর্তা-কর্তারাও তাঁকে যথেষ্ট সমাদর করত।
তিনিও মাঝে মাঝে টাকা- কড়ি দিয়ে তাদের অনুগৃহীত করতেন। শেরশাহ রাজা হয়েও যদি বেলচা চালাতে পারেন, তাহলে কোটিপতি সার্থবাহও—গরুর পিঠে মাল বোঝাই করে যেসব সাধারণ লোক— তাদের মতো নিজের হাতে সব কাজ করার জন্য তৈরি থাকবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
যৌবনকালে তিনি নিজের হাতে সবকিছু করেছেন, এবং তিনি চাইতেন, তাঁর পুত্রও কাজকর্ম ভালোভাবে শিখুক। এত বড় কারবারের জন্য লেখাপড়া শেখা খুবই প্রয়োজন । সার্থবাহ তাঁর পুত্রকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। কয়েকবার সমুদ্রগামী (চট্টগ্রাম) নদীপথে পণ্য-পরিবাহক দলের সঙ্গে এবং বহুবার স্থলপথে গরুর গাড়ির পণ্য-পরিবাহক দলের সঙ্গেও তাঁকে পাঠিয়েছিলেন।
যুবকটি একদিকে যেমন নিজের বিদ্যাবুদ্ধি প্রদর্শন করে পিতাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন, অপরদিকে তেমনি কয়েকবার ডাকাতদের মোকাবিলা করে নিজের সাহসিকতার পরিচয়ও দিয়েছিলেন । এই যুবকটির নাম হেমচন্দ্র, লোকে ভালোবেসে ডাকত হেমু বলে ।
আরও দেখুনঃ