আকবরের আকৃতি পোশাক ইত্যাদি – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “আকবরের অন্তিম জীবন” বিভাগের একটি পাঠ।
Table of Contents
আকবরের আকৃতি পোশাক ইত্যাদি
(১) আকবরের আকৃতি—
প্রৌঢ়াবস্থায় আকবরকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা লিখেছেন : আকবরের শরীর ছিল মাঝারি গড়নের (সম্ভবত পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি)। শরীরের কাঠামো ছিল সুদৃঢ়, না রোগা-পাতলা, না মোটা। প্রশস্ত বুক, ক্ষীণ কটিদেশ এবং দীর্ঘ বাহু ছিল।
শৈশব থেকেই অত্যধিক ঘোড়-সওয়ারি করার জন্য তাঁর পা পিছনের দিকে মুড়ে থাকত। হাঁটার সময় বাম পা একটু মাটিতে ঘষটাতেন, তা থেকে তাঁকে খোঁড়া বলে সন্দেহ হতো, তবে তাঁর পা সম্পূর্ণ নিখুঁত ছিল। তাঁর মাথা ডানদিকে সামান্য কাত হয়ে থাকত । ললাটদেশ ছিল টিকোলো, প্রশস্ত । নাক একটু ছোট ছিল। ক্রোধ প্রকাশ করার
সময় নাকের ডগা খানিকটা স্ফীত হতো। নাকের মাঝখানে হাড় অল্প উঁচু ছিল। বাম নাসাগ্র ও ওষ্ঠের মধ্যখানে ছিল মটরদানার মতো একটা আঁচিল । কালো রঙের সরু ভুরু। ছোট ছোট উজ্জ্বল চক্ষু মঙ্গোল রক্তের পরিচয় দিত। গায়ের রঙ ছিল গোধূম বর্ণ । ছাঁটা-গোঁফ ব্যতীত সারা মুখমণ্ডল সাফ-সুতরো থাকত ।
গম্ভীর প্রকৃতি, তাতে এক বিচিত্র সৌন্দর্য ছিল। জাহাঙ্গির লিখেছেন— “আমার পিতার আচার-ব্যবহার পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মতো ছিল না, তাঁর চেহারায় পরাক্রম স্ফুরিত হতো। যে কোনো ব্যক্তি তাঁকে দেখলেই বুঝতে পারত যে তিনি কোনো পরাক্রমশালী পুরুষ।” আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, একবার সাজ-বদল করে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় লোকে তাঁকে চিনে ফেলেছিল। রণথম্ভৌরে রাও সুর্জন তাঁকে মানসিংহের পরিচারক রূপে দেখেও তাঁকে ঠিক চিনে ফেলেছিলেন।
(২) আকবরের পোশাক—
আকবর পূর্বে তুরানীদের (মোগলদের) পোশাক পরিধান করতেন— লম্বা করা, কটিবন্ধ। পরে তিনি ভারতীয় পোশাকে অভ্যস্ত হন। কবার বদলে গায়ে থাকত লম্বা চওবন্দি, তার উপর কটিবন্ধ। মাথায় থাকত রাজপুতদের প্যাচানো পাগড়ি। সেটাই তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও জাতীয় পোশাক হয়ে গিয়েছিল।
পোশাকের জন্য ফুল-পাতাওয়ালা জরি ও রেশমবস্ত্র ব্যবহৃত হতো। পাগড়িতে হীরে- মুক্তো বসানো থাকত। উত্তম বস্ত্রের পায়জামা গোড়ালি পর্যন্ত, তার মুহরিতে থাকত মুক্তার ঝালর। পাদুকা তিনি নিজের পছন্দমতো বিশেষ ঢঙের তৈরি করিয়েছিলেন, অন্য লোকেরাও তা গ্রহণ করেছিল।
তা খানিকটা চটির মতো, গোড়ালি ঢাকা নয়। বাড়িতে কখনো কখনো ফিরিঙ্গিদের পোশাকও পরতেন। তাঁর কটিদেশে সর্বদা তরোয়াল থাকত। যদিও-বা কখনো কটিদেশে তরোয়াল না থাকত, তাহলে তরোয়ালের কাছেই থাকতেন তিনি। লোকজনের সম্মুখে এলে নওকরেরা কয়েক রকমের অস্ত্র নিয়ে তাঁর নিকটে দণ্ডায়মান থাকত। তাঁর বসার আসন থাকত চারটি খুঁটির উপর টাঙানো চাঁদোয়ার নিচে উঁচু চৌকির উপর, তিনি প্রায়ই সিংহাসনে ঠেস দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসতেন ।
(৩) আকবরের স্বভাব—
আকবরের স্বভাব ছিল মধুর ও আকর্ষণীয়। সাধু জেভিয়ারের বক্তব্য অনুসারে, “তিনি সদানন্দ, স্নেহপরায়ণ ও দয়ালু হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রকৃতি ছিল গম্ভীর ও সুকঠিন।” জেভিয়ার কয়েক বছর আকবরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন— “সত্য সত্যই তিনি বড়দের মধ্যে বড় এবং ছোটদের মধ্যে ছোট ছিলেন।” অন্য এক ইউরোপীয় প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন— “তাঁর পরিবারের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয়, বড়দের কাছে তিনি ভয়ঙ্কর ও ছোটদের কাছে দয়ালু ও স্নেহপরায়ণ ছিলেন ।
সাধারণ মানুষের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাদের জন্য তিনি সর্বদা সময় বের করে নিতেন এবং তাদের প্রার্থনা খুব প্রসন্নতার সঙ্গে স্বীকার করতেন। তিনি ছোট ছোট উপহারকেও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতেন, নিজের কোলে রাখতেন, আমিরদের অত্যন্ত দামি উপঢৌকনের বেলাতেও তিনি তা করতেন না। কতবার তো তিনি তাঁদের বহুমূল্য উপঢৌকনের দিকে দৃষ্টিপাতও করেননি।”
(৪) আকবরের আহার—
অত্যন্ত সাধারণ আহার ছিল তাঁর। দিনে স্রেফ একবারই পুরোপুরি আহার করতেন । তারও কোনো সময় ছিল না। যখন সময় হতো, তখনই চেয়ে নিয়ে খেতেন। তাঁর সামনে নানা রকমের খাদ্যসামগ্রী সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হতো । কেউ যাতে বিষ না দিয়ে দেয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তবে সমস্ত ব্যঞ্জনের স্বাদ নেওয়া তাঁর পছন্দ ছিল না। মাংসে তাঁর রুচি ছিল না।
জীবনের শেষ বছরগুলিতে তো আমিষাহার একদম ত্যাগ করেছিলেন। তিনি স্বয়ং বলতেন— “শৈশব থেকেই আমার জন্য কখনো মাংস রান্না হলে আমার ভালো লাগত না, মাংস পছন্দ করতাম না। আমি আমার এই মনোভাবকে প্রাণী-সংরক্ষণের আবশ্যকতার প্রতি প্রেরণা মনে করে মাংস-ভোজন থেকে বিরত হতে থাকি।” তিনি বলতেন— “নিজের পেটকে প্রাণীদের কবর বানানো মানুষের উচিত নয়।” মাংস-ভোজন কেন তিনি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেননি, সে-ব্যাপারে তিনি বলতেন— “মাংস-ভোজন আমি সম্পূর্ণ বর্জন করিনি, তার কারণ আমি চাইনে, অন্যরাও তা অনুসরণ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ুক।”
আকবরের খুব পছন্দ ছিল ফল। আঙুর, তরমুজ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ফল ছিল, যে- কোনো সময়েই তিনি তা খেতেন। তাঁর খাওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে নানা রকমের ফল আসত।
(৫) আকবরের মদ্যমান—
আকবরের বংশে পানাসক্তি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কখনো কখনো তা মারাত্মক অবস্থাতেও চলে যেত, সুরাতের ঘটনা থেকেই আমরা তা জানি, নিজের নির্ভীকতা দেখাবার জন্য আকবর দূর থেকে দৌড়ে এসে বুক দিয়ে তরোয়ালের ডগায় ধাক্কা মারতে চেয়েছিলেন, এবং তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে মানসিংহকে গলা টিপে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
কিন্তু প্রৌঢ়াবস্থায় তিনি এরূপ সুরাপান পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি বিদেশী নয়, দিশি মদ বেশি পছন্দ করতেন। তাছাড়া তিনি আফিমও সেবন করতে শুরু করেন। সভায় যখন শাস্ত্রালোচনা হতে থাকত, তখন অনেক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। মোনসেরেত এ কথাও লিখেছেন— “আকবর
ক্বচিৎ কখনো সুরাপান করতেন, তাঁর বেশি পছন্দ ছিল আফিম ।” সম্ভবত ভারতে আকবরই প্রথম রাজা, যিনি তামাকু সেবন করেছিলেন। অসদবেগ লিখেছেন— “বিজাপুরে আমি তামাকু দেখতে পাই। ভারতে এরূপ বস্তু কখনো দেখিনি, সেজন্য আমি তা সংগ্রহ করি।
একটা সুন্দর জড়োয়া আলবলা বানাই । তার তিন হাত লম্বা চিনেমাটির সবচেয়ে সুন্দর নৈচে ছিল। শুকিয়ে তাতে রঙ দিই, তারপর তার দুই প্রান্তে আংটা লাগাই । একটা ইয়েমেনী ডিম্বাকৃতি সুন্দর পলাকে মুখ তৈরি করে নৈচার এক প্রান্তে লাগিয়ে দিই। চমৎকার হয়েছিল দেখতে।
আগুন রাখার জন্য একটা সোনালী কল্কেও বানানো হয়েছিল। বিজাপুরের সুলতান আদিল খাঁ আমাকে একটা ভারি সুন্দর পানের বাটা দিয়েছিলেন। তাতে উৎকৃষ্ট মানের তামাকু ভরে নিই। এমন তামাকু যে সামান্য আগুনের ছোঁয়াতেই সমানে জ্বলতে থাকে। একটা রূপোর রেকাবিতে সবগুলো ভালো করে সাজাই।…
হুজুর (আকবর) আমার উপহার পেয়ে খুব খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন : এত অল্প সময়ে এমন আশ্চর্য জিনিসটা কি করে যোগাড় করলেন? আলবলার রেকাবির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি । মনোযোগ দিয়ে তামাকু দেখলেন… এ বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন এবং জানতেও চাইলেন, কোথা থেকে পেলাম। নবাব খানে আজম জানালেন : তামাকু, মক্কা-মদীনায় প্রসিদ্ধ । হাকিম এটা দাওয়াই হিসেবে হুজুরের জন্য এসেছেন।
“আমাকে তৈরি করার হুকুম দিলেন। তিনি সেবন করতে চাইলেন। তাঁর চিকিৎসক তাঁকে নিষেধ করছিলেন, কিন্তু হজরত খুশিমনেই জানালেন : ওঁকে খুশি করার জন্যও সেবন করা দরকার। তারপর নৈচেতে মুখ লাগিয়ে দুই-তিন টান দিলেন। শাহী হাকিমকে বড় চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তিনি আর টানতে দিলেন না । নৈচে থেকে মুখ সরিয়ে আকবর খানে-আজমকে টানতে বললেন। তারপর বাদশাহ তাঁর ওষুধ প্রস্তুতকারককে ডেকে তামাকুর বিশেষ গুণাগুণ সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। তিনি জবাব দিলেন— ‘আমার বইপত্রে এর কোনো উল্লেখ নেই। এটা নতুন আবিষ্কার ।
ইউরোপীয় চিকিৎসকরা এ প্রশংসা করে অনেক কথা লিখেছেন।’ তাঁর কথা শাহী হাকিমের মনঃপূত হল না, তিনি বললেন— ‘আমরা ইউরোপীয়দের অনুসরণ করতে চাইনে, তাদের রীতি-রেওয়াজও আমরা বরণ করে নিতে চাইনে। আমাদের বিচক্ষণ ব্যক্তিরা এরূপ কোনো বস্তু বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ করতে বলেননি।’ আমি (অসদবেগ) বললাম— ‘এটা অদ্ভুত কথা। পৃথিবীতে প্রতিটি রীতি-রেওয়াজই কোনো এক সময় নতুন ছিল। আদমের সময় থেকে আজ পর্যন্ত একনাগাড়ে আবিষ্কার হয়ে চলেছে।
যখন কোনো একটি নতুন বস্তু মানুষের কাছে নিয়ে আসা হয় এবং পৃথিবীতে তার যথেষ্ট নাম হয়, তখন প্রত্যেক মানুষই তা গ্রহণ করে নেয়।’… আমার কথা শুনে বাদশাহ আমাকে সাধুবাদ জানালেন এবং খানে আজমকে বললেন— ‘শুনলে, অসদ কেমন বুদ্ধিমানের মতো কথা বললেন? সত্যিই, অন্যান্য দেশের সচেতন মানুষ যা গ্রহণ করেছে, আমাদের বইপত্রে তার কোনো উল্লেখ নেই, কেবল এই কারণেই তা বর্জন করা উচিত নয় । নইলে আমাদের কোনো প্রগতি হতে পারে না।’
“আমি সঙ্গে করে যথেষ্ট তামাকু ও আলবলা এনেছিলাম। অল্প অল্প করে অনেক আমিরের কাছে পাঠালাম। সত্যিই, বিনা আপত্তিতে সকলেই কিছু কিছু পাঠাতে বললেন এবং তার চল হয়ে গেল। এরপর বেনেরা বিক্রি করতে শুরু করল, তামাকু- সেবনের রেওয়াজ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তা সত্ত্বেও আলা-হজরত (আকবর) তাতে (তামাকু-সেবনে) রাজি হননি।”
(৬) আকবরের শিকার—
শৈশব থেকেই আকবরের শিকারে খুব শখ ছিল। কমরগাহ (শিকারজির্গা)-এর আয়োজন করে জন্তু-জানোয়াদের এক জায়গায় জড়ো করে দেওয়া হয়েছিল। আকবর চার-পাঁচ দিন ধরে খুব শিকার করেন। তারপর তাঁর মন একদম ভেঙে পড়ে এবং পরবর্তীকালে মৃগয়া থেকে একদম হাত গুটিয়ে নেন।
সিকান্দার শূরীর পরাজয়কালে সেখানে পাওয়া ধনসম্পদের মধ্যে একটা শিকারী চিতাবাঘও ছিল। বৈরাম খাঁর ভগ্নীপতি হুসেন কুল্লি খাঁ খানজাহানের পিতা ওয়ালিবেগ জুলকদর চিতাবাঘটাকে আকবরের কাছে নিয়ে যান। চিতাবাঘের নাম ফতেহবাজ এবং চিতা- পালকের নাম দুন্দু। দুন্দু চিতাবাঘের চাতুর্য এমনভাবে দেখাল যে আকবর মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সেদিন থেকেই তাঁর চিতাবাঘের শখ শুরু হয়।
তাঁর চিতাখানায় শত শত চিতাবাঘ থাকত, এমন তাদের শিক্ষা দেওয়া ছিল যে সামান্য একটু ইশারাতেই কাজ হাসিল করত তারা। তাদের গা ঢাকা থাকত কিংখাব-মখমলে, গলায় সোনার শিকল, চোখে থাকত নকশাদার চাশমা । তাদের নিয়ে যাওয়া হতো চার-চাকার গরুর গাড়িতে, গাড়ি-টানা বলদগুলোকেও সাজানো হতো— শিং ঢাকা থাকত সোনালী-রূপোলী খাপে, মাথায় নকশাদার তাজ আর গা ঢাকা থাকত নকশাদার কাপড়ে ।
হাতি বশ করতে গিয়ে আকবর অনেকবার নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন, সে- কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। জংলী হাতিকে বশ মানাতেও তাঁর খুব আনন্দ হতো।
(৭) আকবরের বিনোদন—
সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের উপর তাঁর ভীষণ আকর্ষণ ছিল। প্রথম বয়সেই তানসেন এসে আকবরের সেই শখকে আরও বাড়িয়ে দেন। তাঁর দরবারে ভারতের শ্রেষ্ঠ কালোয়াতরা থাকতেন। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত আকবরের গুণগ্রাহিতার কাছে কৃতজ্ঞ। এ কথাও পূর্বে উল্লেখ করেছি যে তবলা বা পাখোয়াজ বাজানো তাঁর ভালোই অভ্যাস ছিল ।
(৮) আকবরের দিনচর্যা—
রাতে আকবর সম্ভবত ক্বচিৎ-কখনো তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন । অপরাহ্নে সামান্য বিশ্রাম করে তিনি পণ্ডিতদের সভায় যেতেন। যখন শাস্ত্রালোচনার ধুম ছিল, তখন তিনি সব ধর্মের মতামত ও বৈশিষ্ট্য জানার চেষ্টা করতেন। সেখানে ঘণ্টা- দেড় ঘণ্টা কাটানোর পর হাকিমদের পাঠানো আবেদনপত্রের পাঠ শুনতেন এবং যথোচিত উত্তর লেখাতেন।
মধ্যরাতে তিনি পূজা-অর্চনায় রত হতেন। তিন ঘণ্টা ঘুমোনোর পর প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করতেন এবং প্রাতঃকৃত্য ও স্নান সেরে আবার ঘণ্টা দুয়েক পূজা-অর্চনায় নিমগ্ন হতেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দরবারে এসে উপস্থিত হতেন।
তাঁর আগেই দরবারীরা ও অন্যান্য ব্যক্তিরা সেখানে এসে অপেক্ষা করত। তারা তাঁর কথা শুনত। গরিব ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি নিজে উঠে গিয়ে তাদের আবেদন-নিবেদন মন দিয়ে শুনতেন। তারপর আস্তাবল, পিলখানা, উটখানা, হরিণখানায় গিয়ে পশুদের পর্যবেক্ষণ করতেন।
সেখান থেকে কারখানা ও মিস্ত্রিখানা দেখতে যেতেন। বন্দুক, কামান ও অন্যান্য নতুন-নতুন অস্ত্রশস্ত্র শুধু দেখা নয়, সে- সবের নির্মাণ-পদ্ধতিও শেখার খুব শখ ছিল তাঁর। কতবার তিনি নিজেই মিস্ত্রিদের মতো কাজ করতে লেগে যেতেন । তিনি এতই সরল ছিলেন যে মাঝে মাঝে সিংহাসন ছেড়ে অন্যদের সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়তেন এবং নির্বিকারভাবে কথাবার্তা চালাতেন ।
(৯) আকবরের সন্তান-সন্ততি—
আমরা আগেই বলেছি যে আকবরের তিনটি পুত্র ছিলেন— সলীম, মুরাদ (পাহাড়ী) ও দানিয়াল। তিন কন্যার মধ্যে খানম সুলতান সলীমের চেয়ে ছোট ও মুরাদের চেয়ে বড় ছিলেন, বাকি শুকরুন্নিসা ও আরাম বানুর জন্ম হয় দানিয়ালের পরে। আরাম বানু জীবনভর অবিবাহিতা ছিলেন, সে-কথাও বলেছি।
পৌত্রদের মধ্যে খুসরো সবচেয়ে বড় এবং তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ভাবা হয়েছিল। তাঁর মাতা শাহ বেগম জাহাঙ্গিদের প্রিয়তমা পত্নী, রাজা ভগবানদাসের কন্যা তথা মানসিংহের খুল্লতাত ভগ্নী ছিলেন। নিজের পুত্র ও পতির আচরণে তিক্ত হয়ে তিনি কিভাবে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, সে-কথাও আগে উল্লেখ করেছি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী খুসরো পিতামহের সময়েই পিতার সঙ্গে এমন শত্রুতায় উপনীত হন যে তার পরিণাম তাঁর পক্ষে ভালো হয়নি এবং পিতা পুত্রের রক্তলোলুপ হয়ে ওঠেন। খুসরোর সৎ-ভ্রাতা শাহজাহান নাম গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আরও দেখুনঃ