আকবরের মাতা-পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন, আসকরীর পত্নীর তত্ত্বাবধানে থাকতে শুরু করলেন আকবর। খানদানী প্রথা অনুসারে শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য ধাত্রী— আনকা— নিযুক্ত করা হল । শামশুদ্দীন মুহম্মদ ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজের যুদ্ধে নিমজ্জমান হুমায়ূনকে রক্ষা করেছিলেন, তাঁরই পত্নী জীজী আনকার উপর শিশুকে স্তন্যপান করানোর ভার দেওয়া হয়। অপর আনকা ছিলেন মাহম।
আকবরের মাতা-পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন | প্রারম্ভিক জীবন | আকবর
যদিও তিনি কদাচিৎ স্তন্যদান করেছিলেন, তথাপি তাঁকেই প্রধান আনকা বলে গণ্য করা হতো এবং তাঁর পুত্র আকবরের দুগ্ধভ্রাতা (কোকা কিংবা কোকলতাশ)— আদহম খানকে পরবর্তীকালে বহু সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন আকবর। তার মুখ থেকে তাঁর শৈশবের কথা শুনে আবুল ফজল ‘আইনে-আকবরী’তে ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন—
“আমি একথা পরম ধার্মিক শাহানশাহের পবিত্র মুখ থেকে নিজে শুনেছি : ‘আমার বেশ মনে আছে সেই সময়ের একটি ঘটনা। তখন আমি এক বছরের। পরম পূজনীয় পরম ধার্মিক জগৎপতি (হুমায়ূন) ইরানের দিকে চলে যান। আমাকে কন্দাহারে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন আমার বয়স এক বছর তিন মাস।
একদিন আদহম খানের মা মাহম আনকা মির্জা আসকরীকে বললেন— তুর্কিদের প্রথা আছে, যখন শিশু হাঁটতে শুরু করে, তখন তার পিতা, পিতামহ কিংবা তার সমতুল্য যে-কেউ, নিজের মাথার পাগড়ি খুলে তাই দিয়ে হাঁটতে-থাকা শিশুকে আঘাত করে, যাতে সে মাটিতে পড়ে যায়। এখন তো পরম পূজনীয় জগৎপতি এখানে নেই, তাঁর জায়গায় আপনি রয়েছেন, সেজন্য আপনিই এই বিধি পালন করুন, এটা মানুষের কুনজর দূর করার তুকতাকের মতো।
মির্জা তৎক্ষণাৎ তাঁর পাগড়ি খুলে আমার উপর ছুড়লেন। আমি পড়ে গেলাম । সেই আঘাত করা ও আমার পড়ে যাওয়া আমি যেন এখনও স্বচক্ষে দেখতে পাই । সেই সঙ্গেই মঙ্গল-কামনার জন্য তিনি আমায় বাবা হাসান আবদালের রওজায় নিয়ে গিয়ে আমার মস্তক-মুণ্ডন করিয়েছিলেন। সেই যাত্রা ও মস্তক-মুণ্ডনও যেন আয়নার সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল’।” এ থেকেই বুঝতে পারা যাবে, আকবর খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ ।
১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে শাহ তহমাস্প ইরানী সেনার সাহায্যে কন্দাহার আক্রমণ করার অনুমতি দিলেন । কন্দাহারে আকবরকে নিয়ে চিন্তা দেখা দিল। কেউ পরামর্শ দিল, তাঁকে তাঁর পিতার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। কামরান নিজের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলছিলেন।
আসকরী কি বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন, হুমায়ূনের ভাগ্য-পাশা আবার তাঁর অনুকূলে? তিনি আকবরকে কাবুলে পাঠিয়ে দিলেন। কামরান নিজের পিতৃস্বসা খানজাদা বেগমের হাতে অর্পণ করলেন। পরদিন বাওয়াগ-শহর-আরায় দরবার বসেছিল।
শবে- বরাত উপলক্ষ্যে দরবারকে খুব সুসজ্জিত করা হয়েছিল। সেদিন শিশুরা ছোট ছোট ঢোল নিয়ে খেলে। আকবরকেও দরবারে ডেকে পাঠানো হল। কামরানের পুত্র মির্জা ইব্রাহিমকে একটা রঙিন ঢোল দেওয়া হয়েছিল।

আকবর একেবারেই শিশু, তিনি বললেন— আমি ওই ঢোল নেব। উভয়েই জিদ ধরে বসলেন। কামরান বললেন— দু’জনে কুস্তি লড়াই করো, যে জিতবে, সে ওই ঢোল পাবে। ইব্রাহিম একটু বড়, তাই ভাবা হয়েছিল যে সেই জিতবে। কিন্তু ব্যাপার দাঁড়ালো উল্টো। আকবর তাঁকে পটকে দিলেন। সভাসদরা হেসে ফেললেন। যারা ভাগ্যলিপিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা ভাবছিলেন— ওটা খেলনা ঢোল নয়, বলা যেতে পারে, পিতার বৈভবের নাকাড়া।
আরও দেখুনঃ