আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ | মানসিংহ | আকবর

আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, ৯৬৮ হিজরীতে (১৫৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে) আকবর আজমের জিয়ারৎ (তীর্থযাত্রা) করতে গিয়েছিলেন। পথে জনৈক আমির বলেন যে মির্জা রাজা বিহারীমলের উপর জবরদস্তি করছেন, বেচারি প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছেন। বাদশাহ একজন আমিরকে পাঠিয়ে দেন বিহারীমলকে নিয়ে আসার জন্য।

আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ | মানসিংহ | আকবর

 

আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ | মানসিংহ | আকবর

 

রাজা স্বয়ং আসেননি, তবে উপঢৌকনের সঙ্গে আবেদনপত্র এবং সেই সঙ্গে নিজের ভ্রাতাকে দরবারে পাঠান। তাঁর আসার জন্য আকবর পুনরায় আগ্রহ প্রকাশ করলে রাজা বিহারীমল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ভগবানদাসের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করে সাঙ্গানেরে আকবরের দরবারে উপস্থিত হন। বাদশাহ তখন বৈরাম খাঁর হাতের ক্রীড়নক নন।

তাঁর উত্তম ব্যবহারে বিহারীমল তাঁর অনন্য ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং দরবারে আমিরদের মধ্যে তিনি স্থান পান। এর কিছুকাল পরে রাজা ভগবানদাস ও মানসিংহও দরবারে চলে আসেন। বিহারীমল অবসর লাভ করেন এবং পিতা-পুত্র উভয়েই আকবরের সর্বসময়ের সঙ্গী হয়ে থাকার জন্য সভাসদের মর্যাদা লাভ করেন।

আকবর ততদিনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে উভয় জাতিকে একসঙ্গে নিয়ে তাঁকে চলতে হবে, উভয় জাতির মধ্যে যে খাদ রয়েছে তা দূর করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন পরের বছর (১৫৬১-৬২ খ্রিঃ), যখন তাঁর বয়স উনিশ বছর, রাজা বিহারীমলের কন্যা অর্থাৎ মানসিংহের সহোদর পিতৃস্বসাকে তিনি বিবাহ করেন।

এই বেগমই জাহাঙ্গিরের মাতা, অর্থাৎ পরবর্তী মোগল বাদশাহ ছিলেন তারই পুত্র। তাঁকে মরিয়ম জমানী (যুগের মরিয়ম) উপাধি প্রদান করা হয় এবং সেই নামেই তিনি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ। এই সম্পর্কের পরে মানসিংহ ও রাজা ভগবানদাস আকবরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। অন্তঃপুরের বন্দোবস্তের ভার বরাবরের জন্য ভগবানদাসের উপর ন্যস্ত হয়। এ থেকেই জানা যায় যে তার উপর আকবরের কতখানি আস্থা ছিল ।

মানসিংহ বহুদিন কুমার মানসিংহ হিসেবেই থাকেন। ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ভগবানদাসের মৃত্যুর পরেই তিনি রাজা মানসিংহ হন। আকবরের প্রত্যেকটি বড় যুদ্ধাভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। মেওয়াড়ের রানাদের বীরত্বের আশ্চর্য ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য তিনি অত্যন্ত উচ্চপদে আসীন হন। আকবর সমগ্র ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই কাজে যিনি সানন্দে সহযোগিতা করেছিলেন, তিনি মানসিংহ। তাঁর পিতার মতোই তাঁকে মান-মর্যাদা দিয়ে নিজের বশীভূত করেছিলেন তিনি । অনমনীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ।

 

আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ | মানসিংহ | আকবর

 

রানা সাঁগার মতো সাহস ও কৌশল না থাকা সত্ত্বেও রানা উদয়সিংহ বশ্যতা স্বীকার পছন্দ করতেন না। সেজন্য তাঁর শাসনকালের একাদশ বর্ষে (সেপ্টেম্বর, ১৫৬৭ খ্রিঃ) আকবর চিতৌড় অভিযান করেন। বলা হয়, এর পূর্বেও একবার আকবর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। এ কথাও বলা হয় যে মালওয়ার বাজবাহাদুরকে রানা আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে আকবর তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন।

এটাকে অজুহাত বলা যেতে পারে। আকবর জানতেন, যতদিন না চওহানদের রণথম্ভৌর ও চিতৌড়কে পদানত করা যায়, ততদিন পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে না, সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ওই অজেয় দুর্গগুলি শত্রুদের হাতে থাকলে বিপদ থেকে বাঁচবার সম্ভাবনাও থাকবে না।

১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে অক্টোবর চিতৌড়ের দশ মাইল উত্তর-পূর্বে আকবরের সেনা শিবির স্থাপন করে । অবরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিতৌড় মানুষের হাতে তৈরি দুর্গ নয় শুধু, বলতে গেলে, সওয়া তিন মাইল দীর্ঘ, হাজার গজেরও বেশি প্রস্থ, আট মাইল প্রাকার-বিশিষ্ট, চার থেকে পাঁচ শত ফুট উচ্চতার এক অদ্ভুত পাহাড়কে (চিত্রকূট) দুর্ধর্ষ দুর্গে পরিণত করা হয়েছিল।

তবুও তা অজেয় ছিল না, কারণ এর আগে আলাউদ্দীন খিলজী চিতৌড় অধিকার করেছিলেন। বাহাদুরশাহ গুজরাতীও ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে চিতৌড় বিধ্বস্ত করেছিলেন। উদয়সিংহ প্রতিরোধ করতে আসেননি, সে-কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জয়মল্ল রাঠৌর এবং ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি বীর জয়মল্লের মৃত্যুর পরেই আকবর নিজের মনস্কামনা পূর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তিন শত রাজপুত নারী জওহর-ব্রত অবলম্বন করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।

 

আকবরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ | মানসিংহ | আকবর

 

তারা এমন কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে যে আকবরও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েন। শহরে গণহত্যার হুকুম দিয়ে বসেন তিনি। ত্রিশ হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় । রাজা ভগবানদাস চিতৌড়ের যুদ্ধে আকবরের সহযোগী ছিলেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment