আকবর ও জার পিতর

আকবর ও জার পিতর – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “মহান দ্রষ্টা” বিভাগের একটি পাঠ। ভিনসেন্ট স্মিথের পঙ্ক্তিগুলি পাঠ করার পূর্বেই আকবর ও রুশ নির্মাতা মহান পিতরের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পড়ছিল। আমার বন্ধু ড. কে. এম. আশরফ তাতে তাঁর মতভেদ প্রকাশ করেন, ফলে যেসব ব্যাপারে হুবহু সাদৃশ্য প্রশ্ন রয়েছে, আমি সেসব কথাও উল্লেখ করিনি। অথচ এমন বহু বিষয় রয়েছে, যা এই আশ্চর্য সাদৃশ্যকে সমর্থন করে।

আকবর ও জার পিতর

আকবর ও জার পিতর | মহান দ্রষ্টা | আকবর

 

আকবরের জন্ম ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে, তখতে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে । আকবরের মৃত্যুর সাতষট্টি বছর পরে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে পিতরের জন্ম, ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ এবং ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর আঠারো বছর পরে ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু। পিতর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভারতে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন, তিনি সুরাতে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতও করেছিলেন।

পিতর সম্পর্কে কিছু কথা বর্তমান লেখকের ‘মধ্য-এশিয়ার ইতিহাস (২য় খণ্ড)’ থেকে তুলে দিলাম— “পিতর যেখানে রুশকে অতি দ্রুততার সঙ্গে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছিলেন, সেখানে ভারতের ঔরঙ্গজেবের কাজ ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত । পিতর জ্ঞান- বিজ্ঞান ও সহিষ্ণুতার দ্বারা রুশকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলছিলেন, অপরপক্ষে ঔরঙ্গজেব ধর্মন্ধতার দ্বারা মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে রাষ্ট্রকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছিলেন। ঔরঙ্গজেবের অদূরদর্শিতার ফল ভারতকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভুগতে হয়, আর পিতরের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর রুশ পৃথিবীর অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠে । যদি বিপ্লবী পিতরে প্রশংসা না করা হয়, তাহলে সেটা অবাক হওয়ার কথা বৈ-কি!

“মাতা রাজকার্য দেখাশোনা করছিলেন, সুতরাং দেশের মধ্যে পিতরের থাকাটা তত জরুরি ছিল না। মুসলিম তুর্কির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপের রাজ্যগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে মস্কো একট মহা-দূতমণ্ডল প্রেরণ করে, ছদ্মবেশে পিতরও তার মধ্যে ছিলেন ।

তিনি ওইসব রাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়র, গোলন্দাজ ইত্যাদি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে দূতমণ্ডল মস্কো থেকে রওনা হয়, তাদের সঙ্গে পিতর মিখাইলোফ নাম ধারণ করে একজন সাধারণ জাহাজী হলেন। ইউরোপের সমস্ত বিষয় গভীর মনোযোগ সহকারে শিখে নেওয়ার অভিপ্রায় ছিল তাঁর।

পরবর্তীকালে পিতর তাঁর সিলমোহরে খোদাই করে রেখেছিলেন— ‘আমি শিক্ষক অনুসন্ধানকারী ছাত্র।’ এক্ষেত্রে আমরা পিতর ও ঔরঙ্গজেবের মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান লক্ষ্য করি। দূতমণ্ডলের আগেই পিতর কিংসবার্গ শহরে উপস্থিত হয়ে কামান চালানোর কৌশল শিক্ষা করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি হল্যান্ডের সার্ডম শহরে যান।

সার্ডম জাহাজ নির্মাণের জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। পিতর একটি সাধারণ কর্মকারের বাড়ি থেকে সামান্য ছুতোর হিসেবে জাহাজের কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন, কিন্তু সেখানে বেশিদিন আত্মগোপন করে থাকতে পারেননি। বহু ডাচ বণিক রুশ গিয়েছিল, সাড়ে ছয় ফুট লম্বা বলিষ্ঠ যুবক কি তাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে? লোকজনের হাত থেকে বাঁচার জন্য পিতর সেখান থেকে আমস্টডম চলে যান, সেখানে সবচেয়ে বড় একটি জাহাজ-কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। সেটা দুই-একদিনের লোক-দেখানো কাজ ছিল না।

যে জাহাজটি নির্মিত হচ্ছিল, সেটিকে যতদিন না জলে ভাসানো হয়, ততদিন, চার মাস ধরে আমস্টউমে কাজ করেছিলেন তিনি। জাহাজের কারখানায় কাজ করার সময় ছুটির পরে অন্যান্য কারখানা, মিস্ত্রিখানা, মিউজিয়মেও যেতেন, ডাচ বৈজ্ঞানিক ও শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করতেন। হল্যাণ্ড থেকে পিতর ইংল্যাণ্ড যান। সেখানে তিনি শাসনব্যবস্থা অধ্যয়ন করেন। তিনি একবার পার্লিয়ামেন্টের অধিবেশনও দেখতে গিয়েছিলেন । দুই মাস টেম্‌স্‌ নদীর তীরে অবস্থিত ডেপ্টফড কারখানায় জাহাজ-নির্মাণের কলা-কৌশল হাতে-কলমে শিক্ষা করেন তিনি।

 

আকবর ও জার পিতর | মহান দ্রষ্টা | আকবর

 

“পিতর তাঁর রাজ্যকে শক্তিশালী ও সমুন্নত দেখতে চাইতেন, সেজন্য রুশের উপর সুইডেনের আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য তিনি যোদ্ধাদের উৎসাহিত করতে গিয়ে বলেছিলেন— ‘যুবকবৃন্দ, এখন এটা সেই সময়, যখন আমাদের দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সেজন্য তোমরা ভেবো না যে তোমরা লড়াই করছ পিতরের জন্য । তোমরা লড়াই করছ সেই রাজ্যের জন্য যা পিতরকে অর্পণ করা হয়েছে। তোমরা লড়াই করছ তোমাদের পরিবারের জন্য, তোমাদের জন্মভূমির জন্য ।

শত্রুর অজেয়তার খ্যাতি তোমরা কয়েকবার তোমাদের বীরত্বের দ্বারা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছ। পিতরের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকুই যে, তোমরা সুনিশ্চিত জেনো, নিজের প্রাণ তার কাছে তুচ্ছ।’ “আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সুবায় বিভক্ত করেছিলেন এবং তার বন্দোবস্তের জন্য কিছু সংস্কার-সাধন করেছিলে। পিতরও তাই করেছিলেন।

“পিতরের সামরিক সংস্কার ও সে-কারণে সাফল্যলাভের বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি। পিতর স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়েন, তাতে নিয়মানুসারে রংরুট ভর্তি করা হতো, উর্দি ও হাতিয়ার দিয়ে তাদের খুব প্যারেড ও কুচকাওয়াজ করানো হত । পশ্চিম ইউরোপে কামান বহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার চালু হয়, তার পঞ্চাশ বছর পূর্বেই পিতরের তোপখানা ঘোড়া দিয়ে টানানো হতো।

শাসনব্যবস্থাতেও পিতর কয়েকটি বড় বড় পরিবর্তন সাধন করেন। ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজ্যকে আট গুবর্নিয়ায় (সুবা) বিভক্ত করেন। গুবর্নিরায় শাসক হতেন একজন গভর্নর, তাঁর সরাসরি সম্পর্ক থাকত কেন্দ্ৰীয় সরকারের সঙ্গে। প্রথমে গুবর্নিয়াগুলিকে তৈরি করা হয়েছিল বড় বড় আকারে, পরে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যকে পঁচাশিটি প্রদেশে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। প্রদেশ ও জেলার শাসককে বলা হতো যথাক্রমে গভর্নর (রাজ্যপাল) ও ভোয়েভাদ।”

 

আকবর ও জার পিতর | মহান দ্রষ্টা | আকবর

 

ভারতের মুসলমানদের মতো রুশেও সে-সময় দাড়ির সঙ্গে রক্ষণশীলতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । পিতর মনে করতেন যে দাড়ি পরিষ্কার করা মানেই রক্ষণশীলতাকে নিশ্চিহ্ন করা। সেজন্য তিনি নিজেই কাঁচি নিয়ে বসে যেতেন এবং এক নিঃশ্বাসে বড় বড় দাড়ি ছেঁটে ফেলতেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment