শেখ মুবারকের আগরায় আগমন – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শেখ মুবারক” বিভাগের একটি পাঠ। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই এপ্রিল আটত্রিশ বছর বয়সে মুবারক আগরায় আসেন। সময়টা গ্রীষ্মকাল, তার উপর তাপমাত্রার জন্য আগরা যথেষ্ট কুখ্যাত। কিন্তু অলীº-ফকিরের কথায় মুবারকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। আগরাতেও এক মস্ত ফকির শেখ আলাউদ্দীন থাকতেন। তিনিও তাঁকে সেখানে থাকতে বললেন। যমুনার পারে রামবাগ জনপদ তখন ছিল চারবাগ, তাকে আবার হস্ত-বেহেস্ত (অষ্টম স্বর্গ) বলা হতো। বাবরের দেওয়া নূর-আফশান (আলোকবর্ষী) নামেও প্রসিদ্ধ হয়েছিল। শেখ মুবারক চারবাগে গিয়ে পৌছলেন। মীর রফীউদ্দীন চিশতীর প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকার জায়গা জুটল।
শেখ মুবারকের আগরায় আগমন
মীর (সৈয়দ) মহল্লার সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্যক্তি, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। সেখানকার এক কুরেশী পরিবারে শেখ মুবারকের বিবাহ হয়। ১৫৪৭ অথবা ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ মারা যান। মুবারকের পাণ্ডিত্য দেখে সৈয়দ চেয়েছিলেন যাতে তাঁর আরও উন্নতি হয়, কিন্তু তিনি কিছু করে ওঠার আগেই চলে গেলেন। শেখ মুবারক তখন আরও নির্জনবাসে কাটাতে লাগলেন।
বহু বিদ্যার্থী তাঁর কাছে আসতে শুরু করল। তাঁর সন্ত- জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লোকে শ্রদ্ধাবশত নানাবিধ প্রণামী নিয়ে আসত, কিন্তু খুব কমই গ্রহণ করতেন তিনি। আগরায় পৌঁছানোর চার বছর পরে তেতাল্লিশ বছর বয়সে শেখ মুবারকের প্রথম পুত্র ফৈজীর জন্ম হয়। ফৈজী অত্যন্ত পণ্ডিত ছিলেন এবং মুসলিম-জগতের কবি-কুলের মধ্যে খোশরুর সমকক্ষ ছিলেন, অন্যান্য বিদ্যাতেও কারো সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যায় না। ফৈজীর চার বছর পরে ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে মুবারকের দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম হয়, তিনি তাঁর আপন গুরু খতীব আবুল ফজল গাজরুনীর নামে তাঁর নাম রাখেন আবুল ফজল ।
শেখ মুবারক যখন আগরায় আসেন, তখন শেরশাহের রাজত্বকাল চলছিল। দুই বছর পরে শেরশাহের জীবনাবসান হয় এবং ইসলামশাহ শাসনভার গ্রহণ করেন। কেউ কেউ মনে করতেন, ইসলামশাহের দরবারে শেখ মুবারকের যাওয়া উচিত। একদিকে সুফী মতবাদ ও জীবন তাঁকে আকর্ষণ করেছিল, অন্যদিকে শিয়া ও অন্যান্য মতবাদের দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।
তবে মোল্লাদের রক্ষণশীলতা তখনও তাঁর মধ্যে ছিল। কোথাও গান-বাজনা হলে তিনি সে-স্থান দ্রুত অতিক্রম করে চলে যেতেন, কারণ ইসলাম ধর্মে গান-বাজনা শোনাকে পাপ বলা হয়েছে। পায়জামা খুব নিচু হওয়া উচিত নয়, সেজন্য তিনি নিজে শুধু পায়জামা উঁচু করে পরতেন, তাই নয়, অন্য কেউ নিচু পায়জামা পরে তাঁর কাছে এলে বাড়তি অংশটুকু তাকে তৎক্ষণাৎ কেটে বাদ দিতে বলতেন। লাল রঙের পোশাক পরা অনুচিত, সেজন্য কাউকে ওরকম পোশাক পরতে দেখলেই তখনই তাকে খুলে ফেলার নির্দেশ দিতেন ।
সে সময় মোল্লা আব্দুল্লা সুলতানপুরী মখদুমুমুক্ পদ-লাভে সফলকাম হন। হুমায়ূনের দরবারে স্থান পেয়েছিলেন মোল্লা সুলতানপুরী । তিনি তো ইসলামশাহ শূরীর নাকের চুল বরাবর। হুমায়ূনের দরবারে মোল্লা জায়গা পেতেই ইসলামশাহ মনে মনে আল্লার কাছে নিজের মঙ্গল-কামনা করতেন । আসলে সুলতানপুরীর ক্ষমতাতেই হুমায়ূন পুনরায় সিংহাসন ফিরে পান, সেজন্য তিনি তাঁর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তবে হ্যাঁ, আকবরের দরবারের স্বতন্ত্র বাতাবরণ তাঁর তত অনুকূল হয়নি। মোল্লাও ভেবে দেখেন, তাঁর অত কাঙালপনা দেখানোর প্রয়োজন নেই ।
চারবাগের সেই নির্জনবাসী শেখের খ্যাতি অনেক দূর দূর জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বাবরের আমলে আগরা ছিল দিল্লীর প্রতিদ্বন্দ্বী। আকবরের আমলে আগরা তাঁর রাজধানী হয় । শেরশাহের বংশধরেরাও আগরার গৌরব বজায় রাখেন । মোল্লা ফতোয়ার কামাই খেতেন। কাউকে মাথা তুলতে দেখলেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া জারি করে দিতেন। মোল্লা সুলতানপুরীর জন্য লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
যাঁদের উপর এইরকম কোপ পড়ত, তাঁরা শেখ মুবারকের কাছে চলে আসতেন। ইসলামী ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্যে শেখ মুবারকের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি তাঁদের এমন কিছু উপায় বলে দিতেন, যাতে সুলতানপুরীর মুখভার করা ছাড়া উপায় থাকত না। অবশ্য সেটা বুঝতে অধিক বিলম্বও হতো না যে এসব চারবাগের মসজিদে চাটাই পেতে বসে থাকা শেখেরই কারসাজি।
ইসলামশাহের জমানায় সাম্যবাদী শেখ আল্লাঈ যখন প্রথমবার তাঁর দরবারে আসেন, তখন সুলতানপুরী তাঁর সর্বনাশের জন্য কোনো পন্থাই অবলম্বন করতে বাকি রাখেননি। দরবারে আল্লাঈ যখন মুখ খুললেন এবং জানালেন, যেসব দরিদ্রের রক্তঝরা রোজগারে তুমি ফুর্তি করছ, তাদের সেটুকু রোজগার করতে কত ঘাম ঝরাতে হয়— তখন ইসলামশাহের চোখ থেকেও অশ্রু ঝরে পড়েছিল, এবং সে-রাত্রিতে তাঁর সম্মুখে পেতে দেওয়া দস্তরখানে রকমারি স্বাদের খাবারে গরিবদের রক্ত তাঁর চোখে পড়েছিল ।
তিনি সেই খাবার খেতে রাজি হননি। কিন্তু কিছুকাল বাদে সুলতানপুরী ইসলামশাহকে দিয়েই আল্লাঈকে কতল করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ মুবারকও আল্লাঈয়ের উপদেশ দানের আসরে সামিল হতেন এবং তাঁর প্রশংসা না করে থাকতে পারতেন না, সেজন্য যদি কেউ তাকে মেহ্দীপন্থী (সাম্যবাদী) ও নাস্তিক বলে থাকেন, তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ।
ইসলামশাহের আমলে শেখ মুবারককে খুব সতর্ক থাকতে হতো। শেরশাহের বংশ বিলুপ্ত হতে হতে হেমচন্দ্রের (হেমু) প্রতিপত্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। শেখ মুবারকের পাণ্ডিত্য ও উদার মতবাদের সংবাদে হেমু তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। শেখের সুপারিশে হেমু বহু প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু হেমু বেশিদিন টিকে রইলেন না। মোগল ও পাঠানদের মধ্যে যে রক্তাক্ত সংগ্রাম চলছিল, তাতে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে। সেই সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষ হা-অন্ন হা-অন্ন করে মাথা কুটে মরছে। শেখের গৃহে সন্তান, ছাত্র, চাকর-বাকর মিলিয়ে প্রায় সত্তরজন লোক ছিল। সেই দুর্ভিক্ষে কিভাবে সংসার-নির্বাহ হবে! কখনো কখনো সারাদিনে হয়ত সের খানেক শস্যদানা জুটত, তাই মাটির হাঁড়িতে রান্না করে সকলে তার ফেন খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তির চেষ্টা করত। তখন ফৈজীর বয়স আট বছর এবং আবুল ফজলের বয়স পাঁচ বছর। সেই বিপদের মধ্যেও শেখ মুবারক সদা প্রসন্ন থাকার চেষ্টা করতেন ।
হুমায়ূন দিল্লীর সিংহাসন পুনরধিকার (১৫৫৫ খ্রিঃ) করেন। কিন্তু ছয় মাস পরেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। আকবর তেরো বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন । বৈরাম খাঁ তাঁকে খুব বেশি দিন হাতের ক্রীড়নক করে রাখতে সফল হননি। কুড়ি বছর বয়সে (১৫৬২ খ্রিঃ) আকবর শাসনক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। তার দু’বছর পরেই (১৫৬৪ খ্রিঃ) তিনি হিন্দুদের উপর থেকে জিজিরা কর তুলে দেন। ভারতে এক অন্য ধরনের হাওয়া বইতে শুরু করে। তার আগে শেখ মুবারককে গুরুতর বিপদ ও নানা সমস্যার মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল।
শেখ মুবারক দরবেশ ছিলেন না, তাঁর সুফী-সন্তের স্বভাব কিংবা প্রবণতাও ছিল না। কিন্তু তিনি নিজের উদার মতবাদ গোপন করার জন্য সবরকম ভেক নিয়েছিলেন, “অন্তঃশাক্তঃ বহিঃশৈবঃ সমামধ্যে চ বৈষ্ণবাঃ” হতে হয়েছিল তাঁকে। যতই অনাড়ম্বর জীবনযাপন করুন, কিন্তু পরিবার, দাস-দাসী, চাকর-বাকর এবং ছাত্র মিলিয়ে পাঁচ-ছয় ডজন লোকের খরচ— তার সংস্থান করা সহজ ছিল না। শেখ আব্দুন্ নবী সদর-অহ্ লেহাজত ছিলেন— শেরশাহ অভাবগ্রস্ত লোকের সাহায্যের জন্য একটি বিভাগ খুলেছিলেন, এটি সেই বিভাগের অধ্যক্ষের পদ।
ফৈজীকে নিয়ে শেখ সাহেবও ভাগ্য পরীক্ষার জন্য তাঁর কাছে গেলেন। শেখ মস্ত পণ্ডিত, ভালো অধ্যাপক এবং অভাবগ্রস্ত, তাঁর চেয়ে যোগ্য সাহায্যের পাত্র আর কে হতে পারে? তিনি মাত্র এক শত বিঘা জমি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু আব্দুন্ নবী তাঁর আবেদনপত্র গ্রহণ করতেও সম্মত হলেন না, অত্যন্ত ঘৃণাভরে রুক্ষস্বরে বললেন— এই মেহ্দীপন্থী নাস্তিককে দূর করে দাও। সেদিন সেই ঘটনা শেখ মুবারকের কিরূপ মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল এবং ফৈজীর মনে তার কিরূপ প্রভাব পড়েছিল, অনুমান করা কঠিন নয় ৷
আকবরের শাসনকালের প্রথম দিকে শিয়া ও কাফের আখ্যা দিয়ে মীর হবাশ ইত্যাদি বহু মানুষকে বন্দী এবং অনেককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল । আবুল ফজল লিখেছেন— কেউ কেউ আমার পিতাকে শিয়া মনে করে খারাপ কথা বলত। কিন্তু সেটা তিনি বিবেচনায় আনতে রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, কোনো ধর্মমত মেনে চলা এক কথা, আর সে-বিষয়ে জ্ঞানার্জন অন্য কথা।
ইরাক-আজম (ইরান)-এর এক উপযুক্ত পণ্ডিত মসজিদের ইমাম ছিলেন। কয়েকজন মোল্লা হানাফি সম্প্রদায়ের একটা উক্তির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন যে ইরাকীর সাক্ষ্য প্রামাণিক নয়। আর যাদের সাক্ষ্য প্রামাণিক নয়। তারা ইমাম হতে পারে কিভাবে? ইমাম-পদ থেকে অপসারিত করে সৈয়দের জীবিকা কেড়ে নেওয়া হলো। তিনি মুবারকের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুর্দশার কথা জানালেন। শেখ মুবারক তাঁকে সমাধানের পথ বাতলে দিলেন— ইমাম আবু হানিফার ইরাক বলার উদ্দেশ্য ছিল ইরাক-আজম (ইরান) নয়, বরং ইরাক- আরব।
এবং সেজন্য তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে অনেক উদাহরণ জানিয়ে দিলেন। যখন সেই সব প্রমাণ লিখে আকবরের সম্মুখে পেশ করা হলো, তখন বাদশাহ ইমামকে তাঁর পদে পুনর্বহাল করার হুকুম দিলেন। শত্রুরা মনে মনে জ্বলতে লাগলেন, কিন্তু কি করবেন? তাঁরা জানেন, চাবিকাঠি যোগানোর লোকটা কে ।
ঐতিহাসিক বদায়ূনী আকবরের সময়ে একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। দরবারে তাঁর মর্যাদাও ছিল। তিনি শেখ মুবারকেরই ছাত্র ছিলেন, কিন্তু কট্টর মৌলবাদী এবং বাইরে সেটা দেখানোরও প্রযত্ন করতেন। সেজন্য তিনি নিজের গুরুকে যদিও কখনো কখনো অব্যাহতি দিতেন, তাঁর দুই পুত্রের উপর তীক্ষ্ণ কলম চালাতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
বদায়ূনী জানতেন যে তাঁর গুরুকে লোকে শিয়া, মেহ্দীপন্থী, নাস্তিক বলে নিন্দামন্দ করে। মাঝে মাঝে তিনি তাঁর গুরুর সাফাইও গাইতেন। মিয়া হাতিম সম্ভলী তাঁর কালে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মশাস্ত্রী (ফকীহ্) বলে গণ্য ছিলেন। শেখ মুবারকের লেখাপড়ারও সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
একবার তিনি বদায়ূনীকে প্রশ্ন করলেন— শেখের পাণ্ডিত্য ও মতামতের উপযোগ কিরূপ? বদায়ূনী তাঁর গুরুর মোল্লাগিরি, সদাচার, বিদ্যাবুদ্ধি ও ধর্মাচরণের কথা জানালেন । মিয়া বললেন— ঠিক আছে, আমিও তাঁর খুব প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু, লোকে বলে, তিনি মেহ্দীর অনুগামী।
এটা কেমন কথা? বদায়ূনী জবাব দিলেন— মীর সৈয়দ মহম্মদ জৌনপুরীকে শেখ সাহেব অলী (সন্ত) এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলে মানেন, তার মানে এই নয় যে শেখ সাহেব মেহ্দীপন্থী। মিয়া হাতিমও স্বীকার করলেন যে সৈয়দ মহম্মদ জৌনপুরীর শ্রেষ্ঠত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সেখানেই মীর-অদল (ন্যায়াধ্যক্ষ) মীর সৈয়দ মহম্মদও বসে ছিলেন উভয়ের কথাবার্তা শুনে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন— লোকে শেখ মুবারককে মেহ্দীপন্থ বলে? বদায়ূনী উত্তর দিলেন— বলে। তার কারণ, তিনি ভালো কাজের প্রতি আগ্র প্রকাশ করেন এবং মন্দ কাজ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন ।
আরও দেখুনঃ