আবুল ফজলের বাল্যকাল | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের  বাল্যকাল, ভারতের সমগ্র ইতিহাসে শেখ আবুল ফজলের তুলনা আমরা একমাত্র কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্তের সঙ্গেই করতে পারি। কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধিশালী করে তোলার প্রয়াস করেছিলেন। আকবরের সময় একই কাজ করেছিলেন আবুল ফজল।

আবুল ফজলের  বাল্যকাল | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের  বাল্যকাল | আবুল ফজল | আকবর

 

তফাত বলতে এটুকুই যে কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তের কেবল প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, তাঁর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। যদি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আমাদের জন্য তৎকালীন রাজনীতি ও অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়ের ভাণ্ডার হয়, তো আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ ও ‘আইনে-আকবরী’ তদপেক্ষাও অনেক বড় ভাণ্ডার। ধর্ম ও সংস্কৃতির উগ্র কলহ-বিবাদ নিরসনের প্রয়োজন হয়নি কৌটিল্যের, কেননা ধর্মের মধ্যে কিছু ভেদাভেদ থাকলেও মৌর্য-কালীন ভারতের সংস্কৃতি ছিল এক। কিন্তু, আবুল ফজল যে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী ধর্মের নামে হত্যালীলার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল ।

আবুল ফজলের জন্ম ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি, আগরায় যমুনা-তীরে রামবাগে, সেকালে যা চারবাগ নামে পরিচিত ছিল। তাঁর পিতা শেখ মুবারক তাঁর সময়ের একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং সেই সঙ্গে উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। সে কারণে মোল্লারা তাঁকে বিধর্মী বলে তাঁর উপর সবরকম উৎপীড়ন চালাতে উদ্যত হয়েছিল এবং শেখকে আত্মগোপন করে চলতে হতো।

তিনি কখনো কখনো সুফী সন্তের বেশ ধারণ করে সাধনা-উপাসনা করতেন, কখনো মোল্লাদের থেকেও দুই পা বেশি এগিয়ে গিয়ে, সঙ্গীতের আওয়াজ শোনামাত্র কানে আঙুল দিতেন, কেউ ইসলাম ধর্মশাস্ত্র-বিরুদ্ধ দীর্ঘ পোশাক পরিধান করলে তাকে বাড়তি অংশ ছেঁটে ফেলার জন্য বাধ্য করতেও দ্বিধা করতেন না। কিন্তু, সে-সব ছিল তাঁর আত্মরক্ষার কবচ মাত্র। মোল্লারা তাঁকে সাম্যবাদী সৈয়দ মহম্মদ জৌনপুরীর অনুগামী, কখনো শিয়া, কখনো নাস্তিক বলতেন । তাঁর পাণ্ডিত্য থেকে লাভবান হতে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররা আসত তাঁর কাছে । মোল্লা বদায়ূনী তাঁরই শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন ।

 

 

আবুল ফজলের  বাল্যকাল | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল ফজলের শৈশব কেটেছে পিতার সেই দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপনের মধ্যে । তিনি ‘আকবরনামা’র তৃতীয় খণ্ডে নিজের প্রথম জীবনের কিছু কথা লিখেছেন। বলেছেন— “এক সওয়া-এক বছরের মধ্যে ঈশ্বরের কৃপায় আমার মুখে আরও পরিষ্কার কথা ফুটতে শুরু করল। পাঁচ বছর বয়সেই অলৌকিক প্রতিভার জানালা খুলে গেল । এমন সব কথা আমার বোধগম্য হতে থাকে, যা অন্য কারো কপালে জোটেনি।

পনেরো বছর বয়সে আমি পূজনীয় পিতার জ্ঞানভাণ্ডারের খাজাঞ্চী এবং তত্ত্বরত্নের পাহারাদার বনে গেলাম, কোষাগারে আসন পিড়ি হয়ে বসলাম। শিক্ষা-সংক্রান্ত আলোচনার জন্য আমার মন সর্বদা উৎসুক হয়ে থাকত, তুচ্ছ সাংসারিক কাজকর্মের কথা শুনলে মন শত যোজন দূরে বিক্ষিপ্ত হতো। প্রায়ই কিছু বুঝে উঠতে পারতাম না। পিতা নিজের মতো করেই আমাকে পড়াতেন, কানের কাছে জ্ঞানের মন্ত্র আওড়াতেন। প্রত্যেক বিষয়ে এক একখানা পুস্তক লিখে মুখস্থ করাতেন। যদিও জ্ঞান বাড়ছিল, তথাপি মন বসছিল না।

তাঁদের কখনো কখনো কিছুই মাথায় আসত না, কখনো সংশয় পথ অবরোধ করে দাড়াত পিতার বাণী সাহায্য করত না, অবরোধ সামান্য হালকা করে দিত মাত্র। বক্তৃতাতেও আমি পারদর্শী ছিলাম, কিন্তু মুখে কথা যোগাত না। লোকজনের সামনে আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসত, নিজেকেই ধিক্কার দিতাম।…

যাঁদের বিদ্বান বলা হয়, মধ্যে অন্যায় দেখেছি, তাই মনে মনে চাইতাম, একা থাকব, কোথাও পালিয়ে যাব। দিনের বেলা মাদ্রাসায় জ্ঞানচর্চার আলোয় থাকতাম, রাতের বেলা নির্জন ধ্বংসস্তূপে ছুটে বেড়াতাম ।…ইতোমধ্যে একজন সহপাঠীর সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেল, ফলে মাদ্রাসার প্রতি আবার আমার আকর্ষণ বাড়ল “

আবুল ফজল আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । নাম-ধাম যাই হোক, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভারতীয় । গায়ের রঙও ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ । তিনি বলতেন— “ফরসাদের হৃদয় কালো হতে পারে, কিন্তু আমার গায়ের রঙ কালো হলেও হৃদয় সাদা।” তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঘরে দারিদ্র্যের সীমা- পরিসীমা ছিল না, কিন্তু আবুল ফজল বুঝতে পারতেন না, তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে, না পেট ভর্তি। যখন পড়াশোনায় মন দিতেন, তখন যেন দশ বছরের জন্য সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। দুই-তিন দিন পর্যন্ত তাঁর খাওয়ার কথা খেয়াল থাকত না, জ্ঞানের ক্ষুধার সামনে পেটের ক্ষুধা বেমালুম ভুলে যেতেন।

শুকনো বাসি যে কোনো খাবার দু’গ্রাস পেটে পড়লেই তাঁর মনে হতো, মান্নার` চেয়ে কম সুস্বাদু না। তখনও তিনি বালক মাত্র, তবুও প্রবীণ আলিমদের কথাবার্তা শুনে তাঁর সংশয় দেখা দিত। তাঁরা পরস্পরের কাছে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন, শিশু ভেবে তাঁর দিকে মনোযোগ দিতেন না। আবুল ফজলের মন তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠত। তাঁর সৌভাগ্য ছিল যে শেখ মুবারকের মতো পিতা পেয়েছিলেন, তিনি বালকের সংশয়কে অহেতুক মনে করতেন না ।

 

আবুল ফজলের  বাল্যকাল | আবুল ফজল | আকবর

 

পনেরো বছরে পা দিতে না-দিতেই অধ্যাপনা শুরু করলেন । ‘হাশিয়া- আস্ফাহানী’ (আস্ফাহানী রচিত টিকা) পড়ানো হচ্ছিল । পুস্তকখানিও এমন জুটেছিল যে তার পৃষ্ঠাগুলোর অর্ধেকের বেশি উইপোকায় খাওয়া। আবুল ফজল প্রথমে পচা- সড়া পাতাগুলোর ধারে ধারে কাগজ সাঁটলেন। তারপর ঊষাকালে বসে বসে যে যে বাক্য কাটা পড়েছে, তার আদি ও অন্ত দেখে, কিছু ভেবে-চিন্তে, খানিকটা অর্থ অনুমান করে লিখে গেলেন। এইভাবে সারা বইখানাই সম্পূর্ণ করলেন তিনি। মিলিয়ে দেখা গেল, মাত্র বত্রিশ জায়গায় কেবল বিকল্প শব্দের ব্যবধান, তিন-চার জায়গায় একই শব্দ । লোকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment