Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

উজবেকদের বিদ্রোহ | রাজ্যবিস্তার | আকবর

উজবেকদের বিদ্রোহ | রাজ্যবিস্তার | আকবর

উজবেকদের বিদ্রোহ, খানেজমাল আলী কুল্লি খাঁ হুমায়ূনের ভারত পুনরধিকার করতে বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি উজবেক ছিলেন, অর্থাৎ তাঁর সম্পর্ক ছিল মধ্য-এশিয়ার সেই বংশের সঙ্গে, যাঁরা তৈমূরী বংশের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাবরকে বিতাড়িত করেন। তবু, ব্যক্তিগত স্বার্থ কুলগত স্বার্থের উপর স্থান পায় এবং এই উজবেক হুমায়ূনের সেবাকার্য ও সহায়তা করেন।

উজবেকদের বিদ্রোহ | রাজ্যবিস্তার | আকবর

 

 

তাঁকে জৌনপুর সুবার শাসক করা হয়। তিনি ভাবলেন, তিনি নিজেই নতুন শর্কী সুলতান হবেন না কেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে তিনি বিদ্রোহ করে বসলেন। খানেজমানের ভ্রাতা বাহাদুর খাঁ ও পিতৃব্য ইব্রাহিম তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শাহী সেনা বিদ্রোহ দমন করতে আসে। তিনি পরাজয় স্বীকার করে নিমসারের (জেলা সীতাপুর) দিকে সরে পড়েন।

সেই সময় টোডরমলের নাম সর্বপ্রথম উঠে আসে। উভয়পক্ষে আপস-আলোচনা শুরু হয়েছিল। টোডরমল তার কঠোর বিরোধী ছিলেন। আকবর স্বয়ং যাত্রা করলেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে যমুনা অতিক্রম করে, কালপী হয়ে প্রয়াগে পৌঁছান। কড়া মানিকপুরে বাদশাহী শিবির স্থাপিত হয় এবং খানেজমান পাটনার সামনে হাজীপুরে গিয়ে দণ্ডায়মান হতে সাহসী হন, সেখানে গঙ্গা ও গণ্ডকের স্রোত জোটবদ্ধ হওয়ার কাজ করছিল। আকবর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না । তিনি 

জৌনপুরকে নিজের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে রেখেছিলেন। আসফ খাঁ সাহায্য করার জন্য এসেছিলেন। সেখানে গোপন আলোচনা তাঁর কর্ণগোচর হয়— চৌরাগড়ের অপকর্ম ফাঁস হয়ে গেছে এবং সেজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি সঙ্গ ত্যাগ করে পলায়ন করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে তরবারির সাহায্যে মীমাংসা সমীচীন বোধ করলেন না আকবর। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মিটমাট করার উদ্দেশ্যে মুনায়ম খাঁ বক্সারের নিকটে গঙ্গার মাঝখানে নৌকোর উপর খানেজমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। খানেজমান দরবারে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। আকবর ক্ষমা করে দিয়ে ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন।

১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মালওয়ার সুবেদার আব্দুল খাঁ উজবেক বিদ্রোহ করেন। পার মুহম্মদের বদলে আকবর তাকেই সেখানকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনা-সহ আকবর স্বয়ং রওনা হন। নরওয়র অঞ্চলে হাতির খেদা বানিয়ে সত্তরটি হাতি ধরা হয়।

সে সময় ওই এলাকার জঙ্গলে হাতি থাকত। যদিও আজকাল সারা বিন্ধ্য পার্বত্যাঞ্চলে কোথাও তাদের দেখা পাওয়া যায় না। মাণ্ডু পৌঁছে আকবর আব্দুল্লাকে পরাজিত করেন। তিনি গুজরাতে পলায়ন করেন । প্রত্যাবর্তনের সময় সিপরীতেও খেদা করে অনেক হাতি ধরেন এবং অক্টোবরে আগরায় পৌছান।

আকবরের অবাধ্য হাতিকে বশীভূত করার খুব শখ ছিল । এই সময় খাঁড়িরায় হাতিকে তিনি বশ করেন। খাঁড়িরায় একটা অঙ্কুশকে আমলই দিত না। আকবর দুহাট অঙ্কুশ নিয়ে তার ঘাড়ে চেপে বসেন ও তাকে কাবু করতে সফল হন । পরে আব্দুল্লা জৌনপুরে গিয়ে তাঁর উজবেক ভ্রাতা খানেজমানের সঙ্গে মিলিত হন।

 

 

মির্জা হাকিমের আক্রমণ (১৫৬৬ খ্রিঃ)— খানেজমানের বিদ্রোহে আকবরের সৎ- ভ্রাতা মুহম্মদ হাকিমের সাহস বেড়ে যায়। তিনি কাবুল থেকে এসে পাঞ্জাব আক্রমণ করেন। তখন নগরচৈন প্রতিষ্ঠা করে আক-বর বিশ্রাম করছিলেন। খবর পেয়েই তিনি খানখানানকে (মুনায়ম খাঁকে) রাজধানীর দায়িত্ব অর্পণ করে ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর রওনা হন।

দিল্লীতে তাঁর পিতার স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন তিনি। তখনও তার নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হতে তিন বছর বিলম্ব ছিল। ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে তিনি লাহৌর পৌছান। মুহম্মদ হাকিম লাহৌরে এসে নিজের নামে খুৎবা পাঠ করিয়েছিলেন, কিন্তু ভ্রাতার আগমন-সংবাদ পেয়ে সিন্ধু ত্যাগ করে পলায়ন করেন।

লাহৌরে থাকার সময় আড়ম্বরপূর্ণ কমরগা মৃগয়াক্রীড়ার আয়োজন করেন। চেঙ্গিস খারও এই ক্রীড়া খুব প্রিয় ছিল। তৈমূরও অনেকবার এই ক্রীড়ার আয়োজন করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যূহ-রচনার মতো পঞ্চাশ মাইল লম্বা-চওড়া জঙ্গলকে সৈন্য দিয়ে বেষ্টন করা হতো।

তারপর সেই বেষ্টনীকে ক্রমশ ছোট করতে করতে কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে জঙ্গলের সমস্ত জীবজন্তু এক জায়গায় জড়ো হতো। তখন শিকার শুরু হতো। একেই বলা হতো কমরগা। আক-বর তরোয়াল, বর্শা, তীর-ধনুক, বন্দুক— সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চার-পাঁচ দিন শিকার করেন। ভারতে সম্ভবত তিনিই প্রথম ও শেষবার এরূপ মৃগয়া করেন।

এই সময় আসফ খা আকবরের শরণাগত হন এবং তিনি তাঁর অপরাধ মার্জনা করে দেন। এই সময় খবর পান, হুমায়ূনের কৃপায় জায়গিরপ্রাপ্ত তৈমুরী মির্জারা বিদ্রোহ করেছেন, ফলে আক-বরকে আগরায় ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়। মির্জারা আকবরকে বহুদিন পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন। সে- বিষয়ে আমরা পরে বলব।

আক-বর লাহৌর থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে এপ্রিল মাসে থানেসরে শিবির স্থাপন করেন। সে সময় সেখানে কোনো মেলা ছিল। মেলায় স্থান নিয়ে গিরি ও পুরা সাধুদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়। সন্ন্যাসী ও অন্যান্য সাধু ইতিমধ্যে নিজের নিজের নাগাদের সৈনিক-সংগঠন তৈরি করে ফেলেছিল। উভয় দলই বাদশাহের নিকটে প্রার্থনা জানায় যে তরোয়ালের সাহায্যে এই বিবাদের মীমাংসা করতে তাদের অনুমতি দেওয়া হোক । বাদশাহ অনুমতি দিলেন। উভয় দলই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে তরোয়াল হাতে নিয়ে এক-একজন করে নাগা লড়াই করতে এগিয়ে এল।

তারপর শুরু হল উভয় দলের ধুমধাড়াক্কা যুদ্ধ। তরোয়াল বাদ দিয়ে তীর-ধনুক, তারপর ইট-পাথরে নেমে এল। আক-বর দেখলেন পুরী সংখ্যায় কম, তখন তাদের সাহায্য করার জন্য তিনি তাঁর লোকজনকে ইঙ্গিত করলেন। সাহায্য পেয়ে পুরীরা গিরিদের মেরে তাড়াল। কুড়ি জনের মৃত্যু হয় । কারো কারো মতে, পুরীরা দুই তিন শত লোক ছিল আর গিরিরা ছিল পাঁচ শত। আক-বর সেই রক্তাক্ত সংগ্রাম দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন ।

খানেজমানের অন্তিম পরিণতি (১৫৬৭ খ্রিঃ)— খানেজমান আন্তরিকভাবে অধীনতা স্বীকার করেননি । তিনি গঙ্গা অতিক্রম করবেন না বলে অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু তিনি গঙ্গা পেরিয়ে কালপীর দিকে অগ্রসর হন। আক-বরও মানিকপুর ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি হাতির পিঠে চড়েই গঙ্গায় লাফিয়ে পড়েন। অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার, কিন্তু আক-বর তা গ্রাহ্যই করলেন না। তাঁর অনুগামী এক হাজার দেড় হাজার সৈন্যও গঙ্গায় লাফ দেয় । আক-বরের অনুমান ঠিক বলেই প্রমাণিত হয় ।

খানেজমান ও তাঁর সর্দারেরা সুরাপানে নেশাগ্রস্ত ছিলেন। পাহারার জন্য কোনো সান্ত্রীও রাখেননি। লড়াই হয় ইলাহাবাদ জেলার একটি গ্রামে, গ্রামটির নাম সকরাবল কিংবা মকরাবল। বিজয় উপলক্ষ্যে তার নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ফতেহপুর । খানেজমান নিহত হন।

বাহাদুরকে বন্দী করে তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। আক-বর কিছু সর্দারকে ক্ষমা করেন, অনেককে হাতির পদতলে পিষে হত্যা করা হয়। হুকুম দেন, কেউ তুরানী বিদ্রোহীদের মাথা কেটে আনলে তাকে এক আশরফি ও ভারতীয় বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রে এক টাকা প্রত্যেক মাথা-পিছু পুরস্কার দেওয়া হবে ।

 

 

আকবরের ক্রোধের সীমা-পরিসীমা ছিল না। মনকুওয়ার থেকে তিনি প্রয়াগ ও বারাণসী যান। উভয় নগরই ফটক বন্ধ করে দিয়ে অপরাধ করেছিল। সেজন্য তিনি ওই নগর দুইটি লুণ্ঠন করে দণ্ড দিয়েছিলেন । খানেজমানের জায়গির মুনায়ম খা খানখানা লাভ করেন। এই অভিযান সমাপ্ত করে আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই আগরায় ফিরে আসেন ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version