কবিরাজ ফৈজীর মহৎ হৃদয়

কবিরাজ ফৈজীর  মহৎ হৃদয় – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। তাঁকে একই সারিতে সহজেই বসানো যেতে পারে। তাঁর কবিতাগুলি ফারসি ভাষায় রচিত বলে তাঁর পরিচয় খুব কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এটা দুঃখজনক । ফৈজী কেবল কবি নন, তিনি নতুন ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা, যার প্রয়াস শুরু হয়েছিল আকবরের নেতৃত্বে। তবে তাঁর সেই প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি, যদিও সে প্রয়াসের পর সাড়ে তিন শত বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে।

কবিরাজ ফৈজীর মহৎ হৃদয়

 

কবিরাজ ফৈজীর মহৎ হৃদয় | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

ভারত-বিজয়ের পর মুসলিম শাসকের অষ্টম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের কম-বেশি ভূ-ভাগে নিজেদের শাসন-ব্যবস্থা কায়েম রেখেছিলেন। প্রথমে সিন্ধু ও মুলতান পর্যন্তই মুসলিম শাসন সীমাবদ্ধ ছিল। মাহমুদ গজনবী এবং তাঁর পরবর্তী সুলতান-বাদশাহেরা তুর্কি হলেও তুর্কি ভাষা নয়, ফারসি ভাষাকেই রাজভাষা করেছিলেন।

তুর্কি মাতৃভাষা হিসাবেও দু’-চার প্রজন্ম পর্যন্ত চলার পরই লুপ্ত হয়ে যায় । বাবর তুর্কি ছিলেন, মঙ্গোল বা মোগল কখনোই নন। তিনি তুর্কি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ও গদ্যকার ছিলেন। হুমায়ূনও তুর্কি-ভাষী ছিলেন, যদিও পিতার মতো ফারসিও তাঁর নিজের ভাষা ছিল । আকবর তুর্কি ও ফারসি দু’টি ভাষাই মাতৃভাষা হিসাবে জানতেন। পিতা-পিতামহের ভাষা বলে জাহাঙ্গিরেরও তুর্কি ভাষায় দখল ছিল।

কিন্তু তারপরেই তুর্কি ভাষার প্রদীপ-শিখা নিভে যায় এবং ফারসি মোগল রাজবংশের মাতৃভাষা হয়ে ওঠে। শেষ দিকে মোগলেরা দিল্লীর আশেপাশের ভাষাতেও কথা বলত, তবু ফারসিই ছিল তাদের মাতৃভাষা। সেজন্য মুসলিম আমলে ফারসি রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্যের ভাষা হয়।

তাদের মধ্যে কেউ লোকভাষায় (হিন্দীতে) কবিতা রচনা করার আবশ্যকতা বোধ করত না, কারণ দরবারে সে-ভাষার মর্যাদা ছিল না। খুসরোর কিছু হিন্দী কবিতা নমুনা হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়, তবে সেগুলির কোনো পুরাতন হস্তলিপি পাওয়া যায়নি। সেজন্য সেগুলি খুসরোর ভাষার রূপান্তর কিংবা আদৌ তাঁর কবিতা কি না নির্বিবাদে বলা যায় না ।

কবিতায় খুসরোর সঙ্গে ফৈজীর তুলনা করা যেতে পারে। সমগ্র ফারসি-জগতে খুসরোর স্থান অনেক উঁচুতে, তাঁর পাশে ফৈজীকে বসাতে অনেকেরই আপত্তি আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ফৈজী উচ্চশ্রেণীর কবি ছিলেন না। ফৈজী ভারতীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন।

তিনি ফারসি ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফারসি ছিল দরবারের ভাষা, এবং তিনি ছিলেন আকবরের ‘মালিকুশ্ শু’আরা’ (কবিরাজ)। ফৈজী ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করলেও তাঁর সমস্ত কাব্যের বিষয় ভারতীয়। ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করার জন্য ভারি অহঙ্কার ছিল তাঁর। তিনি ইরান ও আরবকে ভারতের মাটির তুলনায় তুচ্ছ মনে করতেন। ‘নল-দমন’ (নল-দময়ন্তী) প্রেমোপাখ্যান (মসৃনওয়ি) তার প্রমাণ। প্রেমেও ভারত সকলের উপরে, এ কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন—

 

কবিরাজ ফৈজীর মহৎ হৃদয় | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

দহিন্দ্ জ-ই সর্ত্তজী-স্ত্। জাঁরা বনওয়াশ্ বাজ গতী-স্ত্ ।

(ভারতে এমন প্রেম হলো যে প্রেমের জন্য প্রাণও উৎসর্গ করে দিল।)

দহিন্দ্ ব-বী কি ইশ্ক্‌ চুঁ বুদ দিল্হা ব-চে দশনাঃ গফ্-খুঁ বুদ্ ।

( ভারতে দেখো প্রেম কেমনতর, হৃদয়কে ডুবিয়ে দিলো রক্তে।)

জী খাক চেনা ইশ্ক্-বাজা রক্তান্দ্ দিল্ জো জিগর গুদাজা

আতিশ জদ্ জো খুদ্-বখুদ্ গুজস্তান্দ্ । খাস্তরে-দেরে ইক্ গান্দ্ ।

 

এই মাটিতে কত শত প্রেমিক হৃদয়-মনকে মুগ্ধ করে দেয়। নিজেকে নিজেই আগুনে পুড়িয়ে, প্রেম-মন্দিরের বিভূতি হয়ে যায়।) এখানে ফৈজী ভালোবাসার জন্য নারীদের চিতায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলতে চেয়েছেন, ভালোবাসায় ভারতের স্থান পৃথিবীর মধ্যে সকলের উপরে। স্বদেশের মাটির জন্য তাঁর গর্ব ছিল। ভারতের নল-দময়ন্তীর বিষয় প্রসঙ্গে তিনি পুনরায় গর্বভরে বলেছেন —

ঈ নশাঃ অজা জিয়াদ্ দারম্ ।

ক-জ শকরে হিন্দ্ বাদাঃ দারম্ ।

আমার এই ভালোবাসার নেশা বেশি,

কারণ আমার পাত্র পূর্ণ ভারতের চিনিতে।

ঈ শো-অ-লা ব-হিন্দ্‌ গম্ খেজ’স্ত্।

ঈজা কি আফ্‌তাব্ তেজ’স্ত্

ইশকে-অরব ব অজম্ শুনীদম্। অহিন্দ্ বগোয়ম্ আঁচে দীদম্। ছাত (এই প্রেমের অগ্নিশিখা ভারতে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। এটি সেই স্থান, যেখানে সূর্য প্রখর । আরব ও ইরানের প্রেমের কথা আমি শুনেছি। ভারতের প্রেমের কথা বলছি, যা আমি দেখেছি।) তারপর ভারতের প্রেমে বিভোর হয়ে দৃষ্টান্তমূলক নগরী (আগরা) সম্বন্ধে সম্ভবত এই বর্ণনা দিয়েছেন— ঈ বাদ মজুবাঃ সজম্ হরকর। কী নশাঃ বহিন্দ্ বাশদ্ য়ো বস্ ঈ রিস্ত্ ব-সেহর্-হিন্দ্ রাদ্। ওয়া-ঈ সজ্ ব-খাকে-হিন্দ্ কান্দ্ । হিন্দ’স্ত ওয়া হজার আলমে ইশ্ক্। হিন্দ’স্ত ওয়া জহাঁ-জহাঁ গমে ইক্ । বে নশা-ওয়াফা খতে জবী নেত্। বেরঙ্গে জিগর্ গুলে-জর্মী নেত্ ।

থাকশ্ হমী জর্রা-জর্রাঃ মুহরাত্। হর্ জর্রঃ চিরাগে-নুহ্-সিপহরাত্। (এই পাত্র একটা দলের প্রত্যেক ব্যক্তিকে মত্ত করে দিতে পারে, কেননা এই নেশা যে ভারতের । ভারতের জীবনের সঙ্গে এই সম্পর্ক জড়িত । ভারতের মাটি থেকে উদ্গত হয়েছে এই সত্য। এই ভারত, যা ভালোবাসার সহস্র পৃথিবী । এই ভারত, যা প্রেমেরদুঃখের জগৎ। প্রেম-রেখা ব্যতীত এখানে ভাগ্যরেখার অস্তিত্ব নেই। হৃৎপিণ্ডের রঙ ছাড়া এখানে ফুলের মাটি হয় না। এর মাটির এক-এক কণা সূর্য। এর প্রত্যেক কণা

“ফারসি সাহিত্যের মহাকবিরা •‘খসা’ ‘পঞ্চ-গঞ্জ’ (পঞ্চনিধি, পঞ্চরত্ন অথবা পঞ্চ মহাকাব্য) লিখে নিজেদের শিল্পকলা ও প্রতিভার সম্যক পরিচয় দিয়ে একটি পরম্পরা তৈরি করেছেন। নিজামী (জন্ম ১১৪১ খ্রিঃ) প্রথম কবি, যিনি পঞ্চ-গঞ্জ লেখেন। জামী (১৪১৪-৯২ খ্রিঃ) নিজামীর অনুকরণে পঞ্চ-গঞ্জ রচনা করেন। তাঁর সমকালীন তুর্কির ।

(উজবেকের) কালিদাস নওয়াই ও (১৪৪১-১৫০১ খ্রিঃ) তুর্কি ভাষায় পঞ্চ-গঞ্জ, লিখেছেন। জামীর পূর্বেই খুসরো দেওয়ি নিজের পঞ্চ-গঞ্জ লিখে ফেলেন। প্রায় এক বা একাধিক উপাখ্যান নিয়ে নিজের কৃতিত্ব প্রদর্শন সহজ কাজ নয়। তবু তারা সে-কাজ করে সাফল্য লাভ করেছেন, এটা নিতান্ত মামুলি ব্যাপার নয়। কাব্যশাস্ত্র শোনার খুব শখ ছিল আকবরের। তিনিই ফৈজীকে নতুন পঞ্চ-পঞ্জ’ লিখতে অনুপ্রাণিত করেন। নিজামীর পঞ্চ-গঞ্জের সামনাসামনি ফৈজীকে নিজের পঞ্চ-গঞ্জ রচনা করতে হবে নিম্ন প্রকারে—

 

কবিরাজ ফৈজীর মহৎ হৃদয় | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

এটা দেখলে বোঝা যাবে যে ‘আকবরনামা’ ও ‘নল-দমন’ ভারতীয় রঙে ফৈজী লিখতে চেয়েছিলেন । তিনি কেবল ‘নল-দমন’ কাব্যই চার হাজার বায়েতে (পঙ্ক্তিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। যদি পাঁচটি মহাকাব্যই ভারতীয় বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে হতো, তাহলে সম্ভবত তিনি সেগুলো করে ফেলতেন। 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment