কাঁগড়া বিজয় – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম” বিভাগের একটি পাঠ। কাঁগড়ার (নগরকোট) রাজা জয়চন্দ্র আকবরের অধীনতা স্বীকার করেছিলেন, দরবারেও হাজির হতেন তিনি। একবার কোনো এক অপরাধের জন্য তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। তাঁর পুত্র বিধিচন্দ মনে করেন, তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। বাদশাহ কবিরাজ মহেশদাসকে রাজা বীরবল পদবি দিয়ে কাঁগড়া জায়গির প্রদান করেন।
কাঁগড়া বিজয়
ভেবেছিলেন, কাঁগড়ায় নগরকোট (ভওয়ন), জ্বালামুখী ইত্যাদি পবিত্র তীর্থ রয়েছে, অধিবাসীরা সকলেই হিন্দু, ব্রাহ্মণকে জায়গির দিয়ে প্রাচীন রাজবংশ অপসারণের ক্ষোভ দূর হয়ে যাবে। হুসেন কুল্লি খাঁর (খানজাহান) উপর আদেশ হয় কাঁগড়াকে রাজা বীরবলের অধিকারে নিয়ে আসতে।
খানজাহান সেনা নিয়ে ধমেরি পৌছান। ধমেরি (ধর্মগিরি) অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গ ছিল, কাঁগড়া যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত। জাহাঙ্গিরের আমলে সেখানকার রাজা নিজের বাদশাহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তার নাম রেখেছিলেন নূরপুর, সে-নাম অপেক্ষা ধমেরি এখনও প্রসিদ্ধ।
ধমেরির শাসক দুর্গ ত্যাগ করে বার্তা পাঠালেন যে কাঁগড়ার রাজা তাঁর আত্মীয়, সেজন্য তিনি খানজাহানের সম্মুখে সশরীরে হাজির হতে পারবেন না, তবে পথ-প্রদর্শন করবেন। ধমেরি অধিকার করে খানজাহান অগ্রসর হন। কোটলার শাসক প্রতিরোধ করলেন। কাঁগড়ায় এক প্রাচীন রাজবংশ ছিল গুলের।
কোটলা ছিল তাদেরই অধিকারে। রাজা রামচন্দ্রের জামাতা গুলেরদের হাত থেকে এই দুর্গ কেড়ে নিয়েছিলেন। গুলের রাজা উত্তমচন্দ শত্রুর শত্রুকে মিত্র ভাবলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। খানজাহান দুর্গের চারদিক অবরোধ করে কামান বসিয়ে দিলেন। দিনভর গোলাগুলি চলল। সন্ধেবেলা তারা শিবিরে ফিরে গেল। দেখা গেল, রাতেই দুর্গের লোকজন পালিয়ে গেছে। সকালে কোটলা অধিকার করা হল। খানজাহান সেটাকে গুলের-রাজের হাতেই তুলে দিলেন। গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেনা এগিয়ে চলল ।
খানজাহান এমন এক পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিলেন যে কোনো কিছুই ভালো করে ঠাহর হচ্ছিল না। কত উঁচু-নিচু জায়গা অতিক্রম করে ঘোড়া, হাতি, উট, লোক-লশকর সমেত তোপখানা নিয়ে যেতে হল। কুঠার দিয়ে পথের ঝোপঝাড় গাছপালা সাফ না করে সম্মুখে যাত্রা সম্ভবই ছিল না। কাঁগড়ার অজেয় দুর্গ পাহাড়ের উপরে ছিল, নিচে উদ্যান ও ঘোড়দৌড়ের ময়দান।
মোগল সেনা সেখানেই শিবির স্থাপন করল। নগরের উপকণ্ঠে প্রসিদ্ধ ভবানী মন্দিরের চারদিকে ভওয়ন উপনগর, তাকে রক্ষা করার জন্য হাজার হাজার হিন্দু প্রাণ দিল, কিন্তু ভওয়নকে রক্ষা করতে পারল না। বদায়ূনীর বক্তব্য অনুসারে, দেবী-মন্দিরের স্বর্ণছত্র গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং বহুকাল সেইভাবেই পড়েছিল। সেখানে প্রায় দুইশত কৃষ্ণ গাভী ছিল, ভক্তিভরে খুব পূজা করা হতো তাদের। মোগল সেনা সেগুলোকে হত্যা করে ফেলে। যে বীরবলের নামে এই কার্যকলাপ সংঘটিত হয়, তাঁকে কাঁগড়াবাসীরা কিরূপে ক্ষমা করতে পারে?
কাঁগড়া দুর্গের রাজপ্রাসাদের উপরেও তোপ দাগা হয়েছিল। রাজা ভোজন করছিলেন। বাড়ি ভেঙে পড়ে এবং ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়ে আশি জন লোকের মৃত্যু হয়। কোনোরকমে রাজার প্রাণরক্ষা হয়। তিনি সন্ধি করতে রাজি হন। দুর্গ দখল করার আর কোনো অসুবিধেই ছিল না, কিন্তু সেই সময়েই খবর এল, ইব্রাহিম মির্জা পরাজিত হয়ে গুজরাতের দিক থেকে পালিয়ে এসে দিল্লী-আগরায় হত্যা-লুণ্ঠন চালিয়ে লাহৌর অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন। লাহৌর রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল।
খানজাহান যুদ্ধ- পরিষদ আহ্বান করে পরামর্শ নিলেন। আমিরেরা বললেন— প্রথমে লাহৌর রক্ষা করা উচিত। কিন্তু কাঁগড়া দুর্গ তো হাতের মুঠোয়, সেটাকে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়া ঠিক নয়। সেনাপতিরা তাঁর কথায় সম্মত হলেন না, তখন তিনি সকলকে তাঁদের মতামত লিখে মোহরাঙ্কিত করে দিতে বললেন যাতে এ বিষয়ে তাঁদের কৈফিয়ৎ নেওয়া যেতে পারে।
সকলেই কাগজে লিখে দিলেন। কাঁগড়ার রাজার উপর আর কঠিন শর্ত আরোপ | করা প্রয়োজন ছিল না। শর্তগুলির মধ্যে একটি ছিল— যেহেতু কাঁগড়া রাজা বীরবলকে জায়গির হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু সে-বাবদ পাঁচ মণ (আকবরী) সোনা ওজন করে তাঁকে দিতে হবে।

রাজা সস্তায় রেহাই পেলেন। দুর্গের সম্মুখে একটি বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করা হল, সেখানে মোল্লা মুহম্মদ বাকার দাঁড়িয়ে আকবরের নামে খুৎবা পাঠ করেন। যখন বাদশাহের নাম পাঠ করা হয়, তখন লোকে আশরফি বর্ষণ করতে থাকে, জয়ধ্বনি দিতে থাকে। কাঁগড়া-বিজয়ের কোনো নামগন্ধও ছিল না এবং চল্লিশ বছর পরে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গিরই কাঁগড়ায় অধিকার কায়েম করেন ।
আরও দেখুনঃ