কাশ্মীর বিজয় | পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম | আকবর 

কাশ্মীর বিজয়, সওয়াতের ইউসুফজঈ পাঠানেরা কাবুল-বিজয়ের পরেও মাথা নত করতে ইচ্ছুক ছিল না, যার ফলে আকবরকে সেদিকে মনোযোগ দিতে হল। এই যুদ্ধে বীরবলের মৃত্যু হয় (‘বীরবল’ অধ্যায় দ্রঃ)। সওয়াতের যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই কাসিম খাঁ ও ভগবানদাসের নেতৃত্বে কাশ্মীরেও এক সেনাবাহিনী পাঠানো হল।

কাশ্মীর বিজয় | পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম | আকবর

 

কাশ্মীর বিজয় | পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম | আকবর

 

সুলতান ইউসুফ ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে প্রতিরোধ করা অর্থহীন ভেবে সন্ধি করতে চাইলেন, কিন্তু আকবর তাতে সম্মত হলেন না। ইউসুফ বারামুলা যাওয়ার পথের বুলিয়াস গিরিপথ বন্ধ করে দিলেন । এই পথ দিয়েই পশ্চিম দিক দিয়ে রাজধানীতে (শ্রীনগরে) পৌছানো যেতে পারত।

বর্ষাকাল এবং বরফ বাধা তৈরি করেছিল, সেই সঙ্গে রসদও কমে এসেছিল। তার উপর সওয়াতে জৈন খাঁ ও রাজা বীরবলের মৃত্যু-সংবাদও আসে। তার ফলে সেনাপতিরা সন্ধি করে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় বিবেচনা করেন। স্থির হয়: বাদশাহের নামে খুত্বা পাঠ করা হবে, আকবরী মুদ্রা চালু হবে; টাকশাল, কেসরের চাষাবাদ, শাল-বয়ন শিল্প ও শিকারের নিয়ম-নীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে শাহী অমাত্যদের হাতে। কিন্তু সন্ধির প্রস্তাব আকবরের মনঃপূত হল না।

সুলতান ও তাঁর পুত্র ইয়াকুব দরবারে এসে আত্মসমর্পণ করলেন। আকবর সুলতানকে ক্ষমা করতে চাইছিলেন না। যদি রাজা ভগবানদাস প্রতিশ্রুতি না দিয়ে থাকতেন, তাহলে সম্ভবত তাঁকে প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হতো। ভগবানদাস সুলতানকে কারারুদ্ধ করাতেও অঙ্গীকারভঙ্গ মনে করলেন এবং নিজের পেটে তরোয়াল বসিয়ে দিলেন। আঘাত বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু শাহী শল্যবিদদের সুচিকিৎসায় তাঁর প্রাণরক্ষা হয়। রাজা ভগবানদাস তাৎক্ষণিক পাগলামিতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বদায়ূনী বলেছেন, রাজা ভগবানদাস অঙ্গীকারভঙ্গের কারণে রাজপুতী আত্মাভিমান রক্ষার জন্যই এরূপ করেছিলেন।

ইউসুফ খাঁ ত্রিশ-চল্লিশ টাকা মাসিক পেনমন পেতেন। তিনি দেখলেন, আকবর সন্ধিপত্র মানতে ইচ্ছুক নন। একদিন তিনি পালিয়ে কাশ্মীর চলে গেলেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। ইঞ্জিনিয়র মুহম্মদ কাসিম খাঁকে সেনা দিয়ে দক্ষিণে ভিম্ভর হয়ে পীর-পঞ্জালের পথে আক্রমণ করার হুকুম হল। ইউসুফ খাঁকে সাহায্য করার জন্য লোকজন রাজি ছিল না, সেজন্য অধিক প্রতিরোধ ব্যতীতই শাহী সেনা রাজধানী শ্রীনগরে প্রবেশ করল।

 

কাশ্মীর বিজয় | পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম | আকবর

 

শেষ পর্যন্ত ইউসুফকে আত্মসমর্পণ করতে হল। সেই সময় কাশ্মীরকে একটি সরকারে (জেলায়) পরিণত করে কাবুল সুবার অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য পর্যন্ত— মোগল সাম্রাজ্য যখন ছত্রখান হয়ে যায় তখনও পর্যন্ত কাশ্মীর মোগল শাসনের অধীনে ছিল।

ইউসুফ খাঁ ও তাঁর পুত্রকে বিহারে নির্বাসিত করা হয়, সেখানে পরে রাজা মানসিংহের উপর তাঁদের দেখাশোনার ভার অর্পণ করা হয়। প্রায় বছরভর নজরবন্দি থাকার পর ইউসুফ খাঁ পঞ্জসদী’ মনসব পান। সেজন্য তিনি দুই হাজার একশত থেকে আড়াই হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতেন। মানসিংহে অধীনে তিনি বহু বছর কাজ করেছিলেন। তাঁর পুত্র আকবরের এক কাশ্মীর-যাত্রার দরবারে হাজির হয়েছিলেন।

আকবর ভূস্বর্গ কাশ্মীর উপত্যকার প্রশংসা অনেক শুনেছিলেন এবং তা দেখারও বড় সাধ ছিল। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২২শে এপ্রিল তিনি লাহৌর থেকে যাত্রা করে মে মাসের শেষে শ্রীনগরে পৌছান। তিনি ভিম্ভর দিয়ে পীর-পঞ্জাল অতিক্রম করেন যেখান দিয়ে আমরা আজকাল সুড়ঙ্গপথে মোটরগাড়ি নিয়ে যাতায়াত করি।

শীতকালেও পথ উন্মুক্ত রাখার জন্য আজকাল সেখানে এবং নিচে অন্য সুড়ঙ্গপথও তৈরি করা হচ্ছে। আকবর তাঁর মুখ্য-ইঞ্জিনিয়র কাসিম খাঁকে দিয়ে পথ ঠিকঠাক করালেন। চড়াইয়ের মুখে শাহজাদা মুরাদ ও বেগমদের রেখে, তাঁদের রোহতাসে (জেহলাম শহরের নিকটস্থ) গিয়ে পুনরায় একত্র হওয়ার কথা বলে তিনি রওনা হলেন। আকবর কাশ্মীরের মনোরম উপত্যকায় ভ্রমণ সেরে বারামুলা, পলি (হজারা জেলা) হয়ে অটকে উপস্থিত হন।

 

কাশ্মীর বিজয় | পশ্চিমোত্তরের সংগ্রাম | আকবর

 

রোহতাসের বদলে সেখানেই তাঁর পরিবার এসে আকবরের সঙ্গী হন। অটক থেকে কাবুল গিয়ে সেখানে তিনি দুই মাস অতিবাহিত করেন। সেখানেই রাজা ভগবানদাস ও টোডরমলের মৃত্যুর খবর পান। ইঞ্জিনিয়র মুহম্মদ কাসিম খাঁর হাতে কাবুলের দায়িত্বভার অর্পণ করে ৭ই নভেম্বর তিনি কাবুল থেকে ভারতের দিকে যাত্রা করেন ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment