টোডরমলের দীওয়ান, সর্বপ্রথম টোডরমলের উল্লেখ পাওয়া যায় আকবরের সিংহাসনে বসার নবম বর্ষে (১৫৬৪ খ্রিঃ)। হুমায়ূনকে ভারতে দ্বিতীয়বার সফল করে তুলতে যেসব সেনাপতিরা সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আলী কুল্লি খাঁ খানজমান অন্যতম। তিনি উজবেক তুর্কি ছিলেন।
টোডরমলের দীওয়ান | টোডরমল | আকবর
হেমুকে হারানোর ব্যাপারে তাঁর বিশেষ হাত ছিল । জৌনপুর সুবার তিনি সুবেদার ছিলেন। তিনি, তাঁর ভ্রাতা বাহাদুর তথা তাঁর পিতৃব্য ইব্রাহিম বাদশাহের বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরিত সৈন্যদের তিনি পরাজিত করেন, তারা নিমসারে (জেলা সীতাপুর) হটে যেতে বাধ্য হয়। খানজমান এবং তাঁর সঙ্গীরা চাইছিলেন না যে যুদ্ধের বাতাবরণ বজায় থাকুক। তাঁরা অনুকূল শর্তসাপেক্ষে সন্ধি করতে আগ্রহী হয়েছিলেন । কিন্তু টোডরমল তাঁর বিরোধিতা করেন।
চিতৌড়, রণথম্ভৌর, সুরাতের যুদ্ধে টোডরমল অংশগ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ সেপাই, সওয়ার, তোপখানা ও হাতির পল্টনের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ নয়। টোডরমল সেই বন্দোবস্ত এমন সুচারুরূপে সম্পাদন করেন যে সকলেই খুশি হয়। ৯৮০ হিজরীতে (১৫৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে) আকবর তাঁকে গুজরাতের দফতর ও রাজস্বের বন্দোবস্ত করার জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে কাগজপত্রের জঙ্গল পেরুনো সাধ্যাতীত, কিন্তু টোডরমলের কাছে সেটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি সব কাগজ ঠিক করে বাদশাহের সামনে পেশ করলেন।
বিহারে ৯৮১ হিজরীতে (১৫৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে) সেনাপতি ছিলেন মুনায়ম খাঁ। যুদ্ধের আর শেষ হচ্ছিল না। আকবরের সেনাধ্যক্ষরা যুদ্ধে লড়াই করার বদলে আরাম বেশি পছন্দ করতেন। বাদশাহ জানতেন, টোডরমল কেবল কলম আর শাসন-সংক্রান্ত বিষয়েই কুশল নন । তিনি তাঁকে সেনাদের বন্দোবস্ত করার জন্য পাঠালেন। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত মুনায়মের সৈন্যদলে গিয়ে পৌঁছলেন টোডরমল ।
সৈন্যদের হিসাব-কিতাব দেখলেন। অভিজ্ঞ প্রবীণ নাম করা তুর্কি সেনাপতিরা ছিলেন সেখানে। তাঁরা হুমায়ূনের এবং কিছুটা বাবরের আমলে নিজেদের তরবারির ক্ষমতা দেখিয়ে এসেছেন। তাঁরা এক কলম-পেষা অখ্যাত মুৎসদ্দীর খবরদাবি কি পছন্দ করেন? কিন্তু তারা এটাও জানতেন যে তিনি কেবল মুসদ্দীই নন, আকবরের চক্ষুকর্ণ, ইতোমধ্যেই নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। টোডরমলের ব্যবস্থা অনুসারে যুদ্ধ হলো। পাঠানরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হলো। পাটনায় বাদশাহের পতাকা উড়ল ।
এই সাফল্য লাভের জন্য টোডরমল পতাকা ও নাকাড়া পুরস্কার পেলেন। সেনাবাহিনী বিহারের পর বাংলার দিকে অগ্রসর হলো। তার জন্য যে-সব সেনাধ্যক্ষদের নিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে পুনরায় টোডরমলের নাম অন্তর্ভুক্ত হলো, বস্তুত এই যুদ্ধের প্রাণ বলতে ছিলেন। তিনিই। আগে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় (মালদা), কিন্তু ম্যালেরিয়ার কারণে | রাজধানী টাডায় স্থানান্তরিত করা হয়। টাঁড়ায় বাদশাহী সেনা যে বিপুল জয়লাভ করে, তাতে সর্বাগ্রে নাম উড়ে আসে মুনায়ম খাঁর সঙ্গে টোডরমলের ।
দাউদ খাঁ ছিলেন বিহার-বাংলার রাজা, পাঠানদের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। তিনি বাদশাহী সেনাকে বহুবার হয়রান করেছিলেন। এক স্থানে পরাজিত হয়ে সাহস হারানোর লোক ছিলেন না তিনি। পরিবারবর্গকে রোহতাস দুর্গে রেখে তিনি বাদশাহী সেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে মুনায়ম খাঁর মনেও সংশয় দেখা দিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর মাঝখানে সেনাপতি মুনায়ম খাঁর পতাকা উড়ছিল। শত্রুসৈন্যের অগ্রবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণে বাদশাহী সৈন্যের অগ্রবাহিনীকে পিছনে ঠেলে নিয়ে যেতে শুরু করল। টোডরমল সৈন্যশ্রেণীর ডানপাশে অবস্থান করছিলেন। তিনি নিজের জায়গায় অবিচল থেকে নিজের সৈন্য সঙ্গে নিয়ে সমানে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলেন। শত্রুরা সংবাদ ছড়িয়ে দিলো যে মুনায়ম খাঁ নিহত হয়েছেন। টোডরমলকে সে-কথা জানালে তিনি উত্তর দিলেন— “খানখানা না থাকল তো কি হল? আমরা পরাক্রমশালী আকবরের সেনাপতিত্বে লড়ছি।” তীব্র সঙ্ঘর্ষ অক্ষুণ্ণ রাখা হল।
সেনাপতি গূজর খাঁ নিহত হলেন। অবশেষে পাঠান সৈন্যরা বাধ্য হয়ে পালাতে শুরু করলে যুদ্ধক্ষেত্র বাদশাহী সৈন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। টোড-রমলের তরবারি তার আশ্চর্য দক্ষতা দেখায়, দাউদ খাঁকে নাকের জলে চোখের জলে একাকার করে ছাড়েন, ৯৮৩ হিজরীতে (১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে) দাউদ সন্ধি প্রার্থনা করেন। তাঁর প্রতিনিধি, খানখানা মুনায়ম খাঁ এবং আমিরগণ তাঁবুর মধ্যে বৈঠকে বসেন।
যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা, সেজন্য সকলেই সন্ধির পক্ষে। কিন্তু টোডরমল সন্ধি বিরুদ্ধে। তিনি বললেন— “শত্রুর শিকড় কাটা পড়েছে, আর একটু চেষ্টা করলেই পাঠানরা একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে। নিজেদের আরাম আর ওদের অনুরোধের কথা এখন ভাববেন না। আক্রমণ চালিয়ে যান, ওদের পিছন ছাড়বেন না।” আমিরেরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু টোড-রমল কারো কথাই কানে তুললেন না। তা সত্ত্বেও সন্ধি হল। টোডরমল সন্ধিপত্রে তাঁর সীলমোহরের ছাপ দিলেন না । বিজয়োৎসব হল, তাতেও টোড-রমল যোগ দিলেন না ।
সেখানকার কাজ থেকে ছুটি পেলে বাদশাহ টোডরমলকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বাংলা থেকে বহু মূল্যবান উপঢৌকন, সেই সঙ্গে চুয়ান্নটি বাছাই-করা হাতি সঙ্গে করে এনেছিলেন । তখন বাংলা হাতির জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। দীওয়ান (১৫৭৫ খ্রিঃ)— বাদশাহ টোডরমলকে সাম্রাজ্যের দীওয়ানের পদ দিয়ে উঠল । এবং অল্পদিন পরেই তাঁকে ‘ওয়াজারাতকুল’ ও ‘ওয়াকালত-মুস্তাকিল’ (স্থায়ী ওয়াকীল)-এর পদ প্রদান করে সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী করলেন। সে-বছর খানখানা মুনায়ম খাঁর মৃত্যু হয় ।
দাউদ খাঁ তো তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই সন্ধি করেছিলেন। অতএব সেই সন্ধিতেই আবদ্ধ থাকবেন কেন? সারা বিহার-বাংলায় আবার আগুন জ্বলে বাদশাহের আমিরেরা তরোয়ালে শান দেওয়ার বদলে নিজেদের থলে ভরতে শুরু করল। অবস্থার অবনতি দেখে আকবর তার এক সেনাধ্যক্ষ খানজাহান হুসেন কুল্লি খা (বৈরাম খাঁর ভগ্নিপতি) ও টোড-রমলকে এই কাজের ভার দিলেন। বিহারে গিয়ে টোড-রমল সেনাধ্যক্ষদের হালচাল দেখে ভীষণ বিস্মিত ও হতাশ হলেন। দেখা গেল, একদিকে তাঁরা স্বস্তিতে নির্ভাবনায় রয়েছেন, অন্যদিকে খানজাহান ও টোড-রমলের অধীনে থাকা তাঁদের পছন্দ নয় ।
অনেকেই আবহাওয়ার দোহাই পেড়ে ছুটি নিতে চান । কেউ কেউ বললেন— খানজাহান কিজিলবাশ (শিয়া), আমরা তাঁর অধীনে কাজ করতে পারব না। টোড-রমল তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে, ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়ে, লোভ- লালসার টোপ দিয়ে তাদের পথে আনলেন। যুদ্ধের জন্য সেনা প্রস্তুত হল। টোড-রমল কেবল লেখনী ও বাক্পটুতাতেই সমৃদ্ধ ছিলেন না। ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁকে আকবরের যোগ্যতম সেনাধ্যক্ষদের অন্যতম বলেছেন। তিনি তরোয়ালের হাত দেখানোতে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলার বিশৃঙ্খল সামরিক ব্যবস্থা সুসংবদ্ধ হয়। দাউদ খাঁ ছিলেন ভয়ঙ্করতম শত্রু।

শেরশাহের সমকালীন ও তাঁর জাতির নেতা ছিলেন। তাঁর চারদিক ঘিরে সমবেত হয়েছিল পূর্বদিকের সমস্ত পাঠান। টোড-রমল জানতেন, পাঠানরা শেরশাহের আমল বিস্মৃত হয়নি, তাদের সঙ্গে কখনও স্থায়ী সন্ধি সম্ভব নয়, বিশেষত যখন দাউদ খাঁ তাদের নেতা। উভয়পক্ষের বীরেরা প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিল। পাঠানরা পরাজিত হল, দাউদ খাঁ ধরা পড়লেন।
তাঁকে জীবিত রাখা বিপজ্জনক ভেবে হত্যা করা হয় । দাউদ খাঁ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পাঠানদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। টোড-রমল দরবারে উপস্থিত হয়ে তিনশত চারটি হাতি ভেট দিলেন— তিনি জানতেনই, আকবরের খুব হাতির শখ, যতই বিগড়ে-যাওয়া হাতি হোক, তাকে বশ করা ছিল তাঁর বাঁ-হাতের কাজ ।
আরও দেখুনঃ