তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব | গুজরাত বিজয় | আকবর

তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব, তৈমূরের সন্তানদের মধ্যে উমরশেখ মির্জার পুত্র বায়করা ও পৌত্র সুলতান ওয়ায়েস, ওয়ায়েসের পুত্র ছিলেন মুহম্মদ সুলতান। খুরাসান তৈমূরদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মুহম্মদ সুলতান কাবুল আসেন বাবরের নিকটে। যদিও উচ্চবংশজাতরা প্রায়ই প্রতারণা করে আসছিল, তবু তৈমূরী শাহজাদাদের প্রতি বাবরের বিশেষ প্রীতি ছিল।

তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব | গুজরাত বিজয় | আকবর

 

তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব | গুজরাত বিজয় | আকবর

 

তিনি সকলকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে চাইতেন। বাবর মুহম্মদ সুলতানকে সমাদরেই রেখেছিলেন। হুমায়ূনও তাঁর উপর অত্যন্ত কৃপা প্রদর্শন করেন। সুলতান মির্জার পুত্রদের মধ্যে হাসান মির্জা ও হুসেন মির্জাও ছিলেন। মুহম্মদ সুলতান মির্জা ও নখওয়ত সুলতান মির্জা অন্যান্য তৈমূরী মির্জাদের সঙ্গে জোট বেঁধে হুমায়ূনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। হুমায়ূন তাঁদের অন্ধ করে দেওয়ার হুকুম দেন। নখওয়তকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ।

মুহম্মদ সুলতানকে তাঁর চোখে কিছু একটা দিয়ে নকল অন্ধ বানিয়ে বায়ানা দুর্গে বসিয়ে রাখা হয়। কিছুদিন পর মুহম্মদ জবান মির্জা (হিরাতের বাদশাহ সুলতান হুসেন মির্জার পৌত্র) পালিয়ে গুজরাত চলে যান। মুহম্মদ সুলতানও কোনোরকমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কনৌজ পৌছে সেখানে পাঁচ-ছয় হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেন।

যে-সময় শেরশাহ হুমায়ূনকে বাংলায় বিপন্ন করে তুলছিলেন, সেই সময় মুহম্মদ সুলতান ও তাঁর পুত্ররা দিল্লীর আশপাশে হত্যা-লুণ্ঠন করে জনজীবন অস্থির করে তোলেন। তাঁদের দমন করার জন্য হুমায়ূন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হিন্দালকে প্রেরণ করেন। হিন্দালের মনে স্বয়ং সিংহাসনে বসার অভিপ্রায় জাগে। হুমায়ূন পরাজিত হয়ে আগরায় পৌছান।

তখন সমস্ত মির্জা শাহজাদাদের টনক নড়ে । মুহম্মদ সুলতান ও তাঁর পুত্ররা হুমায়ূনের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হন, তিনি তাঁদের ক্ষমাও করে দেন, কিন্তু কনৌজে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তাঁরা হুমায়ূনকে ত্যাগ করে পলায়ন করেন। আরও কত আমির তাঁদের অনুসরণ করে । হুমায়ূনের ভারত পুনরুদ্ধারের পর বৃদ্ধ মুহম্মদ সুলতান তার পুত্র-পৌত্রদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় দরবারে এসে হাজির হন। হুমায়ূন তাদের সম্ভল সরকারে (জেলা মুরাদাবাদ) আজমপুর নিটওর ইত্যাদি অঞ্চল জায়গির দেন। মুহম্মদ হুসেন মির্জা, ইব্রাহিম হুসেন, মসুদ হুসেন, আকিল মির্জার রক্তে ছিল বিদ্রোহ।

খানেজমানের বিরুদ্ধে আকবর যখন দ্বিতীয়বার লড়াই করতে যান, তখনও তাঁরা তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে জায়গিরে চলে যান, সম্ভলে হত্যা-লুণ্ঠন শুরু করেন। সেখান থেকে তাঁদের বিতাড়িত করা হলে তাঁর দিল্লী হয়ে মালওয়ার দিকে গিয়ে লুঠতরাজ চালাতে থাকেন। বৃদ্ধ মুহম্মদ সুলতান তখনও ফন্দি-ফিকির আঁটছিলেন।

মুনায়ন খাঁ তাঁকে বন্দী করে বায়ানা দুর্গে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মালওয়ায় মির্জা মার খেয়ে গুজরাতের দিকে পালান। সেখানে মাহমুদশাহ নামমাত্র বাদশাহ ছিলেন। সুরাত, ভড়ৌচ, বড়ৌদা, চম্পানেরে চেঙ্গিস খাঁর শাসন ছিল । তিনি তাকে স্বাগত জানান এবং ভড়ৌচ জায়গির দেন।

কিন্তু ওইটুকু জায়গিরে কি তাঁর কাজ চলে? তিনি এদিক-ওদিক হাত বাড়াতে শুরু করলেন। চেঙ্গিসের কপালে ভাজ পড়ল। মির্জা খানদেশের দিকে পলায়ন করলেন। ইতিমধ্যে আত্মকলহে চেঙ্গিস প্রাণ হারান। খানদেশে পুরো লাভ নেই দেখে মির্জা গুজরাত চলে আসেন। সুরাতে মুহম্মদ হুসেন মির্জা, চম্পানেরে শাহ মির্জা ও সরনাল ইত্যাদিতে ইব্রাহিম হুসেন মির্জা সর্বপ্রভুত্ব-সম্পন্ন শাসক হয়ে বসেন ।

আকবরের নিকটে পরাজিত হয়ে সব মির্জা পাটনের কাছে জড়ো হন। স্থির হয়, ইব্রাহিম মির্জা কনিষ্ঠ ভ্রাতা মসুদ মির্জাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে লুটপাট করতে করতে পাঞ্জাবে গিয়ে সেখানে বিদ্রোহ ছড়াবেন, মুহম্মদ হুসেন মির্জা ও শাহ মির্জা দু’জনে শের খাঁ ফওলাদীর সঙ্গে জোট বেঁধে পাটনে গোলমাল বাধিয়ে দিলেন যাতে আকবর সুরাত অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতে তাঁরা সফল হননি। আকবর সুরাত অধিকার করে আহমদাবাদে ফিরে এলেন। 

 

তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব | গুজরাত বিজয় | আকবর

 

ইব্রাহিম হুসেন মির্জা লুঠপাট করতে করতে নাগৌরে পৌছেছিলেন। রায়সিংহ, রামসিংহ ইত্যাদি আকবরের সর্দারেরা তাঁর উৎসাহে জল ঢেলে দেন। লাহৌর যাওয়ার বদলে তাঁকে যাত্রা করতে হয় সম্ভলের দিকে। আকবর গুজরাতে ছিলেন। হুসেন কুল্লি খাঁ কাঁগড়া অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। ইব্রাহিম দিল্লী-আগরায় হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমিরদের পল্টন মির্জাকে পাঞ্জাবের দিকে পলায়ন করতে বাধ্য করেন। তিনি পথে সোনিপত, পানিপত, করনাল, আম্বালা ইত্যাদি শহর লুণ্ঠন করেন।

লাহৌরে পৌঁছে জানতে পারেন, হুসেন কুল্লি খাঁ তাঁর দিকে দৌড়ে আসছেন। তারপর তিনি লাহৌর থেকে মুলতানের দিকে আহতাবস্থায় বন্দী হন ও তাঁর মৃত্যু হয়। পালান, সেখানে মসুদ হুসেন মির্জাকে বন্দী করে দরবারে পাঠানো হয়। তাঁকে গওয়ালিয়র দুর্গে নিয়ে গিয়ে খতম করে দেওয়া হয়।

মুহম্মদ হুসেন মির্জা, শাহ মির্জা ও শের খাঁ ফওলাদীর সঙ্গে যোগ দিয়ে পাটনে সৈয়দ মাহমুদ বারাকে ঘিরে ফেলেন। খানে-আজম (মির্জা কোকা) খবর শুনেই আহমদাবাদ থেকে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। মির্জা পাঁচ ক্রোশ এগিয়ে এসে যুদ্ধ করেন। তখনও নিষ্পত্তি হয়নি, এমন সময় রুস্তম খাঁ ও আব্দুল মতলব খা বারা কুমক অধিকার করে সেখানে এসে পৌঁছে যান। মির্জা দাক্ষিণাত্যের 

দিকে পলায়ন করেন। ৯৮০ হিজরীতে (১৫৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে) আতিয়ারুল-মুলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গুজরাতের অনেকখানি ভূখণ্ড অধিকার করে ফেলেন। কোকাকে আহমদাবাদে ঘিরে ফেলা হয়। তার ফলে আকবর স্বয়ং দ্বিতীয়বার গুজরাতে গিয়ে উপস্থিত হন। এই যুদ্ধে মির্জারা উভয়েই নিহত হন।

কামরানের কন্যা গুলমুখ বেগম (আকবরের খুল্লতাত ভগ্নী), ইব্রাহিম হুসেন মির্জার পত্নী, সাহসী মহিলা ছিলেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর পিতার কাছ থেকে শত্রুতার উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। মির্জা যখন করনালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাঞ্জাবের দিকে পালান, তখন তিনি সুরাত থেকে পালিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যান। তার পুত্রের নাম ছিল মুজফ্ফর হুসেন মির্জা, তাঁকে মুজফ্ফর হুসেন শাহ গুজরাতীর সঙ্গে এক করে ফেললে চলবে না। মুজফ্ফর দাক্ষিণাত্যে লালিত-পালিত হতে থাকেন।

 

তৈমূরী মির্জাদের উপদ্রব | গুজরাত বিজয় | আকবর

 

১৮৫ হিজরীতে (১৫৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর পনেরো-ষোলো বছর বয়স হলে তিনি পিতার পতাকা হাতে তুলে নেন। আকবর যেসব আমিরকে দমন করেছিলেন, তারা তাঁর পিছনে এসে দাঁড়ায়। আকবরের সেনাকে পরাজিত করে তিনি খম্ভাতে পৌঁছান, তারপর পাটনে গিয়ে ওয়াজির খাঁকে ঘিরে ফেলেন।

এই সময় টোডরমল গিয়ে পৌছে যান। মির্জা পালিয়ে ঢোলকা, তারপর পরাজিত হয়ে জুনাগড়ে পালান। টোডরমল রাজধানীতে (সিক্রীতে) ফিরে আসেন। মির্জা এসে ওয়াজির খাঁকে আহমদাবাদে পুনরায় ঘিরে ফেলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে খানদেশের শাসক রাজা আলী খা নিকটে গিয়ে উপস্থিত হন। আকবরকে খুশি করার একটা ভালো উপহার পেয়ে যান আলী খান, তিনি তাঁকে বাদশাহের দরবারে পাঠিয়ে দেন। আকবর তাঁর প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment