দাউদ খাঁর দমন, ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ টুকরোঈয়ের যুদ্ধ দাউদ খাঁর কোমর ভেঙে দিয়েছিল। টোডরমলের পরামর্শ সঠিক ছিল। অথচ বৃদ্ধ সিপাহসালার দাউদ খাঁকে পুনর্জীবন দান করেছিলেন। মুজফ্ফর খাঁকে বিহারের সুবেদার করে বিদ্রোহ দমন করতে পাঠানো হয়। তিনি হাজীপুরকে নিজের কেন্দ্র করেন।
দাউদ খাঁর দমন | বাংলা-বিহার বিজয় | আকবর
চৌসা থেকে তেলিয়াগড়ী (রাজমহল) পর্যন্ত বিশাল প্রদেশের শাসন মুজফ্ফর খাঁর হাতে আসা মুনায়ম খাঁর পছন্দ হয়নি। দু’জন সিপাহসালারের মতানৈক্যের ফলে শাহী সেনা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুনায়ম খাঁ গৌড়কে নিজের প্রধান কার্যালয় করতে চেয়েছিলেন এই ভেবে যে, যেহেতু ঘোড়াঘাট অঞ্চলে (জেলা দিনাজপুর) সে-সময় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল, গৌড় থেকে তিনি তা দমনা করতে পারবেন।
মুনায়ম খাঁর মৃত্যু এবং আত্মকলহের পূর্ণ সুযোগ নিতে দাউদ খাঁ সন্ধির শর্ত ভাঙলেন এবং বাংলার দ্বার তেলিয়াগড়ী পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশ দখল করে নিলেন। আকবর সংবাদ পেলেন। তিনি খানজাহান হুসেন কুল্লি থাকে (হেমুকে বন্দীকারী পাঞ্জাবের সিপাহসালার) মুনায়ম খার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করলেন ।
খানজাহান বদশা বিজয়ের প্রস্তুতি করছিলেন। খানজাহানকে সাহায্য করার জন্য টোডরমলকেও পাঠানো হয়। দু’জনে ভাগলপুরে পৌঁছে ফিরে আসতে থাকা সৈন্যদের থামান। তারপর অগ্রসর হয়ে দাউদকে কঠোরভাবে পরাজিত করে তেলিয়াগড়ী অধিকার করেন। খানজাহান আকমহলে নিজের ডেরা গাড়েন, পরে (এবং এখনও) তা রাজমহল গ্রামে প্রসিদ্ধ হয়।
মুজফ্ফর খাও সাহায্য করেন। আকবর মনে করেন, তাঁর নিজেরও যাওয়া উচিত। ঘোর বর্ষাকালে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২২শে জুলাই তিনি সিক্রী থেকে যাত্রা করে বিরাড় গ্রামে পৌছান। এখানেই সৈয়দ আব্দুল্লা খা তাঁকে বাংলা- বিজয়ের খবর দেন এবং দাউদ খাঁর মাথা উঠোনে আছড়ে ফেলেন। এই যুদ্ধ হয়েছিল ১২ই জুলাই। সৈয়দ আব্দুল্লা রাজমহল থেকে বিরাড় পৌঁছেছিলেন এগারো দিনে। আকবর আর অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি ।
১২ই জুলাই রাজমহলের নির্ণায়ক যুদ্ধ বিষয়ে বলা হয়, মুজফ্ফর খাঁ বিহার থেকে পাঁচ হাজার সওয়ার সঙ্গে নিয়ে এসে ১০ই জুলাই খানজাহানের সঙ্গে মিলিত হন। উভয়ে দাউদের উপর ঝটিকা আক্রমণ করতে মনস্থির করেন। সৈন্যশ্রেণীর মধ্যভাগে সেনাধ্যক্ষ খানজাহান ছিলেন। তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান ছিলেন দাউদ খাঁ স্বয়ং।
মুজফ্ফর খাঁর সৈন্যের সম্মুখে ছিলেন দাউদ খাঁর পিতৃব্য জুনইয়েদ খাঁ। বাম পার্শ্বে অবস্থিত টোডরমলের সেনার মোকাবিলা করার জন্য ছিলেন দাউদের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত কট্টর মুসলমান কালাপাহাড়। দিনটি ছিল ১২ই জুলাই বৃহস্পতিবার ।
সেদিন রাজমহলের (আকমহলের) নিকটে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়। টোডরমল সর্বদা আগে থাকতেন। তিনি কালাপাহাড়ের উপর আক্রমণ করেন। জুনইয়েদ গত সন্ধ্যায় কামানের গোলায় আহত হয়েছিলেন, সেদিন তাঁর মৃত্যু হয়। কালাপাহাড় আহত হয়ে পলায়ন করেন। দাউদ খাঁর ঘোড়া আটকে যায়। তাঁকে বন্দী করা হয়। বদায়ূনী দাউদের অন্তিম কাল বিষয়ে লিখেছেন—
“তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে দাউদ জল চাইলেন। তাঁর জুতোয় জল ভরে তাঁর সামনে নিয়ে যাওয়া হয় । কয়েদী তা পান করতে অস্বীকার করেন। খানজাহান নিজের কুঁজো থেকে জল দিলে তিনি তা পান করেন। খানজাহান অমন সুন্দর নবযুবককে মারতে চাননি, কিন্তু সেনাধ্যক্ষরা বাধ্য করেন, কারণ তাঁকে জীবিত রাখলে তাঁদের রাজভক্তি সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে। খানজাহান মাথা কেটে ফেলার হুকুম দিলেন। দুই কোপে কাজ হয়নি, তৃতীয় কোটে মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর তাতে ভুসি ভরে সুগন্ধি মাখিয়ে সৈয়দ আব্দুল্লা খাঁর হাতে দিয়ে বাদশাহের নিকটে পাঠানো হয়।”
দাউদ খাঁর মুণ্ডহীন দেহ টাঁড়ার পুঁতে ফেলা হয়। এভাবেই দুই শত পঁয়ত্রিশ বছর (১৩৪০-১৫৭৬ খ্রিঃ) পর বাংলা স্বাধীন রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে, যার শেষ শাসক ছিলেন পাঠান। সারা বছর-ব্যাপী এক-শাসকই ছিলেন না। অধিকাংশ সময় বিভিন্ন জায়গায় পাঠান সর্দারেরা আলাদা আলাদা শাসন কায়েম করেছেন।

কখনো কখনো সুলেমান কিংবা দাউদ খাঁর মতো অধিক শক্তিশালী ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, তখন তাঁদের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন সমস্ত পাঠান সর্দার। পাঠান শাসকেরা বাংলা-বিহার বহু মসজিদ ও অন্যান্য সৌধ নির্মাণ করিয়েছিলেন, তার স্মারক হিসেবে এখনও সেগুলি বিদ্যমান ।
আরও দেখুনঃ