আবুল ফজলের অবদান | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের অবদান, আবুল ফজল যদি আর কিছু না-ও করতেন, কেবল নিজের লেখনী চালিয়েই চলে যেতেন, তবুও তিনি একজন অমর সাহিত্যিক হিসাবে গণ্য হতেন। তিনি কয়েকখানি বিপুলায়তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা তাঁর যুগ ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে বহু জ্ঞাতব্য বিষয় আমাদের অবহিত করে পথ-প্রদর্শন করছে। ‘আকবরনামা’ ও ‘আইনে-আকবরী’ তাঁর বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ।

আবুল ফজলের অবদান | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল ফজলের অবদান | আবুল ফজল | আকবর

 

১. আইনে-আকবরী— ‘আকবরনামা” তিনি তিন খণ্ডে রচনা করেছেন। এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডই ‘আইনে আকবরী’। প্রথম খণ্ডে তৈমূর বংশ সম্পর্কে সংক্ষেপে, বাবর সম্পর্কে একটু বেশি, হুমায়ূন সম্পর্কে আরও একটু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। তারপর আকবরের রাজত্বকালের প্রথম সতেরো বছরের (১৫৫৬-৭৩ খ্রিঃ) ইতিহাস রয়েছে।

আকবরের রাজত্বকালের তিরিশ বছর পূর্তি পর্যন্ত অনেক প্রসঙ্গেরও উল্লেখ আছে এতে। দ্বিতীয় খণ্ডে আকবরের রাজ্য-সংবৎসর (সজলুস) ১৮তম থেকে ৪৬তম বর্ষের (১৫৭৪-১৬০২ খ্রিঃ) ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। আবুল ফজলের মৃত্যুর তিন বছর পরে আকবর দেহত্যাগ করেন। এই সময়ের ঘটনাবলী ‘তারিক আকবরী’-তে রয়েছে। প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় আবুল ফজল লিখেছেন— “আমি ভারতীয়, ফারসি ভাষায় লেখা আমার কাজ নয় । জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ভরসায় এই কাজ শুরু করেছিলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয়, যৎসামান্য লেখা হতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মাত্র দশ বছরের বিবরণ তিনি দেখে যেতে পেরেছেন।”

 

আবুল ফজলের অবদান | আবুল ফজল | আকবর

 

২. আকবরনামা— ‘আকবরনামা’ হলো ‘আইনে-আকবরী’র তৃতীয় খণ্ড। আবুল ফজল ১৫৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে (১০০৬ হিজরীতে) গ্রন্থখানি সমাপ্ত করেছিলেন। এটি এমন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংরেজরা তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং অনেক গেজেটিয়ার লিখে ফেলেন।

গ্রন্থখানি আকবরের রাজত্বকালের বিশাল গেজেটিয়ার। এতে প্রত্যেক সুবা (প্রবেশ), সরকার (জেলা), পরগণার বিস্তৃত বিবরণ ও পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রফল, তাদের ইতিহাস, শস্যাদির উৎপাদন, আয়-ব্যয়, প্রসিদ্ধ স্থান, নদী-নালা-খাল-প্রস্রবণ, লাভ-ক্ষতির উল্লেখ আছে।

সামরিক-অসামরিক ব্যবস্থা, আমির ও তাঁদের পদের ক্রম-বিন্যাস, বিদ্বান, পণ্ডিত, শিল্পকলাবিদ, হস্তশিল্পী, সন্ত-ফকির, মন্দির-মসজিদ ইত্যাদি কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি, সেই সঙ্গে ভারতের জনসাধারণের ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি-রেওয়াজের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। যে বস্তুর গুরুত্ব ইংরেজরা ষোড়শ শতাব্দীতে উপলব্ধি করেছে, আবুল ফজল সাড়ে তিন শত বছর পূর্বেই তা হৃদয়ঙ্গম করে লিখে গেছেন। ‘আকবরনামা’য় আবুল ফজল আলঙ্কারিক ভাষা ব্যবহার করেছেন, অথচ ‘আইনে-আকবরী’তে তার ভাষা বলিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সহজ-সরল হয়ে এসেছে। দু’খানি গ্রন্থই বৃহদায়তন । 

 

আবুল ফজলের অবদান | আবুল ফজল | আকবর

 

৩. মুকাতিবাতে আল্লামী— আবুল ফজলকে আল্লামী (মহৎ পণ্ডিত) বলা হতো। এই গ্রন্থখানি তাঁর পত্রাবলীর সংগ্রহ । গ্রন্থখানি তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে সেই সব পত্রগুলি রয়েছে, যেগুলি আকবর ইরান ও তুরানের (তুর্কিস্তানের) বাদশাহদের উদ্দেশে আবুল -ফজলকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন।

বাদশাহী ফরমানগুলিও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সমরকন্দের শাসনকর্তা উজবেক সুলতান আব্দুল্লা অত্যন্ত পরাক্রমশালী, খান এবং আকবরের বংশগত শত্রুও ছিলেন। তিনি বলতেন— “আকবরের তরোয়াল তো দেখিনি, কিন্তু আবুল -ফজলের লেখনীকে আমি ভয় পাই।” দ্বিতীয় খণ্ডে দরবারের আমির, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের উদ্দেশে লেখা আবুল ফজলের নিজের চিঠিপত্র রয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে তিনি প্রাচীন লেখকদের গ্রন্থাদি সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। এগুলিকে গ্রন্থ-সমালোচনা বলা যেতে পারে ।

৪. ইয়ারেদানিশ- পঞ্চতন্ত্র তার নিজস্ব গুণেই জগদ্বিখ্যাত। ষষ্ঠ শতাব্দীতে নওশেরওয়া এই পুস্তকটি পহ্লবী ভাষায় অনুবাদ করান। আব্বাসী খলিফাদের জমানায় আরবিতে ভাষান্তরিত হয় । সাসনিয়াদের আমলে ফারসির মহান ও আদি কবি রুদকী এটিকে পদ্যবন্ধ করেন। মোল্লা হুসেন ওয়ায়েজ পুস্তকটি ফারসিতে তরজমা করে ভারতে প্রচার করেন।

আকবর সেই পুস্তক পাঠ শ্রবণ করেছিলেন। শোনার পর যখন তিনি জানতে পারেন যে মূল সংস্কৃত পুস্তক তখনও পাওয়া যায়, তখন বললেন— ঘরেরই তো জিনিস, সহজ করে অনুবাদ করো না কেন! আবুল ফজল ১৫৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে (৯৯৬ হিজরীতে) অনুবাদের কাজ সমাপ্ত করে সেটির নাম দেন ‘ইয়ারেদানিশ’” ।

মোল্লা বদায়ূনী এই নিয়েও আকবরের উপর আক্ষেপ না করে থাকতে পারেননি। বলেছেন— ইসলামের প্রত্যেক ব্যাপারে তাঁর ঘৃণা, প্রত্যেক ইমে (শাস্ত্রে) তাঁর বিরক্তি। ভাষাও পছন্দ নয়, হরফও অপ্রিয়। মোল্লা হুসেন ওয়ায়েজ ‘কালীলা- দমনা’ (করকট দমনক)-এর তরজমা ‘আনওয়ার সুহেলী’ কত ভালো করেছেন। তখন আবুল -ফজলের উপর হুকুম হলো ওই পুস্তকটিকেও সাধারণ ঝরঝরে ফারসি ভাষায় লিখে ফেলতে, তাতে যেন উপমা-অতিশয়োক্তিও না থাকে, আরবি বাক্যও না থাকে ।

৫. রুকাতে-আবুল- ফজল— এটি আবুল -ফজলের রুকু’আ-র (লঘু রচনাশৈলীর ছোট ছোট চিঠিপত্রের) সংগ্রহ। এতে ছেচল্লিশটি রুকু’আ-র আকারে বহু ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহজ-সরল অনাড়ম্বর ভাষায় পরিবেশন করা হয়েছে। যাঁদের উদ্দেশে রুকু’ আ-গুলি লেখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন— আব্দুল্লা খান, দানিয়াল, আকবর, মরিয়ম মাকানী (আকবরের মাতা), শেখ মুবারক, ফৈজী, উফী (মার্সিয়া ফৈজী)।

৬. কশ্কোল— ভিক্ষুকদের ভিক্ষাপাত্রকে বলা হয় ‘কশ্কোল’। প্রত্যেক বাড়ি থেকে পাওয়া পোলাও, সেদ্ধ ছোলা, রুটি, শুকনো রুটির টুকরো, মিষ্ট-লবণাক্ত-অম্ল-তিক্ত সমস্ত কিছুই তাতে ঢেলে নেওয়া হয় । আবুল ফজল কোনো সুভাষিত গুনলেই তা সংগ্রহ করে রাখতেন। সেই সুভাষিত সংকলনের নাম দেওয়া হয়েছে কশকোল । এ থেকেই আবুল -ফজলের রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায় ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment