আবুল ফজলের ধর্ম, আবুল ফজলের ধর্ম ছিল মানব ধর্ম । মানবতাকে তিনি বিভিন্ন ধর্ম অনুসারে বণ্টন করতে রাজি ছিলেন না। হিন্দু, মুসলমান, পারসি, খ্রিস্টান, সকলেই তাঁর কাছে সমান ছিল। বাদশাহেরও ছিল একই ধর্মমত। যখন লোকে খ্রিস্টানদের বাইবেলের প্রশংসা করল, তখন তিনি শাহজাদা মুরাদকে বাইবেল পড়ার জন্য বসিয়ে দিলেন এবং আবুল -ফজলকে লাগিয়ে দিলেন অনুবাদ করতে।
আবুল ফজলের ধর্ম | আবুল ফজল | আকবর
গুজরাত থেকে অগ্নিপূজক পারসিরা আকবরের দরবারে এসেছিলেন। তারা জরথুস্ট্রের ধর্মের কথা বলতে বলতে অগ্নিপূজার মাহাত্ম্য কীর্তন করেন। তারপর আর কি, আবুল -ফজলকে হুকুম দিলেন— “ইরানে যেরকম অগ্নিমন্দির চিরকাল প্রজ্বলিত রয়েছে, এখানেও তাই করো । দিন-রাত অগ্নি প্রজ্বলিত রাখো”। অগ্নি পরমেশ্বরের আলোরই এক বিচ্ছুরিত কিরণ । হিন্দুদের মধ্যেও অগ্নিপূজা প্রচলিত রয়েছে, হয়তো সেজন্যই তিনি তার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই। যখন শেখ মুবারকের মৃত্যু হয়, তখন আবুল -ফজল তার ভ্রাতাদের সঙ্গে ভদ্র (মুণ্ডন) করিয়েছিলেন।
আকবর নিজেও মরিয়ম মাকানীর মৃত্যুতে ভদ্র করিয়েছিলেন । লোকজনকে বুঝিয়েছিলেন, এই প্রথা কেবল হিন্দুদের মধ্যেই নয়, তুর্কি সুলতানিতেও রয়েছে। এই সব কারণেই গোঁড়া মুসলমানরা আবুল- ফজলকে বিধর্মী বলত। অথচ, না তিনি বিধর্মী ছিলেন, না ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন।
রাত্রিবেলা তিনি সন্ত- ফকিরদের সেবা করতে যেতেন, তাঁদের চরণে স্বর্ণমুদ্রা প্রণামী দিতেন। বাদশাহ কাশ্মীরে এক বিশাল অট্টলিকা নির্মাণ করিয়েছিলেন, সেখানে হিন্দু-মুসলমান সকলেই এসে পুজো-প্রার্থনা করত । সেই উপাসনাগৃহের জন্য আবুল- ফজল লিখেছিলেন — “ইলাহী, ব-হর্ খানা কি মী নিগরম্, জোয়ায়ে-তূ অন্দ্। ওয়া ব-হর্ জবাঁ কি মী শুনয়ম্, গোয়ায়ে তৃ।”
(হে আল্লা, আমি যে-গৃহের দিকেই দৃষ্টিপাত করছি, দেখছি, সকলেই তোমার সন্ধানে রয়েছে । আর যে-ভাষাতেই কথা শুনছি, দেখি, তারা তোমার কথাই বলছে।) তিনি আরও লিখেছেন — “ঈ খানা ব-নীয়তে ঈ তলাফে-কলূব মোহিদানে-হিন্দোস্তান ওয়া খসুসত্ ওয়া মাবূদ্-পরিস্তান্ অর্সয়ে-কশ্মীর তামীর ইয়াত্তা।”
(এই গৃহ ভারতের একেশ্বরবাদীদের, বিশেষতঃ কাশ্মীরের ঈশ্বরোপাসকদের জন্য নির্মিত হয়েছে।) আবুল- ফজল যদি এখন জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ঈশ্বর-আল্লার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেন। কিন্তু নিজের সময়কালে তিনি অতদূর অবধি যেতে পারেননি। তিনি কেবল এটুকুই কামনা করেছিলেন যে সমস্ত মানুষ নিজেদের ভেদাভেদ ত্যাগ করে নিজের নিজের নিয়মে ঈশ্বরের আরাধনা করুক।
আরও দেখুনঃ