কবিরাজ ফৈজীর জীবনি – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। ফৈজীর জীবনের প্রথম কুড়ি বছর বড় দুঃখ-কষ্টে, চিন্তা-ভাবনা ও বিপদের মধ্যে কেটেছে। শেখ মুবারকের বিদ্যাবত্তার তীক্ষ্ণতা সকলেই স্বীকার করতেন, কিন্তু আকবরের সভারত্ন হওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। সেই সম্মান পেয়েছিলেন তাঁর কুড়ি বছর বয়স্ক পুত্র ফৈজী ।
কবিরাজ ফৈজীর জীবনি
দরবারে আবুল ফজলের যোগ দেওয়ার সাত বছর পূর্বে ফৈজী আকবরের ঘনিষ্ঠ অনুগ্রহভাজন হয়েছিলেন। ১৫৬৬ কিংবা ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে (৯৭৪ হিজরীতে) আকবর রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার উদ্যোগ করছিলেন। এমন সময় দরবারে কোনো একজন তরুণ ফৈজীর প্রশংসা করেন। আকবর তৎক্ষণাৎ তাকে ডেকে আনার আদেশ দেন।
শেখ মুবারকের শত্রুরা সর্বদা ওত পেতে থাকত । গ্রেপ্তার করতে এসেছে বলে তারা পরিবারের সকলকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। তুর্কি সেপাইরাও জানে না, যথাশীঘ্র ডেকে আনা মানে সম্মান-প্রদান, না দণ্ডদান। শেখ মুবারকের কুটিরে পৌছে তারা হল্লা শুরু করে দিলো।
শত্রুরা বাদশাহকে জানিয়ে দিয়েছিল যে শেখ তার পুত্রকে লুকিয়ে রাখবেন, বাজে অজুহাত দেখিয়ে লোকজনকে ফিরিয়ে দেবেন, ভয়-ডর না দেখালে কাজ হবে না। ঘটনাচক্রে ফৈজী বাগানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। শত্রুরা আশা করেছিল যে খবর পেয়েই তিনি ভয়ে পালিয়ে যাবেন ।
শেখকে যখন তার পুত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি জবাব দিলেন- “বাড়িতে নেই।” তাতে কি তুর্কি সেপাইরা হাল ছাড়ে! কিন্তু কিছু করার আগেই ফৈজী এসে উপস্থিত হলেন । আগরা থেকে ফতেহপুর সিক্রী যেতে হবে। আজকালকার মতো সে-সময় মোটর গাড়ি ছিল না যে এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টায় সেখানে পৌছে যাবেন । দরবারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতির সংস্থানই-বা বাড়িতে কোথায়? তাঁরা তো জানেনই না যে ফৈজীকে দরবারে কেন ডেকে পাঠানো হয়েছে। কয়েকদিন ধরে শেখ মুবারক, তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যরা আশঙ্কায় রইলেন। শেষে খবর এল যে বাদশাহ তাঁর পুত্রকে খুব সম্মানিত করেছেন ।
ফৈজী কবি ছিলেন, সেই সঙ্গে নির্ভীকও ছিলেন । বাদশাহের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বাদশাহ রয়েছেন কাঠের জাফরির ওপাশে। কবিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হলো বাইরে। সামনে আড়াল থাকায় তিনি কথাবার্তায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন না। হঠাৎ তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল
বাদশাহা দরূনে-পঞ্জর অস্ত্ । অজ্ সরে-লুফে-খুদ্ মরা জাবেহ্ । জাঁকি মন্ তৃতিয়ে-শকর্ খায়ম্ । জায়ে-তৃতী দরূন পঞ্জরা বেহ্ । (বাদশাহ রয়েছেন খাঁচার মধ্যে, এতে আনন্দবোধ হচ্ছে না। আমি মিছরি-খাওয়া তোতাপাখি, আমার জন্য ভালো জায়গা ওই খাঁচার ভিতরটাই।)
আকবর এই তাৎক্ষণিক কবিতা শুনে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাঁকে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। ফৈজী তাঁর একশত সাতানব্বই শ্লোক-বিশিষ্ট প্রথম কসীদা (প্ৰশস্তি) পাঠ করে শোনান । প্রত্যেক শ্লোকে কাব্য-মাধুর্যের সঙ্গে গাম্ভীর্যেরও বিচ্ছুরণ দেখা যায় । এই কসীদার মধ্যে তাঁকে দূত-মারফত ডেকে আনার সময়কার দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেছিলেন—
অজা জমা চে নওঈসম্ কি বুদ্ বে-আরাম । সফীনয়ে দিলম্ অজ্জ্মওজ্ খেজ্ তূফানী ।
(সে-সময়ের কথা কি লিখব, যখন আমার অসুখী হৃদয়ের নৌকা ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ তরঙ্গের উপর দুলছিল ।)
তাঁর পিতা ও পরিবারের উপর ইসলামের নামে যে আপদ-বিপদের পাহাড় জমানো হয়েছিল, তার বিবরণ দিতে গিয়ে তরুণ কবি বলেছিলেন—
অগর হকীকতে-ইসলাম দর্-জহাঁ ঈনস্ । হজার খন্দয়ে কুফ্ অস্ত্ বর্-মুসলমানী ।
(জগতে যদি ইসলামের বাস্তবতা এই হয়, তাহলে মুসলমানীর উপর বিধর্মিতার উপহাস অজস্র।) আকবরের সমকালীন গোড়া মুসলমানেরা তাঁকে বিধর্মী বলেই গণ্য করত, এবং তাঁকে বিধর্মী করে তোলার দায় চাপাত ফৈজী ও তার ভ্রাতা আবুল ফজলের উপর । অবশ্য তার অনেকটাই সত্যি। বাদশাহ ন্যায়পরায়ণ ও স্বাধীনচেতা ছিলেন, তবে ইসলামের দোহাই পেড়ে যখন তাঁকে ভয় দেখানো হতো, তখন তিনি ঘাবড়ে যেতেন। এতে ভয়-ভীতির কোনো কারণ নেই, ফৈজী ও আবুল ফজল বাদশাহকে এই সাহস যোগান, তিনিও নির্ভীক হয়ে ওঠেন।
ফৈজীর শুধু কবিতাই আকবরকে প্রসন্ন করেনি, তার মধুর স্বভাব আচার- ব্যবহারেও তিনি এমন মুগ্ধ হন যে তাঁকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারতেন না। ফৈজীর চার বছর পরে, অর্থাৎ কুড়ি বছর বয়সে আবুল ফজলও দরবারে যোগদান করেন। তারপর তো দুই ভ্রাতাই আকবরের বাম-দক্ষিণ দুই হাতে পরিণত হন । তখনও পর্যন্ত সরকারী নথিপত্রের লিখন-সংরক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য
ছিল না। বিদেশী আধিকারিক ও মুনশীরা মধ্য এশিয়ার কায়দায় লেখালেখি করতেন এবং হিন্দুরা ভারতীয় কায়দায়। এই বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য টোডরমল ও অন্যান্যদের সঙ্গে ফৈজীও কাজ করেন এবং একটা পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসেন। আকবরের পুত্রদের লেখাপড়া শেখার বয়স হলে তাঁদের পঠন-পাঠনের ভারও দেওয়া হয় ফৈজীর হাতে।
সলীম, মুরাদ, দানিয়াল সকলেই ফৈজীর ছাত্র ছিলেন। শাহজাদাদের শিক্ষক হওয়া অত্যন্ত সম্মানের কাজ ছিল । পিতার প্রভাব থেকেই ফৈজীর রক্তের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার বীজ নিহিত ছিল। যখন দেখলেন আকবরও সেইরকমই, তখন তাঁর আনন্দের সীমা রইল না।
ভারতে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হওয়ার সময় থেকেই মোল্লারা শরীয়তের নামে বাদশাহদের নিজেদের হাত করে রেখে আসছিলেন। আকবরের সময়েও তাঁরা বলতেন— “রাষ্ট্র শরীয়তের (ধর্মশাস্ত্রের) অধীন এবং শরীয়তের মালিক আমরা। সুতরাং রাষ্ট্র-নায়কের উচিত আমাদের বিনা- অনুমতিতে কোনো কাজ না করা। যতক্ষণ আমাদের ফতোয়া হাতে না পৌঁছায়, ততক্ষণ রাষ্ট্র যেন একটি পদক্ষেপও না করে।”
ফৈজী বলতেন— “রাষ্ট্রের মালিক (বাদশাহ) খোদার প্রতিনিধি। তিনি যা করেন, উচিত কাজই করেন। দেশের হিতসাধনও শরীয়ত । বাদশাহ সেই হিতসাধনের লক্ষ্যেই কাজ করেন, সেজন্য সকলকেই তাঁর অনুসরণ করা উচিত। (বাদশাহ) যা বোঝেন, মোল্লা-মৌলবাদীরা তা বুঝতে সক্ষম নন। বাদশাহ হুকুম করবেন, তা মেনে চলা সকলের অবশ্যকর্তব্য। রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের জন্য কোনো ফতোয়ার আবশ্যকতা নেই।”
আকবর চাইতেন না যে তাঁর অগণিত প্রজার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের কল্যাণের ভাবনাকে তাকে তুলে রাখবেন আর শরীয়তের জোয়ালের চাপে তারা নিষ্পেষিত হতে থাকবে ও আর্তনাদ করতে থাকবে এবং তিনি তা অবাধে চলতে দেবেন। তিনি জানতেন, বিদেশী তুর্কি অ-তুর্কি মুসলমানদের উপর নির্ভরশীল যে সিংহাসন, তা বস্তুত বালির উপর প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী। ভারতের আপামর হিন্দুর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠলেই তা সুদৃঢ় হতে পারে।
তিনি জানতেন, যদি সেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তার কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সাহস হবে না কারো । তখন গণতান্ত্রিক যুগ ছিল না যে ধর্মকে কুসংস্কার বলে গণতন্ত্রের নামে নিজস্ব মতামত মানুষকে স্বীকার করাতে সক্ষম হবেন। ইসলামী শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের দৌলতে ফৈজী ও আবুল ফজল বাদশাহকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘোষণা করে মোল্লাদের অস্ত্রশস্ত্র ভোতা করে দেন।
তাহলে তো মোল্লাদের আর কোনো প্রয়োজনই নেই। তাঁরা আক্ষেপ করতে করতে ভ্রাতৃদ্বয়কে চাটুকারদের চূড়ামণি আখ্যা দেন। বর্তমানেও বহু মুসলমানই এ কথা বলে থাকেন, তবে, তাঁরা শুধু নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য চাটুকার ছিলেন না, বরং তাদের ছিল এক মহান স্বপ্ন— সমস্ত ভারত-সন্তানের মধ্যে খাঁটি সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা এবং তার দ্বারা দেশের শক্তি-সামর্থ্য সুদৃঢ় করা ।
ফৈজী ভারতের মাটির কত ভক্ত ছিলেন, তাঁর ব্যবহৃত শব্দের মধ্যেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। একজন মোগল বাদশাহ ফৈজীকে সর্বপ্রথম ‘মালিকুশ্ শু’অরা’ (কবিরাজ) উপাধিতে ভূষিত করেন ১৫৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে (৯৯৬ হিজরীতে)। তারপর থেকে প্রত্যেক বাদশাহ সেই প্রথা বজায় রেখেছিলেন। আকবরের পৌত্র শাহজাহান জগন্নাথকে ‘পণ্ডিতরাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন । উপাধিতে ভূষিত হওয়ার দু’তিন দিন পূর্বে ফৈজী বলেছিলেন—
ছাতা আঁরোজ কি ফৈজে-আম করদাদ্ । মারা মালিকুল্-কলাম করদাদ্ । (যিনি আমাকে বাণীর মালিক বানালেন, সেদিন থেকেই তাঁর অনুগ্রহের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।) ফৈজীর প্রতি আকবর খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তিনি ফৈজীকে কিছু লিখতে দিয়েছিলেন। ফৈজী সে-কাজে মগ্ন ছিলেন। এমন সময় বীরবল এলেন। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে টিপ্পনী কাটার জন্য সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। আকবর চোখের ইশারা করে তাঁকে বললেন— “হরফ ম-জনীদ্ শেখ জীব চীজেঁ মী-নওঈসদ্” (কথা বোলো না, শেখ জীব কিছু লিখছেন)। আকবর ফৈজীকে ‘শেখ জীব’ বলে সম্বোধন করতেন ।
সারা উত্তর ভারতে নিজের শাসন শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করে আকবর মনে মনে সঙ্কল্প করলেন সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে। দক্ষিণের বাহমনী সুলতানিগুলি তা মেনে নিতে রাজি ছিল না। আকবর ভেবেছিলেন, আপস-আলোচনার মাধ্যমে, শান্তির মাধ্যমে তাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করবেন, যাতে তাদের সাহায্য পাওয়া যায়, কিন্তু ভাবলেই কি কাজের সমাধান হয় ?
আহমদনগরের সুলতান বুরহানুল্-মুক্ সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে আকবরের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। আকবরের সাহায্যে সিংহাসন পুনর্লাভ করলেন, কিন্তু সিংহাসনে বসতে না-বসতেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন আক্রমণ করা ব্যতীত উপায় রইল না। কিন্তু তবুও আকবর সন্ধির পথ একেবারে পরিত্যাগ করতে চাননি ।
ভাবলেন, সম্ভবত শেখজীকে পাঠালে কাজ হবে। চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যও সেই দক্ষিণের ওয়াকাটক রাজাকে সন্ধির পথে নিয়ে আসতে কালিদাসকে প্রেরণ করেছিলেন, কালিদাস তাতে সফলও হয়েছিলেন। কালিদাসের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃত কাব্য ‘সেতুবন্ধ’ ওয়াকাটক প্রবরসেনের নামেই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে, এ-ও আমাদের দেশে কিংবদন্তী। এবং দক্ষিণে কবি-দূতেরা সফল হন, এই ঐতিহ্যের কথা আকবরের জানা ছিল, একথা বলা যায় না।
কিন্তু, দশ শতাব্দী পরে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। ফৈজী তার সেই দৌত্য সম্পর্কে যে দীর্ঘ প্রতিবেদন বাদশাহকে পাঠিয়েছিলেন, তা থেকে জানা যায়, ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও তিনি কত মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করেছিলেন। নিজেকে বাদশাহের চক্ষু ভেবে কিভাবে প্রতিটি বিষয় তাঁর কাছে উপস্থাপিত করেছিলেন। রাজী আলী খাঁ খানদেশের হাকিম ছিলেন। সীমান্তে অবস্থিত বলে তার পূর্ণ সুযোগ নিতেন তিনি, কখনও বাদশাহের অনুকূলে, কখনও-বা বাদশাহের প্রতিকূলে দাঁড়াতেন। রাজী আলী কিভাবে বাদশাহের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন, সে ব্যাপারে ফৈজী লিখেছেন —
“সেবক (ফৈজী) তাঁবু ইত্যাদি এমন জাঁকজমক করে সাজিয়েছিল যে জগৎপতির দরবারের সেবকদের উপযুক্ত। মণ্ডপটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগে মহাসিংহাসন পাতা হয়েছিল, পুরোটাই কামদানী রেশমবস্ত্রে আবৃত। উপরে জরিদার মখমলের সামিয়ানা টাঙানো।
সিংহাসনের উপর বাদশাহী তরোয়াল, রাজকীয় পোশাক-পরিচ্ছদ, রাজবর্ম ও মহান শাসন-পত্র স্থাপন করা হয়েছির। আমিরেরা সিংহাসনের পাশে শিষ্টাচারের সঙ্গে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। পুরস্কারের নিমিত্ত ঘোড়াগুলিকেও বিধিমতো সম্মুখে রাখা হয়েছিল। রাজী আলী খাঁ তাঁর রাজকর্মচারীগণকে এবং দক্ষিণের শাসকগণের প্রতিনিধিবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসেছিলেন। পরম সমাদরে তিনি মণ্ডপের প্রথম ভাগে প্রবেশ করেন। তারপর সঙ্গীদের নিয়ে অগ্রসর হন এবং মণ্ডপের দ্বিতীয় ভাগে উপস্থিত হন। মহাসিংহাসন চোখে পড়তেই তসলিম (বন্দনা) জানান, নগ্ন পায়ে কিছুদূর এগিয়ে যান ।
তখন তাঁকে বলা হয়— ‘এখানেই থামুন, তিনবার তসলিম জানান।’ খুব শিষ্টাচারের সঙ্গে তিনি তিনবার তসলিম জানিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন সেবক মহাপ্রভুর ফরমান (শাসন-পত্র) দু’হাতে নিয়ে তাঁকে কিঞ্চিৎ সম্মুখে আহ্বান করে এবং বলে— ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি প্রভু অত্যন্ত অনুগ্রহ ও করুণা প্রদর্শনার্থে আপনার জন্য দুইটি ফরমান প্রেরণ করেছেন। তন্মধ্যে এই একটি।’ তিনি ফরমান দুই হাতে গ্রহণ করে সমাদরপূর্বক মস্তকে স্থাপন করলেন, তারপর তিনবার তসলিম জানালেন। তখন আমি বললাম— ‘দ্বিতীয় ফরমান আমি’ ।”
এইভাবে তখনকার দৃশ্য বর্ণনা করে ফৈজী লিখেছেন- ন— “সেখান থেকে উঠে যেতে তাঁর ইচ্ছে করছিল না। বলছিলেন— ‘এই সামান্য সাহচর্যে তৃপ্তি হচ্ছে না, করছে, সন্ধে পর্যন্ত বসে থাকি।’ চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে রইলেন। সভা সমাপ্ত হলে পান ও ইচ্ছে সুগন্ধি এল । আমাকে বললেন— ‘আপনি নিজের হাতে দিন।’ আমি কয়েক খিলি তাঁর হাতে দিলাম।
তিনি অত্যন্ত সসম্মানে গ্রহণ করলেন।… সেবকের লোক গুনে দেখল, তিনি মোট পঁচিশবার তসলিম করলেন। … প্রথম তসলিমের পর আমাকে বললেন— ‘হুকুম দিন, হজরতের (আকবরের) জন্য হাজার সিজদা (দণ্ডবত) করি । আমি আমার প্রাণ হজরতকে উৎসর্গ করে দিলাম।’ সেবক বলল— ‘আপনার ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সঙ্কল্পের জন্য তাই উচিত, কিন্তু সিজদার জন্য হজরতের হুকুম নেই। দরগাহের ভক্ত তাদের ভক্তি জানাতে এসে ভাবাবেগ বশে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করে, হজরত নিষেধ করে বলেন যে এটা শুধু খোদার জন্য ।”
রাজী আলী খাঁ ও বুরহানুল্-মুকের নিকটে দৌত্যের কাজে ফৈজীর সময় লেগেছিল এক বছর আট মাস চোদ্দ দিন। তাঁর দৌত্যক্রিয়ার সাফল্য স্থায়ী হয়নি, এ কথা সত্য, তবে দৌত্যক্রিয়ায় তার আচার-ব্যবহার ও তার চমৎকার বর্ণনা অবশ্যই যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
“১৫৯২ অথবা ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে (১০০১ হিজরীতে) দরবারে প্রত্যাবর্তন করার পর কবির ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। তখনও তিনি কবিতার ফুল ঝরাচ্ছেন, বাদশাহও তাঁর কথাবার্তায় খুশি হন, তবু তিনি অধিকতর সময় একান্তে চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করছিলেন। এই সময়েই আকবর তাঁকে পঞ্চ-গঞ্জ (খসা) রচনা করতে বলেন।
১৯৬ হিজরীতে (১৫৮৭-৮৮ খ্রিঃ) আকবর গুজরাত-অভিযানে সাফল্য লাভ করে ফিরে আসেন। সেনাপতিদের মতো সাজসজ্জা ও অস্ত্র ধারণ করে দাক্ষিণাত্যের ছোট বর্শা হাতে নিয়ে আগে আগে চলে আসছিলেন। ফতেহপুর সিক্রী থেকে কয়েক ক্রোশ আগে আমিরেরা স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন। ফৈজী গজল পাঠ করে অভিনন্দন জানান— নসীমে-খুশদিলী অজ্ ফতেহপুর মীআয়দ্ । কি বাদশাহে-মন্ অজ্-রাহে-হূর মীআয়দ্। (ফতেহপুর থেকে আসছে খুশিমনের প্রভাতী হাওয়া, কারণ দূর পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসছেন আমার বাদশাহ।)
আরও দেখুনঃ