ফৈজীর ধর্ম

ফৈজীর ধর্ম – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। ফৈজী ও তাঁর ভ্রাতাকে শুধু ইসলামের শত্রুই বলা হতো না, এমনকি আকবরকে বিধর্মী করে তোলার দায়ও চাপানো হয়েছে তাঁদের উপর। আকবর সূর্য-পূজার দ্বারা সমস্ত ধর্মকে সম্মিলিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ফৈজী আকবরের দীন-ই  লাহীর প্রধান স্তম্ভ ছিলেন, সেজন্য তাঁকে সূর্য-পূজক বলা যেতে পারে।

ফৈজীর ধর্ম

ফৈজীর ধর্ম | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

তাঁকে দহরিয়া (নাস্তিক)-ও বলা হতো, কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ফৈজী ঈশ্বর মানতেন না। হুমায়ূনের দ্বিতীয়বার ভারতের সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই রাজনীতি ছিল সমস্ত ধর্মের প্রতি সমাদর ও সহানুভূতি। হুমায়ূন ইরানে পালিয়ে যান। সেখানকার বাদশাহ তহমাপ্ জানতে চান—এমনটা হলো কেন? হুমায়ূন বলেন— ভ্রাতৃ-বিরোধ।

তহমাশ্ জিজ্ঞাসা করেন— প্রজারা সাহায্য করেনি কেন? হুমায়ূন জবাব দিলেন— ওরা অন্য জাতির, অন্য ধর্মের। তহমাশ্প ও ইস্মাইল স্বয়ং যে রহস্যবিদ্যায় সাফল্য লাভ করেছিলেন, সেই বিদ্যার কথা তিনি হুমায়ূনকে জানালেন। আরবদের বিজয় ও নিষ্ঠুরতায় সুসভ্য ইরানীরা আর্তনাদ করছিল।

তারা মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জানত— আমরা কওরোশ ও দারিয়োশের উত্তরাধিকারী, গিরগিটি-খাদক আরবদের চেয়ে হাজার হাজার বছর পূর্বেই আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চ-শিখরে আরোহণ করেছিলাম। আরব রক্ত-সম্পর্কের পক্ষপাতী খাঁটি আরবি উমাইয়া খলিফাদের বংশ- উচ্ছেদকারী তথা আব্বাসী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আবু-মুলিম ও তাঁর সহকর্মীরা ইরানী ছিলেন। তবু আব্বাসী খলিফারাও ইরানী জাতি-সত্তাকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, ততটা দেননি। আব্বাসীদের পতনের পর ইরানী জাতীয়তাবাদ কয়েকবার মাথা চাড়া দিয়েছিল ।

তিনি দেখলেন— সুন্নী মৌলবাদীদের নিয়ে আমাদের কাজ হবে না। এ বিষয়ে শিয়ারা অনেক বেশি উদার। সেজন্য তিনি শিয়া-মতের পক্ষপাতী হয়ে ওঠেন এবং তহমাম্পের বংশ (সাফাঈ) শিয়া ধর্মকে ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে ঘোষণা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই ইরান শিয়াপন্থী। এইভাবে ইরানী জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করে ইস্মাইল, আব্বাস, তহমাপ্ তাঁদের সুলতানির শিকড় মজবুত করে তুলেছিলেন। তহমাশ্ এই গুপ্ত রহস্য হুমায়ূনকে জানিয়ে বললেন – ওখানে যখন যাবে, তখন নিজের প্রজাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করবে, যাতে তোমাদের সঙ্গে তাদের কোনো ভেদ না থাকে।

 

ফৈজীর ধর্ম | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

সেই কারণেই হুমায়ূন কোনো রাজপুত মহিলার হাতে রাখী পরে তার ধর্মভ্রাতা হতেন, আবার অন্যদের অন্যভাবেও আপন করে নিতেন। তিনি ভারতের সিংহাসন পুনর্লাভ করে বেশিদিন বাঁচেননি। কিন্তু তাঁর পুত্র আকবর জ্ঞান-বুদ্ধি হতেই উপলব্ধি করেন, ওটাই পথ। ভাড়াটে তুর্কি সৈন্য ও অন্যান্যরা সুযোগ পেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে । তিনি এ-ও লক্ষ্য করেছিলেন যে তাঁর পিতার সঙ্গে যেসব শিয়া ও ইরানী এসেছিল, তারা মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সেবা করতে প্রস্তুত, নতুন পদক্ষেপ করলে তারাই তাঁর সহায়ক হবে ।

১৫৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে (৯৮২ হিজরীতে), অর্থাৎ সিংহাসন-লাভের অষ্টাদশ বৎসরে আকবর ফতেহপুর-সিক্রীতে একটি খুব সুন্দর ‘চারঈওয়ান’ (চারমহল) প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন। সেটি সর্বধর্মের সম্মিলিত উপাসনা-গৃহও ছিল। সেখানে পণ্ডিতেরা শাস্ত্র- ব্যাখ্যা করতেন। হিন্দু পণ্ডিত, মুসলমান মৌলবী, খ্রিস্টান পাদরী, পারসি মোবিদ— সকলেই নিজের নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতেন এবং অপর ধর্মের দুর্বলতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতেন।

তখন ফৈজীর দরবারে যোগদান করা আট বছর হয়ে গেছে, আবুল ফজলের চার বছর। মোল্লা বদায়ূনীও তখনো গোঁড়া মৌলবাদী হয়ে ওঠেননি। তিনিও সেই শাস্ত্র-ব্যাখ্যায় সামিল হতেন এবং নিজেদের বহু বছরের অভিজ্ঞ সবজান্তা বলে বড়াইকারী প্রবীণ মোল্লাদের ভূমিকাকে ব্যঙ্গ করতেন। ফৈজী ও আবুল ফজল, তাঁদের পিতাকে নাস্তিক ও অধর্মী বলে যারা তাঁর প্রাণ-নাশে উদ্যত হয়েছিল, তাদের উপর সুদে-মূলে প্রতিশোধ নিতেন। আকবর চাইতেন, একদম খোলাখুলি বিতর্ক হোক। ফৈজী ও তাঁর ভ্রাতা বলতেন— “পৃথিবীতে হাজার হাজার ধর্ম রয়েছে। খোদার ধর্ম একটি মাত্র হতে পারে না।

নইলে সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের তিনি লালন-পালন করেন কেন? সমদৃষ্টিতে সকলকে দেখেন কেন? সকলেরই উন্নতি-সাধন করেন কেন? যে-ধর্মকে তিনি নিজের বলে ভাবেন, সেটিকে রেখে বাকিগুলিকে তো বিনষ্ট করে দিতে পারতেন! সেটা যেহেতু দেখা যায় না, সেহেতু এ কথা বলা যেতে পারে যে সমস্ত ধর্মই তাঁর।

বাদশাহ পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া। ঈশ্বরের মতোই সকল ধর্মের প্রতি তাঁর নজর দেওয়া উচিত। সকল ধর্মাবলম্বীদের লালন-পালন ও তাদের সহায়তা করা উচিত । বলা যেতে পারে, এটাই তাঁর ধর্ম।” সেই সময় বিস্মিল্লা কিংবা লাইলাহা-র (দ্বিতীয় ঈশ্বর নেই) বললে ‘আল্লাহো আকবর’ (ঈশ্বর মহান) বলা হতো ও লেখা হতো, তাতেও মোল্লা আকবরের আল্লা হওয়ার গন্ধ পেতেন, সেজন্য বিদ্রূপ করতেন তিনি। আকবর কখনও নিজেকে আল্লা বলে দাবি করেননি। তিনি ঈশ্বরকে মানতেও অস্বীকার করেননি কখনও। মোল্লা যে অর্থ করতে চাইতেন, ‘আল্লাহো আকবর’-এর অর্থ কিছুতেই তা নয়।

ফৈজী সংস্কৃত পড়েছিলেন। আত্মপরিচয় গোপন করে বারাণসীতে কোনো পণ্ডিতের কাছে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি, এটা স্রেফ জনশ্রুতি। যদি তাই হতো, তাহলে আবুল ফজল কিংবা ফৈজী অবশ্যই তা কোথাও উল্লেখ করতেন। এ কথাও বলা হয়, বিদায়-কালে ফৈজী যখন তাঁর পরিচয় প্রকাশ করেন, তখন গুরু তাঁকে দিয়ে এই শপথ করিয়ে নেন যে তিনি গায়ত্রী ও চতুর্বেদ ফারসিতে অনুবাদ করবেন না ।

গায়ত্রী অবশ্য তখনও ব্রাহ্মণরা পড়তেন। কিছু লোক তার অর্থও জানতেন। তবে চতুর্বেদ সম্পর্কে সে-সময় ষড়দর্শনবিদদেরও জ্ঞান ছিল ন-থাকার মতোই। হ্যাঁ, কিছু বৈদিক অবশ্যই তোতাপাখির বুলি আওড়াতেন, বেদ সংরক্ষণের কাজে সহায়ক হয়েছিল তোতাপাখির বুলি আওড়ানো, তাতেও সন্দেহ নেই। ফৈজী সংস্কৃত পাঠ করতে পারতেন আগরাতেই এবং প্রকাশ্যেই। তিনি হিন্দু দর্শন ও সংস্কৃত গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। তার অক্ষয় ছাপ পড়েছিল তাঁর মনের উপর। 

অন্যান্য মোল্লাদের মতো তিনি হিন্দুদের বিধর্মী বলতে রাজি ছিলেন না। সমস্ত হিন্দুই যে তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন, তার কারণ এটাই। ফৈজী আশ্চর্য প্রতিভাশালী হয়েও ছিলেন সরল, চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন হয়েও থাকতেন হাসিমুখে, শাস্ত্র-বিতর্কে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ বর্ষণে সিদ্ধহস্ত হলেও বিপক্ষদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও চুটকি এমন চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন যে লোকে উচ্ছ্বসিত হতো।

যথার্থই তার মুখ থেকে ফুল ঝরত। ক্রোধকে তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতেন না। তাঁর বিপরীত ছিলেন আবুল ফজল, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। ফৈজী অত্যন্ত উদার ও অতিথি-বৎসল ছিলেন। কবি, পণ্ডিত ও গুণী ব্যক্তিদের জন্য তাঁর গৃহদ্বার সর্বদা অবারিত ছিল। 

 

ফৈজীর ধর্ম | কবিরাজ ফৈজী | আকবর

 

তাঁর দস্তরখানায় প্রায়ই নিমন্ত্রিতদের ভিড় লেগে থাকত। তাঁর কাছে এসে কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে হতাশ হয়ে ফিরতে হতো না। স্বগৃহে তাদের সমাদর করতেন, দরবারে সুপারিশ করে তার উপযুক্ত কাজ অথবা পুরস্কার পাইয়ে দিতেন। ফারসি কবি উফী বহুদিন পর্যন্ত তাঁর গৃহে অতিথি হিসেবে কাটিয়েছিলেন।

মোল্লা ইয়াকুব কাশ্মীরী তো ফৈজীর অতিথি-সৎকারে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কাশ্মীর প্রত্যাবর্তনের পরেও তিনি ফৈজীর গৃহে দ্বিপ্রহরের শীতলপাটি বিছিয়ে উপবেশনের কথা স্মরণ করতেন। বলেছেন— “সেটা কাশ্মীরের আবহাওয়ার চেয়ে কম শীতল নয়।” ফৈজীর বিরুদ্ধে মোল্লাদের ও তাঁদের অনুগামীদের অভিযোগ ছিল ঠিকই, তবে ফৈজী ছিলেন শ্রেষ্ঠ কবি, মহান পুরুষ। ভারত সততই তাঁর জন্য গর্ববোধ করবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment