কবিরাজ ফৈজীর মৃত্যু – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। ফৈজীর জীবনের শেষ মাসটি খুব কষ্টে কেটেছিল। ক্ষয়-রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি, দম বন্ধ হয়ে আসত, হাত-পা ফুলে গিয়েছিল, রক্ত-বমি হতো। বিরোধী গোঁড়া মোল্লারা বলত, ইসলাম ও তার পয়গম্বরের বিরুদ্ধাচরণ করার ফল পাচ্ছেন। কুকুরের শখ ছিল আকবরের, ফৈজীরও।
কবিরাজ ফৈজীর মৃত্যু
মোল্লাদের কাছে কুকুর অত্যন্ত অপবিত্র। তাদের বিরক্ত করার জন্যও ফৈজী নিজের কাছে কুকুর রাখতেন। মোল্লারা তো এমনও রটিয়ে দেয় যে তিনি নাকি মৃত্যুকালে কুকুরের মতোই ঘেউ-ঘেউ করতেন। মোল্লারা ফৈজীকে এক যুগ ক্ষমা করতে পারেনি, তাঁর বিরুদ্ধে যা তাদের মনে আসত তাই বলে বেড়াত। তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে আকবর মধ্যরাত্রে দৌড়াতে দৌড়াতে ফৈজীর গৃহে এসে উপস্থিত হন।
কবি তখন সংবিৎ-শূন্য। বাদশাহ কয়েকবার ‘শেখ জীব, শেখ জীব’ বলে সম্বোধন করে বললেন— “হাকিম আলীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি, তুমি কথা বলছ না কেন? কিন্তু তখন তাঁর জ্ঞান কোথায়? আবুল ফজলকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই খবর পাওয়া গেল, ফৈজী আর পৃথিবীতে নেই। আকবরের কাছে সেটা ছিল প্রচণ্ড আঘাত। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর আটচল্লিশ বছর বয়সে এই মহান কবি ও মহান চিন্তাবিদের মৃত্যু হয়। মোল্লা বদায়ূনী ফৈজীদের বাড়িতে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি প্রবীণ মোল্লারা পুরোপুরি মোল্লা ছিলেন।
প্রথম দিকে যখন প্রবীণ মোল্লাদের সঙ্গে বাদশাহকে লড়াই করতে হতো, তখন তিনি বদায়ূনীকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। সরে গেলে তিনি এই নব্য মোল্লাদের আর তত প্রয়োজন বোধ করতেন না। তখন ফৈজী ও আবুল ফজলের যথেষ্ট প্রাধান্য বিস্তৃত হয় এবং বদায়ূনী ক্রমশ পিছিয়ে পড়েন। তাঁর মনে এমন খেদ ছিল যে তিনি মওকা-বেমওকা ফৈজী ও আবুল ফজলের উপর তাঁর লেখনী চালিয়ে মনের জ্বালা মেটাতেন।
ফৈজীর মৃত্যু-দিবস উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি এই শব্দ-সমষ্টি ব্যবহার করেছেন— “ফিলসফী, শিঈ ওয়া তবঈ দরহী” (দার্শনিক, শিয়াপন্থী এবং স্বভাবতঃ নাস্তিক)। তিনি স্বীকার করতেন যে ইতিহাস, শব্দকোষ, চিকিৎসাশাস্ত্র ও নিবন্ধ-রচনায় ফৈজী তৎকালে অদ্বিতীয় ছিলেন।
কবিতায় ফৈজী প্রথমে নিজের উপনাম গ্রহণ করেছিলেন ‘মহুর’, পরে ‘ফৈয়াজী’, তবে সে-নাম মঙ্গলজনক বলে প্রতীয়মান হয়নি, কেননা দু’এক মাসের মধ্যেই তাঁকে চলে যেতে হয়। “তিনি ছিলেন ক্ষুদ্রচেতাদের বিধাতা, দম্ভ-ঔদ্ধত্য-ঈর্ষার সংগঠক শত্রুতা, নোংরামির গুণগ্রাহীদের প্রতি ভালোবাসা ও আস্ফালনের সমাহার।
ইসলাম অনুসরণকারীদের ক্ষতি ও শত্রুতার ক্ষেত্রে, ধর্মের সিদ্ধান্তসমূহকে ব্যঙ্গ করতে, পয়গম্বর এবং তাঁর সহচর ও অনুগামীদের নিন্দাবাদে, অগ্র-পশ্চাৎ আদি-অন্ত মৃত অথবা জীবিত পূজনীয় ব্যক্তিদের অসম্মান প্রদর্শন করতে তিনি বেপরোয়া ছিলেন। সমস্ত আলিম-ফাজিলদের সম্পর্কেও তিনি দিনরাত গোপনে প্রকাশ্যে এই সব কাজেই ব্যস্ত থাকতেন।
ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু ও পারসি তাঁর চেয়ে হাজার গুণে ভালো। মুহম্মদের ধর্মের বিরোধিতা করার জন্য সমস্ত অবৈধ বস্তুকে বৈধ এবং সমস্ত বৈধ কর্তব্যকে অবৈধ বলতেন। তাঁর দুর্নাম শত নদীর জলেও ধুয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তিনি মদ্যপান করে জঘন্য অবস্থায় কুরানের বিন্দুহীন ভাষ্য লিখতেন।
কুকুর এদিক-ওদিক থেকে তাঁর উপর লাফাত-ঝাঁপাত।” কবিতা, দূরে মোল্লা বদায়ূনী আরও লিখেছেন—“ঠিক চল্লিশ বছর ধরে তিনি কবিতা আওড়ে গেছেন, কিন্তু সব বেঠিক। হাড়ের কাঠামো খাসা; কিন্তু তাতে সারবস্তু নেই, একেবারেই নীরস।… যদিও দীওয়ান (অকারান্ত কবিতা-সংগ্রহ) ও মনওয়িতে (প্রেমোপাখ্যানে) কুড়ি হাজারেরও বেশি শ্লোক রয়েছে, কিন্তু তাঁর নিষ্প্রভ বুদ্ধির মতোই একটি শ্লোকেও দীপ্তি নেই।”
আরও বলেছেন— “তাঁর সঙ্গে আমার পুরো চল্লিশ বছর কেটেছে, কিন্তু তাঁর চাল-চলন ক্রমশই বদলেছে, স্বভাব খারাপ হয়েছে, অবস্থার অবনতি ঘটেছে। সেই কারণে ধীরে ধীরে (আমাদের) সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। এখন তাঁর দাবি করার কিছুই নেই। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে। তিনি আমার কাছ থেকে সরে গেছেন, আমিও তাঁর কাছ থেকে সরে এসেছি।”
ফৈজীর রেখে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে সুন্দর বাঁধানো চার হাজার ছয় শত পুস্তক ছিল, সেগুলির অধিকাংশ হয় লেখকের স্বহস্তে লেখা নতুবা তাঁর সময়ের লেখা। সূফী-মত, গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান; এবং (৩) কুরান-ভাষ্য, পয়গম্বর-বাণী (হাদীস), ফিকর’ (ধর্মশাস্ত্র) ও অন্য ধর্মের গ্রন্থাদি ।
শামশুল উমা আজাদ মোল্লা বদায়ূনীর প্রলাপোক্তি সম্পর্কে বলেছেন—
“মোল্লা সাহেব যা-খুশি বলতে পারেন, এখন উভয়েই অন্তিম জগতে, আপসে বোঝাপড়া করে নেবেন। মোল্লা সাহেব, আপনি নিজের কথা ভাবুন, সেখানে আপনাকেও নিজের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। আকবরের অমুক আমির কি কি লিখেছিলেন, তাঁর কি বিশ্বাস ছিল এবং আপনি তাঁকে কতটা জানতেন— এসব কিন্তু আপনার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে না ।”
আরও দেখুনঃ