মোল্লা বদায়নীর অবদান, আবুল ফজল ও ফৈজীর মতোই বদায়ূনী বলিষ্ঠ লেখনীর অধিকারী ছিলেন। তিনি বহু পুস্তক লিখেছেন অথবা অনুবাদ করেছেন, সেগুলোর অধিকাংশই এখনও পাওয়া যায়—
Table of Contents
মোল্লা বদায়নীর অবদান | মোল্লা বদায়নী | আকবর
১. সিংহাসন বত্তীসী— রাজা ভোজ কর্তৃক স্থাপিত সিংহাসন বিষয়ক বত্রিশটি কাহিনী সংস্কৃতে প্রসিদ্ধ। “১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে শাহানশাহ আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় হয়ে প্রীতিভরে বললেন : ‘রাজা বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে সিংহাসন বত্তীসীর যে বত্রিশটি কাহিনী আছে, সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করে ‘তৃতী-নামা’র আদলে গদ্য-পদ্যে রচনা করো, নমুনা হিসেবে এক পৃষ্ঠা আজকেই পেশ করো।’ সাহায্য করার জন্য একজন সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণকে সঙ্গে দিলেন। সেদিনই আমি গল্পের প্রথম পৃষ্ঠাটি অনুবাদ করে দেখালাম । তিনি তাঁর পছন্দের কথা জানালেন।”
অনুবাদের কাজ শেষ করে পুস্তকের নাম রেখেছিলেন ‘নামায়ে-খিরদ আজা’ (প্রজ্ঞাবর্ধিকা) । এই পুস্তক থেকেই মোল্লা বদায়ূনীর অনুবাদের কাজ শুরু হয়। ফৈজীর মতো তিনি সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন না, কিন্তু প্রত্যেক পুস্তক অনুবাদের জন্য পণ্ডিতের সাহায্য পেতেন। পণ্ডিতেরা সম্ভবত পুস্তক পাঠ করে নিজেদের ভাষায় অর্থ করতেন, মোল্লা তা ফারসিতে অনুবাদ করে যেতেন। আকবরের আমলে বহু সংস্কৃত পুস্তকের অনুবাদ এভাবেই করা হয় ।
২. অথর্বন বেদ— ১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে (৯৮৩ হিজরীতে) ‘অথর্ব বেদ’ অনুবাদের আদেশ হয়। দাক্ষিণাত্যের জনৈক শেখ বহাওয়ান, ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান, বাদশাহের শাগরেদ-দলে সামিল হন। তিনি জানান, হিন্দুদের চতুর্থ বেদ ‘অথর্বে’র সঙ্গে ইসলামের কথার মিল আছে।
তাতে মুসলমানদের কলমা “লা-ইলাহা ইল্লাল্- লাহ্” (আল্লা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো ঈশ্বর নেই)-এর মতো বহু ব্যাপার রয়েছে, এমনকি কিছু শর্তসাপেক্ষে গো-মাংস ভক্ষণও বৈধ বলা হয়েছে। শবদাহ ও সমাধিস্থ করার কথাও আছে। জানা যায়, মুসলমান হয়ে-যাওয়া কোনো পণ্ডিত কিংবা মুসলমান প্রভুদের তোষামোদের নিমিত্ত এরূপ নকল ‘অথর্ব বেদ’ রচনা করেন।
সম্ভবত এর অবশিষ্টাংশ ‘আল্লা উপনিষদ’ সকল উপনিষদের পুলিন্দা এক শত আট উপনিষদের মধ্যে এখনও বিদ্যমান। মোল্লা লিখেছেন, ওই গ্রন্থের বহু বাক্যেরই অর্থ সেই ব্রাহ্মণও বলতে পারেননি। প্রথমে ফৈজীকে, তারপর হাজী সরহিন্দীকে এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের দিয়ে কাজ উদ্ধার না হওয়ায় মোল্লাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি সে-কাজ সম্পূর্ণ করেন ।
৩. তারিখ আলফী— ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে (৯৯০ হিজরীতে) খেয়াল হয় যে হজরত মুহম্মদের হিজরতের এক হাজার বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই সময় এমন এক ইতিহাস লেখা যাক, যাতে এক হাজার বছরের মুসলমান বাদশাহদের ইতিহাস থাকবে। আরবিতে ‘আলিফ’ মানে হাজার— ‘আলিফ লয়লা’র অর্থ হাজার রাত্রি, ইতিহাসের নাম ‘তারিখ-আলফী’ রাখা ঠিক হয়।
এমন বৃহৎ গ্রন্থ এক ব্যক্তির পক্ষে লেখা সম্ভব নয়, সেজন্য এক-এক অংশ এক-একজনকে বণ্টন করে দেওয়া হয়। পয়গম্বরের মৃত্যুর পর এক-এক বছরের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সাতজনকে। প্রথম বছর নকীব খাঁকে, দ্বিতীয় বছর শাহ ফতাহ্-উল্লাকে। এইভাবে হাকিম হুমাম, হাকিম আলী, হাজী ইব্রাহিম সরহিন্দী, মির্জা নিজামুদ্দীন আহমদ ও মোল্লা বদায়ূনী এক-একটি অংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এইভাবে দ্বিতীয় সপ্তাহে আরও সাতজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পয়গম্বরের মৃত্যুর পর পঁয়ত্রিশ বছরের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। একদিন রাত্রে মোল্লা আকবরকে সপ্তম বছরের লিখিত বিবরণ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। তাতে দ্বিতীয় খলীফা উমরের সময়ের কিছু প্রসঙ্গ ছিল, তাতে শিয়া-সুন্নীর মতভেদের উল্লেখ ছিল। নসিবীন মেসোপোতামিয়ার খুব সুন্দর শহর এবং বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল। সেখানে মুসলমানদের বিজয়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মোল্লা লিখেছিলেন : ইসলামী ফৌজ যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তখন মুরগির মতো বড় : বড় পিঁপড়ে বেরোতে দেখা যায় । তাই শুনে বাদশাহ বিরক্তি প্রকাশ করে মোল্লাকে প্রশ্ন করলেন— “একথা কেন লিখেছ?”
মোল্লা বললেন— “আমি বইপত্রে যা পেয়েছি তাই লিখেছি, এটা আমার মন-গড়া নয়।” মোল্লার বক্তব্য অনুযায়ী খাজানে (পুস্তকাগার) থেকে মূল বইপত্র আনিয়ে নকীব খাঁকে যাচাই করতে দেওয়া হলো। নকীব খাঁ যখন বললেন— সত্যি সত্যি বইপত্রে একথাই লেখা আছে— তখন শেখ বদায়ূনী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ।
মির্জা নিজামুদ্দীন আহমদ পাক্কা শিয়া ছিলেন। আকবরের আমলে ছাড় ছিল, সেজন্য তাঁর মনে যা এসেছিল, তাই লিখেছিলেন। চেঙ্গিস খাঁর সময় (ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ) পর্যন্ত তিনি দুই খণ্ড গ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন। লোকমুখে জানাজানি হয় যে ওই শিয়া সুন্নীদের এবং তাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কুৎসা করেছেন, তখন মির্জা ফওলাদ বিরলস খুব ক্রুদ্ধ হয়। সে মির্জা আহমদের গৃহে যায় এবং দু’জনে একসঙ্গে গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। পথিমধ্যে ফওলাদ মির্জাকে হত্যা করে। হত্যাকারীও তদনুরূপ দণ্ড পায়। তারপর হিজরী ৯৯০ (১৫৮২ খ্রিঃ) পর্যন্ত ইতিহাস লেখেন আসফ খাঁ।
১০০২ হিজরীতে (১৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে) মোল্লা বদায়ূনীর প্রতি হুকুম হয় গোড়া থেকে ইতিহাস মিলিয়ে দেখতে এবং ঘটনাকাল আগে-পিছে হলে সংশোধন করতে। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড বদায়ূনী সংশোধন করেন, তৃতীয় খণ্ডের দায়িত্ব আসফ খাঁর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এইভাবে ‘তারিখ-আলফী’র কিছু অংশ মোল্লা বদায়ূনী নিজে লিখেছিলেন এবং তিন খণ্ডের মধ্যে দুই খণ্ডের সংশোধনের কাজও করেছিলেন।
৪. মহাভারত— সে-বছরই (১৫৯৩-৯৪ খ্রিঃ) মহাভারত অনুবাদের কাজ শুরু হয়। আকবর সে-সময় ‘শাহনামা’ ও অন্যান্য পুস্তক-পাঠ শুনেছিলেন, কোনো- কোনোটা তো একাধিকবার। আকবরের মনে হলো, আমাদের ভারতেও নিশ্চয়ই এমন বইপত্র থাকতে পারে । তখন তাঁকে মহাভারতের কথা বলা হয়। এ কথাও জানানো হয় যে তাতে নানারকম উপাখ্যান, উপদেশ, নীতিবাক্য, জীব, ধর্ম, তত্ত্ব ও উপাসনার বিধি ইত্যাদি রয়েছে। ভারতের মানুষ এ গ্রন্থ পাঠ করা ও লেখাকে পরম উপাসনা বলে মনে করেন।
‘শাহনামা’ ও ‘আমির হামজার কথা’ পুস্তক দু’টিকে বাদশাহ সচিত্র করে লিখিয়েছিলেন। এবার তিনি ভারতের এই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটি দেখার জন্য এতই উৎসুক হয়ে উঠলেন যে পণ্ডিতদের সমবেত করে তাঁদের কাছে মহাভারতের কথা শুনতে থাকেন, নিজেই ফারসিতে তা নকীব খাকে বলে যান, আর নকীব খাঁ তা লিপিবদ্ধ করেন।
কিন্তু দেড় লক্ষ শ্লোকবিশিষ্ট মহাভারতের মতো বিশাল গ্রন্থ তাঁর পক্ষে নিজে অনুবাদ করা সম্ভব ছিল না, সেজন্য তৃতীয় রাত্রিতে তিনি মোল্লা বদায়ূনীকে ডেকে আদেশ করলেন— “নকীব খাঁর সঙ্গে মিলে তুমি এটা লেখো।” তিন-চার মাসে তিনি অষ্টাদশ পর্বের মধ্যে মাত্র দুই পর্বের অনুবাদ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। একদিকে অনুবাদ হতে থাকত, রাত্রে আবার তা বাদশাহকে পাঠ করে শোনানো হতো।
বদায়ূনী কট্টর মোল্লা ছিলেন, বিধর্মীদের পুস্তক অনুবাদের কাজকেও তিনি মহাপাপ বলে ভাবতেন। ১৯৯ হিজরীতে (১৫৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে) এই পাপ ক্ষালনের জন্য মোল্লা কুরান লিখে তাঁর পীর শেখ দাউদ জহনীর কবরে তা অর্পণ করেন এবং প্রার্থনা করেন, এর দ্বারা যেন তাঁর সমস্ত পাপ মুছে যায়। বাদশাহ তাঁর অনুবাদে গোঁড়ামির প্রতিফলন লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন হারামখোর।
বাকি অনুবাদের কাজ মোল্লা শেরী ও নকীব খাঁকে দেওয়া হয়েছিল। হাজী সুলতান খানেসরীও কিছু কাজ করেছিলেন। ফৈজীকে গদ্য-পদ্যে রচনা করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দুই পর্বের বেশি এগোয়নি। বাদশাহ মোল্লার ধূর্তামি থেকে অনুবাদকে রক্ষা করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন— মক্ষিকার জায়গায় মক্ষিকা অনুবাদ করো। মোল্লা সাহেব এই বিধর্মীর গ্রন্থ অনুবাদের উপর নিজের সহজাত ঘৃণা প্রকাশ করে লিখেছেন— “অধিকাংশ অনুবাদক কৌরব ও পাণ্ডবদের কাছে পৌঁছে গেছেন। যাঁরা বাকি রয়েছেন, খোদা তাঁদের মুক্তি দিন এবং তাঁদের তোবা মঞ্জুর করুন।”
ফিরদৌসীর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘শাহনামা’ (রাজগ্রন্থ), তাতে কবি ইরানের বীরদের গাথা-কাহিনী বড় সুন্দর ভঙ্গিতে পদ্যবন্ধ করেছেন। বাদশাহ ভারতের বীরদের এই মহাগ্রন্থের নাম ‘রজম্নামা’ (যুদ্ধ-গ্রন্থ) রাখেন। আজকালকার মতো তখনও মহাভারতের অর্থ মহাযুদ্ধ বলেই গণ্য হতো।
এই গ্রন্থটিকে বাদশাহ দু’-দু’বার সচিত্র করে লিখিয়েছিলেন এবং আমিরদেরও হুকুম দিয়েছিলেন যে তাঁরাও যেন পুণ্যের কাজ ভেবেই এরূপ করেন। আবুল ফজল এ গ্রন্থের আট পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখেছেন। একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন : এই কাজের দরুন মোল্লা সাহেব এক শত পঞ্চাশ আশরফি এবং দশ হাজার টাকা ইনাম পেয়েছিলেন । মোল্লা অধর্মের রোজগার মনে করে এ কথা গোপন করার চেষ্টা করেছেন।
৫. রামায়ন— ৯৯২ হিজরীতে (১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে) বাদশাহ বাল্মীকি রামায়ণ অনুবাদের ভার দেন মোল্লা বদায়ূনীকে। পঁচিশ হাজার শ্লোক-বিশিষ্ট রামায়ণ মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন। মোল্লা তাঁর ইতিহাসে মধুর দংশন করে বলেছেন— “একটা গল্প। রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজা ছিলেন। তাঁকে রামও বলা হয়, ঈশ্বরের মহিমার প্রকাশ ভেবে লোকে তাঁর পুজো করে। তাঁর সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত এই : তাঁর রানী সীতার
প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে এক দশ মাথা-ওয়ালা দৈত্য (রাক্ষস) তাকে হরণ করে নিয়ে যান। তিনি লঙ্কা দ্বীপের রাজা ছিলেন। রামচন্দ্র তার ভ্রাতা লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে সেই দ্বীপে যান, অসংখ্য বানর ভল্লুক সৈন্য সংগ্রহ করেন।…
সমুদ্রের উপর চার শত ক্রোশ দীর্ঘ সাঁকো তৈরি করা হয়। কোনো কোনো বানর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা লক্ষ প্রদান করে সমুদ্র পেরিয়ে গেল। কিছু পায়ে হেঁটে সাঁকো পেরুলো। এইরকম যুক্তিহীন বহু ব্যাপার, শুনলে মুখ দিয়ে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বেরোয় না। রামচন্দ্র কোনোরকমে বানরের কাঁধে চড়ে সাঁকো পেরুলেন।
এক সপ্তাহ ধুন্ধুমার যুদ্ধ হলো। রাবণ পুত্র-পৌত্র সহ নিহত হলেন। হাজার বছরের বংশ ধ্বংস করে দেওয়া হলো। রাবণের ভ্রাতাকে লঙ্কার সিংহাসনে বসিয়ে রামচন্দ্র ফিরে এলেন। হিন্দুদের বিশ্বাস, রামচন্দ্র পূর্ণ দশ হাজার বছর ভারতবর্ষ শাসন করে স্বস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। এসব কথা সত্য নয়, কেবল গল্প, কেবল কল্পনাবিলাস, যেমন শাহনামা ও আমির হামজার কিস্সা।” রামায়ণ- মহাভারতের কাহিনী মোল্লার নিকটে স্রেফ কিস্সা মনে হয়েছিল, কিন্তু নসিবীনের মুরগির সমান পিঁপড়ে তাঁর নিকটে সত্য বলে মনে হয়েছিল। লাহওয়ল ওয়ালা কুওয়াত।
৬. মু-অজমুল-বলদান—
একদিন হাকিম হুমাম দুই শত জুজ (চল্লিশ হাজার শ্লোকের সমান) বিশিষ্ট এই পুস্তকখানির প্রশংসা করেন বাদশাহের কাছে। বাদশাহ কয়েকজন অনুবাদককে কাজটার দায়িত্ব দেন। মোল্লার ভাগে পড়ে দশ জুজ, তিনি তা এক মাসের মধ্যে আরবি থেকে ফারসিতে অনুবাদ করে দেন। বাদশাহ মোল্লার ভাষা ও তৎপরতা দেখে খুশি হন ।
৭. নজাতুর্-রশীদ—
উপরোক্ত পুস্তক সমাপ্ত করার পর মোল্লা অসুস্থ হয়ে ছুটি নিয়ে খাজা নিজামুদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের জায়গির শামশাবাদ চলে যান। ঘরে গিয়ে খাজার কথায় মোল্লা এই পুস্তকখানি রচনা করেন। এতে মেহ্দী মতবাদের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি এমন চমৎকারভাবে বিষয়টির উপস্থাপনা করেছেন যে মোল্লার অপরিচিত কেউ পাঠ করলে মনে করতে পারে, মোল্লা বদায়ূনী স্বয়ং মেহ্দীপন্থী ছিলেন। কিন্তু মীর সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী মেহ্দীর উপর তাঁর যা কিছু কৃপা, তার কারণ অন্য ।
মুহম্মদ জৌনপুরীর জামাতা শেখ আবুল ফজল গুজরাতীর সঙ্গে মোল্লা বদায়ূনীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। মেহ্দীপন্থী লোকজন কেবলমাত্র আর্থিক সাম্যেরই প্রচার করেনি, তাদের মধ্যে সন্ত-সুফীদের মতো ধ্যান-যোগও চলত। শরীয়তের বহুবিধ কর্তব্য-পালনে তারা অন্যান্য মুসলমানদের থেকে এক পা এগিয়ে থাকত। সেই কারণে মোল্লা বদায়ূনী মেহ্দীপন্থীদের সঙ্গে সুবিচার করার উদ্দেশ্যে তাদের মতের ধ্যান-উপাসনা শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে নিজের মতাবলম্বীদের সুপরিচিত করে, মেহ্দী মত ও পথের ধ্যান-উপাসনা শিক্ষা-দীক্ষার উপকারের ঋণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন ।
সেই বছরই, মোল্লা যখন অসুস্থতাজনিত ছুটি নিয়ে বদায়ূনে রয়েছেন, তখন বাদশাহ ‘সিংহাসন বত্তীসী’ পুনরায় অনুবাদ করার জন্য বার কয়েক হুকুম পাঠান। প্রথম অনুবাদ পাঠাগারে নিখোঁজ হয়ে যায়। আকবরের বেগম সলীমা সুলতানের খুব পছন্দ ছিল পুস্তকখানি, তিনি বারবার বাদশাহকে তাগাদা দিচ্ছিলেন। মোল্লা বাদশাহের আদেশ উপেক্ষা করে বদায়ূনে পড়ে রইলেন। আকবর হুকুম দিলেন— ওর জায়গির বাতিল করে দাও। আর লোক পাঠাও, ওকে ধরে আনুক। শেখ আবুল ফজল বর্ম হয়ে মোল্লাকে রক্ষা করেন।
৮. জামে’অ-রশীদী—
এই আরবি ইতিহাস গ্রন্থটির প্রশংসা শুনে বাদশাহ সেটি অনুবাদ করতে মনস্থ করেন। মির্জা নিজামুদ্দীন আহমদ ইত্যাদি ব্যক্তিরা কাজটির ভার বদায়ূনীর উপর দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। মোল্লা এসে উপস্থিত হলে আল্লামী শেখ আবুল ফজলের পরামর্শানুক্রমে মোল্লার প্রতি অনুবাদের কাজ করার আদেশ হয় । এই গ্রন্থে বনী-উমাইয়া, আব্বাসিয়া, মিশরী খলীফাদের বিশদ বর্ণনা আছে। ইসলামের সেবাকর্ম, সেজন্য মোল্লা খুব আনন্দের সঙ্গে কাজটা করেছিলেন ।
৯. মুন্তখিবুত্-তওয়ারিখ—
মোল্লা বদায়ূনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক গ্রন্থ এটি। এ-গ্রন্থ তিনি টাকা-পয়সার জন্য লেখেননি, ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসার তাগিদেই লিখেছেন। যদিও উদারপন্থীদের তিনি সরাসরি দংশন করতে ছাড়েননি, তবুও ঐতিহাসিক-সুলভ দ্বিধাকৃত অভিমত প্রকাশের নমুনাও এতে রয়েছে। আকবরের আমলের শেষ বছরগুলি অতিক্রম করে জাহাঙ্গিরের শাসনকাল পর্যন্ত গ্রন্থটিকে বড় কষ্টে রক্ষা করতে হয়েছিল । জাহাঙ্গির যখন গ্রন্থটি সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি সেটিকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে সে-গ্রন্থ একখানা থেকে হাজারখানা হয়ে যায়, তখন তা আর বিনষ্ট করা সম্ভব ছিল না।
হুসেন খাঁ টুকড়িয়া যেমন নিজের তরোয়ালের অপপ্রয়োগ করেছিলেন, খানিকটা সেরকমই নিজের কলমের অপপ্রয়োগ করেছিলেন মোল্লা বদায়ূনী, তবে অপপ্রয়োগের বদলে প্রায়শই তিনি সত্য উদ্ঘাটনে সফল হয়েছেন ।
আরও দেখুনঃ