Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

মোল্লা বদায়নীর বাল্যকাল | মোল্লা বদায়নী | আকবর

মোল্লা বদায়নীর বাল্যকাল | মোল্লা বদায়নী | আকবর

মোল্লা বদায়নীর বাল্যকাল , মোল্লা আব্দুল কাদির বদায়ূনী সমসাময়িক কালে একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও বলিষ্ঠ লেখনী শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রচুর লিখেছেন, এবং সেই লেখাগুলি এমন যে, যে- কোনো পাঠাগারের পক্ষে তা মহামূল্যবান রত্ন হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

মোল্লা বদায়নীর বাল্যকাল | মোল্লা বদায়নী | আকবর

 

 

শামশুল-উমা মুহম্মদ হুসেন আজাদ বদায়ূনীর মোল্লাপনা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কঠোর বিরোধী ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর যোগ্যতা স্বীকার করে লিখেছেন— “রাজ্যের সাধারণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সেনা-অভিযান সম্পর্কে যে-কোনো ব্যক্তিই পরিচিত হতে পারে, কিন্তু রাজ্যের অধিপতি ও রাজ্যের স্তম্ভ-সমুদয় থেকে শুরু করে প্রত্যেকের চাল-চলন, তাদের গোপন ও প্রকাশ্য ব্যাপার-স্যাপার সম্পর্কে বদায়ূনী যতটা পরিচিত ছিলেন, সম্ভবত অন্য কেউ ততটা নয়।

তার কারণ, নিজের গ্রন্থ ও শিক্ষা বিষয়ক অভিজ্ঞতা, সমাজ-সচেতনতা ইত্যাদি গুণাবলী তাঁর মধ্যে ছিল। আকবরের নিভৃত বাস-গৃহে ও দরবারে সর্বদা বাদশাহের সন্নিকটে তিনি স্থান পেতেন, কথা বলার সুন্দর ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব-সুলভ আলাপ-আলোচনায় দরবার মাতিয়ে দিতেন। সেই সঙ্গে আলিম, সন্ত, শেখ-রা তো তাঁর বাড়িরই লোকজন। যেটি প্রশংসার যোগ্য তা হলো, তিনি তাঁদের মধ্যেই থাকতেন, অথচ তাঁদের দোষ-ত্রুটির সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতেন না ।

দূর থেকে দেখতেন, সেজন্য তাঁদের দোষ-গুণ ভালোভাবে তাঁর দৃষ্টিগোচর হতো। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতেন, সেজন্য প্রত্যেকটি জায়গার খবর এবং সেই খবরের তাৎপর্য তাঁর অবগত হতো। তিনি আকবর, আবুল ফজল, ফৈজী, মখদুমুল্-মুক্ ও সদরের (নবীর) প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাই যা-কিছু ঘটেছিল, সমস্ত স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেন। আসল কথা হলো, একটা স্বতন্ত্র লিখন-শৈলী ছিল তাঁর।

তাঁর লেখনী-মুখে সেই গুণ ছিল ভগবদ্দত্ত। তাঁর ইতিহাসে কিছু ঘাটতি আছে ঠিকই, তাতে বিভিন্ন অভিযান ও বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায় না, ঘটনার পারম্পর্যও রক্ষা করেননি, কিন্তু তাঁর গুণের প্রশংসা কোন কলমে লিখি? তাঁর ইতিহাস আকবরের আমলের এক প্রতিচ্ছবি। … তাঁরই সৌজন্যে আমরা সমগ্র আকবরী যুগটাকে দেখতে পাই ।

এতসব বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও যে দুর্ভাগ্য তাঁর উন্নতির প্রতিবন্ধকতার মূলে, তা হলো, যুগের সঙ্গে তিনি তাঁর মানসিকতাকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। যে ব্যাপার তিনি খারাপ মনে করতেন, তিনি চাইতেন, সেটা তাঁর নিজের মনোমতো হোক।… যেমন তাঁর মনে উদ্দীপনা ছিল, তেমনি তাঁর রসনায় জোর ছিল। সেজন্য তিনি যে কোনো উপলক্ষ্যে কোনো দরবারে ও বৈঠকে কথা না বলে থাকতে পারতেন না। আর এই স্বভাবটাই

আকবর তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।… “অসাফল্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু কলম ও কাগজের উপর তো তার আধিপত্য, যেই সুযোগ পেতেন, কলমে খসখস করে মোক্ষম চোট দিয়ে বসতেন । এমন চোট যে কেয়ামত পর্যন্ত সারবার নয়। ”

“মোল্লা বদায়নী শরীয়তের বিধি-নিষেধের ব্যাপারে কট্টর মোল্লাদের চেয়েও কয়েক পা বেশি এগিয়ে থাকতে চাইতেন, গাইতেন বাজাতেন, বীণার তারে সুর তুলতেন, দু-চার হাত দাবাও খেলে নিতেন— যাকে বলা হয় সর্ববিদ্যাবিশারদ। তিনি তাঁর পুস্তকে প্রত্যেকটি ঘটনা প্রত্যেকটি কথা খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, এমন চিত্রাঙ্কন করেছেন যে কিছুই বাদ পড়েনি। তাঁর ইতিহাসের (“মুন্তখিবুত্-তওয়ারিখ”-এর) প্রত্যেকটি শব্দ চুটকি, প্রত্যেকটি বাক্যই পরিহাস (রূপক)। তাঁর লেখনীর ছিদ্রে রয়েছে হাজার হাজার বাণ ও ছোরা ।

তাঁর লেখায় বাক্য সুবিন্যস্ত করার কোনো প্রয়াস নেই। তিনি অনেক বিষয়ই এলোপাথাড়ি লিখে যান। তাই দিয়ে তিনি যেদিকে খুশি সুচ বেঁধান, যেদিকে চান শলাকা, যেদিকে ইচ্ছে ছুরি চালিয়ে দেন। দরকার মনে করলে একহাত তরোয়ালের কোপও ঝাড়েন। এসব এমন চমৎকারভাবে করেন যে, যারা দেখে তাদের কথা ছেড়েই দিন, আহত ব্যক্তিরও মন ভরে যায়। নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা- তামাশা করতেও ইতস্তত করতেন না। সবচেয়ে প্রশংসনীয় যে, আসল ঘটনা উদ্ঘাটনে তিনি বন্ধু ও শত্রুর মধ্যে কোনো ভেদ রাখতেন না ।”

মোল্লা বদায়ূনীর “মুন্তখিবুত্-তওয়ারিখ” (ইতিহাস-সংগ্রহ) আকবরের আমলে লোকচক্ষুর অন্তরালে লেখা হয়েছিল। যদি তার ছ্যাঁকা আকবর ও তাঁর সভাসদদের লাগত, তাহলে মোল্লার রেহাই থাকত না। তিনি এটি খুব সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আকবরের আমলে কেউ সন্ধান পায়নি। জাহাঙ্গিরের আমলে তা জানা যায়। তিনি গ্রন্থখানি দেখেছিলেনও। হুকুম দিয়েছিলেন, মোল্লা আমার পিতার বদনাম করেছেন, ওঁর পুত্রকে কয়েদ করো, বাড়ি লুটপাট করো। বদায়ূনীর উত্তরাধিকারীদের গ্রেপ্তার করে আনা হলো।

তাঁরা বললেন— “আমরা তো সে-সময় শিশু ছিলাম, কিছুই জানতাম না আমরা।” তাঁরা মুচলেকা দিলেন যে তাঁদের কাছ থেকে যদি কোনো পুস্তক উদ্ধার হয়, তাহলে যে-কোনো শাস্তি তিনি দিতে পারেন। পুস্তক-বিক্রেতাদের কাছ থেকেও মুচলেকা নেওয়া হলো যে তারা ওই ইতিহাস কিনবে না, বিক্রীও করবে না। খাফী খাঁ শাহজাহানের আমল থেকে মুহম্মদশাহের আমল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দী কাটিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে যাবতীয় কড়াকড়ি সত্ত্বেও রাজধানীতে পুস্তক- বিক্রেতাদের দোকানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন বদায়ূনী ।

মোল্লা বদায়ূনী শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন, আজাদের কয়েকটি লাইন থেকে তা বোঝা যাবে। যদিও ফৈজীর মতো তিনি সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন না, তথাপি অপরাপর পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে তিনি ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘মহাভারত’, ‘রামায়ণে’র মতো সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন । এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল বহুমুখী ।

 

 

মোল্লা আব্দুল কাদির বদায়ূনী গর্বভরে বলতেন যে তাঁর জন্ম হয়েছিল বাদশাহ শেরশাহের আমলে । তিনি আকবরের বিধর্মী ঠাটবাটে বিরক্ত ছিলেন। শেরশাহকে মনে করতেন খাটি ধর্মপরায়ণ সম্রাট। অথচ অনেক অবাঞ্ছিত কথাবার্তা শুরু করেছিলেন শেরশাহ নিজেই। মোল্লাকে বলা হয় বদায়ূনী, তাতে এরকম ধারণা হতে পারে যে তিনি বদাŽতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। বস্তুত, হয় আগরা থেকে আজমের যাওয়ার পথে পঞ্চশ ছাউনি বিসাওয়রের কাছে অবস্থিত টোণ্ডা নামক গ্রামে, তাকে টোণ্ডাভীমও বলা হতো। সে সময় তা আগরা সরকারের (জেলার) অন্তর্ভুক্ত, আবার কখনও তা আজমের সুবায় পড়ত। তাঁর মাতুলালয় ছিল বায়ানা, যেখানে সাম্যবাদের শহীদ শেখ আল্লাঈ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মোল্লা খলীফা উমরের বংশের ফারুকী শেখ ছিলেন। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেননি। বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না।

তবে হ্যাঁ, মাতুলালয় ও পিত্রালয় উভয়ই শিক্ষা ও ধর্ম বিষয়ে দীনহীন ছিল না। তাঁর পিত, হামিদশাহের পুত্র মলুকশাহ, সম্ভলের সন্ত শেখ মঞ্জুর শিষ্য ছিলেন। পিতা মামুলি আরবি-ফারসি বইপত্র পড়েছিলেন। তাঁর মাতামহ মখদুম আশরফ ইসলামশাহের এক পাঁচহাজারী সর্দারের সেনাবাহিনীতে ফৌজী অফিসার ছিলেন এবং সেই সূত্রে আগরার ছোট শহর বায়ানার কাছে বিজওয়াড়ায় থাকতেন। ১৫৪৫ থেকে ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ (৯৫৩-৯৬১ হিঃ) পর্যন্ত শেখ আব্দুল কাদির পিতা মলুকশাহের কাছে ছিলেন।

সম্ভলে থেকে পাঁচ বছর বয়সে তিনি কুরান ইত্যাদি পাঠ করেন। তারপর মাতামহ তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নেন এবং ব্যাকরণ ইত্যাদি বহু বইপত্র নিজে পড়ান। দুটি বংশেরই লোকজন ধর্মে অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর পীর (দীক্ষাগুরু) সৈয়দ মুহম্মদ মখদুম সেখানেই থাকতেন ।

তিনি খুব ভালো কুরান পাঠক ছিলেন। তিনি আব্দুল কাদিরকে মধুর স্বরে কুরান পাঠ করা শেখান। তখন ৯৬০ হিজরী (১৫৫২-৫৩ খ্রিঃ), ইসলামশাহ শূরীর শাসনকাল। প্রসিদ্ধ কুরান পাঠকের শিষ্য হওয়াটা তাঁর কাছে খুব লাভজনক হয়েছিল। আর এই কারণেই আকবরের দরবারে গিয়ে তিনি বাদশাহ কর্তৃক সাত দিনে সাত ইমামের একজন হয়ে ‘ইমাম-আকবরশাহ’ পদবি লাভ করেন । তাঁর জন্ম

তিনি লিখেছেন : “বারো বছর বয়স। পিতা সম্ভলে এসে মিয়া হাতিম সম্ভলীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১৫৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দে (৯৬১ হিজরীতে) মিয়া সম্ভলীর খানকাহে (মঠে) পৌছে তিনি বহু ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করেন এবং তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

 

 

মিয়া একদিন পিতাকে বললেন যে তিনি তাঁর গুরু মিয়া শেখ আজীজুল্লা সাহেবের পক্ষ থেকে আব্দুল কাদিরকে টুপি-চাদর পুরস্কার দেবের যাতে বাইরের লোকজনের কাছেও তাঁর বিদ্যা স্বীকৃতি লাভ করে। এর ফল হলো, বদায়ূনী ফিকা (ধর্মশাস্ত্র) অত্যন্ত অনুশীলন করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে ভাগ্য তাঁকে অন্য দিকে চালিত করেছিল, কিন্তু মুসলিম ধর্মশাস্ত্র তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল বরাবর । শেখ সাদুল্লা নহবী একজন ব্যাকরণের বিচক্ষণ আচার্য ছিলেন। তিনি বায়ানায় থাকতেন। মাতামহের গৃহে এসে আব্দুল কাদির তাঁর কাছে ‘কাফিয়া’ পুস্তক পাঠ

করেন। যখন হেমুর সৈন্যরা লুঠপাট করতে করতে বিসাওয়রে পৌছায়, তখন আব্দুল কাদির সম্ভলে ছিলেন। লুঠপাটে বিসাওয়র বরবাদ হয়ে যায়। বড় দুঃখ করে তিনি লিখেছেন : “পিতার পাঠাগারও লুঠ হয়ে গিয়েছিল। পরের বছর দুর্ভিক্ষ। মানুষের করুণ অবস্থা চোখে দেখা যায় না। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। মানুষ মানুষকে খাচ্ছে।”

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version