মোল্লা বদায়নী আগরায়, সম্ভল কিংবা বায়ানায় থেকে বেশি পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না, সেজন্য সাতান্ন বছর বয়সে পিতা, ১৫৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দে (৯৬৬ হিজরীতে), পুত্র-সহ দেশ ছেড়ে আগরায় যান। সেখানে পুত্র মীর সৈয়দ মুহম্মদের টীকা ‘শমশিয়া’ অধ্যয়ন করেন।
মোল্লা বদায়নী আগরায় | মোল্লা বদায়নী | আকবর
মীর আলী হমদানীর পুত্র ছিলেন মীর সৈয়দ মুহম্মদ। কাশ্মীরকে মুসলমান করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হমদানীর। সে-সময় নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত বুখারা- নিবাসী কাজী আবুল মুওয়ালী আগরায় থাকতেন। সমরকন্দ ও বুখারায় তখন দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের খুব বাড়-বাড়ন্ত। লোকে ধার্মিক মুসলমানদের ঠাট্টা করে বলত—“গাধা, একদম গাধা।” কেউ বারণ করলে বলত— “আমরা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারি ।
দেখো, প্রত্যক্ষভাবেই গাধা পশু নয়। পশু সাধারণ, মানুষ বিশিষ্ট যেহেতু তার মধ্যে পশু-প্রবৃত্তি (সাধারণ) নেই। আবার ওদের মধ্যে বিশিষ্ট মনুষ্য-স্বভাবও নেই। তাহলে গাধা নয় তো কি?” এসব কথা এমন সীমা ছাড়িয়ে গেল যে সেখানকার শেখ-সুফীরা ফতোয়া লিখে খান আব্দুল্লার সম্মুখে পেশ করলেন এবং তর্কশাস্ত্র অধ্যয়ন-অধ্যাপনা অবৈধ ঘোষণা করে দিলেন।
এই সব কাণ্ডের জেরে কাজী আবুল মুওয়ালীকে এবং আরও অনেককে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। আব্দুল কাদির আবুল মুওয়ালীর নিকটেও পড়াশোনা করেছিলেন। সে-সময় নকীব খাঁ তাঁর সহপাঠী ছিলেন। এই পরিচয় তাঁর খুব কাজে এসেছিল, কেননা নকীব খাঁ পরে আকবরের পুস্তক-পাঠক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
সেকালে ফৈজী ও আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারকের বিদ্যাবত্তার খুবই সুখ্যাতি ছিল, যদিও মোল্লারা তাঁকে বিধর্মী বলতে কুণ্ঠিত হতেন না। এবার আব্দুল কাদির তাঁর শিষ্য হলেন। তিনি তাঁর গুরুর বিষয়ে লিখেছেন : “আমি যৌবনে কয়েক বছর তাঁর চরণাশ্রিত হয়ে পড়াশোনা করেছি। আমার উপর তাঁর অধিকার যথেষ্ট।” ফৈজী ও আবুল ফজল তাঁর গুরু-পুত্র। যদি তাঁরা পুত্র হিসেবে মুবারকের বিদ্যা ও প্রতিভায় সমৃদ্ধ হন, তাহলে আব্দুল কাদির শিষ্য হিসেবে।
কিন্তু, যেখানে পুত্ররা পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তা-ভাবনা লাভ করেন, সেখানে আব্দুল কাদির মোল্লা-কে-মোল্লাই থেকে যান, আর সেই কারণেই তিনি উন্নতি করতে পারেননি, যদিও তার ফলে আকবরের দরবারে তাঁর পৌছানোর পথ সুগম হয়েছিল আগরায় সর্দার মেহের আলী বেগ আব্দুল কাদির ও তাঁর পিতাকে নিজের কাছে খুব সমাদরে রেখেছিলেন । শেরশাহী আমলে আলী খানও ছিলেন, তাঁর কর্মচারী জামাল খাঁ চুনারগড়ের (জেলা মির্জাপুর) হাকিম ছিলেন।
তিনি স্বয়ং আকবরের দরবারে প্রার্থনা জানালেন যে যদি কোনো শাহী আমির আসেন, তাহলে তিনি তাঁর হাতে দুর্গ সমৰ্পণ করে দেবেন। বৈরাম খাঁ এ কাজের জন্য মেহের আলীকেই উপযুক্ত মনে করলেন । বেগ মোল্লা আব্দুল কাদিরকে বললেন—তুমিও চলো। তিনি স্বয়ং মোল্লা এবং মোল্লার পুত্র ছিলেন। চুনার গিয়ে আবার কি বিপদে জড়িয়ে পড়েন, তার চেয়ে আগরায় থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই ভালো মনে করলেন আব্দুল কাদির। বেগ মলুকশাহ ও শেখ মুবারককে নিরুপায় করার জন্য বললেন—যদি তিনি না যান, তাহলে আমিও যেতে অস্বীকার করব। শেষে আব্দুল কাদিরকে সম্মতি দিতে হলো। লিখেছেন—
“ভরপুর বর্ষাকাল । কিন্তু দুই গুরুজনের কথা মান্য করা উচিত মনে হলো। নতুন যাত্রা, পড়াশোনা শিকেয় তুলে পথ-পর্যটনের আশঙ্কা ও বিপদ মাথায় নিতে হলো। কনৌজ, লখনৌতী, জৌনপুর, বারাণসী (বেনারস) পাড়ি দিতে দিতে, পৃথিবীর বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে, জায়গায় জায়গায় আলিম ও শেখদের সাহচর্য লাভ করতে করতে গেলাম।
আমরা চুনারে পৌছলাম, তো জামাল খাঁ খুব দেখনদারির সঙ্গে খাতির তোয়াজ করলেন। কিন্তু বুঝতে পারলাম, মনের মধ্যে মতলব আছে। মেহের আলী বেগ আমাকে সেখানেই রেখে, নিজে বাড়িঘর ঘুরে দেখার অজুহাতে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে কাঁধের বোঝা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। জামাল খাঁ দুর্নামের ভয়ে ঘাবড়ে গেলেন। আমি বললাম— ‘কোনো ক্ষতি নেই, কেউ হয়তো ওঁর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঠিক আছে, আমি নিজে গিয়ে ওঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিয়ে আসছি”।”
এই বাহানায় মোল্লাও সেখান থেকে চম্পট দিলেন। চুনার দুর্গ পাহাড়ের উপর, নিচে গঙ্গা সশব্দে বয়ে চলেছে। নৌকায় যাচ্ছিলেন। বর্ষার স্রোতোবেগ নৌকাটাকে টেনে নিয়ে চলল। এরপর মোল্লা তাঁর ভয়-আশঙ্কার কথা বর্ণনা করেছেন— “নৌকা খুব বিপজ্জনক ঘূর্ণিজলে গিয়ে পড়ল।
তরঙ্গাঘাতে দুর্গ-প্রাচীরের কাছে একটা পাহাড়ি খাঁজে আটকে গেল । বিরুদ্ধে এমন বাতাসও বইতে শুরু করল যে মাল্লারা কিছুই করে উঠতে পারছিল না। জঙ্গল ও নদীর ভগবান যদি না তখন কর্ণধার হতেন, তাহলে আশঙ্কা করছিলাম, নৌকা ওই আপদ ঘূর্ণিতে পড়ে সাক্ষাৎ-মৃত্যু পাহাড়ে গিয়ে ঠোক্কর খাবে।
নদী পেরিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। খবর পেলাম, গওয়ালিয়রের সন্ত শেখ মুহম্মদ গওস পাহাড়ের ধারে এই জঙ্গলে তপস্যা করতেন। তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হলো । তিনি একটি গুহা দেখিয়ে বললেন— ‘এখানেই শেখ মুহম্মদ গওস গাছের পাতা খেয়ে বারো বছর ধরে তপস্যা করেছিলেন’।”

আগরায় তিন বছর ছিলেন, এমন সময় ১৫৬১-৬২ খ্রিস্টাব্দে (৯৬৯ হিজরীতে) পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর শবদেহ বিসাওয়রে নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করা হয়। পরের বছর মোল্লা সম্ভলে (মুরাদাবাদ) সহসওয়ান এলাকায় ছিলেন। সেখানে চিঠি পেলেন, মাতামহ মখদুম আশরফও বিসাওয়রে প্রাণত্যাগ করেছেন।
দু’বছরের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও সহৃদয় পিতা ও মাতামহের বিয়োগ-ব্যথা তাঁকে সহ্য করতে হয়। তখন সংসার যেন তেড়ে আসছে তাঁকে দংশন করতে। “দুই বিষাদ, দুই শোক, আর আমি একা। একটি মাথা, দুইটি খোয়ারি ঝেড়ে ফেলার শক্তি কোথায় পাব? একটি বুক, দুইটি বোঝা কি করে বইব?”
আরও দেখুনঃ