বীরবলের দরবারী | বীরবল | আকবর

বীরবলের দরবারী , শামশুল উমা আজাদ বলেছেন— “বীরবলের মৃত্যুর পর আকবর এমন অস্থির ও শোকাভিভূত হন যে তা দেখে লোকে অবাক হয়ে গিয়েছিল। অমন আলিম-ফাজিল, সংবেদনশীল, সাহসী নেতা এবং দরবারী পরাক্রমশালী অনেকে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আকবরের সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু এমন কি কারণ ছিল যে বীরবলের মতো কারো মৃত্যুতেই তিনি এত বিহ্বল হয়ে পড়েননি।

বীরবলের দরবারী | বীরবল | আকবর

 

বীরবলের দরবারী | বীরবল | আকবর

 

আলেকজান্ডারের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের নাম যেমন উচ্চারিত হয়, ঠিক তেমনি আকবরের সঙ্গে বীরবলের নাম। কিন্তু যদি খ্যাতির দিক দিয়ে বিচার করা যায়, তাহলে মনে হবে, বীরবল তাঁর কাছে অ্যারিস্টটলের চেয়েও অনেক বেশি।”

আকবর বীরবলকে তাঁর অভিন্নহৃদয় বলে মনে করতেন এবং তাঁকে এত সম্মান করতেন যে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করেও সন্তুষ্ট নি। এমন অন্তরঙ্গতা যে অন্তঃপুরেও তাঁকে নিজের কাছে রাখতেন । কিন্তু আকবর ও বীরবলের নামে যেসব গল্প জনপ্রিয় তা থেকে বীরবলকে একজন দারুণ কৌতুকপ্রিয় এবং বাদশাহের মনোরঞ্জনকারী দক্ষ বিদূষকের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। কিন্তু একথা মন কিছুতেই মেনে নিতে চায় না যে কেবল ভাঁড়ামির সাহায্যে তিনি আকবরের মতো এক মহান প্রতিভার অধিকারীর এত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন

বীরবলের আসল নাম মহেশদাস। কালপীতে (জালৌন জেলা) এক ব্রহ্মভট পরিবারে তাঁর জন্ম। মোল্লা বদয়ূনী তাঁকে ‘ভাট’ বলে তাঁর নাম ব্রহ্মদাস উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথমে রামচন্দ্র ভটের কাছে চাকরি করতেন, বিভিন্ন জায়গায় কবিতা শুনিয়ে বেড়াতেন। আকবরের রাজত্বকালের প্রথমবর্ষে (১৫৫৬ খ্রিঃ) কোথাও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়।

মহেশদাসের কথাবার্তা শুনে বাদশাহ এত খুশি হন যে তাঁকে নিজের কাছে রেখে দেন। মোল্লা বদায়ূনী বলেছেন— “বাল্যকাল থেকেই বাদশাহের ব্রাহ্মণ, ভাট এবং হিন্দু সমাজের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বিশেষ ভাব-ভালোবাসা ছিল। রাজত্বকালের প্রারম্ভে কালপীর অধিবাসী এক কাঙাল ব্রাহ্মণ ভাট তাঁর সেবাকার্যে নিযুক্ত হন, তখন তাঁর পেশা ছিল হিন্দুদের গুণ কীর্তন করা। উন্নতি করতে করতে তিনি খুব উচ্চ পদমর্যাদা লাভ করেন এবং বাদশাহের দশা হয়ে পড়ে—

মন্ তৃ শুদম্ তূ মন শুদী মন্ তন্ শুদম্ তূ জা শুদী । (আমি তুমি হয়ে গেছি, তুমি হয়ে গেলে আমি, আমি হলাম দেহ, তুমি হলে তার প্ৰাণ ।) প্রথমে বাদশাহ তাঁকে কবিরায় (কবিসম্রাট) উপাধি দিয়েছিলেন, তারপর রাজা বীরবল।

৯৮০ হিজরীতে (১৫৭২-৭৩ খ্রিঃ) আকবরের সেনাপতি হুসেন কুলী খাঁ নগরকোট (কাঁগড়া) জয় করেন। বাদশাহের ষোলো বছর বয়স্ক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীরবলকে ওই অঞ্চল জায়গির দেওয়ার হুকুম হলো। কাঁগড়ার পাহাড়ী মারকুটে লোকজনের উপর আজকের মতো তখনও ইসলাম ধর্মের প্রভাব খুব কম ছিল।

বাদশাহ ভেবেছিলেন, একজন ব্রাহ্মণকে জায়গিরদার করা হলে তারা খুশি হবে। কাঁগড়ার যুদ্ধ সর্বদা শত্রুদের নাজেহাল করে রাখত। ঋগ্বেদের সময় রাজা দিবোদাসকে এখানকার রাজা শম্বর নাকের জলে চোখের জলে একাকার করে ছেড়েছিলেন এবং সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে আর্যদের সর্বশক্তি ব্যবহার করে দিবোদাস তাঁর প্রাণবধ করতে সফল হয়েছিলেন।

কেবল আক-বর ও জাহাঙ্গির নন, এমন কি পার্বত্য যুদ্ধে অদ্বিতীয় গোর্খারাও সারা হিমালয় জয় করে কাঁগড়ায় গিয়ে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় । আক-বরের সৈন্যবাহিনী প্রবলভাবে কাঁগড়া আক্রমণ করেছিল। সৈন্যবাহিনীতে হিন্দু- মুসলিম উভয় সৈন্যই ছিল ।

 

বীরবলের দরবারী | বীরবল | আকবর

 

প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানা হয়েছিল । কিন্তু যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই, অন্যদিকে, শাহ্জাদা ইব্রাহিম মির্জা বিদ্রোহী হয়ে পাঞ্জাবে নিজের শাসন-কর্তৃত্ব ঘোষণা করেন । মোগল সেনাপতি হুসের কুল্লী খাঁ রাজার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তসমূহের অন্যতম হলো : যেহেতু বাদশাহ এই অঞ্চল বীরবলকে জায়গির দিয়েছেন, সেহেতু এর বদলে তাঁকে পাঁচ মণ সোনা দিতে হবে। বীরবল তাতেই সন্তুষ্ট হলেন, আর যাই হোক, এইসব পাহাড়িদের সঙ্গে প্রত্যহ বিবাদ-বিসংবাদ থেকে তো স্বস্তি লাভ করলেন। বীরবল সেখান থেকে (গুজরাত) আকবরের নিকটে উপস্থিত হলেন । মান থেকে প্রস্থান করে আহমদাবাদে

লি আকবরের একান্ত ইচ্ছা যে তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ও উপদেষ্টাদের গৃহে গমন করে তাঁদের আতিথ্য-আপ্যায়ন গ্রহণ করেন। পূর্বে বাদশাহের পক্ষে এরূপ আচরণ অসংগত বলেই বিবেচনা করা হতো, কিন্তু আকবর তো সকলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যেতে চান। বাদশাকে যাঁরা নিমন্ত্রণ করেন, তাঁরা মন উজাড় করে নিমন্ত্রণের আয়োজন করে থাকেন।

গৃহাদি উত্তমরূপে সুসজ্জিত করা হয়। পাপোশ বিছানো হয় মখমলের নকশাদার কিংখাবের। বাদশাহ আগমন করলে তাঁর উপর সোনা-রূপোর পুষ্পবর্ষণ করা হয়। ঢেলে দেওয়া হয় থালাভর্তি মুক্তো। সওয়া এক লক্ষ টাকা নিচে রেখে তার উপর নির্মাণ করা হয় চবুতরা, সেই চবুতরার উপর পেতে দেওয়া হয় বাদশাহের বসবার আসন।

উপঢৌকন-সামগ্রী হিসাবে তাঁর সামনে হাজির করা হতো চুনি-মণি রত্নাদি, শাল-দোশালা, নকশাদার মখমল, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র, সুন্দর সুন্দর ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, সেরা সেরা হাতি ঘোড়া ইত্যাদি । লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হতো উপঢৌকনে ।

লোকে বীরবলকে বলল— সকলেই বাদশাহকে নিমন্ত্রণ করছেন, তুমিও করো না! বীরবল বেচারি তো সেনাপতি হয়ে যুদ্ধ করতে যান না যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে আনবেন! তিনি তাঁর সাধ্যমতো নিমন্ত্রণের আয়োজন করলেন । বাদশাহের নিমন্ত্রণকারীদের উপঢৌকনের তুলনায় কিছুই না। তবু, বীরবলের ছিল বচনামৃত, যার ফলে তাঁর শাকান্নেও বাদশাহ এত পরিতৃপ্ত হলেন যে আমিরদের লক্ষ লক্ষ টাকার আয়োজনও তাঁকে অমন পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম হয়নি ।

 

বীরবলের দরবারী | বীরবল | আকবর

 

কিন্তু, তার মানে এই নয় যে বীরবল দরিদ্র জীবনযাপন করতেন । রাজা-মহারাজা, আমির-নবাব বাদশাহের অভিন্নহৃদয় বন্ধুর নিকট দামী দামী উপহার পাঠাতেন। বিক্ষুব্ধ রাজাদের কাছে প্রায়ই তাঁকে দূতরূপে পাঠানো হতো তাঁদের ক্ষোভ নিরসনের জন্য। কোটি কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ যুদ্ধের কাজ তিনি তাঁর সুমধুর কথাবার্তাতেই সেরে ফেলতেন। ৯৮৪ হিজরীতে (১৫৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে) তাঁকে এরূপ একটা কাজে ডোগরপুরের রায় লুনকরনের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল।

একবার শাহী-পিলখানার একটা হাতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হাতিটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল এবং লোকজন প্রাণভয়ে পালাচ্ছিল। এমন সময় বীরবল সহসা হাতির সামনে এসে পড়েন। অন্যদের ছেড়ে দিয়ে হাতি তাঁর দিকে তেড়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে বীরবলের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। এমন সময় আকবর অশ্বারোহণে হাতির কাছে এসে পৌঁছান, অমনি হাতি সেখানেই থমকে দাঁড়ায় ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment