Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

বীরবলের যুদ্ধ | বীরবল | আকবর

বীরবলের যুদ্ধ | বীরবল | আকবর

বীরবলের যুদ্ধ, কাশ্মীর থেকে পশ্চিম-কাশ্মীর যেমন সুন্দর, তেমনি হিমালয়ের চমৎকার উপত্যকাগুলির মধ্যে অন্যতম সওয়াৎ-বুনের অঞ্চল। ঋগ্‌বৈদিক আর্যরা দেশটি দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে তারা এর নাম দিয়েছিল সুওয়াস্তু’ (ভালো ভালো ঘরবাড়ি বিশিষ্ট), আর তারই বিকৃত রূপ সওয়াৎ। খুবই উর্বর জমি।

বীরবলের যুদ্ধ | বীরবল | আকবর

 

 

গ্রীষ্মকালে অধিক মনোরম ও শীতল হয়। এর উত্তরে চিরতুষারাবৃত হিমালয় পর্বতশ্রেণী। দক্ষিণে খয়বার থেকে আসা পর্বতশ্রেণী, পশ্চিমে সুলেমান পর্বতশ্রেণী চলে গেছে এবং পূর্বে কাশ্মীর। এখানে কোথাও তিরিশ মাইল, কোথাও বা চল্লিশ মাইল দীর্ঘ উপত্যকা । এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য পাহাড় অতিক্রম করার গিরিপথ আছে।

সওয়াৎ অঞ্চল শস্য-শ্যামল। আজাদ তাঁর রচনায় সওয়াতের ভূ-পরিচয় দিয়েছেন— “হে আমার বন্ধুরা, এই পার্বত্যাঞ্চল এমন বেঢঙের যে যারা সেখানে ভ্রমণ করেছে, তারাই সেখানকার দুর্গমতা জানে। অনভিজ্ঞতা তা কল্পনাই করতে পারবে না। যখন পর্বতে প্রবেশ করা হয়, তখন পাহাড় অর্থাৎ জমি একটু একটু করে উপরে উঠছে বলে মনে হয়।

তারপর মনে হয় দূরে মেঘপুঞ্জ, ডানদিক থেকে বামদিক বরাবর আবৃত করে আছে। মেঘপুঞ্জ ক্রমশ উপরে উঠে এগিয়ে আসতে থাকে। যেমন যেমন অগ্রসর হবে, ছোট ছোট টিলা চোখের সামনে প্রকটিত হতে থাকবে। সেগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে আরও অগ্রসর হও, দেখবে উঁচু উঁচু পাহাড় শুরু হয়ে গেছে। একটা পাহাড়শ্রেণী অতিক্রম করে কিছু দূর চড়লেই দেখা যাবে খোলা মাঠ, আবার সেখান থেকেই শুরু হয়েছে পাহাড়শ্রেণী ।

সেখানে দুটি পাহাড়ের ফাঁক (গিরিসঙ্কট) দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে, অথবা কোনো পাহাড়ের গায়ে চড়তে চড়তে উপরে উঠেই অতিক্রম করতে হবে। চড়াই-উৎরাই উভয় পথেরই ধারে ধারে এমন গভীর গভীর খাদ যে সেদিকে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। সামান্য পা হড়কালেই হলো, পাতালের আগে কোনো ঠাঁই ঠিকানা জুটবে না। কখনো সমতল মাঠ, কখনও এক ক্রোশ দুই ক্রোশ এক নাগাড়ে যেমন চড়তেও হয় তেমনি নামতেও হয়, আবার কখনো কেবলই চড়ে যাওয়া।

পথে স্থানে স্থানে ডাইনে-বাঁয়ে গিরি- উপত্যকা, কখনো-বা পথ বেঁকে অন্যদিকে চলে যায়। এইসব উপত্যকায় ক্রোশের পর ক্রোশ লাগাতার মানুষের বসতি, তাদের হালচাল সম্বন্ধে কারো ধারণা নেই। কখনো দুটি পাহাড়ের মাঝখানটা গলি হয়ে কয়েক ক্রোশ চলে গেছে।

চড়াই (সরাবালা), উত্রাই (সরাশেব), তরাই (দামনেকোহ্), ডাঁড়া (কমরেকোহ্), দ্রার (গরীবানেকোহ্ গলিয়ারা (তঙ্গিয়েকোহ্), ধার (তেজিয়েকোহ্)— এইসব শব্দের অর্থ সেখানে গেলে মালুম হয়। সমস্ত পাহাড় ছোট-ছোট বড়-বড় গাছপালায় আচ্ছাদিত। ডাইনে-বাঁয়ে উপর থেকে জলের ঝরণা নেমে এসেছে, সেই জল কোথাও নালা কোথাও-বা খাল তৈরি করে বয়ে চলেছে।

কোথাও দুই পাহাড়ের মধ্যখানে বয়ে চলে, সেতু বা নৌকা ব্যতীত সেখানে পার হওয়া কঠিন। জল উপর থেকে নিচে পড়ে পাথরে ঘা খেতে খেতে বইতে থাকে, সেজন্য স্রোত তীব্র, পায়ে হেঁটে পার হওয়া সম্ভব নয়। সাহস করে একটু চেষ্টা করতে গেলে পাথরের উপর থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে নিস্তার নেই ।”

 

 

এই পার্বত্যাঞ্চলে (সওয়াৎ) আফগানরা বাস করে। আফগানদের পাতুনও বলা হয়, ঋগ্‌বৈদিক আর্যরা তাদের পাত্ বলত। আর্যদের এক বীর জাতি ছিল পাত্ এবং ঋগ্‌বেদের কালে তারা সিন্ধুর পশ্চিমে বাস করত। হতে পারে, সওয়াৎ কখনো তাদের বাসভূমি ছিল। এই পার্বত্যভূমির উপর আফগানদের গভীর ভালোবাসা। সীমান্তগান্ধী খান আব্দুল গাফ্ফার খান পাতুনদের এই আদি বাসস্থান সম্পর্কে প্রশংসা না করে থাকতে পারতেন না।

একবার বলেছিলেন— “সেখানকার জল ও অন্য জায়গার দুধ এক সমান। সেখানকার ফলমূলের স্বাদ অন্য জায়গায় পাওয়া যায় না।” সওয়াতের আফগানরা দুম্বা ও উটের পশম দিয়ে কম্বল, ধোসা, শতরঞ্জি, চট ইত্যাদি বোনে। পশম দিয়ে তারা ছোট ছোট ছোলদারি বানায়। পার্বত্যাঞ্চলে নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করে সন্নিকটস্থ ক্ষেতে চাষাবাদ করে।

সেখানে জংলী আপেল, বিহি, ন্যাশপাতি, আঙুর ফলে। পাঠানেরা বড় স্বাধীনতাপ্রিয় । শত্রু এলে তারা প্রাকৃতিক দুর্গ পাহাড়ের সহায়তা নিয়ে মোকাবিলা করে। কোনো উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে বাজনা বাজিয়ে শত্রুর আগমন-সংবাদ ঘোষণা করা হয়। সে-সময় প্রত্যেক সওয়াতী ব্যক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। ঘর থেকে দু-তিন বেলা আহারের মতো কিছু রুটি কিছু আটা বেঁধে নিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় ।

আকবর নিজেকে কাবুলের প্রভু, কাশ্মীরের মালিক বলে মনে করেন। সওয়াকে কি তিনি নাগালের বাইরে রাখতে পারেন? জৈন খাঁর উপর যুদ্ধাভিযানের হুকুম হলো । সওয়াতী লোকেরা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করল। যখন দেখল মোকাবিলা করা অসম্ভব, তখন তারা পাহাড়ে পালিয়ে গেল।

 

 

আকবরের পল্টনের সৈন্য সমভূমির মানুষ; চড়াই ভেঙে পাহাড়ে ওঠা তাদের কাছে বিপদের কথা। জৈন খাঁ যে সামান্য সাফল্যলাভ করেছিলেন, সেই খবর পাঠিয়ে আরও সৈন্য চাইলেন। দরবারে পরামর্শ চলছিল, সৈন্যের সঙ্গে কোন আমিরকে প্রেরণ করা যায়, যিনি ওই রকম দুর্গম পাহাড়ে অনায়াসে উপস্থিত হতে সক্ষম। আবুল ফজল নিজে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন।

বীরবল বললেন— “আমি যাব।” গুটি চালা হলো, নাম উঠল বীরবলের। বাদশাহ তা আশা করেন নি। বীরবলের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হলো । কিন্তু তিনি বাধ্য। আদেশ দিলেন, বাদশাহের তোপখানাও সঙ্গে যাবে। যখন বীরবল গমনোদ্যত, তখন আকবর তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন—“বীরবল, শীঘ্র ফিরে এসো।” যাত্রাপথে একদিন আকবর মৃগয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে স্বয়ং তাঁর শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলেন, অনেক কথা বোঝালেন তাঁকে। প্রচুর সৈন্য ও যুদ্ধসামগ্রী দিয়ে বীরবলকে প্রেরণ করেছিলেন তিনি। 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version