শেখ মুবারকের মহান কার্য

শেখ মুবারকের মহান কার্য – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শেখ মুবারক” বিভাগের একটি পাঠ। সুখী জীবন— শেখ মুবারক আকবরের সম্মান ও অনুগ্রহভাজন ছিলেন। কিন্তু তিনি দরবারে কোনো পদ গ্রহণে সম্মত হননি। শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার মিথ্যা অভিযোগে মীর হবাস প্রভৃতির হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল আকবরের শাসনকালেই। যাঁরা তাঁকে হত্যা করিয়েছিলেন, সেই আব্দুন্ নবী ও মোল্লা সুলতানপুরী শেখ মুবারককেও শিয়া ও মেহ্দীপন্থী বলেছিলেন।

শেখ মুবারকের মহান কার্য

 

শেখ মুবারকের মহান কার্য | শেখ মুবারক | আকবর

 

দুঃসময়ের দিনে শেখ মুবারক সলীম চিশতীকে দিয়েও সুপারিশ করাতে চেয়েছিলেন। শেখ সলীমের প্রতি আকবরও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাঁরই আশীর্বাদে তিনি পুত্রলাভ করেন এবং শেখের নামেই তিনি পুত্রের নামকরণ করেন সলীম— তিনিই জাহাঙ্গির নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।

চিন্তীর জন্যই আকবর তাঁর রাজধানী ফতেহপুরে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শেখ কিছু টাকাকড়ির সঙ্গে বার্তা পাঠান : “এখান থেকে তোমার চলে যাওয়াই ভালো। তুমি গুজরাতে চলে যাও।” মির্জা আজিজ বাদশাহকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তেষট্টি বছর বয়সে শেখের ভাগ্য খুলে যায়, ১৫৬৬ কিংবা ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে ফৈজী দরবারে স্থানলাভ করেন, তার চার বছর পরে আবুল ফজলও গিয়ে মীরমুনশী (মহাসচিব) পদ অলঙ্কৃত করেন।

সত্তর-বাহাত্তর বছর বয়সে শেখ মুবারকের যৌবন ফিরে আসে। যে-ব্যক্তি এক সময় সঙ্গীত ধর্মবিরুদ্ধ বলে কোথাও সঙ্গীতের আওয়াজ কানে এলে দ্রুত সে-স্থান অতিক্রম করে চলে যেতেন, তিনিই এখন তানপুরা আর তারানা শুনতে শুনতে এতটুকু ক্লান্তিবোধ করেন না ৷ আকবর নিরক্ষর ছিলেন, তার মানে এই নয় যে তিনি অশিক্ষিত ছিলেন। এমন একটা সময় তো ছিল যখন মানুষ শুনে শুনেই বিদ্যা অর্জন করত, লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না। আকবর ছিলেন শ্রুতিধর।

ফারসি ও তুর্কি দু’টি ভাষাই ছিল তার কাছে মাতৃভাষার মতো। নকীব খাঁর কাজ ছিল অবসরের সময় বাদশাহকে ইতিহাস ও বিবিধ বিদ্যার বইপত্র পড়ে শোনানো। “হায়াতুল হওয়ান” (প্রাণী-জীবনী) নামক একখানি আরবি পুস্তক ছিল, তার অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে হতো। বাদশাহ পুস্তকটির ফারসি অনুবাদের দায়িত্ব দেন শেখ মুবারককে। বাদশাহ বিভিন্ন ধর্ম ও শাস্ত্রের আলোচনা শুনতে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। সেই সব বিতর্ক সভায় হঠাৎ তাঁর মনে হয়, আরবি ভাষাটাও শিখে নেওয়া যাক না।

শেখ মুবারকের চেয়ে ভালো শিক্ষক আর কোথায় পাওয়া যাবে? ফৈজী পিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। আরবি ব্যাকরণ শুরু হলো। এই সময় ফৈজী বাদশাহকে বললেন— “শেখেমা তকল্লুফ অস্লা ন দারদ” (আমাদের শেখ কিন্তু একেবারেই আদব-কায়দা জানেন না)।

আকবর জবাব দিলেন— “আরে, তকল্লুফাত্ রা হমা বর-শুভা গুজাতা অদ্” (হ্যাঁ, সমস্ত আদব-কায়দা তোমাদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন কি না)। মাত্র কয়েকদিন আরবি শেখার ঝোঁক রইল, আকবরের আরবি শেখার সময় কোথায়?

 তাছাড়া আকবরের দরবারের আধ ডজন সদস্যের মধ্যে ফৈজী ও আবুল ফজল হলেন দু’জন, বাদশাহ তাঁদের অভিন্নহৃদয় বলে মনে করতেন এবং তাঁদের সঙ্গে আচার- ব্যবহারে দরবারী রীতিনীতির তোয়াক্কা করতেন না। তাঁদের পিতাকেও খুব সম্মান করতেন তিনি । মাঝে মাঝে শেখ মুবারক দরবারে এলে তাঁর দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য- সংক্রান্ত আলোচনা শুনে সন্তোষ লাভ করতেন। শেখের সঙ্গীত-বিদ্যার শখ ছিল, সে- কথা শুনে আকবর একবার বললেন— “এই কলাবিদ্যার যে-রত্ন সংগ্রহ করেছি, আমি আপনাকে দেখাব।”

তারপর শেখ মঞ্জু, তানসেন ও অন্যান্য কালোয়াতদের ডেকে শেখের গৃহে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য। শেখ সকলের সঙ্গীত শুনলেন। তানসেনকে বললেন— “শুনেছি, তুমিও কিছু কেরামতি দেখাতে পারো।” তানসেনের গান শুনে মন্তব্য করলেন— “জন্তু-জানোয়ারের মতো খানিকটা ভ্যা-ভ্যা মনে হচ্ছে।” তানসেনের সঙ্গীত-পারঙ্গমতার বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ ছিল না, এ কথা অবশ্যই ঠিক, তবে গানের জন্য যে মধুর কণ্ঠের আবশ্যকতা বিবেচনা করা হয়, অপরাপর সঙ্গীত-উস্তাদদের মতো সম্ভবত তানসেনের তা ছিল না, সেজন্য তাঁর রাগ-রাগিণীকে ভ্যা-ভ্যা বলে মনে হয়েছিল ।

আকবর উদার হৃদয় ও দৃঢ়-সাহসী ব্যক্তি ছিলেন । কিন্তু সমস্ত শাসনযন্ত্র ও নিয়ম- কানুন সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া তাঁর আয়ত্তের মধ্যে ছিল না, বিশেষত শাসনকালের প্রথম দিকে। মথুরায় এক ব্রাহ্মণ একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো যে তিনি মসজিদ ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন।

মামলা যায় সর্বোচ্চ বিচারপতির কাছে, তিনি ব্রাহ্মণকে প্রাণদণ্ড দেন। আকবর ভীষণ মনঃকষ্টের মধ্যে ছিলেন। সেই সময় শেখ মুবারক কোনো এক বিশেষ উপলক্ষ্যে আকবরকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন। বাদশাহ তাঁর সম্মুখে অনেক প্রশ্ন তুলে ধরে বললেন— “এই সব মোল্লাদের দাপটে লোকের প্রাণসঙ্কট দেখা দিয়েছে।

ওঁরা নিজেদের ধর্ম ও আইনের অধিকারী বলে মনে করেন।” শেখ মুবারক জানালেন — “ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ সর্বময় অধিকারী। যে বিষয়ে মতভেদ দেখা দেবে, দেশকাল বিবেচনা করে সে-বিষয়ে তিনি স্বয়ং আদেশ দেবেন। মোল্লারা তো এমনিতেই শূন্যকুম্ভ, ওঁদের ভিতরে কিছু নেই। ওঁদের প্রশ্ন করারও দরকার নেই আপনার।”

আকবর বললেন— “হরগাহ্ শুভা উস্তাদে-মা বাশীদ্, সবক পেশে-শুভা খান্দা বাশীম, চিরা মারা অজমিন্নতে ঈ মুল্লায়ী খলাস্ ন মী-সাজীদ (আপনি যখন আমার শিক্ষক, আপনার নিকটে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি, তাহলে এই সব মোল্লাদের অনুগ্রহ থেকে আমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করছেন না কেন)?”

শেখ মুবারক একটি শাসনতন্ত্র রচনা করেন যা মোল্লাদের কবল থেকে আকবরের সাম্রাজ্যকে উদ্ধার করে। তখন আকবর নির্ভয়ে নতুন ভারত নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হন। তাঁর আরব্ধ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য যথাযোগ্য উত্তরাধিকারী পাওয়া যায়নি, সেজন্য আকবর যদি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে না পেরে থাকেন, তাহলে তাতে তাঁর দোষ কি?

শেখ মুবারক কুরান ও ইসলামী ধর্মশাস্ত্রের বাণীগুলি, তৎসহ পুরাতন নজির-সমূহ একত্র করে একটি দলিল তৈরি করেন, তার সারমর্ম— যে-সব বিষয়ে মতভেদ দেখা দেবে, সে-সব বিষয়ে বাদশাহ নিজের রায় অনুসারে হুকুম দিতে পারেন, তাঁর রায় আলিম ও ধর্মশাস্ত্রবিদদের সিদ্ধান্ত অপেক্ষা চূড়ান্ত প্রামাণিক বলে গ্রাহ্য করতে হবে।

খুব সংক্ষিপ্ত সেই দলিল, আঠারো-কুড়ি পক্তির বেশি নয়, কিন্তু তা ভারতের ম্যাগ্‌নাচার্টা, সেই দলিল অনুসারে গোঁড়া মোল্লাদের হাত থেকে ধর্ম-বিষয়ক প্রশ্নও কেড়ে নেওয়া হয়, সে-বিষয়ে চূড়ান্ত অধিকার প্রদান করা হয় বাদশাহকে । দলিল রচনা করে ৯৮৭ হিজরীর রজব মাসে (আগস্ট/সেপ্টেম্বর, ১৫৭৯ খ্রিঃ) দরবারে পেশ করা হয়। বড় বড় আলিম-ফাজিল, মুক্তী-কাজীদের আহ্বান করা হয়েছিল। সেদিনের সভায় সভাপতি ছিলেন শেখ মুবারক । তাঁর পুরনো শত্রুরা এসে ভেজা বেড়ালের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে বসে ছিলেন, দলিলে সীলমোহর লাগানোর হুকুম হলে বিনা- বাক্যব্যয়ে সকলকেই সীলমোহরের ছাপ দিতে হলো।

শেখ মুবারক স্বাক্ষর দিয়ে ও কথাও লিখে দিলেন— “ঈ অমরেস্ত, কি মন্ ব-জান্-ব-দিল্‌ খোওয়াহাঁ ব অজ্‌ সাল্হায়ে বাজ্ মুন্তজিরে-আঁ বুদম্” (প্রাণে মনে যে স্বপ্ন দেখেছি, বছরের পর বছর য কামনা করে প্রতীক্ষা করে আসছি, এটা সেই বস্তু)।

আকবর ও তাঁর সহযোগীদেরও আগে থেকে শেখ মুবারক দেশের স্বপ্ন দে আসছিলেন। মেহ্দী জৌনপুরীর সাম্যবাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি সেই কারণে কেননা তিনি মুষ্টিমেয় মানুষের নয়, সমস্ত মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য দেখতে চাইতেন। শি গোষ্ঠীর প্রতি তাঁর সহানুভূতি অবশ্যই ছিল।

তিনি জানতেন, ইরানে ইসলাম যের শিয়া-মত রূপে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে, সেরকম ভারতেও প্রয়োজনীয়তা আছে। ভারতে হিন্দু হোক অথবা মুসলমান, দেশের মাটির ও সকলের একই ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। মহাকবি ফিরদৌসী যেমন ইরা সংস্কৃতি-সমন্বয়ে ‘শাহনামা’ রচনা করে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও সদ্ভাব থাকা দরকার। 

 

শেখ মুবারকের মহান কার্য | শেখ মুবারক | আকবর

 

একবার তিনি বীরবলকে বলেছিলেন— “এখানে তোমাদের (হিন্দুদের) গ্রন্থসমূহে যেরকম নানা পরিবর্তন ঘটেছে, সেরকম আমাদের গ্রন্থ-সমূহেও ঘটেছে। সেজন্যই ওগুলো প্রামাণিক নয়।” শেখ মুবারক চাইতেন, মানুষ যেন মোল্লা ও পুঁথিপত্তরের ফেরে না পড়ে।

শেখ মুবারক সাতাশি বছরের দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে অক্টোবর লাহৌরে তাঁর মৃত্যু হয়। আবুল ফজলের আগ্রহে তিনি তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। তাঁর মৃত্যুর পর একজন বলেছিলেন—

আঁকি ফেফে-জহাঁ বুদ বর্-দিলশ, দুরহায়ে আসমানে-ময়ানী কুশাদাঃ বুদ্ । বে-য়ো য়তীম্‌ ব মুর্দাঃ দিল্ অন্দ্‌ অকবায়ে-য়ো, (তিনি জগতের দার্শনিক ছিলেন, তাঁর কাজকর্ম ছিল মানুষের মন নিয়ে, তিনি চলে গেলেন, দিব্য গুপ্তরহস্যের মুক্তারাজি তিনি উন্মোচন করে দিয়েছেন, তাঁর শূন্যতায় তাঁর সমীপবর্তীরা অনাথ ও নিষ্প্রাণ।)

পিতার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রেরা শ্মশ্রু-মস্তক মুণ্ডন করেন। আকবর হিন্দু- মুসলমানকে এক করে একজাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, সেজন্য পরস্পরের রীতি-রেওয়াজ অনুসরণকে উপেক্ষা করা হতো না। শেখ মুবারকের আট পুত্র ও চার কন্যা। পুত্রেরা হলেন— 

১. আবুল ফয়েজ ফৈজী, 

২. আবুল ফজল, 

৩. আবুল বরকত, 

৪. আবুল খয়ের, 

৫. আবুল মুকারিম, 

৬. আবু তুরাব, 

৭. আবু হামিদ এবং 

৮. আবু রশিদ। 

 

 

শেখ মুবারকের মহান কার্য | শেখ মুবারক | আকবর

 

সপ্তম ও অষ্টম দাসী-পুত্র ছিলেন, কিন্তু অন্যান্য ভ্রাতারা তাঁদের সহোদর ভ্রাতা বলে মনে করতেন। কন্যারা ছিলেন— আফীফা, দ্বিতীয়…তৃতীয়— দরবারের ভালো ভালো আমিরের সঙ্গে তাঁদের বিবাহ হয় । সর্বকনিষ্ঠ কন্যা ছিলেন লাডলী বেগম, তাঁর প্রতি বিশেষ স্নেহ-বাৎসল্যই স্বাভাবিক। তাঁর বিবাহ হয়েছিল শেখ সলীম চিত্তীর পৌত্রের সঙ্গে ।

লাহৌরে মৃত্যু হলেও তাঁর লাশ আনা হয় আগরায়। আকবরের সমাধির (সিকান্দারা) ক্রোশখানেক দূরে লাডলী বেগমের সমাধি। আগে জায়গাটার পাশে · ভালো বাগান ও বিশাল দরজা ছিল। তারই ভিতর কয়েকটি সমাধি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছে নতুন ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুবারক, কবিরাজ ফৈজী।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment