শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ | আবুল ফজল | আকবর

শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ, ১৫৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে (১০০৬ হিজরী) দাক্ষিণাত্যের সমস্যা খুবই সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। দক্ষিণের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসার জন্য আকবর অনেক বড় বড় সেনাপতির সঙ্গে শাহজাদা মুরাদকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু মুরাদ -সুরাপান করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন এবং সেনাপতিদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। তার এক বছর পূর্বে সমরকন্দের উজবেক সুলতান আব্দুল্লার মৃত্যু হয়। উজবেকরা বাবরকে তাদের দেশ থেকে মেরে তাড়িয়েছিল।

শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ | আবুল ফজল | আকবর

 

শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ | আবুল ফজল | আকবর

 

আকবরের রক্তে প্রতিশোধ-স্পৃহা ছিল যে তিনি সমরকন্দ পুনরাধিকার করবেন। এখন তার অনুকূল পরিস্থিতি, কেননা তৈমূর-বংশীয় শাহজাদাদের আত্মকলহের নিমিত্ত উজবেকদের পক্ষে সমরকন্দ গ্রাস করার যেমন সুযোগ হয়েছিল, তেমনি সুযোগ এখন আকবরের সম্মুখে। কিন্তু এদিকে দক্ষিণেও দিগ্‌বিজয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেখান থেকেও পিছিয়ে আসতে পারেন না।

আকবর এবং তাঁর দেশের দুর্ভাগ্য যে তিনি একটিও উপযুক্ত পুত্র লাভ করেননি। বাসনা ছিল, জ্যেষ্ঠ পুত্র সলীমকে সৈন্য-সামন্ত সহ তুর্কিস্তান প্রেরণ করবেন, কিন্তু তিনিও সুরাপানে মত্ত হয়ে থাকেন। দ্বিতীয় পুত্র দানিয়াল সম্পর্কে সংবাদ পেয়েছেন, তিনি ইলাহাবাদ থেকে আরও আগে চলে গিয়েছেন, তাঁর মনোভাব ভালো নয় ।

তুরানের চিন্তা ত্যাগ করে আকবর প্রথমে আহমদনগরের যুদ্ধ সামলানোই সঠিক মনে করলেন, কারণ সেখানে বীরাঙ্গনা চাঁদবিবি আকবরের সেনাপতিদের নাকে দম লাগিয়ে রেখেছেন। আকবর লাহৌর থেকে রওনা দিলেন এবং আবুল ফজলকে বললেন— “ভেবে দেখলাম, দাক্ষিণাত্য অভিযানে হয় আমাকে, না-হয় তোমাকেই যেতে হবে । এছাড়া অন্য কোনো সঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।”

১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১০০৭ হিজরী) আকবর আবুল ফজলকে হুকুম দিয়ে বললেন— শাহজাদা মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে যাও। যদি কোনো সেনাপতি সেখানকার কাজের দায়িত্ব নিতে চায়, ভালোই, নইলে শাহজাদাকে পাঠিয়ে দেবে, আর তুমি সেখানেই থেকে সব দেখাশোনা করবে।

আবুল ফজলকে এবার লেখনী ছেড়ে তরোয়াল ধরতে হলো। তারা বুরহানপুরের নিকটে পৌছলেন, তো আসিরগড়ের শাসনকতা বাহাদুর খাঁ-ও চার ক্রোশ পথ নিচে নেমে স্বাগত জানাতে এলেন। তিনি তাঁকে আতিথ্য গ্রহণ করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন, কিন্তু তখন আতিথ্য গ্রহণ করার অবকাশ কোথায়! বুরহানপুরে উপস্থিত হলেন তো বাহাদুর খাঁ-ও সেখানে গিয়ে পৌছলেন। আবুল ফজল বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে বললেন, কিন্তু তিনি নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করলেন। তবে হ্যাঁ, এক হাজার সৈন্য-সহ তার পুত্র কবীর খাকে আবুল ফজলের সঙ্গে দিলেন।

আবুল ফজল লিখেছেন— “আমাকে এই কাজ দেওয়া দরবারের বহু আমিরের পছন্দ ছিল না। তাঁরা সব রকমের বাধা সৃষ্টি করেছিলেন।” অনেক পুরনো সঙ্গী-সাথী দূরে সরে গিয়েছিল, তাকে নতুন সৈন্যের বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। ভাগ্য ভালো ছিল, বহু সেপাই এসে যোগ দিয়েছিল। আবুল ফজল একজন অভিজ্ঞ সেনাপতির মতো সম্মুখে অগ্রসর হলেন। দেওল গাঁও হয়ে তিনি খুব দ্রুততার সঙ্গে শাহজাদার সৈন্য- শিবিরে পৌছে গেলেন। শাহজাদার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল । আবুল ফজল গিয়ে পৌছানোর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। ওই রকম একটা পরিস্থিতি সামলাতে হলো তাঁকে। 

শাহপুরে শাহজাদার শবদেহ পাঠিয়ে সেখানে সৎকার করা হলো । কিছু লোক তখনও তিনকে পাঁচ করার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় পিছনে রেখে আসা তিন হাজার সৈন্য এসে হাজির হলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মাথা ঠাণ্ডা হলো তাতে । এই যুদ্ধে আব্দুর রহমানও পিতার সঙ্গে ছিলেন। বাদশাহী ফৌজ নিয়ে আবুল ফজল আহমদনগরের দিকে অগ্রসর হলেন। পথে গোদাবরী গঙ্গী (নদী), তার জল বাড়ছিল, কপালগুণে শীঘ্রই তাঁরা সেখানে পৌছে গিয়েছিলেন বলে সৈন্যবাহিনী সহজেই নদী পার হলো। নদী-তীরে আহমদনগরের সৈন্যদের নজর পড়তেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেল ।

 

শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ | আবুল ফজল | আকবর

 

আবুল ফজল যখন আহমদনগরের বিশৃঙ্খলা দমন করতে ব্যস্ত, সেই সময় সলীমের (জাহাঙ্গিরের) মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল, পিতার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে আগরা ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি। সলীম অযোগ্য ছিলেন, কিন্তু অন্যান্য পুত্ররাও তাই। অনেক তপস্যা ও সাধু-সন্তের আশীর্বাদে আকবর এই প্রথম পুত্র লাভ করেছিলেন, সেজন্য তাঁর প্রতিই আকবরের স্নেহ-ভালোবাসা ছিল বেশি।

আহমদনগরের সুলতান বুরহানুল্-মুল্ক্ রাজপাটে বঞ্চিত হয়ে আকবরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, বাদশাহের সাহায্যেই তিনি পুনরায় রাজাসন লাভ করেন। আশা করা হয়েছিল, তিনি আকবরের প্রভুত্ব অস্বীকার করবেন না; কিন্তু দাক্ষিণী তাতে রাজী ছিলেন না। এখন বুরহানুল্-মুল্ক্ নেই, তিনি দেহত্যাগ করেছেন। তাঁর পৌত্র বাহাদুর খাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে পিতৃাসা চাঁদবিবি সুলতানি রক্ষা করার জন্য হাতে তরোয়াল তুলে নিয়েছেন। চাঁদবিবি যেমন সাহসিনী ছিলেন, তেমনি বিচক্ষণও ছিলেন।

দরবারের সভাসদদের তিনি বিশ্বাস করতে পারতেন না। তিনি আকবরের বাদশাহীর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে আপস করার কথা ভাবলেন। সে-কথা লিখে জানালে আবুল ফজল জবাব দিলেন— “যদি দূরদর্শিতা ও সৌভাগ্যের জন্য দরবারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে চান,

তাহলে তার চেয়ে ভালো কি?” চাঁদবিধি নিজের হাতে অঙ্গীকারপত্র লিখে পাঠিয়ে দিলেন— “যখন আপনি আমঙ্গ খাঁকে (আহমদনগরের সেনাপতি) পরাজিত করবেন, তখন আমি আপনাকে দুর্গের চাবি দেবো। কিন্তু এটুকুই প্রার্থনা, দৌলতাবাদ যেন আমার জায়গির থাকে, আর এই অনুমতিও চাই যে, আমি কয়েকদিন সেখানে গিয়ে থাকব এবং যখন আমার ইচ্ছে হবে, দরগায় হাজির হব। বাহাদুরকে আমি দরবারে পাঠিয়ে দেবো।”

কিন্তু, সে-সবের কিছুই হলো না। তরোয়ালের সাহায্যেই আবুল ফজলকে জয়লাভের চেষ্টা করতে হলো। এদিকে আহমদনগরের সমস্যা চলছে এরকম, আসিরগড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ল, কেননা আসিরগড় বিদ্রোহী হলে বাদশাহী ফৌজের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

আসিরগড় দক্ষিণের প্রবেশপথ। পাহাড়ের উপর এমন অনেক দুর্গ ছিল, যার উচ্চতা ও দৃঢ়তা অতুলনীয়। পাহাড়ের কটিদেশে উত্তর দিকে মালী দুর্গ। মালী হয়েই আসিরগড়ে যাওয়া যেত। ওই দুর্গের উত্তরে ছোট মালী, তার প্রাচীরের সামান্য অংশই নির্মিত, বাকি সমস্তটাই পাহাড়ের পার্শ্বদেশ প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দক্ষিণের দিকে কর্দা নামক পাহাড়, তার পার্শ্বদেশকে পাহাড়ী সর্পিণী বলা হতো। শত্রুরা প্রতিরক্ষার জন্য সব রকমের কামান আর সেপাই মোতায়েন করে রেখেছিল। আসিরগড়কে লোকে বলত অজেয় ।

বাদশাহী ফৌজ আক্রমণ করত, কিন্তু তাতে শত্রুদের কোনো ক্ষতি হতো না। আবুল ফজলকে সেই আসিরগড় জয় করতে হবে। তিনি একটা গোপন পথ খুঁজে বের করলেন, যে- পথে আচমকা মালীর প্রাচীরের নিচে গিয়ে পৌছানো সম্ভব । ওদিকে

অন্ধকার রাত্রি, বৃষ্টি পড়ছিল। সেই সময় আবুল ফজল কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সর্পিণী পাহাড়ে চড়তে শুরু করলেন, তৃতীয় প্রহরে সৈন্যরা সেই চোরাপথে গিয়ে মালী দুর্গের ফটক ভেঙে ফেলল। কিছু সৈন্য দুর্গে প্রবেশ করে নাকাড়া বাজাতে লাগল। নাকাড়ার আওয়াজ শুনেই আবুল ফজল সেদিকে দৌড়ালেন।

ভোরের আলো ফুটতেই সকলেই হাজির হলেন সেখানে। প্রাচীরের অন্যদিকে মই লাগিয়ে সকলের আগে আবুল ফজল উপরে উঠে লাফিয়ে পড়লেন দুর্গের মধ্যে। তারপর অন্যান্য বীর সৈন্যরাও পিঁপড়ের সারির মতো উপরে উঠে পড়ল। বাধ্য হয়ে শত্রুসৈন্য আসিরগড়ের দিকে পালিয়ে গেল । তখন মালী দুর্গ আবুল ফজলের দখলে । এই পরাজয়ে বাহাদুর খাঁ ভীত হয়ে পড়লেন। ওদিকে খবর পাওয়া গেল যে দানিয়াল ও খানখানা আব্দুর রহীম আহমদনগর জয় করে নিয়েছেন।

বাহাদুর খাঁর আর এতটুকু সাহস অবশিষ্ট রইল না। তিনি আসিরগড় সমর্পণ করলেন। সেটা ১৬০০-১৬০১ খ্রিস্টাব্দের (১০০৯ হিজরীর) ঘটনা। এই সময় বীরত্বের এক আশ্চর্য দৃশ্য আবুল ফজল প্রত্যক্ষ করলেন। পরাতম নামে সুলতান বাহাদুর খাঁ গুজরাতীর এক কর্মচারী ছিল। সে বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে পড়েছিল বলে তার যুবক পুত্র দুর্গের দেখাশোনা করত। দুর্গের চাবি থাকত বৃদ্ধের কাছেই । সে যখন শুনল যে বাহাদুর খাঁ মোগলদের হাতে দুর্গ সমর্পণ করেছে, তখন সে মনে এত আঘাত পায় যে তৎক্ষণাৎ তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। তার পুত্ররা বলল— এই সুলতানির কপাল পুড়েছে। আমাদের আর বেঁচে থাকা লজ্জার কথা। এই বলেই তারা আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করে ।

 

শুধু লেখনীতে নয়, তলোয়ারবাজিতেও দক্ষ | আবুল ফজল | আকবর

 

দক্ষিণে আসিরগড় ও আহমদনগর বিজয় এক অসাধারণ জয়লাভ। সুতরাং আনন্দ হওয়ারই কথা, কিন্তু খবর এল, জাহাঙ্গির প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন । বাদশাহের হুকু” এল, আহমদনগর গিয়ে খানখানার (রহীম) সঙ্গে কাজে হাত দাও ৷

আবুল ফজল সেখানে গিয়ে খানখানা ও নিজের পুত্র আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজকর্ম সামলালেন। তারপর তাঁর প্রত্যাবর্তনের ফরমান এল বাদশাহের কাছ থেকে । সলীমের বুদ্ধি কম ছিল, সেটা এ থেকেই বোঝা যায় যে তিনি বরাবর নূরজাহানের হাতের পুতুল হয়ে ছিলেন। একবার তাঁর সুমতি হয়েছিল, কিন্তু ১৬০২-৩ খ্রিস্টাব্দে (১০১১ হিজরীতে) পুনরায় লোকে তাঁর মন বিষাক্ত করে তোলে। জয়পুরের রাজা মানসিংহের ভগ্নীর সঙ্গে সলীমের বিবাহ হয়, তাঁদেরই পুত্র শাহজাদা খুসরো ।

পিতামহ তাঁকে অত্যন্ত আদর করতেন। লোকে সলীমকে বোঝায় যে বাদশাহ তাঁকে বঞ্চিত করে খুসরোকে যুবরাজ করবেন এবং এ কথাও বোঝানো হয় যে এর পিছনে আবুল ফজলের মন্ত্রণা রয়েছে। আবুল ফজল আকবরের জন্য নিজের সবকিছু সমৰ্পণ করেছিলেন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি পিতা-পুত্রের মতভেদ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াবেন।

তবে সলীম ভাবতেন যে আবুল ফজল তাঁর নামে কুৎসা রটিয়ে বেড়ান। যখন তিনি জানতে পারলেন যে বাদশাহের ফরমান পাঠানো হয়েছে এবং আবুল ফজল প্রত্যাবর্তন করছেন, তখন তিনি আরও শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। আবুল ফজলকে তিনি সবচেয়ে বড় পথের কাঁটা মনে করতেন ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment