শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য

শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শেখ আব্দুন নবী ” বিভাগের একটি পাঠ। আকবরের আমলে আব্দুন্ নবী অত্যন্ত প্রভাবশালী মোল্লা এবং মোল্লাদের সদর (প্রধান) ছিলেন। গোড়ার দিকে আকবর তাঁদের যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন, তাঁদের প্রভাব তাঁর সংস্কারের কাজে সহায়ক হবে। কিন্তু কুকুরের লেজ কি কখনও সোজা করা যায়?

শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য

 

শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

শেখ আব্দুন্ নবী শেখ (সুফী) বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর পিতা শেখ আহমদ বসবাস করতেন গঙ্গোহ্ অঞ্চলের আন্দারীতে (জেলা সাহারানপুর)। গৃহে জ্ঞানানুশীলন ধর্মানুশীলনের পরিবেশ ছিল। লোকে বলত, তিনি এক প্রহর সমাধিস্থ হয়ে বসে থাকতেন। কয়েক বার মক্কা-মদীনা জিয়ারত করে এসেছিলেন এবং সেখানেই হাদিস অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন চিশতী সুফী-সম্প্রদায়ের। 

পিতা-পিতামহের আমল থেকেই পরিবারে কাওয়ালি গানের রেওয়াজ চলে আসছিল। কিন্তু যখন তিনি হাদিস অধ্যয়ন করে মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন তিনি সেটাকে অধর্মাচরণ বোধ করলেন এবং শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ও ধর্মোপদেশ বিতরণেও অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

নিজের রাজত্ব-কালের প্রথম আঠারো বছর ইসলাম ধর্মের উপর আকবরের বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল এবং আলিমদের তিনি খুব কদর করতেন। আমির ও উজির কুল (সর্বোচ্চ প্রতিনিধি) মুজফ্ফর খাঁ শেখের প্রচুর প্রশংসা করেন, ফলে আকবর ১৫৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে (৯৭২ হিঃ) আব্দুন্ নবীকে ‘সদরুসদর’ (ধর্মাধ্যক্ষদের অধ্যক্ষ) পদমর্যাদায় ভূষিত করেন। সে সময় আকবরের সিংহাসনে আরোহণ আট বছর পূর্ণ হয়েছিল এবং তখন তাঁর বয়স অনধিক একুশ বছর।

মোল্লাদের নষ্টামির সীমা-পরিসীমা ছিল না, অথচ মোল্লা সুলতানপুরীর সৌভাগ্য- সূর্য তখন অস্তাচলগামী। সে সময় আব্দুন নবীর নক্ষত্র উপরে উঠল, জ্বলজ্বল করে। আব্দুন্ নবীর এত নামডাক যে আকবর স্বয়ং কখনো কখনো হাদিস শোনার জন্য গৃহে পদার্পণ করতেন। যুবরাজ সলীমকেও হাদিস শিক্ষার জন্য তাঁর নিকট প্রেরণ করতেন। শেখের উপদেশ আকবরের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি কঠোরভাবে শরীয়তের বিধান মেনে চলার চেষ্টা করতেন, স্বয়ং মসজিদে আজান তাঁর দিতেন এবং নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম হতেন, নিজের হাতে মসজিদে ঝাড়ু দেওয়াকে পরম ভাগ্য বলে ভাবতেন।

একদিন আকবরের জন্মদিন ছিল। তিনি কেসরে রাঙানো জামা পরে প্রাসাদের বাইরে এলেন। তাই দেখে আব্দুন্ নবী বললেন— “এই রং এবং কেসরে রাঙানো পোশাক শরীয়ত বিরুদ্ধ। এটা পরা উচিত হয়নি।” তিনি উত্তেজনায় এমন অস্থির হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁর ছড়ি বাদশাহের জামা স্পর্শ করল। আকবর সেখানে কিছু বললেন না, কিন্তু অন্তঃপুরে এসে মা-কে অভিযোগ জানালেন। মা বললেন—“ও কিছু না। এটা রাগের কথা নয়, বরং মুক্তির উপায়। গ্রন্থে লেখা থাকবে, একজন পীর এমন মহামহিম সম্রাটকে ছড়ি দিয়ে মেরেছিলেন, অথচ কেবল শরীয়তের সম্মান রক্ষার্থেই তিনি চুপচাপ তা বরদাস্ত করেছিলেন।”

ভারতে মুসলিম রাজত্বের প্রথানুযায়ী সব মসজিদে ইমামদের নিয়োগ করতেন বাদশাহ। আর এই নিয়মের ফলে প্রত্যেক মসজিদের ইমাম রূপে সরকারের চর সর্বত্র ছড়ানো থাকত। তাঁরা শুধু মুসলমানদের ধর্ম ও ইমানের দেখাশোনাই করতেন না, বরঞ্চ তাঁদের কাজ ছিল শাসকদের সাহায্য করার জন্য গোয়েন্দা পুলিশের। খুব ভালোভাবে যাচাই করে ইমামদের নিয়োগ করা হতো।

সরকারের তরফ থেকে তাঁরা জায়গির পেতেন। এ সময় দেখা গেল যে জায়গির অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। পূর্ববর্তী সমস্ত বাদশাহ্ মিলে যতগুলি জায়গির দিয়েছিলেন, এই কয়েক বছরেই জায়গিরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তার সমপরিমাণ। তাতে কারচুপিও ছিল। দরবার থেকে ফরমান জারি হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত সদরুসদরের হস্তাক্ষর ও প্রমাণপত্র না পাওয়া যায়, ততক্ষণ করোড়ী (পরগণা-শাসক) ও তহসিলদার যেন জায়গিরের বরাদ্দ ভাতা অনুমোদন না করেন।

কাবুল থেকে বাংলা, দাক্ষিণাত্য থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্যের এরূপ সমস্ত জায়গিরদারকেই তখন সেই হস্তাক্ষর ও প্রমাণপত্র সংগ্রহের জন্য ফতেহপুরসিক্রী দৌড়াতে হলো। সদরের কাছে সকলেই হাজির হবেন কিভাবে? যাঁরা সুপারিশ যোগাড় করতে পারলেন, তাঁরাই পৌঁছতে পারলেন সদরের কাছে, তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো।

তাতে সদরের উপদেষ্টা ও মোসাহেবদের বাঁ- হাতের কারবার তো শুরু হলোই, তাঁর চাকর-বাকর, দারোয়ান, সহিস এমন কি ধাঙড়কেও লোকে ঘুষ দিতে লাগল। যে-ইমাম তা করতে পারলেন না, তাঁকে ঠ্যাঙানি খেয়ে বেরিয়ে যেতে হলো। তাঁদের অনেকেই গ্রীষ্মের লু-বাতাসে মারা পড়লেন। সে- খবর গিয়ে পৌছল আকবরের নিকটেও। কিন্তু শরীয়তের হাওয়া গরম, সেজন্য তিনি

কিছু করতে সমর্থ হলেন না । শেখ আব্দুন্ নবীর দাপটের কথা কি বলব? দরবারের বড় বড় আমির তাঁকে তোষামোদ করতে যেতেন। শেখের মেজাজ তুঙ্গে, কারো প্রতি সম্মান দেখানো প্রয়োজন বলেই ভাবতেন না। সুপারিশ শুনে গেলেন, শেষে ভালো ভালো আলিমরাও একশো বিঘে করে জমি পেলেন তো ধরে নিন সেটাই যথেষ্ট। বছরের পর বছর ধরে হাতে-থাকা জমিও কেটে দেওয়া হলো। অযোগ্য ইমামরাই নয়, হিন্দুরা পর্যন্ত জায়গির পেয়ে গেলেন । তার ফলে আলিমদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল ।

সদর তাঁর দফতরে দ্বিপ্রাহরিক নামাজের জন্য অজু (হস্তপদ প্রক্ষালন) করতেন। সেখানে বসে থাকা আমির ও অন্যান্যদের মুখে-মাথায়, তাদের কাপড়-চোপড়ে তাঁর গা-যোওয়ার জল ছিটকে পড়ত। দায়ে-পড়া লোকজনকে সবই সহ্য করতে হয়, কিন্তু মনে মনে খুবই খারাপ লাগত তাদের। শেখের যখন দুঃসময় এসেছিল, তখন তারা তার মূল্য সুদে-আসলে উত্তল করতে কসুর করেনি। শেখ আব্দুন নবীকে জীবনে যতখানি ভুগতে হয়েছিল, সম্ভবত আর কোনো সদরকে তত ভুগতে হয়নি।

বারো বছরেরও বেশি সময় শেখ মানুষের উপর উৎপীড়ন চালিয়েছিলেন। তারপর ফৈজী ও আবুল ফজল দরবারে যোগদান করেন। ১৫৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দ (হিজরী ৯৮৫) নাগাদ শেখের বাড়বাড়ন্ত থাকা খায়। বাদশাহের কাছে বরাবরই অভিযোগ আসছিল।

এবার আদেশ হলো, যাদের নিষ্কর জায়গির পাঁচশো বিঘার বেশি, তাদের নিজেদেরকে ফরমান নিয়ে আসতে হবে বাদশাহের কাছে। ফরমান দেখা নিয়েই শেখের ভাগ্য- বিপর্যয় শুরু হলো। এতদিন সমগ্র সাম্রাজ্যের উপর তাঁর যে অধিকার ছিল, তা বণ্টন করে দেওয়া হলো। আর্জি নিষ্পত্তির জন্য প্রত্যেক সুবায় এক-একজন আমির নিযুক্ত হলেন। পাঞ্জাবে এ কাজের ভার পড়ল মোল্লা আব্দুল্লা সুলতানপুরীর উপর। আগে থেকেই পরস্পরের রেষারেষি ছিল, এখন আগুনে ঘি পড়ল। দুই মোল্লা পরস্পরের পাগড়ি ধরে টানাটানি শুরু করলেন।

একদিন বাদশাহ আমিরদের সঙ্গে বসে ভোজন করছিলেন। শেখ সদর একটা পাত্রে হাত দিতেই আবুল ফজল ব্যঙ্গ করে বলে উঠলেন— যদি কাপড়ে লাগা কেসরের রং অপবিত্র হয়, হারাম হয়, তাহলে তার ভোজনসামগ্রী কিভাবে হালাল হতে পারে? বেচারি শেখের কাছে এর কি উত্তর থাকবে?

একদিন বাদশাহ আমিরবর্গের সঙ্গে বসে ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন—“পত্নীর সংখ্যা কত হওয়া উচিত? যৌবনে তো এসব ভাবিনি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কি করা দরকার?” প্রত্যেকে নিজের নিজের মত প্রকাশ করলেন। আকবর জানালেন— “একদিন শেখ সদর বলছিলেন, কিছু কিছু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ নয়জন পত্নী বিধেয় বলে রায় দিয়েছেন।” দরবারের জনৈক আমির বললেন—“হ্যাঁ, ইবন্ আবী-লয়লার এই মত কেননা কুরানের আয়ত্— ফাকেহুমা তাবা লাকুম মিনান্ নেসা— য়ে মাস্না— ওয়া সুলা—সা ওয়া রুবা-আ’ (তো বিবাহ করো দুইটি ও তিনটি ও চারিটিকে)।

দুই, তিন, চার যোগ করলে নয় হয়। কেউ আবার ওই আয়তের ‘দুই-দুই ও তিন-তিন এবং চারি-চারি’ অর্থ গ্রহণ করে সংখ্যাটি আঠারো বলেও মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব অভিমতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া যায় না।” বাদশাহ্ তখনই শেখকে জিজ্ঞাসা করতে পাঠালেন, তো তিনি জবাব দিলেন— “আমি আলিমদের মতভেদের কথা উল্লেখ করেছিলাম মাত্র, ফতোয়া দিই নি।” কথাটা আকবরের ভালো লাগে নি । শেখ একবার কিছু বলতেন, পরের বারে অন্য কিছু।

শেখের আরবি ভাষায় জ্ঞান ও হাদিসে পাণ্ডিত্যের খুব অহঙ্কার ছিল। তিনি ভাবতেন— আমি মদীনায় হাদিস অধ্যয়ন করেছি। হাদিস সংগ্রহকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রাচীন ইমাম আজমের সন্তান আমি। আমার সামনে দাঁড়াবার সাধ্য আছে কার? কিন্তু, একদিন আকবরের দুগ্ধভ্রাতা মির্জা আজীজ কোকা তাঁর একটা শব্দে ত্রুটি ধরেন। শেখ একজন শাহজাদাকে উল্টোপাল্টা পড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আসলে আরবিতে দুই প্রকারের ‘হ’ এবং চার প্রকারের ‘জ’ আছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেক পরিশ্রম করে পার্থক্য মনে রাখার চেষ্টা করে, অথচ আমাদের ভাষায় তার ব্যবহার নেই। সেজন্য কোন ‘হ’ কণ্ঠ থেকে উচ্চারণ করতে হবে, না সাধারণভাবে, মনে রাখা কঠিন। যে হাদিস জ্ঞান নিয়ে শেখের এত বড়াই এবং যার সাহায্যে তিনি এত উচ্চপদে পৌঁছেছেন, তাতেই তাঁর এই দশা। ফৈজী ও আবুল ফজল কেন ওই বৃদ্ধকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবেন না? ওদিকে পুরনো মোল্লা সুলতানপুরীও শেখকে ধরাশায়ী করার কোনো সুযোগই হাত-ছাড়া করতে চান না।

 

শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

এটা ক্রমে নিশ্চিত হচ্ছিল যে সদর নিরপরাধ মীর হবাশকে শিয়া হয়ে যাওয়ার মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করিয়েছেন এবং পয়গম্বরকে অবমাননা করার অপবাদ দিয়ে খিজির খাঁ-র প্রাণনাশ করেছেন। এমন সময় কাশ্মীরের হাকিমের (রাজ্যপাল) পক্ষ থেকে ভেট নিয়ে মুকীম আস্ফাহানী ও মীর ইয়াকুব হুসেন খাঁ এলেন। সে সময় কাশ্মীরে শিয়া-সুন্নীর ঝগড়া বেধেছিল, তাতে একজন শিয়া নিহত হয়।

তার বদলা নিতে এক সুন্নী মুফতীকে খুন করা হয়। বলা হলো, এর জন্য মুকীমই দায়ী। মুকীম ও ইয়াকুব উভয়েই শিয়া, তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শেখ সদর দু’জনকেই হত্যা করালেন। লোকে বলতে শুরু করল—এ-ও তো নিরপরাধীদের খুন করা।

বাদশাহের মন আগেই বিরূপ হয়েছিল। সেই সময় আরও একটা গর্হিত কাজ করে বসলেন শেখ। মথুরায় জনৈক ব্রাহ্মণ মসজিদের জায়গায় শিবমন্দির নির্মাণ করাচ্ছিলেন। যখন তাঁকে বাধা দেওয়া হলো, তখন তিনি পয়গম্বরের সম্মান হানিকর কিছু মন্তব্য করে বসেন এবং মুসলমানদের অপমান করেন। ব্রাহ্মণ খুব প্রভাবশালী ছিলেন, সেজন্য মথুরার কাজী কিছু করতে পারেন নি। তিনি নালিশ পেশ করেন সদরের কাছে। সদর ব্রাহ্মণকে হাজির হওয়ার জন্য হুকুম পাঠালেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ সে- হুকুমে কর্ণপাত করলেন না। ব্যাপারটা বাদশাহ পর্যন্ত গড়াল।

তাঁর পরামর্শে বীরবল ও আবুল ফজল প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রাহ্মণকে ফতেহপুর সিক্রীতে নিয়ে আসেন। আবুল ফজল যাচাই করে বাদশাহকে জানালেন যে ব্রাহ্মণ অবশ্যই দোষ করেছেন, কিন্তু আলিমরা দ্বিধাবিভক্ত—একপক্ষ বলছেন, প্রাণদণ্ডই উচিত, অপর পক্ষের মতে জরিমানা। শেখ সদর প্রাণদণ্ডই উচিত মনে করেন এবং সেজন্য বাদশাহের অনুমতি প্রার্থনা করতে লাগলেন । বাদশাহ কোনো পক্ষে নন, দোটানায় ইতস্তত করতে করতে শুধু বললেন— শরীয়তী মামলার দায়িত্ব তোমার উপর।

ব্রাহ্মণ দীর্ঘকাল কয়েদখানায় আটক রইলেন। আকবরের অন্তঃপুরে হিন্দু রানীরাও ছিলেন, তাঁদের যথেষ্ট মান-সম্মান ছিল। নিজেদের ধর্মের প্রতি তাঁদের আসক্তি ছিল। তাঁরাও ব্রাহ্মণের প্রাণরক্ষার জন্য বাদশাহের কাছে সুপারিশ করলেন। শেখের কাছেও সেই সুপারিশ গেল, অথচ তিনি নিজের মতে গোঁ ধরে রইলেন। শেখ পুনরায় বাদশাহকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বাদশাহ সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। শেখ অগ্রপশ্চাৎ কিছু বিবেচনা না করে তৎক্ষণাৎ প্রাণদণ্ডের হুকুম দিলেন।

ব্রাহ্মণের প্রাণদণ্ডের খবর বাদশাহের কাছে পৌছলে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। রাজপ্রাসাদের রানীরা এবং বাইরে আকবরের অনুগত রাজারা বলাবলি শুরু করলেন, ওই কট্টর মোল্লাটাকে হুজুর এমন মাথায় তুলেছেন যে ও বাদশাহের খুশি-অখুশিরও তোয়াক্কা করে না, নিজের দাপট দেখাবার জন্য যখন-তখন হুকুম দিয়ে মানুষকে হত্যা করছে। বাদশাহের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছিল, এবার তা সহ্যের বাইরে চলে গেল। দরবারে বসে ছিলেন। মোল্লা আব্দুল কাদির বদায়ূনীও সেখানে ছিলেন।

তাঁর উপর | বাদশাহের নজর পড়ল। নাম ধরে তাঁকে কাছে ডেকে বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন— “তুমিও শুনেছ, যদি নিরানব্বাই জন প্রাণদণ্ডের পক্ষে মত প্রকাশ করে এবং একজন প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে, তাহলে কি মুক্তীর উচিত নয় শেষ ব্যক্তির কথা মান্য করা?” মোল্লা বদায়ূনী জানালেন— “মহামান্য বাদশাহ যা বললেন, সে-কথাই ঠিক।” আকবর প্রশ্ন করলেন— “শেখের কি এ জ্ঞানটুকুও নেই, সে বেচারি ব্রাহ্মণকে মেরে ফেলল? এটা কি ধরনের ঘটনা?” মোল্লা বদায়ূনী নিজের মোল্লা ভাইকে ফাঁদে পড়তে দিতে রাজি না, বললেন— “হয়তো এর কোনো তাৎপর্য আছে।” আকবর জিজ্ঞাসা করলেন— “তাৎপর্যটা কি?”

—“এই ধর্মবিরোধিতার মূলোৎপাটন করা, লোকের যেন সেই দুঃসাহস না হয়।” বাদশাহ মোল্লার কথাবার্তাকে অভদ্রতা মনে করলেন এবং এটাও বুঝলেন যে মোল্লা সদরের পক্ষপাতিত্ব করছেন। মোল্লা বদায়ূনী তাঁর ইতিহাস-গ্রন্থে লিখেছেন— “লোকজন বাদশাহের দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর গোঁফজোড়া বাঘের গোঁফের মতো খাড়া হয়ে উঠেছিল। পিছন থেকে লোকে (আমায়) নিষেধ করছিল, আমি যেন কিছু না বলি ।

বাদশাহ হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে বলে উঠলেন—“কি সব আজেবাজে বকছো!” মোল্লা বদায়ূনী তসলিম জানিয়ে দ্রুত পিছনে সরে গেলেন । তিনি লিখেছেন— “সেদিন থেকে শাস্ত্রালোচনার সভা থেকে এবং ওই রকম দুঃসাহস থেকে দূরে দূরে থাকতে শুরু করি। মাঝে মাঝে দূর থেকেই কুর্নিশ (দণ্ডবৎ) করি। শেখ আব্দুন নবীর কাজকর্ম দিন দিন কমে আসছিল। তাঁর মনে ক্রমশ আরও ময়লা জমছিল। বাদশাহ্ মনে মনে আরও বিরূপ হয়ে উঠছিলেন।… শেখের হাত থেকে নতুন-পুরাতন ক্ষমতা একে একে চলে যেতে লাগল, দরবারে যাওয়া একদম ছেড়ে দিলেন তিনি।”

শেখ মুবারক তক্কে তক্কে ছিলেন। সেই সময় তিনি কোনো উপলক্ষে বাদশাহকে অভিনন্দন জানাতে আগরা থেকে ফতেহপুর সিক্রী এসেছিলেন। সাক্ষাতের সময় বাদশাহ তাঁকে সমস্ত কথা জানালেন। শেখ মুবারক বললেন—“আপনি স্বয়ং প্রমাণ, নিজের আমলের ইমাম। শরীয়তী কিংবা রাষ্ট্রীয় আদেশ জারি করার জন্য মোল্লাদের প্রয়োজন কি? ওঁদের খ্যাতি ভিত্তিহীন, বিদ্যা-বুদ্ধিও কিছু নেই ওঁদের।”

বাদশাহ অনুযোগ করলেন—“আপনি আমার গুরু, আমি আপনার কাছে পড়াশোনা করেছি। তাহলে এই সব মোল্লাদের বেড়াজাল থেকে আমার মুক্তির ব্যবস্থা করছেন না কেন?” তার ফলে শেখ মুবারক শাসনতন্ত্র (মজহর) রচনা করলেন এবং তাতে সমস্ত বিতর্কিত বিষয়ে বাদশাহকে সর্বোপরি প্রমাণ বলে স্বীকার করে মোল্লাদের সীলমোহর লাগিয়ে নিলেন।

 

শেখ আব্দুন্ নবীর প্রতাপ সূর্য | শেখ আব্দুন্ নবী  | আকবর

 

শেখ আব্দুন্ নবী দরবারে যাতায়াত ত্যাগ করে মসজিদে বসে বসে বাদশাহ ও তাঁর সভাসদদের অধার্মিক ও বিপথগামী বলে দুর্নাম ছড়াতে লাগলেন। মোল্লা সুলতানপুরীর সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল, এখন আবার দু’জনে এক নৌকার সহযাত্রী হলেন, দু’জনের মনের মিল হয়ে গেল। লোকজনের কাছে তাঁরা বলে বেড়াতে লাগলেন— আমাদের উপর জবরদস্তি করে শাসনতন্ত্রে সীলমোহর লাগিয়ে নিয়েছেন ।

আকবর কতদিন তা আর সহ্য করবেন? অবশেষে ৬৮৭ হিজরীতে (১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে) মোল্লা সুলতানপুরী ও আব্দুন্ নবী উভয়কেই জোর করে হজে পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে বললেন – সেখানেই উপাসনা করতে থাকো। বিনা হুকুমে ফিরে আসবে না।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment