সলীমের বিদ্রোহ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “আকবরের অন্তিম জীবন” বিভাগের একটি পাঠ। আকবর তাঁর পুত্রদের খুবই ভালোবাসতেন। তিনি সলীমকে যুবরাজ ও বারোহাজারী মনসব, মুরাদকে দশহাজারী ও দানিয়ালকে সাতহাজারী মনসব দিয়েছিলেন। মুরাদের জীবনলীলা তো আগেই শেষ হয়েছিল, দানিয়াল দাক্ষিণাত্যে ছিলেন।
সলীমের বিদ্রোহ
এ কথাও বলা হয়েছে যে সলীমকে আগরা ও আজমের সুবা প্রদান করে মেওয়াড়ের উপর আক্রমণ করার হুকুম হয়েছিল। রাজা মানসিংহও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আকবর সলীমকে ইচ্ছাপত্র, তুর্কি ঝাণ্ডা, নিদর্শন, নাকাড়া, ফরাশখানা ইত্যাদি যাবতীয় বাদশাহী সামান, নগদ এক লক্ষ আশরফি তথা সওয়ারির জন্য আমির-সহ হাতি প্রদান করেছিলেন দানিয়াল সলীমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁর প্রভাবও কম ছিল না। সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সেনাধিনায়ক রহীম খানখানা তাঁর শ্বশুর ছিলেন। বিজাপুর-সুলতান ইব্রাহিম আদিলশাহ শাহজাদা দানিয়ালের সঙ্গে তাঁর কন্যা বেগম সুলতানের বিবাহের প্রার্থনা জানালেন। আকবরের খুশি হওয়া উচিত, কেননা আহমদনগরের পর এবার বিজাপুরও তাঁর চরণে মাথা নত করতে আগ্রহী হয়েছে।
রানার সঙ্গে সলীমের লড়াই করার কোনো আগ্রহ ছিল না, সেটা খেলা বা তামাশার ব্যাপারও নয়। তার বদলে আজমেরের আশেপাশে শিকার করে বেড়ানো তাঁর বেশি পছন্দ ছিল। তিনি তাঁর লোকজনকে রানার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে রানার মৃত্যুর পর মেওয়াড়পতি অমরসিংহ পিতার মতোই যোগ্য বীর ছিলেন। তিনি মোগল সেনাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন।
সলীম মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার কারণ, পিতা দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছেন, কে জানে কতদিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে সিংহাসনের জন্য! ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, না সব আশা-আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে নিয়ে মুরাদের মতোই চলে যেতে হবে! তিনি জানতেন, আবুল ফজল ও রহীম তাঁকে পছন্দ করেন না।
চাটুকার মোসাহেবরাও তাতে ঘৃতাহুতি দিত। ইতিমধ্যে খবর এল (১৬০০ খ্রিঃ) বাংলায় বিদ্রোহ শুরু হয়েছে, উসমান খাঁ মানসিংহের সেনাকে পরাজিত করেছেন। মানসিংহ সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মানসিংহ যদিও সলীমের শ্যালক ছিলেন, তথাপি আকবরই ছিলেন মানসিংহের ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর থাকার সময় সলীমের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ছিল।
তিনি বাংলা রওনা হলেন তো সলীম মওকা পেলেন নিজের খুশি মতো চলার। তিনি মেওয়াড়ের যুদ্ধ বাদ দিয়ে আগরায় গিয়ে শহরের বাইরে ডেরা গাড়লেন। আকবরের মতো হামিদা বানু (মরিয়ম মাকানী) লাল দুর্গে ছিলেন। দুর্গপাল কিলিচ খাঁ আকবরের নাম-করা সিপাহসালার।
তিনি দুর্গ থেকে বেরিয়ে সলীমকে যথেষ্ট অভ্যর্থনা জানালেন, নজরানা দিলেন, অনেক ভালো ভালো কথাবার্তা বললেন, তার ভাবগতিক দেখে সলীম বুঝলেন, একে দিয়ে তার কোনো উদ্দেশ্য সাধন হবে না। মোসাহেবরা অনেক বোঝাল যে এই পুরনো পাপীটাকে গ্রেপ্তার করা দরকার, কিন্তু সলীম তাদের কথায় কান দিলেন না।
সলীম শিকারে যাওয়ার অজুহাতে যমুনা অতিক্রম করলেন। পিতামহী (মরিয়ম মাকানী) আসল কথা জানতে পারলেন। তিনি পুত্র অপেক্ষাও সলীমকে বেশি স্নেহ করতেন। তিনি তাঁকে ডেকে পাঠালেন, কিন্তু সলীম এলেন না। তখন তিনি স্বয়ং গেলেন। খবর পেলেন, সলীম নৌকোয় চড়ে ইলাহাবাদের দিকে রওনা হয়েছেন।
পিতামহী হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। ইলাহাবাদে উপস্থিত হয়ে সলীম পুরনো আমিরদের সমস্ত জায়গির বাজেয়াপ্ত করে নিলেন। ইলাহাবাদ আসফ খাঁ মীরজাফরের হাতে ছিল। সেটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিলেন। বিহার, অওধ ও পার্শ্ববর্তী সুবাগুলিও হস্তগত করলেন এবং সব জায়গায় নিজের হাকিম নিযুক্ত করলেন। ত্রিশ লাখেরও বেশি কোষাগার-সহ বিহার সুবা তাঁর কোকা (দুগ্ধ-ভ্রাতা) শেখজীবন— সলীম চিন্তীর পুত্রকে প্রদান করে তাঁকে পদবি দিলেন কুতুবুদ্দীন খান ।
মানসিংহ বাংলায় গিয়ে শেরপুর-আতাইয়ে (জেলা মুর্শিদাবাদ) উসমান খাঁ পাঠানকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন। তারপর ১০১৩ হিজরী (১৬০৪-৫ খ্রিঃ) পর্যন্ত মানসিংহ বাংলাতেই থাকেন । আকবর মনের মধ্যে যাবতীয় আশা পোষণ করতেন সলীমকে কেন্দ্র করেই। দানিয়াল আরও বেশি মদ্যপ ও অপদার্থ ছিলেন। সলীমের পুত্র তথা মানসিংহের ভাগিনেয় খুসরোকেও তিনি খুব স্নেহ করতেন, তবে তার মানে এই নয় যে পিতাসহ পুত্রের বদলে পৌত্রকে সিংহাসনে বসাতে চান।
সলীমের বিদ্রোহের খবর পৌঁছে গিয়েছিল আকবরের কাছে। তিনি আগরায় পৌছেই পুত্রকে আসার জন্য বার্তা পাঠালেন। একবার খবর পাওয়া গেল, ত্রিশ হাজার সওয়ার-সহ সলীম আসছেন এবং রাজধানী থেকে তিয়াত্তর মাইল দূরে অবস্থিত ইটাওয়াতে পৌঁছেও গেছেন।
সলীম ইলাহাবাদে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে নিজের নামে টাকা ও আশরফি তৈরি করালেন এবং পিতার মনে জ্বালা ধরানোর জন্য তার নমুনা তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বিখ্যাত চিত্রকর কাজা আব্দুস সামাদের পুত্র মুহম্মদ শরীফ সলীমের বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন, আকবর তাঁকে পাঠালেন সলীমকে বোঝানোর জন্য।
এ কথাও জানাতে বললেন যে বাংলা ও ওড়িশার জায়গির দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। জাহাঙ্গিরের মোসাহেবরা কি তাঁকে চুপচাপ বসে থাকতে দেয় কখনো? তাদের পরামর্শে তিনি ত্রিশ হাজার সওয়ার নিয়ে ইটাওয়ায় এলেন। আকবর বুঝতে পারলেন, এর পিছনে কোনো অভিসন্ধি রয়েছে।
তিনি ফরমান পাঠালেন : যদিও পুত্রকে দেখার আগ্রহ প্রবল, বৃদ্ধ পিতার সতৃষ্ণ নয়নে তার পথ চেয়ে আছেন, তথাপি এত আড়ম্বর দেখা করতে আসা অত্যন্ত কদর্য মনে হচ্ছে। যদি দেখা করতে চাও, তাহলে তা সানন্দে স্বীকার করা হবে।
লোকজনকে জায়গিরে পাঠিয়ে দাও এবং সাধারণভাবে একা চলে এসো, পিতার নিষ্প্রভ চক্ষুকে আলোকিত করো এবং নিরাশ অন্তরে আনন্দ সঞ্চার করো। আর যদি লোকের কুপরামর্শে তোমার মনে কোনো সন্দেহ থাকে যা আমি ভাবতেও পারছিনে— তাহলে কোনো কথা নেই, ইলাহাবাদে ফিরে যাও, মনকে সন্দেহমুক্ত করো। যখন তোমার মনে আর কোনো আশঙ্কা থাকবে না, তখন আমার কাছে এসো।
ফরমান এতই প্রীতিপূর্ণ ছিল যে জাহাঙ্গিরও লজ্জিত হলেন এবং সেখানে থেকেই প্রার্থনা জানালেন যে সেবা ও দর্শন ব্যতীত সেবকের আর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। তার উত্তরে আকবরের যে পত্র পেলেন, তাতে তিনি ইলাহাবাদে ফিরে গেলেন।
বাদশাহ পুত্রকে সমগ্র বাংলা জায়গির দিলেন এবং এ কথাও লিখলেন যে শাসনব্যবস্থার জন্য তিনি তাঁর নিজের লোকজন নিযুক্ত করুন। এই সময় শাসন-ক্ষমতার কেন্দ্র হয়েছিল দুইটি । আকবর জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন, সলীম ভাবী বাদশাহ ছিলেন, সেজন্য বিশ্বস্ত লোকের দশাও হয়েছিল ডামাডোল।
আবুল ফজল তখনও দাক্ষিণাত্যে ছিলেন। আকবর তাঁর অভাব অনুভব করছিলেন, তাঁকে শীঘ্র আসার জন্য লিখলেন। সমস্ত খবরই সলীমের কাছে এসে পৌঁছেছিল। তিনি ভাবলেন, যদি বৃদ্ধ ওয়াজির বাদশাহের কাছে এসে হাজির হন, তাহরে তিনি আবার মন্ত্রণা দিয়ে আকবরকে দিয়ে কি করান বলা যায় না, সেজন্য কিভাবে প্রতারণা করে পথেই আবুল ফজলের প্রাণনাশ করান, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। এমন পরম বন্ধুর মৃত্যুতে আকবর চরম আঘাত পেয়েছিলেন ।
কিন্তু তখনও তো সব শেষ হয়ে যায়নি, ভবিষ্যতের সুখশান্তির কথাও ভাববার ছিল। সলীমের মনের আশঙ্কা দূর করতে চাইছিলেন আকবর। তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসার জন্য চারদিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন সলীমা সুলতান বেগমের (খদিজা জমানী) উপর তাঁর নজর পড়ল। সলীমা বৈরাম খাঁর সাত বছরের বিধবা এবং আকবরের পিসতুতো ভগ্নী ছিলেন, বাদশাহ বৈরাম খাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করে, সলীমার শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁকে বিবাহ করেন। আকবরের পত্নীদের মধ্যে সলীমা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালিনী, চতুর ও মধুরভাষিণী।
সৎ-পুত্র সলীমের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল, সেজন্য আকবর সলীমাকেই নিজের বার্তাবাহক করলেন। পুত্রের জন্য যেসব উপহার পাঠালেন, তার মধ্যে ছিল ‘ফতাহ- লশকর’ নামক প্রসিদ্ধ হাতি, মূল্যবান খিলাত, বহুমূল্য দ্রব্যাদি, ফলমূল-মিষ্টান্ন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার। সলীমা ১৬০২ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে অথবা ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ইলাহাবাদ যান।
সস্ত কথা খুলে বলেন, উঁচু-নিচু তারতম্য বোঝান । সলীম যদি অপরের কথায় কান না দিতেন, তাহলে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতেন না । সলীমার জাদু কাজে লাগল । তিনি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আগরায় উদ্দেশে রওনা হলেন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের আশেপাশে আকবর খবর পেলেন যে সলীম ইটাওয়া ত্যাগ করে অগ্রসর হয়েছেন। সলীমা বেগম আকবরের মাতা মরিয়ম মাকানীকে লিখলেন যে তিনি যেন সলীমকে নিজের আশ্রয়ে গ্রহণ করেন। মরিয়ম মাকানী একদিনের পথ অগ্রসর হয়ে সলীমকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেলেন।
তিনি পিতা-পুত্রের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সলীমের একদিকে ধরলেন মরিয়ম মাকানী, আর একদিকে সলীমা বেগম। পিতার সম্মুখে গিয়ে তিনি তাঁর পায়ে মাথা রাখলেন। আকবর তাকে তুলে বুকে অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকলেন, অশ্রুপাত করলেন, তারপর নিজের মাথার পাগড়ি খুলে পুত্রের মাথায় পরিয়ে দিলেন। পুনরায় সলীমকে যুবরাজ উপাধি দেওয়া হল, বাজনা বাজানো হল, উৎসব পালন করা হল। সেদিন সলীম বারো হাজার আশরফি ও সাত শত সত্তরটি হাতি পিতাকে ভেট দিলেন।
হাতিগুলোর মধ্যে তিন শত চৌষট্টিটি হাতি এত ভালো যে বাদশাহ সেগুলোকে নিজের পিলখানায় জায়গা দিলেন, বাকিগুলো পুত্রকে ফিরিয়ে দিলেন। আকবর যে খুব হাতি ভালোবাসেন, সলীম তা জানতেন। সলীমের কোন কোন হাতি পছন্দ তা জানাতে বললেন পিতা। সলীম তা জানালে বাদশাহ তাঁকে সেগুলো দিয়ে দিলেন ।
প্রতাপের উত্তরাধিকারী রানা অমরসিংহ বাদশাহী এলাকাতেও হামলা শুরু করে দিয়েছিলেন। আকবর সলীমকে মেওয়াড়ের যুদ্ধ প্রেরণ করেন। তিনি যাত্রা করে সিক্রীতে গিয়ে উপস্থিত হন। অর্থ ও কিছু সাজ-সরঞ্জাম পৌছতে বিলম্ব দেখে তিনি ফের বিরূপ হয়ে উঠলেন। পিতার নিকটে অভিযোগ করে বললেন— সমস্ত সেনা ও সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা হোক, তারপর আমি যুদ্ধে যাব, এখন আমি জায়গিরে ফিরে যেতে চাই। আকবর দেখলেন উদ্দেশ্য বানচাল হতে চলেছে, সেজন্য তিনি নিজের ভগ্নীকে পাঠালেন সলীমকে বোঝাতে। কিন্তু সলীম তাঁর কথায় কান দিলেন না । বাধ্য হয়ে পিতাকে অনুমতি দিতে হল। কয়েকজন আমির বললেন, তাঁকে হাতের বাইরে যেতে দেওয়া উচিত নয়, কিন্তু আকবর তাঁদের কথা মানতে সম্মত হলেন না।
শীতকালের ঠাণ্ডা। পরদিন তিনি সলীমকে বহুমূল্য সাদা সমূরী পোশাক পাঠালেন, জানালেন— এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই আমি চাই, তুমি এটা পরো। তার সঙ্গে আরও কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ই নভেম্বর সলীম মথুরার নিকটে যমুনা অতিক্রম করে ইলাহাবাদে পৌঁছলেন এবং পিতার সঙ্গে পুনর্মিলনের ঘটনাকে খুব ধুমধামের সঙ্গে পালন করলেন।
কিন্তু তখনও কান ভারি করার মোসাহেবরা তাঁর সঙ্গে ছিল। এই সময় সলীমের প্রধান বেগম— রাজা মানসিংহের খুল্লতাত ভগ্নী তথা সলীমের জ্যেষ্ঠ পুত্রের মাতা শাহ বেগম— অকস্মাৎ প্রয়াত হলেন সলীম শাহ বেগমকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। শ্বশুরের সঙ্গে পতির মনোমালিন্য ও নিজের পুত্রের পিতার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আশঙ্কা তাঁকে নিদারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে, জীবনটাকেই বোঝা বলে মনে হতে থাকে তাঁর এবং অবশেষে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
জাহাঙ্গির তাঁর তুজুকে লিখেছেন—“তাঁর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা ছিল, সেজন্য তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকদিন আমি শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকি। বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে দুঃসহ মনে হচ্ছিল। আমি চার দিন মুখে অন্ন তুলিনি, জলও পান করিনি।”
আকবর তাঁকে ধৈর্য না হারাতে পত্র লেখেন, সেই সঙ্গে খিলাত ও নিজের মাথার পাগড়িও প্রেরণ করেন। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরুতে বিজাপুরের সুলতান দানিয়ালের সঙ্গে বিবাহের উদ্দেশ্য মীর জালালুদ্দীন হুসেন ও ঐতিহাসিক ফরিশ্তার সঙ্গে নিজের কন্যাকে পাঠিয়ে দেন।
গোদাবরীর তীরে পায়ঠনে বিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই বছরই এপ্রিলের শুরুতে বুরহানপুরে অত্যধিক মদ্যপান-হেতু দানিয়ালের মৃত্যু হয়। সুরাসক্ত হওয়ার কারণে উভয় পুত্রের জন্য আকবরের মনে ভীষণ অসন্তোষ ছিল। এখন তাঁর অবশিষ্ট রইল একমাত্র শেখুজী— আকবর সলীমকে আদর করে শেখুজী বলে ডাকতেন ।
তাঁকেও মদ ও আফিমের বদভ্যাসে পেরে বসেছিল। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে কোনো এক ওয়াকিয়ানওয়িসের (ঘটনা-লেখকের) দুষ্কর্মে সলীম এত ক্ষুব্ধ হন যে জীবিতাবস্থায় তার শরীরের খাল খুলে নেওয়া হয়। সেই সংবাদ যখন আকবরের কানে এসে পৌছায়, তখন তাঁর বুকে বড় ধাক্কা লাগে।
বলে ওঠেন— “শেখুজী, আমি তো ছাগলেরও ছাল ছাড়ানো দেখতে পারিনে, আর তুমি এত নিষ্ঠুরতা কোথায় শিখলে?” আকবর দেখলেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও তাঁর অনুজ ভ্রাতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। তখন তিনি ভাবলেন, স্বয়ং গিয়ে পুত্রকে বুঝিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। তদনুসারে ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মকালে ইলাহাবাদ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আগস্টে যমুনা অতিক্রম করে ছয় মাইল দূরে সেনা সমবেত করলেন।
নিজে নৌকোয় আরোহণ করে রওনা দিলেন, কিন্তু নৌকো আটকে গেল। এমন প্রবল ধারায় বর্ষাও নামল যে বাদশাহী শামিয়ানা বাদে সমস্ত তাঁবু বন্যায় তালগোল পাকিয়ে গেল। সলীমের পিতামহীর আশঙ্কা হল, পিতা-পুত্রের মধ্যে মিল নেই, রক্তারক্তি না যুদ্ধ বেধে যায়। তিনি পুত্রকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু সফল হলেন না।
তাতে বৃদ্ধার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ল। খবর পেয়েই আকবর ফিরে গিয়ে মায়ের খাটের কাছে গিয়ে বসলেন। মায়ের বাক্শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চার দিন পরে ২৯শে আগস্ট বানু প্রাণত্যাগ করলেন। আকবর তাঁর মাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। শোকে মস্তক-মুণ্ডন করালেন, তাঁর সঙ্গে অন্যান্য চোদ্দ শত লোকও সেইরূপ নিজেদের মস্তক-মুণ্ডন করান।
পুত্র তাঁর মাতার শবাধার কিছুদূর পর্যন্ত কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যান। আমিরেরাও কাঁধে নেন। তারপর তাঁকে তাঁর পতির (হুমায়ূনের) সঙ্গে সমাধিস্থ করার জন্য দিল্লী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হামিদা বানু তাঁর গৃহের ধনসম্পদের ব্যাপারে বলেছিলেন যে সেসব যেন তাঁর সমস্ত পুরুষ সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়।
কথিত আছে, আকবর তাঁর মাতার অভিপ্রায়ের কোনো মূল্য না দিয়ে সমস্ত রাজকোষের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সলীমের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। তিনি অক্টোবরে ইলাহাবাদ থেকে যাত্রা করে ৯ই নভেম্বর নিজের লোকজনকে শহর থেকে দূরে রেখে নিজে রাজধানীকে এসে উপস্থিত হন। সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র পারভেজও (বয়স চোদ্দ বছর) ছিলেন।
সলীম তাঁর পিতাকে উপহার দেওয়ার জন্য দুই শত আশরফি-সহ এক লক্ষ টাকার মালা ও চার শত হাতি নিয়ে এসেছিলেন। আকবরের সামনে সিজদা করলেন তিনি। পিতা তাঁকে ধরে অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন। পুত্রের গালে কয়েকটা চপেটাঘাত করলেন, অনেক ভালোমন্দ কথাও শোনালেন। তারপর তাঁর মদ-আফিমের নেশায় শঙ্কিত হয়ে নিকটস্থ স্নানাগারে আটকে রাখার হুকুম দিলেন ।
তাঁর জন্য চিকিৎসক রাজা সালিবাহন, দুই জন কর্মচারী রূপ খওয়াস ও অর্জুন হাজামকে নিযুক্ত করলেন। চিকিৎসক মদ-আফিমের নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। সলীমের কুমন্ত্রণাদাতাদের ধরে এনে জেলখানায় ভরে দেওয়া হল। কাঁগড়ার নিকটস্থ মউ (নূরপুর)-এর রাজা বাসু সময়মতো খবর পেয়েই সেখান থেকে চম্পট দেন। সলীমকে চব্বিশ ঘণ্টা আফিম দেওয়া হয়নি।
তাঁর খারাপ অবস্থা দেখে পিতা গিয়ে নিজের হাতে তাঁকে আফিম দিলেন। বেগমদের অনেক অনুরোধ-উপরোধে আকবর তাঁকে ভৃত্য-কর্মচারী সহ একটি উপযুক্ত মহলে রাখার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সলীম তখন সম্পূর্ণরূপে পিতার কথা মেনে চলতে সম্মত হন। আকবর তাঁকে দানিয়ালের সুবা প্রদান করলেন এবং সলীম আগরাতেই থাকতে শুরু করলেন।
ইতিমধ্যে সলীম ও তাঁর পুত্র খুসরোর মতবিরোধ বৃদ্ধির এক ঘটনা ঘটল । একদিন হাতির লড়াইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শৈশব থেকেই আকবরের খুব শখ ছিল তাতে। সলীমের একটা প্রকাণ্ড হাতি ছিল, তার নাম গিরাবার (বহুমূল্য)। লড়াইয়ে অন্য কোনো হাতি তার সঙ্গে টক্কর দিতে পারত না।
সলীমের পুত্র খুসরোরও এক জবরদস্ত হাতি ছিল, তার নাম অপরূপ। দু’টিকে লড়ানোর কথা ঠিক হয়। বাদশাহী হাতি রনথমনও তাদের পাল্লা দিতে সমকক্ষ ছিল। ঠিক হল, দু’টি হাতির মধ্যে যে পিছু হঠতে থাকবে, তাকে সাহায্য করার জন্য রনথমনকে নিয়ে যাওয়া হবে ।
বাদশাহ ও শাহজাদারা ঝরোকার আড়ালে বসে তামাশা দেখছিলেন। অনুমতি নিয়ে জাহাঙ্গির ও খুসরো ঘোড়ায় চড়ে মাঠে গেলেন। গিরাবার ও অপরূপ দুইটি পাহাড় পরস্পরের সঙ্গে লড়াই শুরু করল। খুসরোর হাতি পালিয়ে যাচ্ছিল, জাহাঙ্গিরের হাতি তার পিছু তাড়া করল । পূর্বনির্ধারিত কথা অনুযায়ী মাহুত রনথমনকে নিয়ে অপরূপকে সাহায্য করার জন্য অগ্রসর হল। জাহাঙ্গিরের কর্মচারীদের ইচ্ছে ছিল না যে গিরাবার হেরে যাক। তারা রনথমনকে আটকাতে চাইল।
মাহুত নিবৃত্ত হল না। জাহাঙ্গিরের লোকেরা পাথর ও বর্শা দিয়ে আক্রমণ চালালো। একটা পাথর এসে বাদশাহী মাহুতের মাথায় লাগল, রক্ত ঝরছিল। খুসরো পিতামহের নিকটে গিয়ে তাঁর পিতার লোকজনের বাড়াবাড়ি এবং শাহী মাহুতের আহত হওয়ার কথা বললেন। আকবরের ভীষণ রাগ হল, কিন্তু নিজেকে দমন করলেন তিনি।
জাহাঙ্গিরের পুত্র খুররম— পরবর্তীকালে বাদশাহ শাহজাহান পিতামহের নিকটেই থাকতেন, আকবর তাঁকে বললেন— “যাও, তোমার শাহ-ভাইকে বলো যে শাহ বাবা বলছেন : দু’টো হাতিই তোমার, দু’জন মাহুতই তোমার। জানোয়ারের পক্ষ নিয়ে আমাদের আদব-কায়দা ভুলে যাওয়া— এটা কেমন কথা!”
সে-সময় খুমের উপর আশা করা হচ্ছিল যে জাহাঙ্গিরের পর তিনিই গদিতে বসবেন। তিনি পিতাকে গিয়ে আকবরের কথা জানালেন। তিনি ফিরে এসে পিতামহকে বললেন যে শাহ-ভাই বলছেন, “হজরতের মঙ্গল আমার মাথার কসম। এমন একটা বাজে ব্যাপার ঘটতে পারে, সেবকের তা মাথাতেই ছিল না। ভাবতে পারছিনে যে চাকর-বাকরেরা এমন বেয়াদবি করতে পারে।”

আকবর আর কি চান? খুসরোকে (জন্ম: ১৫৮৭ খ্রিঃ) আকবর মাঝে মধ্যে অবশ্যই বলতেন যে তিনি তাঁর পিতা অপেক্ষা বেশি বুদ্ধিমান, কিন্তু আকবর নিজের পুত্রকে বঞ্চিত করে পৌত্রকে সিংহাসনে বসাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। খুসরোর তেমন কোনো অসাধারণ গুণও ছিল না ।
তাঁর অবশ্যই একটা অহংকার ছিল যে তিনি বাদশাহের সবচেয়ে বড় পৌত্র, তাঁর মাতুল দরবারের সবচেয়ে বড় আমির— সাম্রাজ্যের সেনাধিপতি রাজা মানসিংহ। কিন্তু ভাগ্যদেবতা হাসছিল, কেননা তার আশীর্বাদ ছিল খুসরোর ছোট ভ্রাতা খুররমের উপর। খুমও যোধপুরের রাজা মালদেবের পৌত্রীর পুত্র ছিলেন ।
আরও দেখুনঃ