Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ] GDCN

সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী

সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী | হেমচন্দ্ৰ হেমু | আকবর

সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “হেমচন্দ্ৰ হেমু” বিভাগের একটি পাঠ। দাস বংশ, খিলজী বংশ ও তুগলক বংশ— এই তিন তুর্কি বংশ দিল্লীর সিংহাসনে বসে ভারত শাসন করে গেছেন। এই তিন বংশই বিদেশী। ভারতীয়তার রঙের ছোঁওয়া যাতে শরীরে না লাগে, সর্বতোভাবে তার প্রচেষ্টা ছিল তাঁদের। প্রজাদের শোষণ- উৎপীড়নের দ্বারা যে সম্পদ সংগৃহীত হতো, তা সবই বিদেশাগত তুর্কি শাসকদের নিমিত্তই।

সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী

 

 

কিছু উচ্ছিষ্ট ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যে জুটত, আর তা থেকে উদ্বৃত্ত এক- আধটু পেত হিন্দু কেষ্টবিষ্টুরা। শুধু আর্থিক ব্যাপারেই নয়, সাংস্কৃতিক ব্যাপারেও তুর্কি বংশ ভারত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চাইতেন। যদি এ ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ সফল না হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা নিজেদের দোষে।

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী তুর্কিদের রাজধানী হয়। তার দুইশত বছর পরে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার এক তুর্কি— তৈমূরলঙ— তুর্কি বংশের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ান। সেই বেদম প্রহারে তুর্কি শাসনব্যবস্থা টলমল করে ওঠে এবং মুসলিম সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় দক্ষিণে একটি বড় অংশ জুড়ে বাহমনী সুলতানি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় গুজরাতে পৃথক গুজরাতী মুসলিম সুলতানি রাজ্য, বাংলাতেও মুসলিম সুলতানি রাজ গড়ে ওঠে। 

সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল জৌনপুরের সুলতানি রাজ্য যেটাকে বলা হতে শর্কী (পূর্বদিকস্থ) সুলতানাৎ। দিল্লীর বিদ্রোহী হয়ে যেসব সুলতান নিজেদের স্বত অস্তিত্ব জাহির করেছিলেন, তাঁরা ভারতের মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ ছিলেন। বস্তুত সেই শক্তিতে নির্ভর করেই তাঁরা দিল্লীর সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে সাহসী হ কেননা বড় বড় মোল্লা, শাসনকর্তা ও সেনাপতি সকলেই ছিল দিল্লীর সমর্থক ।

আশ্চর্যের বিষয়, হিন্দু রাজ্য নয়, বরং এই মুসলিম সুলতানি রাজ্যগুলিই আমাদের প্রাদেশিক সাহিত্য নির্মাণে সর্বাগ্রে উদ্যোগী হয়। ইসলাম প্রভাবিত হিন্দী অর্থাৎ উর্দু সাহিত্যের সূত্রপাত বাহমনীদের আমলেই। বাংলাতেও একই ঘটনা। জৌনপুরের শর্কী সুলতানাৎ আমাদের কুতুবন, মঞ্জুন, জায়সীর মতো রত্ন উপহার দেয়।

জৌনপুর আমাদের দেশের মৃত্তিকার অনেক গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে, একশত বছরেরও বেশি সময়, অধুনা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রাজধানী হয়ে থেকেছে জৌনপুর। তার মহত্ত্ব ও গুরুত্বের কথা আজ খুব কম লোকই জানে। এই জৌনপুরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী। তাঁর মৃত্যু হয় ১৫০৫-৬ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ৯১১ সনে)। জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাঁর জন্ম। তাঁর যৌবনকালে দেশের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। চারদিকে অশান্তির কালো ছায়া। জৌনপুর বিধর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করে ধর্ম- বিরোধিতার দিকে আরও এক পা বেশি অগ্রসর হয়। 

 

 

হিন্দু-মুসলিম শাসক কিংবা ধর্মাচার্য তা পছন্দ করত না। চাল-ডালের মতো তাদের মেশামেশি, তার সমর্থকও খুব একটা বেশি ছিল না, তা সত্ত্বেও কেউ তার সেরকম বিরুদ্ধাচরণ করেনি। শেরশাহ জৌনপুরে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য দেখেছিলেন, সেখানেই তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছিল। সেই শেরশাহ প্রায় প্রতিটি বিষয়ে আকবরের পথ-প্রদর্শক হন ।

জৌনপুরের অপেক্ষাকৃত উদার বাতাবরণ এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দুর্ব্যবস্থা সৈয়দ মুহম্মদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামের আগে ইরানে সাম্যবাদের তরঙ্গোচ্ছ্বাস প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে সেন্ট মানী ধর্মীয় সংস্কার ও সমন্বয়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সাম্যের মতাদর্শ নিয়ে চলছিলেন, সেজন্য তাঁকে দেশের বাইরে প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াতে হয়। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেন্ট মানীর পতাকাই সম্মুখে ধারণ করে মজুদক এগিয়ে আসনে, ফলে আরও একবার ইরানে আর্থিক সাম্যবাদ সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সাসানী বংশের সম্রাট কওয়াদ স্বয়ং তার প্রভাবে প্রভাবিত হন, ফলে তাঁকে সিংহাসনও হারাতে হয়।

 অবশেষে তিনি এবং তাঁর পুত্র নওশেরওয়াই মজ্দকের মধুর স্বপ্ন ধূলিসাৎ করার কারণ হয়ে দাঁড়ান । এর একশত বৎসর পরে ইরান ইসলামের পতাকা-তলে আসতে থাকে। সপ্তম শতাব্দী শেষ হতে না-হতেই ইরান একটি ইসলামিক দেশে পরিণত হয়। সেখানে জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের প্রভাব খুব অল্পই অবশিষ্ট থেকে গিয়েছিল।

কিন্তু মজ্‌দক ও তাঁর লক্ষ লক্ষ শিষ্যের আত্মত্যাগ বিফল হয়নি। ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনকারে, দূর থেকে সেই মনোরম সুবর্ণ যুগ, তার চেয়েও অধিক শুভবার্তার প্রতিধ্বনি মননশীল ব্যক্তিদের কানে এসে পৌছল। মজদকী পথ তখন জিন্দিক নামে পরিচিত হতে থাকে । জিন্দিক বাইরে থেকে দেখতে অন্যান্য মুসলমানদের মতোই, কিন্তু তাদের অন্তরে সাম্যবাদের চিন্তা কাজ করছিল, আর সেজন্যই ইসলামের অন্যান্য শাখাগুলির তুলনায় জিন্দিকদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা কম দেখা যায় ।

সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরীর মতো বিদ্বান ব্যক্তির নিকট জিন্দিক অপরিচিত থাকার কথা নয়। শাসক ও শোষকদের পক্ষে বিপজ্জনক চিন্তা-ভাবনা সেকালে ধর্মের পাকাপোক্ত ঘেরাটোপেই লালিত-পালিত হতো। সৈয়দ মুহম্মদও সেই ধর্মের আড়াল অবলম্বন করলেন। কবীর তাঁর সমকালীন ছিলেন। তিনি নিজেকে পয়গম্বর থেকে কোনো অংশে কম বলে দাবি করেন নি, কিন্তু তিনি নিজের জন্য ইসলামের পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারে বিরত ছিলেন।

নিজের মতবাদের প্রতি মুসলমানদেরও নিশ্চয়ই আকর্ষণ করার চেষ্টা ছিল, কিন্তু তিনি সফলতা লাভ করেন হিন্দুদের মধ্যেই। কবীরের ভাষা ও পদ্ধতি সম্পর্কে অপরিচিত মোল্লারা তাঁর দিকে আঙুল ওঠাতে সক্ষম হননি। কবীর আর্থিক সাম্যবাদের বিষয়টাও এড়িয়ে গেছেন। মুহম্মদ জৌনপুরী সম্ভবত আত্মসমাহিত হওয়ার সময় শুনেছিলেন—অন্ত্-ল্-মেহ্দী (তুমিই মেহ্দী)। মেহ্দী’ শব্দের অর্থ শিক্ষক অর্থাৎ অন্তিম শিক্ষক।

ইসলামে হজরত মুহম্মদের পরে যে পয়গম্বরের আবির্ভূত হওয়ার কথা, সেই সর্বশেষ পয়গম্বরকে মেহ্দী বলা হয়। মুসলমানদের মধ্যে মেদীর স্থান অনেকটা হিন্দুদের কল্কি অবতারের মতো। মোল্লাদের কাছে ছিল সেটা অত্যন্ত তিক্ত গলাধঃকরণ। সৌভাগ্যবশত সৈয়দ মুহম্মদের জন্ম দিল্লীতে না হয়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল জৌনপুরে, সেখানে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ ছিল ।

মেহ্দীর প্রচারের ভঙ্গি ও কথাবার্তা এমন ছিল যে, লোকেরা তাঁর দিকে সহজেই আকৃষ্ট হতে শুরু করল। অনুগামীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি হতে দেখে ইসলামের ধ্বজাধারীরা কিভাবে চুপচাপ বসে থাকতে পারে? জৌনপুরে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল । সেখান থেকে তিনি গুজরাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

জৌনপুরের মতোই দিল্লীর শাসনের বিদ্রোহী হয়ে গুজরাতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি সুলতানি রাজ্য । সেখানে মেহ্দীর উপদেশের প্রভাব কেবল মুসলিম জনসাধারণের মধ্যেই পড়েনি, এমন কি, আবুল ফজলের বর্ণনা অনুসারে, সুলতান মাহমুদ স্বয়ং তাঁর উপদেশ-বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর অনুরক্ত হন। সেখানেও তিনি খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারলেন না। 

 

 

অবশেষে সেখান থেকে আরব গেলেন। মক্কা মদীনা দর্শন করলেন । ঘুরতে ঘুরতে ইরানে এলেন। সেখানেও তাঁর পাশে ভক্তের ভিড় জমে উঠতে লাগল । শাহ ইসমাইল ইরানের জাতীয়তাবোধকে উদ্দীপিত করার জন্য এবং তার দ্বারা নিজের রাজবংশকে সুদৃঢ় করার জন্য শিয়া ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। শিয়া ধর্ম কট্টর ইসলামের বহু বিষয় বর্জন করেছে। মেহ্দী জৌনপুরী সেখানে আরও একটি শাখা রোপণ করতে চান । সেটা শাহ ইসমাইলের পছন্দ ছিল না, সেজন্য তিনি কড়াকড়ি শুরু করলেন। ফলে সৈয়দ ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ইরানের মজ্দকের অনুগামীরা জিন্দিক’ নামে কখনও সেখানে বসবাস করত। 

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version