হুসেন খাঁ টুকড়িয়ার পূর্ব-পাদপীঠ, আমাদের দেশে সর্বত্র মানুষের হাতে ভাঙা প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। একথা সকলেরই জানা আছে যে মুসলমানরা সেগুলো ভেঙেছিল— ইসলাম ধর্মে মূর্তি ভাঙা সওয়াবের (পুণ্যের) কাজ বলে গণ্য হয়, সেজন্য প্রত্যেক গাজী বিধর্মিতার এই পাপচিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করে। তারা এটুকু ভেবে দেখে না যে ওই মূর্তিগুলো নিরাকার আল্লা ও ভগবানের চেয়েও বেশি মূল্যবান। সে-সবের অনেকগুলিই উৎকৃষ্ট শিল্পকলার নিদর্শন, তাদের সৌন্দর্য দেখে মানুষ অভিভূত হয়। কিন্তু তা বোঝার জন্য মানুষের বেশি সংস্কৃতিসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন ।
হুসেন খাঁ টুকড়িয়ার পূর্ব-পাদপীঠ | হুসেন খাঁ টুকড়িয়া | আকবর
বর্বর একেশ্বরবাদী ওসব কি বুঝত খ্রিস্টধর্মও মূর্তির বিরুদ্ধে ছিল। ইসলাম ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মই মূর্তির সঙ্গে শত্রুতা শিখেছিল ইহুদিদের কাছ থেকে। এই তিন সেমিটিক ধর্ম মিলে পৃথিবীর কোণে কোণে উত্তম শিল্প নিদর্শন নষ্ট করার মহাপাপ করেছে। পূর্বানুগামী দু’টি ধর্ম এখন মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে, কেননা তারা এখন বেশি সংস্কৃতিবান।
একসময় গ্রীস ও রোমের মূর্তিগুলো যারা সচেতনভাবে ধ্বংস করে আনন্দ অনুভব করত, এখন তারাই সেগুলো সংগ্রহপূর্বক সংরক্ষণ করে এবং তার প্রেরণায় গৌরব বোধ করে। গ্রীসের প্রাচীন মূর্তিগুলো ও সেগুলোর শিল্প-নিরীক্ষকেরা ইউরোপকে নবজাগরণে প্রেরণা জুগিয়েছিল। দূরে যাবেন কেন, আফগানিস্তানেই দেখুন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আমি কাবুলে ছিলাম ।
আফগানরা তখন এবং এখনও শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। অথচ তারা নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। বামিয়ান ও বেগ্রামের বৌদ্ধ মন্দির ও চিত্রসমূহ বিনষ্ট করে একদা পাঠানরা গর্ববোধ করত, আর এখন আমি দেখেছি, তরুণ পাঠান শিল্পী ওই সব মূর্তি ও চিত্র নিয়ে শিল্পপাঠ গ্রহণ করে গর্ববোধ করছে এবং বলছে— আমাদের পূর্বপুরুষেরা এগুলো তৈরি করেছিল। উত্তম শিল্পকলার সঙ্গে শত্রুতা মানবতার সঙ্গে শত্রুতা।
যারা শিল্প ধ্বংস করেছে, তারা নিজেদের বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্রমশই বেশি-বেশি ধিক্কারের পাত্র হয়ে উঠবে। ভারতে অনেক মূর্তি-ধ্বংসকারী এসেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে দু’একজনেরই কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমরা অবহিত— হুসেন খাঁ টুকড়িয়া তাদের অন্যতম। কুমায়ূন- গাড়ওয়ালে আজকাল যেসব ভাঙা-চোরা মূর্তি পাওয়া যায়, সে সব টুকড়িয়ার কাজ টুকড়িয়া মূর্তি ভাঙার জন্য, মন্দিরের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য আলমোড়া থেকে সোমেশ্বর, বৈজনাথ, বাগেশ্বর, দারাহাট—সব জায়গাতেই গিয়েছিলেন।
গাড়ওয়ালে যোশীমঠ, বদরিনাথ, তপোবন, কেদারনাথের বহু মূর্তি ও মন্দিরের ধ্বংস-সাধন করেছিলেন টুকড়িয়া। তাঁর আগে সম্ভবত কতিপয় মুসলমান বিজেতাই এ কাজের জন্য পাহাড়-পর্বত সমাকীর্ণ ভূভাগে অত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল।
এটা নিশ্চিত যে নিজেদের ট্যাকের পয়সা খরচ করে যদি জেহাদীদের মূর্তি ভেঙে পুণ্যার্জন করতে হতো, তাহলে তারা ওইসব দুর্গম অঞ্চলে কখনো যেত না। আসলে সেখানকার অগাধ বৈভবের লোভ তাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ধাতুর মূর্তি গলিয়ে বিক্রি করে দিত, নগদ টাকাকড়ি অলঙ্কারাদি হস্তগত করত, তারপর মন্দিরে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিত। মূর্তিগুলোকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলত । হাতুড়ির প্রথম ঘা পড়ত মূর্তির নাকের উপর।
টুকড়িয়া যত মূর্তি ভেঙেছিলেন, বোধ হয় আর কেউ তত ভাঙেনি। কেদারনাথের পথে ময়খন্ডায় হরগৌরীর অসাধারণ সুন্দর মূর্তির ভগ্নাবস্থা দেখে মন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না। কিভাবে সেই আততায়ীর হাত উঠেছিল এমন সুন্দর শিল্পকর্মের উপর! মুসলমানদের আল্লা, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বর কখনো ছিল না, সে তো একেবারেই মিথ্যা।
শিল্পকর্মের আশ্চর্য নিদর্শনগুলিকে টুকড়িয়া নির্মমভাবে বিনষ্ট করেছেন, অথচ ঈশ্বর নীরবে তা দেখে গেছে, ঈশ্বর না থাকার প্রমাণ এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে! টুকড়িয়া কে ছিলেন, আকবরের একজন সম্মানিত উচ্চ পদাধিকারী, একথা জেনে আরও বিস্মিত হতে হয়। অথচ তার মানে এই নয় যে তাঁর এই মহাপাপের কাজে আকবরের সমর্থন ছিল। বরং এ থেকে বোঝা যায়, আকবরকে কি ধরনের লোকের মাঝখানে থেকে কাজ করতে হতো। মাহমুদ গজনবীর সময় থেকে চলে আসা রীতিনীতি তখনও ছিল তেমনই মজবুত।
টুকড়িয়া একজন আদর্শ মুসলিম ধর্মবীর ছিলেন। হুমায়ূন যখন ভারতের দিকে প্রত্যাবর্তনের সময় আফগানিস্তানে এসে পৌঁছান, সে সময় হুসেন খাঁ নামক একজন আফগান বৈরাম খাঁ খানখানানের ভৃত্য হয়ে হুমায়ূনের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কান্দাহার বিজয়ে তিনি তাঁর বাহাদুরির প্রমাণ দিয়েছিলেন।
তাঁর খ্যাতি বাড়ে। হুমায়ূনের এক পাঠান সর্দার মেহন্দী কাসিম খাঁর কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় । মেহন্দী তাঁর মাতুলও ছিলেন। হুমায়ূনের পর আকবর সিংহাসনে বসেন। তখনও পাঞ্জাবের দিকে সিকান্দার শূরের সঙ্গে মোগলদের লড়াই চলছে। মানকোটের দুর্গে তাঁর সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ হলো। ভাই হাসান খাঁ নিহত হলেন। হুসেন খাঁর বীরত্বের প্রশংসা করেছিলেন আকবর ও সিকান্দার উভয়েই। ৯৬৫ হিজরীতে (১৫৫৭-১৫৫৮ খ্রিঃ) জয়লাভের পর আকবর দিল্লী ফিরলেন। সেই সময় তিনি হুসেন খাঁকে পাঞ্জাবের হাকিম নিয়োগ করেন। মাহমুদ গজনবীর সময় থেকেই লাহৌর মুসলমান শাসনাধীন ছিল।
মালিকদের দেখাদেখি হিন্দুদেরও দাড়ি রাখার শখ হয়। একজন লম্বা দাড়িওয়ালা লোক হাকিমের দরবারে এলেন। সম্মান দেখানোর জন্য হুসেন খাঁ উঠে দাঁড়ালেন, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। পরে জানতে পারলেন, তিনি হিন্দু। হুসেন খাঁ হুকুম দিলেন— এখন থেকে হিন্দুরা প্রত্যেকে কাঁধে একটুকরো রঙিন কাপড় আটকে রাখবে। লাহৌরের সমস্ত হিন্দু নিজের নিজের কাঁধে রঙিন কাপড়ের টুকরো আটকে নেয়। তারাই তাঁর নাম রাখে টুকড়িয়া। ওই নামেই প্রসিদ্ধ হন তিনি।
পরের বছর টুকড়িয়া আগরায় আকবরের নিকটে আসেন। তাকে রনথম্ভোরের যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় তাঁর মনিব বৈরাম খাঁর দিনকাল খারাপ যাচ্ছিল। টুকড়িয়া যুদ্ধ ছেড়ে গওয়ালিয়র হয়ে মালওয়া চলে যেতে চাইছিলেন। খানখানানের আহ্বানে তিনি তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁর হয়ে বরাবর যুদ্ধ চালিয়ে যান।
কিন্তু থানখানানের শত্রুদের পিছনে ছিল আকবরের হাত। কয়েকজন আমিরের সঙ্গে হুসেন যা বন্দী হলেন। আকবর হুসেন খাঁর বীরত্বের কথা অবগত ছিলেন, সেজন্য প্রথমে তাঁকে তাঁর শ্যালকের অধীনে রাখলেন, পরে পাটিয়ালি এলাকা জায়গির দিয়ে দিলেন। এই সেই পাটিয়ালি, যেখানে ফারসির মহান কবি আমির খুসরো জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৯৭৪ হিজরীতে (১৫৬৬-১৫৬৭ খ্রিঃ) হুসের ধার শ্বশুর তথা মাতুল মেহন্দী কাসিম হজ-যাত্রা করলেন। টুকড়িয়া তাঁকে বিদায় জানাতে সমুদ্রতট পর্যন্ত গেলেন। প্রত্যাবর্তনের সময় দেখলেন, ইব্রাহিম হুসেন মির্জা প্রভৃতি তৈমূর বংশের শাহজাদারা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
তিনিও প্রভুর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলেন। যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটল। ইব্রাহিম বিপক্ষদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমর্পন করতে রাজি করালেন। টুকড়িয়াকেও শাহজাদার নিকটে যেতে অনুরোধ করা হলো, কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না, জানালেন বাদশাহের বিদ্রোহীকে তিনি সালাম জানাতে পারবেন না।
আকবরের কাছে আগেই সে খবর এসে পৌঁছেছিল, তিনি এসে উপস্থিত হলে তাঁকে তিন হাজারীর মর্যাদা দেওয়া হলো এবং শামশাবাদ অঞ্চল জায়গির দেওয়া হলো। ধর্ম তাঁকে অন্ধ করে তুলেছিল, নইলে তাঁর মনে লোভ ছিল না, রাজকীয় ব্যয়ের জন্য অর্থের অভাবও ছিল না। অত বড় জায়গির পাওয়ার পরেও তিনি ব্যয়কুণ্ঠ ছিলেন ।
তিন বছর পর ৯৭৭ হিজরীতে (১৫৬৯-৭০ খ্রিঃ) টুকড়িয়া লখনউয়ের জায়গির পান। সেই সময়েই তাঁর শ্বশুর হজ থেকে ফিরলেন এবং আকবর তাঁকে লখনউয়ের সেই জায়গির দিয়ে দিলেন। হুসেন খাঁ জায়গির ছাড়তে সম্মত ছিলেন না। জায়গিরের জন্য মামা-ভাগিনেয় তথা শ্বশুর-জামাতার মনোমালিন্য দেখা দিল। বাদশাহ তো শ্বশুরকে জায়গির দিয়েই দিয়েছেন। টুকড়িয়া শ্বশুরের উপর ঝাল মেটানোর জন্য নিজের পিতৃব্য কন্যাকে পুনর্বিবাহ করলেন। নতুন বেগমকে পাটিয়ালিতে নিজের কাছে রেখে কাসিম খাঁর কন্যাকে খয়রাবাদে (জেলা সীতাপুর) তাঁর ভ্রাতাদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।
আরও দেখুনঃ