তানসেন নবরত্ন , আকবরের দরবারের নবরত্নের মধ্যে তানসেন অন্যতম। নবরত্ন ছিলেন—১. রাজা বীরবল, ২. রাজা মানসিংহ, ৩. রাজা টোডরমল, ৪. হাকিম হুমাম, ৫. মোল্লা দোপিয়াজা’, ৬. ফৈজী, ৭. আবুল ফজল, ৮. রহীম এবং ৯. তানসেন। ভিনসেন্ট স্মিথের বক্তব্য অনুসারে, ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তানসেন বান্ধবগড়ের (বায়া, রীওয়া) রাজা রামচন্দ্রের রাজসভা থেকে আকবরের নিকটে আসেন ।
তানসেন নবরত্ন | তানসেন | আকবর
চিতৌড় ও রণথম্ভৌরের অজেয় দুর্গ অধিকার করার পর যখন আকবরের নজর গিয়ে পড়ল কালিঞ্জরের উপর, তখন রাজা রামচন্দ্র খুশি মনে তা মজনু খাঁ কাকশালের হাতে অর্পণ করেন। সেই সুখবর ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে আকবরের কাছে পৌঁছায় এবং তিনি খুশি হয়ে রামচন্দ্রকে প্রয়াগের সন্নিকটস্থ একটি বড় জায়গির প্রদান করেন। ভারতীয় সঙ্গীতের মর্মজ্ঞ শ্রী দিলীপ চন্দ্র বেদীর মতে, রামচন্দ্রের রাজসভাতেই তানসেনের বয়স পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। তিনি ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে আকবরের দরবারে উপস্থিত হন।
তার অর্থ, ১৫১২ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তাঁর জন্ম। বেদীজীর কথা অনুযায়ী, আকবরের মৃত্যুর (১৬০৫ খ্রিঃ) পরে তানসেন গওয়ালিয়র চলে যান এবং সেখানে তাঁকে রাজা মানসিংহের সঙ্গীত-বিদ্যালয়ে প্রধান সঙ্গীতাচার্য পদে নিযুক্ত করা হয়। তার মানে দাঁড়ায়, ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় নব্বই বছর বয়সে তানসেন গওয়ালিয়রে গিয়ে সঙ্গীতের অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেই হিসাবে একশত বছরের কিছু বেশি কাল জীবিত ছিলেন। অথব ভিনসেন্ট স্মিথ তানসেনের যে সমকালীন চিত্র তাঁর গ্রন্থে (৪২২ পৃষ্ঠার সম্মুখ ভাগে, দ্বিতীয় সংস্করণ) সন্নিবেশ করেছেন, তাতে তাঁকে একেবারে নবযুবক বলে মনে হয়।
একথাও স্মরণযোগ্য যে, গওয়ালিয়রের মানসিংহ আকবরের পূর্বেই ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন। দিল্লীর সুলতানি দুর্বল হয়ে পড়ার পর যে জৌনপুর, বাংলা, বাহমনী, গুজরাত প্রভৃতি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলোর মধ্যে গওয়ালিয়রও একটি। হিন্দু সাহিত্য, সঙ্গীত ও মোল্লা দোপিয়াজা— আকবরের নবরত্নের মধ্যে তাঁকে গণ্য করা হয়। আরবে জন্ম। হুমায়ূনের একজন সেনাপতির সঙ্গে ভারতে আসেন এবং তাঁর মনোরঞ্জক কথাবার্তার জন্য আকবরের অত্যন্ত প্রিয় বিদূষক হয়ে ওঠেন। আকবরের সমকালীন নবরত্নের চিত্র সম্ভারের মধ্যে তাঁর বহু চিত্র পাওয়া যায় ।
অথচ তাঁর আসল নাম কি ছিল, তা জানা যায় না। —রা.সা. শিল্পকলার কেন্দ্র হয়ে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। সেখান বড় বড় কবি ও সঙ্গীতকার ছিলেন, সেই কারণে বল্লভ সম্প্রদায়ের অষ্টছাপের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার পূর্বে ব্রজভাষাকে গওয়ালিয়রী ভাষা বলা হতো। আকবর ১৫৫৮ থেকে ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই গওয়ালিয়র ও জৌনপুর অধিকার করেন, তখন শাসনক্ষমতার রাস ছিল বৈরাম খাঁর হাতে।
ভিনসেন্ট স্মিথ তানসেনকে গওয়ালিয়রের মানুষ বলেছেন। গওয়ালিয়রে জন্ম, না গুরু-আশ্রম গওয়ালিয়রে, কি কারণে তাঁকে গওয়ালিয়রের মানুষ বলা হয়েছে? এটা তো নিশ্চিত যে ১৫৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যখন গওয়ালিয়রের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল, তখন উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ কলাকেন্দ্র ছিল গওয়ালিয়র।
সেখানে দূর দূর থেকে মানুষ আসত সঙ্গীত শিখতে। বেদীজী তানসেনের জন্মস্থান ইত্যাদি বিষয়ে জানিয়েছেন : পরম্পরা সূত্রে তানসেনজীর ব্রহ্মভাট পূর্বপুরুষ লাহৌর ত্যাগ করে দিল্লীতে এসে বসবাস করতে থাকেন। তানসেনের জন্ম দিল্লীতে। তাঁর পিতার নাম মকরন্দ ভাট।
রাজ-দরবারে কবিতা শোনানো ছিল তাঁর জীবিকা। তানসেনজীর জ্যেষ্ঠতাত রামদাস, নাদব্রহ্মযোগী স্বামী হরিদাসজীর উপযুক্ত শিষ্য ছিলেন। যে দিনগুলি তিনি গওয়ালিয়রে অতিবাহিত করেন, সেই সময়েই বালক তন্-সুখের প্রাথমিক সঙ্গীত-শিক্ষা হয়। গওয়ালিয়র নিবাসী পীর মহম্মদ গওস সাহেব—যাঁর পূর্ব নাম ছিল অমরদাসজী— রামদাসজীর পরম বন্ধু ছিলেন।
তাঁর আগ্রহে রামদাসজী তন্মুখকে তাঁর পূজনীয় গুরু স্বামী হরিদাসজীর আশ্রমে প্রেরণ করেন, সেখানে তমুখ বছরের পর বছর সঙ্গীত- সাধনার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য অধ্যয়নও করেন। স্বামী হরিদাসজীর শিষ্য তানসেন কেবল সঙ্গীতাচার্য ছিলেন না, সাহিত্যিকও ছিলেন। আর সেজন্যই তিনি উচ্চশ্রেণীর কবিও হতে পেরেছিলেন।
পণ্ডিত হরিহর নিবাস দ্বিবেদী তাঁর “মধ্যদেশীয় ভাষা” গ্রন্থে (পৃঃ ৫৮) তানসেন সম্পর্কে লিখেছেন : “আকবরের আমলে কোনো গায়ক সঙ্গীতশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বিষয়ে রাজা মান-এর সময়ে গায়কদের সাহায্য পাননি।… সম্রাট আকবরের সময় বহু দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন যাঁদের গায়ন-রীতিতে ব্যবহারিক জ্ঞান ছিল, পরন্তু সঙ্গীতশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বিষয়ে অপরিচিত ছিলেন।
মিয়া তানসেন, সুভান খাঁ ফতেপুরী, দুই ভ্রাতা চাঁদ খাঁ ও সুরজ খাঁ, মিয়া চাঁদ (তানসেনের শিষ্য), তানতরঙ্গ খা তথা বিলাস খাঁ (তানসেনের পুত্র), রামদাস মুণ্ডিয়া ডাটী, মদন খাঁ, মোল্লা ইসহাক খাঁ ডাটী, খিজির খাঁ, তাঁর ভ্রাতা নবাব খাঁ, হাসান তত্ত্বনী— এঁরা সকলেই কুশলী গায়কশ্রেণীর মধ্যে পড়েন। বাজবাহাদুর (মালওয়ার নবাব), নায়ক চর্চ, নায়ক ভগবান, সুরতসেন (তানসেনের পুত্র) লাল ও দেবী (দুই ব্রাহ্মণ ভ্রাতা), বাদ খাঁর পুত্র আকিল খা—এঁরা কোনো-না- কোনো মাত্রায় সঙ্গীতের সিদ্ধান্ত বিষয়ে পরিচিত ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাঁরা নায়ক বৈজু, নায়ক পাণ্ডে তথা নায়ক বন্ধুর মতো সঙ্গীতের আচার্য ছিলেন না।
ফকিরুল্লা নায়ক বৈজুকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়ক গোপালের সমকক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। বর খ্যাতিও অদ্বিতীয়। বখ্শু মানসিংহের পরেও গওয়ালিয়রে থেকেছেন। পানিপথে মানসিংহের পুত্র বিক্রমাজিতের মৃত্যুর (১৫২৬ খ্রিঃ) পরে তিনি কালিঞ্জরের রাজা কীরাতের আশ্রয়ে চলে যান। কালিঞ্জর থেকে গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ্ (১৫২৬-৩৬ খ্রিঃ) তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন।”। এরপর দ্বিবেদীজী তানসেন সম্পর্কে লিখেছেন
“তানসেন মকরন্দ পাণ্ডের পুত্র। তাঁর জন্ম হয়েছিল গওয়ালিয়রের নিকটস্থ বেহট নামক গ্রামে। তাঁর পূর্ব নাম ছিল ত্রিলোচন পাণ্ডে। তিনি স্বামী হরিদাসের নিকট কাব্যতত্ত্ব শিক্ষা করেন, সেইসঙ্গে সঙ্গীতেরও শিক্ষালাভ করেন। কিছুকাল মহম্মদ গওসের কাছেও গায়ন বিদ্যা অনুশীলন করেন, যার ফলে তিনি ত্রিলোচন থেকে তানসেন হন এবং তাঁর উপর ইরানী সঙ্গীতের চটুলতারও প্রভাব পড়ে। সেখান থেকে তিনি শেরশাহের পুত্র দৌলত খাঁর নিকট চলে যান।
তারপর তিনি রীওয়ার নরপতি রাজা রামচন্দ্র বাঘেলার রাজসভায় যোগ দেন। তাঁর সঙ্গীতের খ্যাতি সম্রাট আকবরের কাছে পৌঁছায়। আকবর রামচন্দ্রের উপর এমন চাপ সৃষ্টি করেন যাতে তিনি তানসেনকে আকবরের সভায় প্রেরণ করতে বাধ্য হন। এভাবে সন ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে গওয়ালিয়রের এই মহান কালোয়াত তৎকালীন জগতের মহান রাজসভার নবরত্নমালার মণি হয়ে ওঠেন।”
সম্ভবত তানসেনের জন্মস্থান ব্যাপারে দ্বিবেদীজীর বক্তব্যই বেশি সঠিক। তানসেন বালগন্ধর্ব ছিলেন। তাঁর চিত্র দেখেও সেটা মালুম হয়। সঙ্গীতকলা ও শাস্ত্রে পারঙ্গম হয়ে উঠতে বোধ হয় তাঁর বেশি বছর সময় লাগেনি। দ্বিবেদীজীরও ইঙ্গিত সেদিকেই, এবং ভিনসেন্ট স্মিথও লিখেছেন (পৃঃ ৫০) যে তানসেন শূরী বাদশাহ মহম্মদ শাহ্ আদিলের (আলীর) কাছে সঙ্গীত শিক্ষা পান, যাঁর কাছ থেকে মালওয়ার সুলতান বাজবাহাদুরও সঙ্গীত শিক্ষালাভ করেছিলেন।
শেরশাহের উত্তরাধিকারী ইসলামশাহ্ শূরী বংশের অন্তিম প্রতাপশালী বাদশাহ্ ছিলেন। তারপর সিংহাসনের জন্য সহোদর ও খুল্লতাত ভ্রাতাদের মধ্যে রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয়। ইসলামশাহের বারো বছর বয়স্ক পুত্র ফিরোজ খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তাঁর মাতুল মুবারক শাহ ইসলামশাহের খুল্লতাত ভ্রাতা ও শ্যালক উভয়ই। ইসলামশাহ্ তাঁর স্ত্রী বিবিবাঈকে বলতেন— “যদি পুত্রের প্রাণ তোমার কাছে প্রিয় হয়, তাহলে ভ্রাতার মস্তকে হাত তোলো, আর যদি ভ্রাতা প্রিয় হয়, তাহলে পুত্রের মায়া ত্যাগ করো।” নির্বোধ মহিলা প্রত্যেকবার একই উত্তর দিতেন— “আমার ভাই আমোদ-প্রমোদে মজে থাকা মানুষ, এসব ব্যাপারে তাঁর আদৌ ভ্রূক্ষেপ নেই।”
কিন্তু যা আশঙ্কা ছিল, তাই ঘটল। ভাগিনেয় সিংহাসনে আরোহণের তৃতীয় দিনে মুবারকশাহ্ উন্মুক্ত তরবারি হাতে গৃহে প্রবেশ করলেন। ভগ্নী জোড়হাত করে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন— “ভাই, বিধবার সন্তান— আমি ওকে নিয়ে এমন জায়গায় পালিয়ে যাব, যেখানে ওর নাম কেউ মুখে আনবে না, সে-ও কখনো সুলতানির নাম উচ্চারণ করবে না।” কিন্তু মুবারকশাহ্ কবে কারো কথা কানে তোলার পাত্র ছিলেন? তিনি ভাগিনেয়কে সেখানেই খণ্ড-বিখণ্ড করে স্বয়ং মহম্মদ আদিলশাহ্ নাম নিয়ে (১৫৪৯ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসলেন।
আদিলশাহ্ শেরশাহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিজাম খাঁর পুত্র ছিলেন। তিনি চাইতেন লোকের কাছে আদিল কিংবা আদলী (ন্যায় প্রিয়) হিসাবে পরিচিত হতে, কিন্তু তাঁর আঁধিসাঁধি কারবারের জন্য লোকে তাঁকে আঁধলি বলত। তিনি সে-আমলের ওয়াজিদ আলী শাহ্ ছিলেন। দিনরাত আমোদ- প্রমোদ, রাগ-রঙ্গ, মদ-মাংসে ডুবে থাকতেন। দু’হাতে রাজকোষের অর্থ ওড়াবার শখ ছিল তাঁর। এক তোলা সোনার ফলকের কুত্তাবাসী নামে এক প্রকার তীর তৈরি করা হতো, সেগুলো তিনি যাতায়াতের সময় এদিক-ওদিক ছুঁড়ে দিতেন। যে কোনো ব্যক্তি তা এনে দিলে তাঁকে দশ টাকা পুরস্কার দিতেন।
অথচ সেই আঁধলি তাঁর সময়কালে মহান সঙ্গীত-বিশারদ ছিলেন। আজাদের মতে, “বড় বড় গায়ক-বাদক তাঁর সামনে মাথা হেঁট করতেন। আকবরের আমলে মিয়া তানসেন এ-বিষয়ে জগদ্গুরু ছিলেন, তিনিও তাঁকে উস্তাদ বলে সম্মান প্রদর্শন করতেন।”
তিনি আরও বলেছেন— “দক্ষিণের একজন বাদ্যকর হিন্দুস্তানে এসেছিলেন । তিনি উস্তাদির নাকাড়ায় কাঠি ছোঁয়ালেন, অমনি চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল । তিনি একটা পাখোয়াজ তৈরি করিয়েছিলেন, তার দুই দিক দু’হাতে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। একদিন তিনি খুব গর্বের সঙ্গে দরবারে এলেন, সঙ্গে সেই পাখোয়াজ, অর্থাৎ কেউ সেটা বাজিয়ে দেখাক। সে সময় যত গায়ক-কালোয়াত দরবারে উপস্থিত ছিলেন, সবাই হতবাক হয়ে বসে রইলেন। আদিল একবার সেটার দিকে তাকালেন, সঙ্গে সঙ্গে রহস্যভেদ হলো।
তিনি একটা বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন, পাখোয়াজটাকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর তার একদিক এক হাতে বাজান, অন্য দিকে পায়ে তাল দিতে থাকেন। দরবারের সবাই একসঙ্গে হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। সেখানে যত গায়ক উপস্থিত ছিলেন, সকলেই স্বীকার করলেন, আদিল ‘ইস্পাতের ফলা’।”
তিনি বলেছেন, আদিলের শৌচাগারে দুর্গন্ধ দূরীকরণ ও সুগন্ধিকরণের জন্য এত কর্পূর ছড়ানো হতো যে ঝাড়ুদার রোজ দু’-তিন সের কর্পূর লোপাট করে দিত। তা সত্ত্বেও আদিল যখন শৌচাগার থেকে বেরোতেন, তখন তাঁর মুখচোখ কখনো হলুদবর্ণ ” দেখাত, কখনো পাংশু তিনি দুর্গন্ধ একদম বরদাস্ত করতে পারতেন না ।
আদলীর আঁধিসাঁধি কারবার বেশিদিন চলেনি। সিংহাসনে বসার দ্বিতীয় মাসেই চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। তিনি বলপূর্বক বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য বাংলায় গেলেন। ইত্যবসরে শেরশাহের এক সম্বন্ধী ইব্রাহিম শূর এসে আগরা প্রভৃতি অধিকার করে নেন। আদলী হেমুর পরিচালনায় এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। ভীষণ সংঘর্ষ হয় এবং হেমু আগরা ও দিল্লী পুনরুদ্ধারে সফল হন ।
উপরোক্ত বিবরণ থেকে বোঝা যাবে যে গওয়ালিয়র শিল্পকলার এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং হয়তো সেই সুবাদে আদলী ও বাজবাহাদুরের দরবারেও সঙ্গীতের খুব কদর ছিল। হতে পারে গওয়ালিয়রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেই আদলীর সঙ্গীতাচার্য হওয়ার শখ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল এবং সেখানে তিনি সঙ্গীতও শিক্ষা দিতেন তানসেনের সঙ্গে এক দীর্ঘ বংশ-পরম্পরা জড়িত।
তিনি প্রথমে হিন্দু ছিলেন। আকবরের দরবারে যখন তিনি আসেন, তখন তিনি সুন্নি মুসলমান, এবং হিন্দুদের প্রতি তাঁর উদার মনোভাবের অভাব ছিল। জানা যায়, কোনো এক নবনীত-কোমলাঙ্গিনী যবনীর প্রেমে পড়ে মুসলমান হয়ে যান। বেদীজী তাঁর বৃদ্ধ বয়সে মুসলমান হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু তার সম্ভাবনা কম। আকবর তাঁর জীবনের শেষ তেইশ বছর মুসলমান থাকেন নি।
তাঁর ‘দীন-ইলাহী’ হিন্দু ও পারসি ধর্মের খিচুড়ি ছিল এবং সেই ধর্মে তাঁর এমন উৎসাহ ছিল যে মুসলমানরা তাঁকে একেবারে বিধর্মী বলে মনে করত । তিনি কাউকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে দেখলে খুশি হতেন, তাহলে, তানসেন আবার সে সময় মুসলমান হতে যাবেন কেন? আবুল ফজল তানসেন সম্পর্কে ঠিক কথাই লিখেছেন—“গত এক হাজার বছরে এরূপ সঙ্গীতাচার্য একজনও জন্মান নি ।”
মাে তানসেনের সঙ্গীত সম্পর্কে মন্তব্য করার পূর্ণ অধিকার আছে সঙ্গীতজ্ঞ শ্রী দিলীপ চন্দ্র বেদীর। তিনি বলেছেন—“তানসেন অনেক প্রাচীন রাগ-রাগিণীর মূল আঙ্গিক কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করেছিলেন এবং শত শত নতুন গান রচনা করে তাতে সুরারোপ করেছিলেন, সেই সঙ্গে নতুন নতুন রাগ-রাগিণী সৃষ্টিও করেছিলেন। প্রচলিত রীতির পক্ষপাতী অনেকে তাঁর বিরোধিতাও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছিলেন তানসেনই । তানসেনের সঙ্গে বৈজু বাওরার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাগিণীর সঙ্গে তানসেনের প্রেম-পীরিত ইত্যাদি মুখরোচক গালগল্পের কোনো হদিস পাওয়া যায় না।”
“ভাব-কল্পনা ও রসমাধুর্যের দৃষ্টিতে সংস্কৃত সাহিত্যের গীতিকাব্য কেবল ভারত নয়, বরং সারাবিশ্বের পরম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। গীতিকাব্যের ধারাবাহিকতা…সংস্কৃতের মহান কবিকুল থেকে আরম্ভ করে হিন্দীর বিদ্যাপতি, হিতহরিবংশ, স্বামী হরিদাস, তানসেন, বৈজু বাওরা, সুরদাস, তুলসীদাস ইত্যাদি কবিদের সুমধুর বাণীতে সমৃদ্ধ হয়ে সঙ্গীতজ্ঞদের জন্য গানের ভাণ্ডার পূর্ণ হতে হতে চলে আসছে।
সঙ্গীতকে অমরত্ব দান করার ক্ষেত্রে গীতি-কবিতার সাহিত্য সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য স্বামী হরিদাস এবং তাঁর সুযোগ্য শিষ্য তানসেনজী শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত অধ্যবসায় করে গেছেন। বর্তমান কালের আলাপ, ধ্রুপদ-ধামার গান— এই অদ্বিতীয় আচার্যদের অবদান। শুধু তাই নয়, হিন্দুস্তানি ‘খেয়াল গান’-ও আলাপ ও ধ্রুপদ গানেরই সংমিশ্রণ, যার প্রথম আচার্য ছিলেন নেয়ামত খাঁ সদার জी।
সদারজঙ্গী তানসেন-কন্যার বংশধর ছিলেন। গীতিকাব্যের জন্য সংস্কৃত কাব্যসমূহকে ও কবিদের সমস্ত প্রশংসা অর্পণ করা অর্থহীন। ভাঙাচোরা সংস্কৃতে রচিত ‘গীত গোবিন্দ’-ই একখানি উল্লেখযোগ্য গীতিকাব্য। তার মানে এই নয় যে পূর্বে গীতের প্রচলন ছিল না।
এখনকার প্রসিদ্ধ রাগ-রাগিণীর মধ্যে অনেকগুলির উল্লেখ পাওয়া যায় অপভ্রংশ-কালের (৫৫০-১২০০ খ্রিঃ) সাহিত্যে। প্রাকৃতকালেও (১-৫৫০ খ্রিঃ) সম্ভবত গীতিকাব্য রচিত হয়ে থাকবে, একই কথা পালি-কাল (৬০০-১ খ্রিঃ পূঃ) এবং তারও পূর্ব সময়কালের জন্য প্রযুক্ত হতে পারে। জানা যায়, প্রত্যেককালেই গেয় গান প্রচলিত ভাষায় রচিত হয়েছে। এবং সেটা উচিতও, কেননা সঙ্গীত কেবল কতিপয় পণ্ডিতের মনোরঞ্জনের বস্তু নয়।
অন্যরাও তার স্বাদ উপভোগ করতে ইচ্ছুক, আর সম্ভব হয় তখনই যখন গেয় পদ আকবর প্রচলিত ভাষায় রচনা করা হয়। সঙ্গীত যেমন উদয়ন, আদলী, বাজবাহাদুর (বায়েজীদের সুলতান), রঙ্গীলে মহম্মদশাহ এবং ওয়াজিদ আলি শাহের মতো আমোদ-প্রমোদে বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তিদের নিজের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত করতে সফল হয়েছে, তেমনি সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এবং বাবর, আকবরের মতো বীরদেরও নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে এবং তাঁদের পরাক্রমকে এতটুকু হ্রাস হতে দেয়নি। তাই বলা যায়, সঙ্গীতের উপর
বিলাসিতার কলঙ্ক আরোপ করা যেতে পারে না। যদিও বিলাসিতার জন্য সঙ্গীতের ব্যবহার আগেও হয়েছে এবং এখনও চলচ্চিত্রে খুব আড়ম্বর সহকারেই তা করা হচ্ছে। আদলীর দরবারে তানসেন বোধ হয় শিষ্য হিসাবে নয়, বরং কালোয়াত হিসাবেই যোগদান করে থাকবেন এবং তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, আদলীর রাজত্বকাল অবসানের পর রামচন্দ্রের দরবারে যান, সেখানে তিনি দশ-বারো বছরের বেশি থাকেন নি, কারণ ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিনি আক-বরের দরবারে উপস্থিত হন ।
বলা হয়, রামচন্দ্র তসুখের বদলে তাঁর নাম তানসেন রেখেছিলেন, আর সেকথা বিশ্বাস করাও উচিত, যেহেতু রামচন্দ্র তানসেনের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা প্রদর্শন করেছিলেন। সে কারণে রামচন্দ্রের দরবার ছেড়ে চলে যাওয়া তানসেনের ভালো না লাগারই কথা। হতে পারে, তাঁর সামনে আক-বরের দরবারের মান-মর্যাদা তাঁর কাছে ফিকে মনে হতো, সেজন্য তিনি সুখী ছিলেন না এবং তাঁর মন বসানোর জন্য তাঁকে সেখানে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছিল। আক-বরের রাজত্বকালের প্রারম্ভেই বীরবল তাঁর নিকটে গিয়েছিলেন। তিনিও কবি, শিল্পী ছিলেন।
সেজন্য হয়তো তাঁদের দু’জনের অন্তরঙ্গতা ভালোই জমেছিল। আক-বরের দরবারের প্রসিদ্ধ বীণাবাদক ঠাকুর সম্মুখ সিংহ ওরফে মিশ্রী সিংহের সঙ্গে তানসেনের কন্যার বিবাহ হয়। এঁদেরই বংশধর ছিলেন প্রসিদ্ধ কালোয়াত নেয়ামত খা ‘সদারঙ্গ’।
“তেষট্টি বছর বয়সে নাদব্রহ্মের এই অদ্বিতীয় পূজারীর দেহাবসান হয় (১৫৯৫ খ্রিঃ)।” এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। এই থেকেই প্রমাণ হয়, তানসেন তিরিশ বছর বয়সে আকবরের দরবারে গিয়েছিলেন এবং বত্রিশ বছর ছিলেন।
সঙ্গীতে তিনি মিয়া নামেই বেশি প্রসিদ্ধ। মিয়া কি টোডী, মিয়া কি মল্লারের মতো রাগ-রাগিণী তাঁর আবিষ্কার। তাঁর কবিত্ব শক্তির নিদর্শন শ্রী বেদীজী উদ্ধৃত করেছেন— প্রভাকর ভাস্কর, দিনকর হিমাকর ভানু প্রগটে বিহান। তেরে উদয় সে পাপ-তাপ কটে, কর্ম ধর্ম প্রেম নেম, হোয় গুরু-জ্ঞান ঔর ধ্যান।
জগমগাত জগত পর জগচক্ষু, জ্যোতিরূপ কশ্যপ সুত জগত কে প্রাণ ৷ তেরে উদয় সে জগ কপাট খুলত, তানসেন কীজিএ কৃপা বিদ্যা-নিধান। (প্রভাকর ভাস্কর, দিনকর স্নিগ্ধোজ্জ্বল সূর্য নিয়ে আসে সকাল । তোমার উদয়ে পাপ-তাপ কাটে, শুরু হয় কৰ্ম ধর্ম প্রেম, হতে থাকে গুরু-জ্ঞান ও ধ্যান।
আলো-ঝলমল জগতের উপর জগৎ-চক্ষু, জ্যোতিরূপ কশ্যপ সুত জগতের প্রাণ । তোমার উদয়ে জগতের দ্বার খোলে, কৃপা করে তানসেনকে করো বিদ্যা-নিধান।) আক-বর সূর্যের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। প্রাতঃকাল, মধ্যাহ্ন কাল, সায়ংকাল ও মধ্যরাত্রি— এই চারবার সূর্যের আরাধনা করতেন। এই কবিতা তাঁর কতখানি প্রিয় হতে পারে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন ।
তানসেন প্রকৃতি-প্রেমিকও ছিলেন— সঘন মন ছায়ো রী দ্রুম বেলী, মাধব ভবন গতি প্রকাশ বরনবস পুষ্প রঙ্গ লায়ৌ। কোকিলা কীর কপোত খঞ্জন অতিহি, আনন্দ করি চহুঁ ওর রঙ্গ ঝরি লায়ৌ । (বৃক্ষ-লতায় সঘন বনছায়া, মাধব-ভবনের পথ আলোকিত হোক বর্ণাবাস পুষ্পের রঙে। পিক শুক কপোত খঞ্জন আসুক, আনন্দে করী চারদিকে রঙিন জল বর্ষণ করুক।
আরও দেখুনঃ