দুর্বিপাকের ঘনঘটা

দুর্বিপাকের ঘনঘটা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “আকবর” বিষয়ের “শেখ মুবারক” বিভাগের একটি পাঠ। শেখ মুবারকের পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে দেওয়া হলো। কয়েকজন তাঁর শিষ্য সেজে পড়াশোনার ছলে কাছে কাছে থাকতে লাগল। একদিন খবর পাওয়া গেল যে মোল্লা ষড়যন্ত্র সাজিয়ে ফেলেছেন। শেখ মুবারককে ধরে নিয়ে গিয়ে দরবারে তাঁর উপর ধর্ম- বিরোধী হওয়ার অভিযোগ চাপিয়ে দেওয়া হবে। আবুল ফজল সে খবর পেয়েছিলেন মাঝরাতে। তখনই তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালেন। বাঁচানোর একটাই পথ, যতক্ষণ না বাদশাহ (আকবর) সত্য অবগত হন, ততক্ষণ তাঁকে কোথাও আত্মগোপন করে থাকতে হবে। আবুল ফজল গিয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ফৈজীকে সমস্ত জানালেন।

দুর্বিপাকের ঘনঘটা

 

দুর্বিপাকের ঘনঘটা | শেখ মুবারক | আকবর

 

ফৈজী অনুজের মতো কৌটিল্যের অবতার নন, খুবই সহজ-সরল মানুষ। তিনি তখনই শেখের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে সমস্ত কথা বললেন। শেখ বললেন— “শত্রু সবল, তবে খোদা তো রয়েছেন? মাথার উপরে তো ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের ছত্রছায়া রয়েছে। যদি ভাগ্যবিধাতা আমাদের জন্য মন্দ কিছু না লিখে থাকে, তাহলে কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি ঈশ্বরের ইচ্ছে তাই হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আমি হাসতে হাসতে আমার জীবন সমর্পণ করতে প্রস্তুত।”

বোঝাতে বোঝাতে ফৈজী হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি তৎক্ষণাৎ হাতে ছুরি তুলে নিয়ে বললেন— “দুনিয়ার কথা এক এবং সাধু-সন্তের কাহিনী আর এক। আপনি যদি এখনই না চলেন, তাহলে আমি আমার জীবন শেষ করে দেবো। তারপর আপনি আপনার ব্যাপার বুঝবেন। আমি ওই দুর্দিন দেখতে প্রস্তুত নই।” জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখে এই অভিমান-পূর্ণ কথা শুনে শেখ মুবারকের আর ক্ষমতা রইল না পুত্রের অনুরোধ অস্বীকার করার ।

আবুল ফজল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে কথা বলে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। পিতা তাঁকেও ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সেই অন্ধকার রাতে তিনজন পদব্রজে বেরিয়ে পড়লেন। কোনো পথ-প্রদর্শক নেই। কোথায় যাবেন? ফৈজী যার নাম করেন, আবুল ফজল তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। আবার আবুল ফজল যার কথা বলেন, ফৈজী সেটা সঠিক বলে মানেন না। ফৈজী জনৈক ব্যক্তির কথা খুব আগ্রহের সঙ্গে তুললেন তিনজনে সেখানে গেলেন। কিন্তু সে ব্যক্তির ভাব গতিক দেখে ফৈজী আক্ষেপ করতে করতে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে বললেন— “তোমার জ্ঞানবুদ্ধি কম হলেও তুমি ঠিকই বুঝেছিলে ।

এখন বলো কি করা যায়।” আবুল ফজল প্রস্তাব করলেন— “এখনও তে খারাপ কিছু হয়নি, চলো, বাড়িতেই ফিরে যাই। যদি দরকার পড়ে, তাহলে আমাকে উকিল করে পাঠিয়ে দেবে, দুশমনদের উলঙ্গ করে ছেড়ে দেবো।”

শেখ সমর্থ করলেন— “সাবাশ, আমারও তাই মত।” ফৈজী এতবড় বিপদ মাথায় নিতে রাি হলেন না। ভ্রাতার প্রতি বিরক্ত হয়ে বললেন— “এসব ব্যাপারে তুই কিছুই খ রাখিসনে। ওই সব ধূর্ত ভণ্ড প্রতারকদের সম্বন্ধে কি জানিস তুই? বাড়ির কথা ছাতে উপায়ের কথা বলো।” আবুল ফজল জনৈক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেন— “আ মন বলছে, যদি কোনো দৈব-দুর্বিপাক না ঘটে, তাহলে তিনি আমাদের সাহায্য কর পারেন।”

রাত্রিবেলা। সময় বেশি নেই। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন। আবুল ফজলের কথা অনু সেদিকেই যাত্রা করলেন । পিচ্ছিল জলাভূমি। তাঁরা এগিয়ে চলেছেন, কিন্তু মনের সংশয়ও রয়েছে। পা উঠতে চাইছে না, শ্বাস-প্রশ্বাসেও কষ্ট হচ্ছে। অদ্ভুত বিপজ্জনক রাত্রি এবং আগামীকাল সর্বনাশ অথবা মহাপ্রলয়ের দিন।

যখন তিন পুত্র সেই ব্যক্তির দ্বারদেশে উপনীত হলেন, তখন সকাল হয়ে আসছে। সে-ব্যক্তি আগ্রহে তাঁদের স্বাগত জানালেন। একটা ভালো ঘরে তাঁদের থাকতে দিলেন। নিশ্চিন্তে কাটল। তৃতীয় দিন খবর পাওয়া গেল যে শত্রুরা বাদশাহের কাছে পেশ করেছে, বাদশাহের মনও বিরূপ হয়ে উঠেছে। তিনি মোল্লাদের বলে দিয়েছেন তোমাদের বিনা পরামর্শে দেশের কেন, মালীর কাজও হয় না। আর এটা তো বিশেষভাবে ধর্ম ও আইনের ব্যাপার। এর ফয়সালা করা তোমাদের কাজ। আদালতে ডেকে পাঠাও। শরীয়ত যা ফতোয়া দেয়, বিজ্ঞজনেরা যা সঠিক মনে করেন, তাই করবেন।

শত্রু সভাসদেরা তৎক্ষণাৎ অভিযুক্তকে ধরে আনার জন্য চোপদারদের পাঠিয়ে দিলেন। তারা খুব খানা-তল্লাসি চালাল। বাড়ি থেকে তিন পিতা-পুত্র উধাও। সেখানে পাহারা বসিয়ে দেওয়া হলো। ছোট ভাই আবুল খয়েরকে ধরে নিয়ে গেল তারা। বিস্তর অতিরঞ্জিত করে বাদশাহকে বোঝানো হলো যে শেখ নিশ্চিত অপরাধী, না হলে এমন করে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়ায়। আকবর নবযুবক, কিন্তু তবু তাঁর মধ্যে বোধ-বুদ্ধি ছিল। তিনি চিত্রের কেবল একটা দিকেই মনোযোগ দিতেন না।

তিনি বললেন— “শেখের তো এদিক-ওদিক বেড়ানোর স্বভাব, কোথাও গেছেন হয়তো। এই শিশুটাকে খামোকা ধরে এনেছ কেন? বাড়িতেই বা পাহারা বসিয়েছ কেন?” তখনই ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো এবং পাহারাও তুলে নেওয়া হলো। সব খবরই তিন পিতা-পুত্রের কাছে এসে পৌঁছেছিল, তবু প্রকাশ্য জনসমক্ষে বেরিয়ে আসা ঠিক নয় মনে করছিলেন। শত্রুরা ব্যর্থ হওয়ার পর ভাবলেন, দু-তিনজন গুণ্ডা পাঠিয়ে দেওয়া যাক, যেখানে তাঁকে পাবে, সেখানেই তাঁকে খতম করে দিক। তাঁদের আশঙ্কা হচ্ছিল যে বাদশাহের মতিগতির পরিবর্তন দেখে তিনি স্বয়ং না দরবারে এসে হাজির হন, তাহলে তাঁদের সকলকেই বেকায়দায় পড়তে হবে।

একজন গৃহস্থ তাঁদের এক সপ্তাহ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর মনেও আশঙ্কা দেখা দিল। শত্রুরা নানারকম গুজব ছড়াচ্ছিল। ভাবলেন, অতিথিদের আশ্রয় দিতে গিয়ে তিনিই না আবার বাদশাহের কোপে মারা পড়েন । সেরকম ইঙ্গিত পেয়ে আবার তিনজনে উপায় খুঁজতে লাগলেন ।

পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তরুণ কৌটিল্যের বুদ্ধির ধারে আস্থা রাখতে শুরু করেছিলেন। তাঁরই উপর উপায় খোঁজার ভার ছেড়ে দেওয়া হলো। সন্ধ্যা হলে সেই বাড়ি থেকে তাঁরা পুনরায় পথে নামলেন। যেতে যেতে একটা গঞ্জ চোখে পড়ল। সেখানে শেখের এক শিষ্য থাকতেন। তাঁর গৃহে তাঁরা গেলেন, খানিকক্ষণ বিশ্রামও নিলেন, কিন্তু সেখানেও ঠাঁই কোথায়? আবুল ফজল বলেছেন— “এই হলো ভালো ভালো বন্ধু আর পুরনো-পুরনো শিষ্য।

খাঁটি শিষ্যদের হালচাল কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশ হয়ে পড়ল। তখন আবার এই সিদ্ধান্ত হলো, এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি এবং এইসব ভীতু বন্ধু-বান্ধবদের সংস্পর্শ থেকে যত শীঘ্র সম্ভব দূরে চলে যাই। খুব দেখেছি, বাতাসে এদের বন্ধুত্বের পদক্ষেপ, ক্ষমতার মূল নদী-তরঙ্গে। শহরে চলো, কোনো গোপন স্থান খুঁজি। 

 

দুর্বিপাকের ঘনঘটা | শেখ মুবারক | আকবর

 

হয়তো কোনো অপরিচিত সজ্জন ব্যক্তিই আশ্রয় দেবেন আমাদের। সেখান থেকেই বাদশাহের মতিগতি বুঝবার চেষ্টা করব। যদি সুযোগ পাই, ভাগ্য-পরীক্ষা করে দেখব । যদি আশা না থাকে, তাহলে পৃথিবী তো ছোট নয়। পাখিদের জন্যও বাসা থাকে, ডালপালা থাকে। হতচ্ছাড়া এই শহরকে (আগরা) তো আমরা প্রলয়কাল পর্যন্ত নিজেদের বিক্রী করে দিইনি। জনৈক আমির দরবার থেকে অপসারিত হয়ে নিজের এলাকায় চলে এসেছেন, সবাইকে বাদ দিয়ে তাঁর কাছেই চলো আশ্রয় প্রার্থনা করি। অপরিচিত জায়গা, হয়তো একটু বিশ্রাম পাওয়া যাবে।

যদিও সংসারী মানুষের দয়ার উপরে নির্ভর করা যায় না, ভরসা তবে বলতে এইটুকুই, শত্রুদের সঙ্গে তাঁর এখন সম্পর্ক নেই ।” ফৈজী বেশভূষা বদল করে তাঁর কাছে গেলেন। সব শুনে খুব খুশি হয়ে তিনি তিনজনকেই স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত। শত্রুরা সবকিছুই করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছে, সেজন্য ফৈজী কয়েকজন তুর্কি সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে পিতা ও ভ্রাতাকে সব কথা জানালেন। তাঁরাও নিজেদের পোশাক বদল করে পৃথক-পৃথকভাবে এক-এক করে আমিরের বাসভবনে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

আপ্যায়ন দেখে দেহমন তৃপ্ত হলো, আরামেই কাটল কয়েকদিন। যখন তাঁরা পুনরায় সুদিনের মুখ দেখবেন বলে ভাবছেন, ঠিক সেই সময় দরবারে ফের আমিরের আমন্ত্রণ এসে গেল। অমনি তাঁর হাবভাবও বদলে গেল। রাত্রিবেলা বেরিয়ে তাঁরা আর একজন বন্ধুর গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তিনি যথেষ্ট খাতির তোয়াজও করলেন, কিন্তু তাঁর এক দুরাত্ম প্রতিবেশীর জন্যই তিনি আশঙ্কিত। লোকজন ঘুমিয়ে পড়লে সেখান থেকেও তাঁ বেরোলেন। কোথায় আশ্রয় নেবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। অনেক ঘুরে ফি শেষে সেই আমিরের বাসভবনেই আবার প্রত্যাবর্তন করলেন ।

সেখানকার লোকজনে তাঁদের চলে যাওয়ার কথা জানত না। আমির পুনরায় এই আপদ মাথায় নিতে র নন। তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন দেখে ভৃত্যরাও চোখ ফিরিয়ে নিল। আবুল য ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, কিন্তু ফৈজীর অত বাস্তব-বুদ্ধি কোথায়? আমির দেখ এঁরা তো এখান থেকে নড়তে চাইছেন না, সুতরাং তিনি তাঁদের সঙ্গে আর কোনো না বলেই সকালবেলা বাসভবন ত্যাগ করে চলে গেলেন। চাকর-বাকরেরাও উপড়ে ফেলল । তিন পিতা-পুত্র খোলা আকাশের নিচে বসে রইলেন।

এখন আর সেখানে থাকার ঠাঁই কোথায়? অতএব আবার পথে। দিনের লোকজনের ভিড়ের মধ্যেই বেরোতে হলো। কিন্তু মনে হলো তাদের চোখে প আছে। যেতে যেতে একটা বাগান দেখে একটু থামলেন, কিন্তু অচিরেই পারলেন সেখানেও গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁরা এদিক-ওদিক দৌড়ঝাঁ বেড়াচ্ছিলেন, এমন সময় একজন মালী তাঁদের দেখেই চিনে ফেলেছে দেখে স উঠলেন। মালী বড় জেদাজেদি শুরু করল, জোর করে নিজের বাড়িতে বি তুলল তাঁদের। ফৈজী মনে মনে যথেষ্ট ভয় পেলেন, কে জানে লোভে পড়ে কিছু করে বসে।

একটু রাত হলে বাগানের মালী এসে বলল— আ আপনাদের ভক্ত থাকতে কেন আপনারা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন? গরিবেরা যত ঈমানদার হতে পারে, অপরের জন্য যত আত্মত্যাগ ক আমিরেরা তা পারে না। সে তাঁদের নিয়ে গিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় করল। এক মাসেরও বেশি সময় ভারতের ভাবী মহামন্ত্রী এবং কবি পিতার সঙ্গে সেখানে আরামে কাটান। সেখান থেকে তাঁরা তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পত্র পাঠান। সকলেই চেষ্টা করতে শুরু করেন। সাদাসিধে চালচলন অথচ আশ্চর্য প্রতিভাশালী ফৈজী সাহসের পরিচয় দিলেন।

প্রথমে আগরা, পরে আকবরের তৎকালীন রাজধানী ফতেহপুরসিক্রাতে গেলেন। সেখানে হিতাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। একদিন দরবারে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সাহস করে বলতে শুরু করলেন— “হুজুর, শেষ জমানা কি সমাপ্ত হতে চলেছে? কেয়ামত এসে গেল নাকি? হুজুর, বাদশাহিতে দুর্বৃত্ত ও মতলববাজেরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভালো মানুষেরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।

এটা কিরকম ব্যবস্থা?” বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন— • “তুমি কিসের কথা বলছ? তোমার তখন আকবর উদ্দেশ্য কোন ব্যক্তি সম্পর্কে?” যখন সেই ব্যক্তি শেখের নাম বললেন, উত্তর দিলেন— “এখনকার হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরা আপদের পাহাড় সরাতে ও প্রাণ নিতে কোমর বেঁধে ফতোয়া তৈরি করেছে। আমি জানি, আজ শেখ অমুক জায়গায় রয়েছেন। কিন্তু জেনেও না-জানার ভান করে আছি। একজনকে একথা অন্যজনকে আর এক কথা বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছি। তুমি কিছুই জানো না, তাই অনর্থক মেজাজ গরম করছ। যাও, আজ সকালেই লোক পাঠিয়ে শেখকে এনে হাজির করো, মোল্লাদেরও জড়ো করো।”

ফৈজী যখন সে-কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি তৎক্ষণাৎ দৌড়াতে দৌড়াতে পিতা ও ভ্রাতার নিকট উপস্থিত হলেন। তিনজনে সাজসজ্জা বদল করে কারোকে কিছু না জানিয়ে আগরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। মৃত্যুর মুখবিবর দিয়ে যেতে হবে, কারণ এই রাত্রিবেলা শত্রুরা যদি তাঁদের গুণ্ডাদের পাঠিয়ে দেয়, তাহলে আকবরের ক্ষমতা নেই তাঁদের রক্ষা করার। অন্ধকার রাতে চারদিক নিস্তব্ধ নির্জন । তাঁরা আগরার দিকে দ্রুতপদে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বেশ-ভূষা পাল্টালেও মনের মধ্যে বিশ্বাস আসবে কোত্থেকে।

 সামনে একটা ভেঙে-পড়া বাড়ি, সেখানে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। পরামর্শ করে স্থির হলো সেখানে ঘোড়ার বন্দোবস্ত করে ফতেহপুরসিক্রী চলে যাওয়া যাক। রাতের মধ্যেই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সিক্রীর দিকে রওনা হলেন। এদিক-ওদিক ঘুরে তাঁরা এক জায়গায় পৌঁছলেন, সেখানে পরিচিতরা নানা রকমের কথা বলে তাঁদের মস্তিষ্ককে আরও চিন্তাভারাক্রান্ত করে তুলল। বলল— “লোকেরা আবার বাদশাহকে উল্টো-সিধে বুঝিয়ে কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। আগে আসতেন, তাহলে সহজে কার্যোদ্ধার হতো।

এখন কাছাকাছি একটা গ্রামে কিছুদিন কাটান। বাদশাহের মনোভাব অনুকূল দেখলে তখন কিছু করা যাবে।” গরুর গাড়িতে চড়িয়ে তাঁদের গ্রামটার দিকে রওনা করিয়ে দেওয়া হলো। গ্রামের যে ব্যক্তির ভরসায় সেখানে যাওয়া, তিনি বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু কি করা যায়, তাঁরা তো এসে পড়েছেন। সেখানকার দারোগার কোনো একটা কাগজ পড়ে নেওয়ার দরকার ছিল । মুসাফিরদের দেখে তিনি তাঁদের শিক্ষিত বোধ করলেন এবং তাঁদের ডেকে পাঠালেন। তিনজনেই গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই মালুম হলো যে গ্রামখানা কোনো এক বড় বদমায়েশের তালুক।

পুনরায় সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। এক পথ-প্রদর্শককে সঙ্গে নিয়ে পথ ভুল করে, অনর্থক অনেক পথ ঘোরাঘুরি করে আগরার নিকটস্থ একটা গ্রামে গিয়ে পৌছলেন । সেদিন তাঁদের ত্রিশ ক্রোশ হাঁটতে হয়েছিল। একটা বাড়ির কাছে এসে তাঁরা গরুর গাড়ি থেকে নামলেন, জানতে পারলেন, সেই জমির মালিকও এক পাজী, সে মাঝে মাঝে এদিকে আসে। মাঝরাতে সেখান থেকে ফের পালালেন। সকাল হতে হতে আগরায় পৌঁছলেন।

এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দম ফেললেন। অল্পকালের মধ্যেই গৃহস্বামী তার অবিশ্বস্ত মনোভাবের পরিচয় দিয়ে বলল যে তাঁর প্রতিবেশী খুব ধোঁকাবাজ। আসলে গৃহস্বামী অজুহাত খুঁজছিল। দু’দিন এভাবেই কাটল, সেই দু’দিন প্রতিটি নিশ্বাস অন্তিম নিশ্বাস বলে বোধ হচ্ছিল।

 

দুর্বিপাকের ঘনঘটা | শেখ মুবারক | আকবর

 

শেষে একজন ভালোমানুষের সন্ধান পাওয়া গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাঁর গৃহের ঠিকানা বের করে সেখানে গিয়ে উপনীত হলেন তাঁরা। গৃহস্বামীর ব্যবহার দেখে তাঁরা খুশি হলেন। যদিও তিনি শেখের শিষ্য নন, কিন্তু বড় সজ্জন ব্যক্তি বলে প্রতীয়মান হলো। আবুল ফজলের মতে— “দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও পুণ্যকর্মের জোরেই জীবনে জয়ী হয়েছিলেন তিনি, সামান্য ধনসম্পদে আমিরের মতো থাকতেন, ছোট হাতকেও দরাজ হাতে পরিণত করতেন, বৃদ্ধাবস্থাতেও যুবকের মতো তাঁর চেহারা ঝকঝক করত।”

তারপর লেখালেখির কাজ শুরু হলো। দুই মাসের প্রতীক্ষার পর ভাগ্য এখন দিক্-বদলের অভিমুখে। ফৈজীর সঙ্গে শেখ মুবারক দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। আকবর যেরকম অনুগ্রহ ও উদারতার পরিচয় দিলেন, তাতে শত্রুরা স্তব্ধ হয়ে গেল, ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন স্তিমিত হলো।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment