আবুল ফজলের মৃত্যু | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের মৃত্যু, ১৬০২ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট। আবুল -ফজল অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে আগরার দিকে চলেছেন, সঙ্গে অল্পসংখ্যক সৈন্য। বর্রা সরাই থেকে আধ ক্রোশ এবং ছোট শহর অন্তরী থেকে তিন ক্রোশ— এমন জায়গায় পৌছলে সামনে উৎক্ষিপ্ত ধূলিজাল দেখে আবুল -ফজল অশ্বের বল্গা টেনে ধরে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছিলেন, তাঁর ভক্ত সেবক গদাই খাঁ পাঠান নিকটে ছিলেন, তিনি অনুরোধ করলেন— “এখন দাঁড়াবার সময় নেই। মনে হচ্ছে শত্রুরা খুব দ্রুতবেগে আসছে। আমাদের লোকজন কম । আপনি ধীরে সুস্থে ফিরে যান। আমি আমার লোকজন নিয়ে ওদের পথ আটকাব।

আবুল ফজলের মৃত্যু | আবুল ফজল | আকবর

আবুল ফজলের মৃত্যু | আবুল ফজল | আকবর

 

আমাদের প্রাণ দিতে দিতেই আপনি সহজে অন্তরী পৌঁছে যাবেন। সেখানে পৌঁছতে পারলে আর কোনো ভয় নেই, কারণ রাজা রাজসিংহ সেখানে তিন হাজার সৈন্য নিয়ে পৌছে গেছেন।” আবুল- ফজল বললেন— “গদাই খাঁ, তোমার মতো মানুষের মুখে এ কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি।

এ সময়ে কি এরকম পরামর্শ দেওয়া উচিত? জালালুদ্দীন মুহম্মদ আকবর বাদশাহ আমার মতো এক ফকির-সন্তানকে মসজিদের কোণ থেকে তুলে এনে সদর (প্রধানমন্ত্রী)- i)-এর পদে বসিয়েছেন। আজ আমি কি তাঁর প্রতিষ্ঠা মাটিতে মিশে যেতে দেব? ওই চোরের সামনে থেকে পালিয়ে যাব? তারপর অন্যদের সামনে মুখ দেখাব কিভাবে? যদি পরমায়ু শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, কপালে মৃত্যু লেখা থাকে, আর কি করা যাবে!” তাহলে

আবুল -ফজল নির্ভয়ে ঘোড়ার লাগাম হাতে ধরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন । গদাই খাঁ আবার দৌড়ে সামনে এসে বললেন— “এরকম পরিস্থিতিতে সৈন্যদের অনেকবার পড়তে হয়। এখন মোকাবিলা করার সময় নয়। অন্তরী গিয়ে সেখান থেকে লোকজন নিয়ে এসে প্রতিশোধ নেওয়াই সৈনিকের রণকৌশল।”

কিন্তু আবুল -ফজল তাঁর কথা মানতে চাইলেন না । শাহজাদা সলীম তাঁর পথের কাঁটা আবুল -ফজলকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁকে জানানো হয়েছিল, আবুল- ফজলের ফিরে আসার পথ বুন্দেলদের দেশের ভিতর দিয়ে। ওরছার রাজা নরসিংহদেবের পুত্র মধুকর ইদানীং বিদ্রোহের পথে নেমে পড়েছেন। তিনি এ কাজে সাহায্য করতে পারেন। সলীম মধুকরকে লিখেছিলেন যে, “যদি তুমি আবুল- ফজলকে খতম করতে পারো, তাহলে আমি সিংহাসনে বসার পর তোমাকে অঢেল ধনসম্পদ দেবো।”

 

আবুল ফজলের মৃত্যু | আবুল ফজল | আকবর

 

মধুকর তাঁর লোকজন নিয়ে শেখের কাছে পৌঁছে গেলেন। আবুল ফজলের তখন একান্ন বছর বয়স, কিন্তু যেন যৌবনের তেজে তাঁর রক্ত ফুটছে টগবগ করে । তরোয়াল হাতে নিয়ে তিনি মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন। সঙ্গী পাঠানরাও প্রাণপণ লড়াই করছিল।

আবুল ফজলের শরীরে কয়েকটা চোট লেগেছিল। তারপর একটা বর্শা এসে তাঁকে এমন সজোরে আঘাত করল যে তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। অন্যান্য সৈন্যরা তখন যুদ্ধে ব্যস্ত। শেষে বুন্দেলরা আবুল ফজলের নিষ্প্রাণ শরীর একটা গাছের নিচে দেখতে পায়। সেখানে আশেপাশে আরও বহু লাশ পড়ে ছিল। মধুকর আবুল ফজলের মাথা কেটে সলীমের নিকট পাঠিয়ে দেন। শাহজাদা সেটাকে শৌচাগারে নিক্ষেপ করেন। বেশ কিছুদিন সেখানেই তা পড়ে থাকে। সলীম জাহাঙ্গির নাম নিয়ে সিংহাসনে বসে ওরছার রাজা মধুকরকে তিনহাজারী মনসব দিয়েছিলেন। আবুল ফজলকে অন্তরীতে সমাধিস্থ করা হয়। 

গওয়ালিয়রের পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত একটা ছোট্ট পল্লীগ্রামে আজও আমাদের ইতিহাসের অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ, পরম দেশ- প্রেমিক শুয়ে রয়েছেন। পরাধীন বিমূঢ় ভারত তার মর্যাদা দেয়নি, কিন্তু এখনও কি অন্তরী সেইরকমই অখ্যাত উপেক্ষিত থেকে যাবে ?

আকবরের কাছে সেই দুঃসংবাদ পৌঁছানোর সাহস দেখাতে পারে কে? সকলেরই চিন্তা, বাদশাহের কাছে প্রসঙ্গটি কিভাবে উত্থাপন করা যায় । আকবরের নিকটে আবুল ফজল ছিলেন বাইরে বিচরণশীল তাঁর প্রাণ। তিনি জানতেন, আবুল ফজলই তাঁর সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ হিতাকাঙ্ক্ষী।

তৈমূর বংশের রীতি ছিল, যখন কোনো শাহজাদার মৃত্যু হতো, তখন সেই সংবাদ বাদশাহকে সরাসরি জানানো হতো না। মৃত ব্যক্তির প্রতিনিধি হাতে কালো রুমাল বেঁধে বাদশাহের সম্মুখে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াত । বাদশাহ জানতে পারতেন যে তার প্রভুর মৃত্যু হয়েছে। আবুল -ফজলের উকিল (প্রতিনিধি) হাতে কালো রুমাল বেঁধে ভয়ে ভয়ে, ধীর পদক্ষেপে মাথা নিচু করে সিংহাসনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আকবর দারুণ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “খয়ের বাশদ্” (কুশল 

 

আবুল ফজলের মৃত্যু | আবুল ফজল | আকবর

 

তো)? প্রতিনিধি আসল কথা জানাতেই বাদশাহের এমন অবস্থা হলো যে পুত্রের পিতার অমন দশা হয় না। কয়েকদিন তিনি দরবারে এলেন না, কোনো আমিরের সঙ্গেও কথা বললেন না। অনুশোচনা করতেন আর কাঁদতেন। হাত দিয়ে মৃত্যুতেও বারবার বুক চাপড়াতেন আর বললেন— “হায় হায়, শেখুজী, বাদশাহি নেওয়ার ইচ্ছে ছিল তো আমাকে মারতে হতো, শেখকে মেরে কি হলো!” আকবর সলীমকে শেখুজী বলে ডাকতেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment