টুকড়িয়ার সেবায়, হুসেন খাঁ টুকড়িয়া হুমায়ূনের সময় থেকেই একজন খুব বিশ্বস্ত সেনাপতি হিসেবে কাজ করে এসেছিলেন। তাঁর অতীতের রাজসেবা ও আত্মত্যাগের কথা ভেবে আকবর তাঁর উপর অত্যন্ত সদয় ছিলেন। কিন্তু টুকড়িয়া ছিলেন ধর্মান্ধ, ঔরঙ্গজেবের আমলে তাঁর জন্মগহণ করা উচিত ছিল।
টুকড়িয়ার সেবায় | মোল্লা বদায়নী | আকবর
আকবর যখন হিন্দু-মুসলমানকে এক করার উদ্যোগ নিয়েছেন, স্বয়ং আধা-হিন্দু হয়ে উঠেছেন, তখনও টুকড়িয়া কুমায়ূন-গাড়ওয়ালের মন্দিরসমূহ লুঠপাট করছেন, ধ্বংস করছেন, তরোয়ালের আঘাতে মানুষের প্রাণ সংহার করছেন। মোল্লা বদায়ূনীর কাছে তিনি একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন।
হিজরী ৯৭৩ থেকে ৯৮১ সন (১৫৬৫-৭৩ খ্রিঃ) পর্যন্ত আট বছর তিনি টুকড়িয়ার সঙ্গে কাটান। ‘এটা’ জেলার পাটিয়ালী গ্রামে মহাকবি আমির খুসরোর জন্ম হয়। সেই পাটিয়ালী এলাকা হুসেন খাঁ জায়গির লাভ করেছিলেন। ১৫৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে (৯৭৩ হিজরীতে) মোল্লা সাহেব টুকড়িয়ার সঙ্গে যোগ দেন।
আকবরের দরবারেরও আকর্ষণ ছিল, কিন্তু সেই ধর্মান্ধ পাঠানই তাঁর বেশি মনঃপূত হলো । হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের রক্তে রক্তাক্ত যাঁর হাত, সেই নৃশংস ব্যক্তিটিকে বদায়ূনী “সদাচারী সন্ত-স্বভাব, দাতা, পবিত্র আত্মা, ধর্মভীরু, বিদ্যোৎসাহী” ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত করেছেন। মোল্লা তাঁর কাছেই এক অজ্ঞাত অখ্যাত ব্যক্তির মতো জীবন কাটাতে থাকেন।
তাঁর মতে, ‘টুকড়িয়া ভালোমানুষদের তত্ত্বাবধান করেন, সাহায্য করেন।’ মোল্লা সাহেব টুকড়িয়ার প্রশংসা করতে করতে কলম ভেঙে ফেলেছেন। আজাদের ভাষায়— “(মোল্লা সাহেব টুকড়িয়াকে) পয়গম্বরদের আসন পর্যন্ত না হোক, পয়গম্বরের বন্ধু আওলিয়াদের নিকট পর্যন্ত অবশ্যই পৌছিয়ে দিয়েছেন।”
টুকড়িয়া আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দ্বাবিংশ রাজ্যবর্ষ (১১ মার্চ, ১৫৭৭–১০ মার্চ, ১৫৭৮ খ্রিঃ) পর্যন্ত অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং তিনহাজারীর পদ লাভ করেছিলেন। এরূপ ধর্মান্ধ রক্ষণশীলের মোল্লা আব্দুল কাদিরের মতো লোককে প্রয়োজন ছিল ।
“কেমন ফুলসাজে একলা রয়েছে, আমি যাব। দু’জন পাগল একসাথে মিলে বেশ কাটাব।” আট বছর পর্যন্ত মোল্লা বদায়ূনী তাঁর সঙ্গে থেকে, ‘কালল্-লাহু, কালর্-রসূলু” (আল্লা তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে এই বলেছেন, রসুল তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে এই বলেছেন) করতে করতে নিজের ও টুকড়িয়ার মনে আনন্দ জুগিয়েছেন, সেই সঙ্গে টুকড়িয়ার জায়গিরের কাজকর্মে সাহায্য করেছেন।
এইভাবে টুকড়িয়ার সঙ্গে তিনি চব্বিশ থেকে বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। এটা এমন এক বয়স, যখন যে-কোনো রঙের ছাপ পড়লেই তা পাকা রঙ হয়ে যায়, তাই এটা কোনো আশ্চর্যের কথা নয়— যদি মোল্লার কলম বিধর্মীদের গলা কাটতে টুকড়িয়ার তরোয়ালের সঙ্গে পাল্লা দেয়। বসায়ূন— সন্ ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে (৯৭৫ হিজরীতে) মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে মোল্লা সাহেব বদায়ূন যান এবং সেখানে দ্বিতীয় বিবাহের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন ।
এই বিবাহের বর্ণনা তিনি স্রেফ দেড় পঙ্ক্তিতে শেষ করেছেন। তবে তা থেকেই বোঝা যায়, স্ত্রী সুন্দরী ছিলেন, তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। বলেছেন— “এ বছর বর্তমান লেখকের দ্বিতীয় বিবাহ হলো এবং বিল্ আখির তো খায়রূন্ লকা মিনাল্-উলা’ (প্রথম অপেক্ষা আন্তম তোমার জন্য উত্তম)” এই বাক্য অনুসারে শুভ হয়েছিল। জানা যায় যে প্রথম স্ত্রী শুভ প্রতিপন্ন হননি। কিছুকাল পরে নববধূর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয় । মোল্লা পুনরায় তাঁর মালিকের কাছে যান।
টুকড়িয়া তখন জায়গির পেয়েছিলেন লখনৌতে। কিছুদিন সেখানে ঘোরাঘুরি করেন। জায়গির পরিবর্তন করার জন্য টুকড়িয়া বাদশাহের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি কুমায়ূনের পাহাড়-পর্বতে তরোয়ালে আগুনে আল্লার বান্দাদের হত্যা করে জেহাদের পূণ্য অর্জন করতে গেলেন।
তিনি শুনেছিলেন, সেই সব পাহাড়ে সোনা-রূপোর মন্দির রয়েছে। রথ দেখা কলা বেচা : ধন-সম্পদ লুঠপাট ও ইসলামের প্রচার। সে-সময় টুকড়িয়ার সঙ্গে থাকা পছন্দ হয়নি মোল্লার। তরোয়ালের সাহায্যে ইসলামের প্রচারকে তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন না, তবে তাঁর নিজের বাহুতে তেমন শক্তি ছিল না। এই সময় তাঁর অনুজের মৃত্যু হয় এবং তাঁর শিশুপুত্রও হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে কবরে রওনা হয়। ভ্রাতৃ- বিয়োগের পর তিনি অত্যন্ত ভাবাবেগের সঙ্গে মর্সিয়া (শোক-গাথা) লিখেছেন, তার দু’টি পক্তি হলো—
হালে দিল হেচ ন দানম্ ব-কে গোয়াম চি কুনম্ । চারএ-দর্দে-দিলে-খুদ’জ কে জোয়াম্ চি কুনম্ । (মনের অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছিনে। কাকে বলব, কী করব? নিজের মনঃপীড়ার ওষুধ কার কাছে খুঁজব, কী করব?) মোল্লা আব্দুল কাদির সমস্ত ডিম এক ঝুড়িতে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি
পা রাখতেন কয়েকটা নৌকায়। তবে হ্যাঁ, ইসলামের চৌহদ্দির মধ্যেই। শরীয়ত ও ইসলামের পদাঙ্ক অনুসরণের কথা তিনি গর্বভরে স্বীকার করতেন, আবার সেই সঙ্গে সন্ত-ফকিরদের অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্য নিতেও কসুর করতেন না। হিজরী ৯৭৯ সনের (১৫৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দের) ঘটনা।

মোল্লার বয়স তখন তিরিশ বছর অতিক্রম করেছে। হুসেন খাঁ কাঁটগোলা (জেলা মুরাদাবাদ) জায়গির নিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল হিমালয়ে হামলা চালানো। মোল্লা সাহেবও তাঁর প্রভুর সঙ্গে সেখানে যান। ফকিরদের যত্ন-আত্তির ভার দেওয়া হয় মোল্লা সাহেবের উপর। সেখানে তিনি জানতে পারেন, কনৌজ এলাকায় মকনপুরে (জেলা কানপুর) শেখ বদীউদ্দীন মাদারের পবিত্র কবর রয়েছে, দর্শন করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
মোল্লা সাহেবের ‘জ্ঞানচক্ষু’ পরদায় ঢাকা পড়ল। তিনি সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। দরগায় কিছু একটা ‘ভারি বেয়াদবি’ করে বসেন, তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাঁর শাস্তিও পেয়ে যান। শত্রু তরোয়াল কোষমুক্ত করে তাঁর দিকে তেড়ে আসে, একের পর এক, ন’বার আঘাত করে।
হাত ও কাঁধের ক্ষত অগভীর, কিন্তু মাথায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। তরোয়াল মাথার খুলি ভেদ করে ইবাদতখানায় (প্রার্থনা-মন্দিরে) তখন শাস্ত্রালোচনা চলছে, বদায়ূনীর সহপাঠী ফৈজী ও আবুল ফজল তাঁদের যুক্তি ও বিদ্যাবুদ্ধির কেরামতি দেখাচ্ছেন। ইবাদতখানায় (প্রার্থনা-মন্দিরে) তখন শাস্ত্রালোচনা চলছে, বদানীর সহপাঠী ফৈজী ও আবুল ফজল তাঁদের যুক্তি ও বিদ্যাবুদ্ধির কেরামতি দেখাচ্ছেন।
আরও দেখুনঃ