টোডরমল শ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষ, গুজরাতে (১৫৭৬-৭৭ খ্রিঃ)— গুজরাতে ওয়াজির খাঁকে অসফল দেখে আকবর মঈনে অত্সুদ্দৌলা (রাজ-বিশ্বাসভাজন) টোডরমলকে উক্ত কাজের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি গিয়ে সুলতানপুর এলাকার বন্দোবস্ত দেখেন, তাতে স্বস্তি পান। ভড়ৌচ, বড়ৌদা, চম্পানের, পাটন-এর দফতরগুলো দেখে তিনি বুঝতে পারেন শাসনব্যবস্থায় ত্রুটি কোথায়। ওই অব্যবস্থা থেকেই শত্রুরা ফায়দা লুটছিল।
টোডরমল শ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষ | টোডরমল | আকবর
আকবরের পিতৃব্য কামরানের কন্যার সঙ্গে বাবরের অনুগ্রহভাজন তৈমূরী শাহজাদা ইব্রাহিম মির্জার পরিণয় হয়েছিল । তিনি তাঁর কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে গুজরাতে এসেছিলেন। ক্ষুব্ধ লোকেরা তাঁর পতাকাতলে এসে সমবেত হতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ক্ষমতা ছিল না ওয়াজির খাঁর, তিনি দুর্গ বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে চুপচাপ বসে রইলেন। টোডরমলের কাছে লোক এল দৌড়াতে দৌড়াতে । তিনি দফতরের কাজ ছেড়ে তরোয়াল হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালেন। ওয়াজির খাঁকে দুর্গ থেকে টেনে ময়দানে বের করে আনলেন। বিদ্রোহীরা বড়ৌদা অধিকার করে নিয়েছিল।
সেদিকে যেতে হলো। বড়ৌদা পৌঁছতে তখনও চার ক্রোশ পথ বাকি, বিদ্রোহীরা খবর পায়। তারা লেজ গুটিয়ে পালায়। সম্মুখে বিদ্রোহীরা পালাতে থাকে, টোডরমল পিছন-পিছন ধাওয়া করেন। তারা খম্ভাতে পৌছলে টোডরমলও সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। জুনাগড়ে গিয়েও তাদের আশ্রয় জুটল না, পালিয়ে ধোলকা গেল, সেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হতে বাধ্য হলো তারা।
বিদ্রোহীদের নেতা মেহের আলী কুলাবী ওয়াজির খাকে নয়, রাজা টোডরমলকে দেখে যমরাজ বোধ করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, যদি কোনোরকমে টোডরমলকে খতম করে দিতে পারা যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু টোডরমল যুদ্ধক্ষেত্রে পাকা খেলোয়াড়। তাঁর সামনে আস্ফালন করা ব্যর্থ দেখে কুলাবী ওয়াজির খাঁর উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
তাঁকে রক্ষার জন্য টোডরমল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধে কামরান-কন্যা পরাজিত হন। কন্যা তাঁর পিতার প্রাণের শত্রুর সঙ্গে নতুন কায়দায় যুদ্ধ করছিলেন। বেগমের দেখাদেখি অন্যান্য নারীরাও উদ্দীপিত হয়। পুরুষের পোশাকে মহিলা সেনাবাহিনী তৈরি হয়েছিল। তীর, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র চালানো শিখেছিল তারা।
যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা সৈনিক ছিল। লুঠ করা মালপত্র ও হাতিগুলোর সঙ্গে টোডরমল, মহিলা সৈনিকদের যেমনকার তেমনি, পুরুষের পোশাকে, হাতে তীর-ধনুক দিয়ে দরবারে পাঠিয়ে দিলেন। টোডরমলের পুত্র ধারা তাদের সিক্রীতে নিয়ে যান ।
বাংলায় (১৫৮০-খ্রিঃ)— টোডরমল তাঁর সহকারী ইরানী মহাগণক খাজা শাহ মনসুরকে সঙ্গে নিয়ে হিসাব-কিতাবের কাজ সামলাতে লাগলেন। এই সময় সমগ্র সুলতানিকে বারোটি সুবায় বিভক্ত করা হয়। সুবার শাসনকর্তাকে সিপাহসালার বলা হতো, পরে তাদের বলা হতে থাকে সুবেদার।
বিভিন্ন বিভাগের অধ্যক্ষ পদ তৈরি হয়— দীওয়ান (অর্থমন্ত্রী), বখ্শী (সৈনিক-বেতন বিভাগ), মীর-অদল্ (মৃত্যু- দণ্ডনায়ক), সদর (ধর্মাধ্যক্ষদের অধ্যক্ষ), কোতওয়াল (পুলিস), মীর-বহর (নৌকা- জাহাজ-ঘাট ইত্যাদির অধ্যক্ষ) এবং ওয়াকিয়া-নওয়িস (ঘটনা-লিপিবদ্ধকরণের অধ্যক্ষ)। বাংলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সমস্ত কাজের ভার শাহ মনসুরের উপর ছেড়ে দিয়ে টোডরমলকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বাংলা রওনা হতে হয়।
আগে বাংলায় বিদ্রোহ করত পাঠানরা, কিন্তু তখন বাদশাহী অমাত্যরাই বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়েছিল। প্রশংসনীয় যেটা, তা হলো, সকলেই তুর্কি ও মোগল অর্থাৎ আকবরের রক্ত-সম্পর্কের। আকবর তিন পুরুষ থেকে দেখে আসছিলেন যে উদ্দেশ্য-চরিতার্থের ক্ষেত্রে রক্ত-সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই এবং জাতভাই তুর্কি-মোগলদের উপরেও বিশ্বাস রাখা যায় না।
আর সেই কারণেই তো তিনি মানসিংহ ও টোডরমলকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। আকবর যদি হিন্দুদের কাছে টেনে না নিতেন, তাহলে তিনি এত সাফল্য লাভ করতে পারতেন না, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যাদের বাদশাহের আপনজন বলা হতো, টোডরমলকে পাঠানো হলো তাদের বিরুদ্ধে। তিনি আচারনিষ্ঠ হিন্দু, আর বিদ্রোহীরা সকলেই মুসলমান। তিনি এটাও জানতেন যে হাজার হলেও এরাই তখতের বলিষ্ঠ সহায়ক এবং পরেও এদের প্রয়োজন হবে। তিনি চাইছিলেন তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে পথে আনতে।
ওদিকে টোডরমলের আসার কথা শুনে বিদ্রোহীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তারা চাইল কোনোরকমে টোডরমলের প্রাণনাশ করতে। কিন্তু টোডরমল সব ব্যাপারেই দক্ষ ছিলেন। তিনি লড়াই করতে করতে তাদের ভেদ করে মুঙ্গেরে গিয়ে পৌঁছলেন। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল মুঙ্গেরকে এক শক্তিশালী সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত করা।
সেখানে গঙ্গার তীরে এক বিশাল দুর্গ নির্মাণ করলেন। চার মাস ধরে বিদ্রোহীরা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। টোডরমল এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে বিদ্রোহীরা যাতে আর বেশি দিন সেখানে থাকতে সাহস না পায়। বাধ্য হয়ে ওরা পালাতে শুরু করে।
বাদশাহী সেনা এগিয়ে গিয়ে তেলিয়াগড়ীর ঘাট দখল করে নেয় । রাজমহলের পাহাড়শ্রেণী ও গঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত এই ঘাট, তাকে বাংলার দ্বারও বলা হতো। বাংলার বিদ্রোহ দমন করার পরই টোডরমলকে আবার দিল্লী ফিরে যেতে হলো। শাসনব্যবস্থায়, বিশেষত অর্থব্যবস্থায় তাঁর এতটাই প্রয়োজন ছিল, যতটা সামরিক-ব্যবস্থায় ।
‘দীওয়ানকুল’– দিল্লী প্রত্যাবর্তনের পর আকবর টোডরমলকে দীওয়ানকুল (সমগ্র সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী) করে দেন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল ভোজসভার আয়োজন করেন। আকবর তাঁর গৃহে আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে চারহাজারী মনসবদার ছিলেন তিনি ।
পশ্চিমোত্তর সীমান্তে (১৫৮৬ খ্রিঃ)— আকবর কাশ্মীর অধিকার করার জন্য প্রথম সওয়াত উপত্যকা হস্তগত করতে চেয়েছিলেন। এই যুদ্ধে প্রাণপ্রতিম বীরবলকে হারাতে হয়েছিল। নিজের নর্ম-সচিবের মৃত্যুতে আকবর খুবই মর্মাহত হন। সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি টোডরমলকে এই যুদ্ধে পাঠান।
মানসিংহ জমরূদে (পেশাওয়ারের নিকট) শিবির স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে মিলে টোডরমলের কাজ করার কথা। টোডরমল গিয়ে কোহলঙ্গরের কাছে সওয়াতের কোল-ঘেঁষে ছাউনি গাড়েন। সেখানকার পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে খুব দেরি হয়নি। তারপর বাকি কাজের দায়িত্ব মানসিংহের উপর ছেড়ে দিয়ে টোডরমল ফিরে আসেন।

টোডরমল তখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। ভক্ত মানুষ। চাইতেন, শেষ সময়টা তিনি হরদওয়ারে গঙ্গার তীরে ভগবানের জপতপ করে কাটাবেন। বাদশাহের কাছে তিনি সেই প্রার্থনা জানান। বাদশাহ প্রথমে তাঁকে খুশি করার জন্য সম্মতিপত্র পাঠিয়ে দেন, কিন্তু তার পরেই বাদশাহের দ্বিতীয় ফরমান গিয়ে পৌঁছায় : ভগবানের উপাসনা ভগবানের সৃষ্টি মানুষের সেবা ও তাদের সাহায্য করার চেয়ে বেশি নয়, সেই সেবাকেই উপাসনা হিসেবে গ্রহণ করো। সম্মতিপত্র পাওয়ার পর তিনি হরদওয়ারের উদ্দেশে যেতে যেতে লাহৌরে নিজের প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণীর তীরে শুয়ে ছিলেন, এমন সময় দ্বিতীয় ফরমান পেলেন। সুতরাং তাঁকে আবার ফিরে যেতে হচ্ছিল।
কিন্তু খুব বেশি দিন রাজসেবা করার সুযোগ পাননি তিনি। একাদশ দিনে স্বজাতির এক ব্যক্তি (লাহৌরে) তাঁকে হত্যা করে। টোডরমল কোনো এক অপরাধে তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। আততায়ী বৃদ্ধের উপর হামলা চালায়। রাজা ভগবানদাসের মৃত্যুর পরে, ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে, টোডরমলেরও জীবনাবসান হয়। আকবরের নবরত্নের মধ্যে টোডরমলের স্থান ছিল অনেক উঁচুতে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক মোল্লা বদায়ূনী কোনো অমুসলিমের যশ-খ্যাতিকে সুনজরে দেখতে পারতেন না। টোডরমলের মৃত্যুতে তিনি আনন্দ প্রকাশ করে বলেন—
টোডরমল আঁকি জুল্মশ্ ব-গিরাহ্ বুদ্ আলম্ ।
চূঁ র সূয়ে-দোজখ খলকে শুদান্দ্ খুম্ ।
(টোডরমল, যাঁর অত্যাচার দুনিয়াকে নিষ্পেষিত করে রেখেছিল, যখন তিনি। নরকের দিকে চ গেলেন, তখন লোকে খুশি হয়ে উঠল।)
আরও দেখুনঃ